কবি রত্নেশ্বর হাজরার কবিতা
*
বর্ণপরিচয়
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত ‘দেশ’ সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলন ১৯৩৩-১৯৮৩ থেকে নেওয়া।


ঘুরে গেলেই একটা ফাঁকা | আমি ফাঁকার মধ্যে দাঁড়িয়ে
মুঠো থেকে প ছুঁড়ে দিই | প থেকে পৃথিবী এবং প্রশ্ন
প্রতিবাদ প্রতিশোধ এবং প্রেম ছড়িয়ে পড়ে --- পড়তে পড়তে
প্রহর চলে যায় ----

প্রেম শব্দে প্রভুর চেয়ে প্রেমিকা সহজ---যেহেতু প্রেম
সহজাত কবচকুণ্ডল সহজাত মৃত্যুবোধের সমান
যাকে চেনার ঢের আগে আমাকে ম নামক অক্ষর
শিখতে হয়েছে
ম থেকে মধু মধু বাতা ঋতায়তে
মধুক্ষরতি মৃত্যু --- আমি মৃত্যুকে দেখি কিন্তু চিনতে পারি না---

ছেলেবালায় চ অক্ষর শিখতে শিখতে কেউ চাঁদ হয় কেউ চন্দন
আমি চাতক হয়ে উড়ে যেতাম চিহ্ন থেকে চিহ্নহীন একা---
জ-এর উপর জাহাজ ভাসতো নদী পেরিয়ে সমুদ্রে
আমি জল চিনতাম
জল চিনতে চিনতে জন্ম
জন্ম চিনতে চিনতে
আমি মৃত্যুর কাছে দাঁড়িয়ে থাকি---- দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
বিন্দুর মতো চিহ্ন থেকে চিহ্নহীন---

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমি স্বাভাবিক
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
দেশ-এর কবিতা ১৯৮৩—২০০৭, দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা
সংকলন থেকে নেওয়া।

অমৃত করেছি পান দুই হাত পেতে
.           বিষ যে খাইনি তা-ও নয়—
অমর হইনি---- কিন্তু মৃত্যুও আসেনি ডেকে নিতে
জ্বর হয় শীত করে ঠা-ঠা রোদে গরমে ঘামাই..
এক পা দুয়ারে রাখি অন্য পা উঠোনে
মৃত্যুকে সমীহ করি
.           সংসারের ধর্মে হেঁটে যাই---

আছি এরকমই ---- আছি ----যে রকম ওরা
অনেকেই থাকে
আজ থাকে  কাল থাকে   পরশুদিন রাত্রেও ঘুমোয়
মাছের ভিতরে মাছ    জলের পায়ের কাছে জল
সবুজে সবুজ ---- গন্ধে গন্ধ স্বাভাবিক
একা থাকে
.          ভিড়ে থাকে
.                     যে যার মতন হয়ে শোয়
জড়বাদী মায়াবাদী আমি আর চূড়ান্ত নাস্তিক...
যে যার মতন দৃশ্য দেখে --- আমি দেখি
নদীর দু’পার থেকে সম্পর্কের চিহ্ন নিয়ে
জল ভেসে যায় |
অমৃত কখনো এসে ডাকে  শুনতে পাই
বিষ এসে ডাকে   শুনতে পাই---
এক পা দুয়ারে রাখি অন্য পা উঠোনে
মৃত্যুকে সমীহ করি
.           সংসারের ধর্মে হেঁটে যাই----

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পাতা পড়ে, পাতা কেন পড়ে!
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
দেশ-এর কবিতা ১৯৮৩—২০০৭, দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা
সংকলন থেকে নেওয়া

পাতা পড়ে
উচ্ছিষ্টের মধ্যে পড়ে     আঁস্তাকুড়ে পড়ে
পরিচ্ছন্নতারও মধ্যে জন্মের সম্পর্ক ছিঁড়ে পাতা
দিনে পড়ে---- শুনশান রাত্তিরেও পড়ে |
জীবিত প্রাণীর খুব কাছে পড়ে পাতা
পাথরের বুক জুড়ে পড়ে থাকে পাতা ---
.            প্রত্যেক মুহূর্তে পাতা পড়ে
কিশোরের হাত থেকে কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতন
.            দুঃখ হয়ে টাল খেয়ে পড়ে |

