রস-সাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী – জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার মেহেরপুর সাবডিভিশনের
অন্তর্ভুক্ত বাগোয়ানের কাছে বাঁড়েবাঁকা গ্রামে, এক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশে। তাঁর পিতার নাম বিজয়রাম
ভাদুড়ী। দুর্ভাগ্যবশত সংকলক পূর্ণচন্দ্র দে, অনেক চেষ্টা করেও কবির মাতার নাম বা মাতৃকূলের কোনো
খবর সংগ্রহ করতে পারেন নি।
কবিপত্নীর নাম ছিল দক্ষিণা। কবির এক পুত্র যাদু ও এক কন্যা তারা (মতান্তরে এক পুত্র ও দুই কন্যা,
গিরিশচন্দ্র, শিবসুন্দরী ও তারাসুন্দরী)। যাদু অল্পবয়সে মারা যান নিঃসন্তান অবস্থায়। কন্যা তারার বিবাহ
হয় শান্তিপুরের হাটখোলার গোস্বামী পাড়ার সান্যাল বাড়ীতে। তিনি অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তাঁর
শান্তিপুরের বাড়িতেই রসসাগর, ৫৩ বছর বয়সে, গঙ্গাতীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রসসাগরের পূর্বপুরুষ সকলেই সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনিও ছেলেবেলা থেকেই সংস্কত ও
বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। তখনকার দিনের প্রথা অনুযায়ি তাঁকে হিন্দী, উর্দু ও পারসী ভাষাও শিখতে
হয়েছিল। নবাব-সরকারের লোকগণের এবং ফৌজদার প্রভৃতি সম্রাটের প্রধান প্রধান কর্মচারিদের সঙ্গে
কথাবার্তা ও লেখালেখির ভাষা ছিল উর্দু ও পারসী ভাষা।
ইংরেজ আমলে, ১৮৩৭ সালের ২৯ বিধি (আইনের ধারা) অনুসারে বাংলার
প্রত্যেক জেলার বিচারালয়ে পারসী ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু
করা হয়।
বিদ্বান হলেও, অর্থের দিক দিয়ে তিনি তাঁর গ্রাম বাঁড়েবাঁকে তে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে না পেরে,
ভাগ্য-অন্বেষণে চলে আসেন কৃষ্ণনগরের। সেখানে তিনি আশ্রয় পান মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজ
গিরিষচন্দ্রের রাজসভায়, সভাকবি হিসেবে। ঘটনাটি এরকম ছিল যে একবার রসসাগরের জমির খাজনা
অনাদায়ে মহারাজ গিরিশচন্দ্র তাঁর জমি ক্রোক করেছিলেন। তখন কবি মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে,
তাঁর সাহিত্বশক্তির পরিচয়ে ভিষণ খুশি হয়ে তাঁকে তাঁর সভাপণ্ডিত হিসেবে নিয়োগ করার সংকল্প করেন।
প্রপিতামহ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো, গিরিশচন্দ্রের আর্থিক অবস্থা মোটেই সচ্ছ্বল ছিলনা। তাঁর বিষয়-বুদ্ধি
কম হলেও, তাঁর প্রপিতামহের মতোই বিদ্বান পণ্ডিতজনের সমাদর ও পৃষ্ঠপোষণে পিছপা হতেন না। তিনিই
কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুরী কে “রস-সাগর” উপাধীতে ভূষিত করেন।
রস-সাগর সুকবি ছিলেন এবং মুখে মুখে, খুব দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন। তার বেশিরভাগই
সম্ভবত কোথাও লেখা হয়নি এবং আর আমাদের তা পাবার আশা নেই। “রস-সাগর” সংকলন গ্রন্থে পূর্ণচন্দ্র
দে লিখেছে যে তিনি রস-সাগরের কবিতা পেয়েছিলেন, ১৮৮৮ সাল নাগাদ, সরস্বতী নামের ৭১ বছর বয়স্কা