তখন অনেকে জেগে থাকে ---- এবং অনেকে
ঘুমের একদম কাছে গিয়ে     একটু শোয়----
কোথাও মৃত্যুর বাড়ি থেকে
আঁতুড়ঘরের গন্ধ রহস্যের মতো উঠে আসে
বহু জটিলতা আর মীমাংসারও দেখা হয়ে যায়
.            মুখোমুখি----
তবু শব্দে----- শব্দহীনতায়ও পাতা পড়ে | আর
বালকের মধ্যে বসে পিতার মতন কেউ প্রশ্ন করে----পাতা
সহজ সম্পর্ক ছিঁড়ে পড়ে
.             আয়ুর সম্পর্ক ছিঁড়ে পাতা    কেন পড়ে !

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রকৃতি যা তাই
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
উত্তম দাশ, মৃত্যুঞ্জয় সেন ও পরেশ মণ্ডল সম্পাদিত কবিতা : ষাট সত্তর থেকে নেওয়া।

তুমি আর কিছু নও
.                   নিজেকে যা গড়ো তুমি তাই---
নদী হলে শুধু নদী                  সমুদ্র না দিঘিও না
চাঁপা হয়ে গড়ে উঠলে মল্লিকা না রজনীগন্ধাও কিন্তু নও---
গাছ হলে গাছ ছায়া হলে ছায়া সুখ হলে সুখ |
উষ্ণ হবে, লাল হবে প্রবাহিত       আমাকে বাঁচাবে
.            না হলে তোমাকে কেন রক্ত বলবো ?
আমাকে না দগ্ধ করলে অগ্নি নও             হিম---

কেউ আর কিছু নয়           নিজেকে যা গড়ে নিজে তাই---
তিনি তো ধুলোর মধ্যে বসেও সম্রাট
কেউ বিষ             কেউ বিশল্যকরণী
.                   ওকে তো কেবল ক্ষমা হতে দেখলাম |
অর্থাৎ নিজেকে যেমনি গড়ে তুলবে                তাই---
নীল হলে নীল তাপ হলে তাপ শোক হলে শোক
.                   আর যদি প্রাণ হয়ে গড়ে ওঠো প্রাণ-ই বলবো
.                   মৃত্যু নয়             অমৃত-ও না |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কেউ না কেউ সঙ্গে থাকেই
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
উত্তম দাশ, মৃত্যুঞ্জয় সেন ও পরেশ মণ্ডল সম্পাদিত কবিতা : ষাট সত্তর থেকে নেওয়া।


কাউকেই একা পাই না            কেউ না কেউ
.                       সঙ্গে থাকেই---
জলের সঙ্গে স্রোত হাওয়ার সঙ্গে গতি রোদের সঙ্গে তাপ
এঘর ওঘর এবাড়ি ওবাড়ি
.                           কেউ না থাক
.                                     ছায়া থাকে
নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্বাস তাপ বলতে উষ্ণতার মতো

দেয়াল সরিয়ে দিলে চার-চারটে দিক ঘিরে ধরলো
ছাদ সরালামতো আকাশ নিচু মেঝে উঠলো ুপরে
পথে নামলে পথই সঙ্গী
পিছনে অতীত সামনে ভবিষ্যৎ
.                               জন্মের কাছে যাই
.                            মৃত্যু তার কাঁধ ছুঁয়ে ঠায় দাঁড়ানো
অন্ধকারের সঙ্গে নক্ষত্রমণ্ডলী সারারাত ছায়াপথে ছায়াপথে---

কাউকেই আর একা পাই না
কেউ না থাক
অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীত
আমার সঙ্গে আমি তাপ বলতে উষ্ণতা |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মৃত্যু চেয়ে
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
মেঘ বসু সম্পাদিত ও সংকলিত আবৃত্তির কবিতা, কবিতার আবৃত্তি, নির্বাচিত ৫০০
কবিতার সংকলন থেকে নেওয়া।

উল্টো হয়ে পড়ে আছে সাঁকোটার ছায়া
অলৌকিক জলের ভিতর---
আমি পার হতে গিয়ে দেখি
উল্টো আমি পার হচ্ছি সাঁকো |
জলের অন্তরে কেউ থাকে !
সে যেন বলছে : ওকে ডাকো – ওকে
অথই বুকের কাছে ডাকো |

আমি সেই ডাক শুনে অকস্মাৎ ঝাঁপ দিয়ে পড়ি
নীচের গহিন অন্ধকারে----
কিছুক্ষণ নড়ি না চড়ি যন্ত্রণায়
তারপর
শিক্ষিত সাঁতার কেটে এক সময় উঠে যাই পাড়ে |

অতঃপর
জলে ঢেউ থেমে যায় | ঢেউয়ের বিপুল শব্দ থামে |
শব্দ থেমে গেলে কেউ অন্য এক গভীরতা থেকে
বলতে থাকে যেন----
সাঁতার জানিসই যদি আমার বুকের কাছে
ঝাঁপ দিলি কেন ?

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
রাত্রিবাস
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
মেঘ বসু সম্পাদিত ও সংকলিত আবৃত্তির কবিতা, কবিতার আবৃত্তি, নির্বাচিত ৫০০
কবিতার সংকলন থেকে নেওয়া।


ধরেছি রাত্রির মুখ দু’হাতের মাঝখানে --- তারপর
.                                          অধরে তুলেছি---
রাত্রি জানে এ-পীড়নে ব্যথা নেই    অন্য কিছু
.              মায়া ও মমতা লেগে আছে
মানুষের গন্ধ আছে---- মুখের নিঃসৃত লালা আছে
নিশ্বাসে রয়েছে গন্ধ ফুসফুসের
.                          রক্তেরও রহস্য লেগে আছে---- |

এখন রাত্রির দেহে প্রতিধ্বনি নড়ে যায় যে রকম
শব্দ নড়ে শঙ্খের ভিতর
যেরকম মুক্তো নড়ে ঝিনুকের গর্ভে ও অস্তিত্বে
.                   সামান্য হাওয়ায় নড়ে তিলফুল যেরকম
গাছের গর্তের মধ্যে পাখিদের ডিম ফেটে অন্ধকার নড়ে |
দু’হাতে ধরেছি কিছু সেরকম নড়াচড়া তারপর
ধরেছি অস্তিত্বময় অন্ধকার কিছু
তুলেছি ঠোঁটের কাছে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা তার
.              মাংস আর স্নায়ুদের নির্জন দাহিকা ---
পোড়ে না শরীর --- শুধু জ্বলে যায় এ-দহনে...
একটা চৈতন্য থেকে অরেক চৈতন্যে যায় ঘ্রাণ
এবং নড়ে না অগ্নি সেই চলাচল থেকে
.              রাত্রি কি বোঝে না কিছু ! বোঝে
এ-পীড়নে ব্যথা নেই
.              মায়া আছে             তাপ আছে
রক্তেরও রহস্য লেগে আছে ----

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সে এরকমই
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
মেঘ বসু সম্পাদিত ও সংকলিত আবৃত্তির কবিতা, কবিতার আবৃত্তি, নির্বাচিত ৫০০
কবিতার সংকলন থেকে নেওয়া।


মৃত্যুর নিজস্ব কোনো ঘর নেই বাড়ি নেই--- জয়বায়ু নেই
যে-দিগন্তে যায় মৃত্যু সেখানে বানায় গেরস্থালি
তা সেটা রাজবাড়ি হোক কিংবা কোনো প্রাচীন জীর্ণতা
সমস্ত শরীরে জোড়াতালি
যেখানে যেমন ঠিক সেখানে তেমনি হয়ে থাকে
কখনো ঝড়ের রাত্রে ডানা ভাঙা ঈগলের ছানা
কখনো খেয়ার মাঝি ঠিক রাখে স্রোতের বৈঠাকে |
জীবনযাপন তার এরকমই --- যে-কোনো জীবনই তার প্রিয়
সুন্দরে যেমন তার সিংহাসন
রোগাভোগা শরীরেও পুরো রাজকীয় |

আসলে যেখানে মৃত্যু একটু জীবন পায়
সেখানেই তার বাসভূমি
সে থাকে হরিণে হরিণ আর বাঘের সরীরে বাঘ হয়ে
জীবন্ত গাছের দেহে গাছ | লতার শরীরে লতা | তার
করতলে অনন্ত আকাশ
মানুষের দেহে মৃত্যু ঠিক মানুষের মতো
আকৃতি এবং প্রকৃতিতে ---- জীবনযাপনে তার নিশ্বাস প্রশ্বাস |