এক নাপিত-পত্নীর কাছ থেকে। এই ভদ্রমহিলা পূর্ণচন্দ্র বাবুর এক বন্ধুর বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলেন।
তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর স্বামীকে রস-সাগর, বিভিন্ন মজলিস ও সভায় নিয়ে যেতেন এবং তাঁর কাজই
ছিল রস-সাগর কোন কবিতা রচনা করলেই তা শুনে শুনে তাঁর খাতায় লিখে নেওয়া। মূলত সরস্বতী দেবীর
স্বামীর হাতে-লেখা খাতাটি থেকেই পূর্ণচন্দ্রবাবু তাঁর সংগ্রহের বেশিরভাগ কবিতা পেয়েছিলেন। সরস্বতী
হিন্দুনারী, তাই তিনি তাঁর স্বামীর নাম কিছুতেই মুখে আনেন নি। আকারে ইঙ্গিতে যা
বলেছিলেন, পূর্ণচন্দ্রবাবু, ঘটনার ৩২ বছর বাদে তাঁর সংকলনটি রচনা করতে বসে আর মনে করতে
পারেননি। তাই রস-সাগরে এই স্টেনোগ্রাফারের নাম আর জানার কোন উপায় নেই। সরস্বতী দেবী শ্রুতিধর
মহিলা ছিলেন। তিনি পূর্ণচন্দ্রবাবুকে আরও বলেছিলেন যে অ্যন্টনি সাহেব (অ্যন্টনি ফিরিঙ্গী) ও ভোলা
ময়রার বহু গান তাঁর কণ্ঠস্থ রয়েছে। কিন্তু অল্পবয়সী পূর্ণচন্দ্রবাবু তখন ধৈর্য্যের অভাবে তা শুনে লিখে নেন
নি। পরে আফসোস করেছিলেন। একথা জানতে পেরে আমরাও এখন আফসোস করছি!
সমস্যা পূরণ কবিতা – কেউ একটি বাক্যে কিছু কথা বললে সেটিকে একটি সমস্যা হিসেবে ধরা হোতো।
কবি তা শুনে সেই বিষয় কে কেন্দ্র করে একটি কবিতা রচনা করতেন, সেই সমস্যা-বাক্যটি কবিতার মধ্যে
রেখেই। এটাই সমস্যা পূরণ কবিতার মূল কথা। অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি কোনো ধাঁধার আকারে হোতো।
কবি, সমস্যা পূরণের মধ্য দিয়ে সেই ধাঁধারও সমাধান করে দিতেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে ইতিহাস,
শাস্ত্র, সাহিত্য ও বিভিন্ন ভাষার অসামান্য জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় রসসাগরের সমস্যা পূরণ কবিতার
মধ্য দিয়ে।
এই কবিতা মিলনসাগরে তোলার মূল কারণ হলো এই যে রস-সাগরের সমস্যাপূরণ কবিতার মাধ্যমে আমরা
বাংলা তথা ভারতের বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বর্ণনা জানতে পারি। এমনকি ইংরেজ শাসনকালের
ন্যায়বিচারের ভণ্ডামির সবচেয়ে বড় নিদর্শন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসীর সম্পূর্ণ বর্ণনাও রসসাগরের এই
কবিতাগুলির ভেতর পাওয়া যায়। জানা যায় কলকাতার উপকণ্ঠে মার্হাট্টা ডিচ্ (বর্তমানে সার্কুলার রোড)-
এর ইতিহাসও। ইতিহাসাকারের কোনো দায় তাঁর উপর ন্যস্ত ছিলনা বলে তিনি যা সত্য বা যা
শুনেছিলেন বা জেনেছিলেন, তা ই তাঁর কবিতায় বলেছেন। সম্ভবত তাই এই কবিতা ইতিহাসের দিক দিয়ে
সত্যের অনেক কাছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
“রসসাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থের ( ১৩২৭ বঙ্গাব্দ ) সংকলক ও
সম্পাদক কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর বি-এ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ পরীক্ষায়
পরীক্ষকও ছিলেন। আমরা তাঁর গ্রন্থের রস-সাগরের জীবন-চরিত থেকে শেষ অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি . . .
“ . . . রস-সাগর মহাশয় যেরূপ সুরসিক ও সুচতুর, সেইরুপ আবার আমোদ-প্রিয় ও উপস্থিত-বক্তা ছিলেন।
তিনি সকল প্রকার লোকেরই সহিত মিশিয়া থাকিতে ভালবাসিতেন। তিনি স্পষ্ট কথা মখের সম্মুখেই বলিয়া
ফেলিতেন ; তাহাতে তিনি কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করিতেন না। তবে কাহাকেও কোন কিছু স্পষ্টভাবে বলিতে
ইচ্ছা করিলে তিনি তাহা সরল-ভাবেই বলিতেন, এবং তাহাতে লোকের মনে কষ্ট বা ক্ষোভ হইত না। তাঁহার
কবিতায় বিসক্ষণ রস থাকিত। যে কবিতাটি যে রসে রচনা করিলে তাহা বিষয়োপযোগিনী হয়, সেটি তিনি
সেই রসেই রচনা করিতেন। তাঁহার কোন কোন কবিতার ছন্দঃপতন দৃষ্ট হয়। বোধ হয়, দ্রুত রচনা করিতে
গিয়াই মধ্যে মধ্যে এইরূপ ছন্দঃপতন হইত। ইহাই বিষয়ের বিষয় যে, যে কোন লোক যে কোন ভাবের
সমস্যা-পূরণ করিতে দিলেই তিনি তত্ক্ষণাৎ তাহা পূরণ করিয়া দিতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে
গুপ্তিপাড়া-নিবাসী বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার মহাশয় অবিলম্বে সংস্কৃত-সমস্যা পূরণ করিয়া দিতেন বটে, কিন্তু রস-
সাগরের মত বাঙ্গালা সমস্যা পূরণ করিবার লোক বড়ই বিরল। রস-সাগর যে সকল কবিতা রচনা করিয়া
গিয়াছেন, তাহা প্রায় সমস্তই ফরমাইশ জনিত।
ফরমাইশ-কবিতা বস্তুতঃ সর্ব্বাঙ্গ-সুন্দর হয় না। কবি স্বাধীন-ভাবে কবিতা রচনা করিলে তাহা যেমন তাঁহার
মনঃপূত হয়, ফরমাইশ-অনুসারে কবিতা রচনা করিলে তাহা তেমন মনঃপূত হয় না। রস-সাগর স্বকৃত
কবিতায় যে পরিমাণে কবিত্ব-শক্তি দেখাইয়াছেন, তাঁহার স্বাভাববিক কবিত্ব-শক্তি যে তদপেক্ষা অধিক ছিল,
তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তাঁহার স্বরচিত সমস্যা-পূরক কতকগুলি কবিতা সংস্কৃত শ্লোকের রূপান্তর ও
ভাষান্তর বলিয়াই বোধ হয়। ইহা দ্বারা বোধ হয় যে, তিনি অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন। নতুবা
কোন কোন সংস্কৃত শ্লোকের সহিত তাঁহার স্বরচিত কবিতার ঠিক ঐক্য হয় কেন! যাহা হউক, ইহা দোষের
বিষয় নহে। ভাব লাগাইয়া যে কোন প্রকারে সমস্যাটি যথাযত পূরণ করাই তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এস্থলে
তিনি সংস্কৃত কিংবা যে কোন ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করুণ, তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র প্রত্যবায় নাই।”
আমরা মিলনসাগরে কবি রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে
পারলে আমাদের এই প্রচেষ্টার সার্থকতা। এই কবিতায় শুধু কাব্যই নয়, আমরা বাংলার এক
অতি ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক সময়ের এমন বহু চরিত্রের কথা জানতে পারছি, যা আমাদের সরকারী ইতিহাস
বইগুলোর পাতায় লেখা হয়নি।
উত্স - কবিভূষণ শ্রী পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর বি-এ সংগৃহিত ও সম্পাদিত,
. "রসসাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী মহাশয়ের বাঙ্গালা-সমস্যা-পূরণ" গ্রন্থ, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ (১৯২০)।
রসসাগর কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতা প্রথম প্রকাশ - ১১.১২.২০১৫
...