অথচ মৃত্যুর কোনো ফোটো নেই কারোর অ্যালবামে
তার বর্ণ রামধনুর কল্পনা থেকেও বহু দূরে ----
তবু মৃত্যু জন্ম নেয়--- যে-কোনো জন্মের সাথে
জাতকের মৃত্যুও জন্মায় | তারপর
একদিন মৃত্যু তার নিজেরই মৃত্যুর কাছে ফিরে আসে ঘুরে |

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
এসেছে যখন
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
মেঘ বসু সম্পাদিত ও সংকলিত ‘হে প্রেম’, কবিতার সংকলন থেকে নেওয়া।


ডাকো
অন্তত একবার তাকে ডাকো---
সে তো অনেকক্ষণ এসে গেছে
নিজের বানানো সাঁকো পার হয়ে আগে যেরকম
.         একা আসত---তেমনি এসেছে---
বারান্দায় বসে আছে আলস্যের মতো টুকরো     একা
কখনো নির্লিপ্ত দেখছে পরিপাটি আসক্ত সংসার
.         কখনো দেখছে দূরে সাঁকো |
সাঁকো ছিল সন্ধিপত্র --- যাকে
হঠাৎ বৃষ্টির পর মনে হতো দুপার মেলানো রামধনু |
তার নীচে জল---
.         কিন্তু আজ পরিচ্ছন্ন নয়----তার
বহুদিন স্নান নেই খাওয়া নেই---রোগা হ্যাংলা দেহ
তবু জল---জল তো বটেই--- আদি রহস্যময়তা
যাকে চোখে রেখে দিলে চোখের আকৃতি পায়
.                           মেঘে রাখলে মেঘ |

একটু ডাকো
টুকরো মেঘের মতো বারান্দার ছায়া জুড়ে একা
বসে আছে
.          বন্ধুর মতন বসে আছে
.                         প্রতিশোধ নিতে বসে আছে |
সন্ধিপত্র ছিঁড়ে ফেলে উড়িয়ে দেবার ঠিক আগে
আরেকবার কাছে
.          এসেছে যখন --- তাকে ডাকে |
নিজের বানানো সাঁকো ভেঙে দিয়ে যাবে বলে ----আসা
আর কোনোদিন ফিরে আসবে না বলেই তার আসা --- |
‘যাও’ তো বলবেই ---তবে
যাও বলবার আগে অন্তত একবার একটু ডেকে
না হয় বললেই মিথ্যা – এসো---

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দেখছি তাকে
কবি রত্নেশ্বর হাজরা
শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দুই বাংলার প্রেমের কবিতা’ থেকে
নেওয়া।

পায়ের নিচে পাথর মাটি ---- শক্ত নরম
একটু দুব্বো ঘাস
.       মাড়িয়ে দিয়ে পা হেঁটে যায়--- | না
পা দু-টো নয়--- বরং যাকে লুকিয়ে হাঁটে পা
দেখছি তাকে--- |
দেখতে চাই না গোটা শরীর--- রক্ত মাংস
মেদ বা শুধু স্নায়ু
.       বরং আয়ুর সাহচর্য একটুখানি ঘ্রাণ
এবং শুধু ইন্দ্রিয় নয় ঘ্রাণের জন্য বরং গন্ধে
যা লুকিয়ে থাকে---
দেখতে চাই না বুক খুলে বুক  বরং বুকে
.       যা আছে তাই দেখি
.                      দেখছি তাকে |

ধরে নিচ্ছি দু-ঠোঁট থেকে শব্দ যাচ্ছে উড়ে
কিন্তু শব্দ কেবল কি দুই ওষ্ঠে থাকে | না----
বরং শব্দ তৈরি হওয়ার আগের মুহূর্তে যা
ঠোঁটের ছায়ায় লুকিয়ে ছিল---- দেখি
চোখ দুটো নয়--- বরং চক্ষু আড়াল করে যাকে
কেবল তাকেই
.        দেখছি তাকে---

.                 **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর