মানুষের স্বরুপ
কবি রেহানুল হক


অনেক সময় ভাবি মানুষ আসলে কি !

মানুষ দেখলে মনে হয় একটি জটিল অণুর বিকাশে
বিকশিত হয় বোধ তা বোধ হয় ঠিক নয়
অণু-পরমানুর নিরন্তর কারসাজি যে সৌন্দর্য
তাতে সন্দেহ জাগে
অনেক প্যাঁচ বিশিষ্ট বুনো মারকরের শিং
সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধানো হলেও
মারপ্যাঁচের বুদ্ধি যে সুন্দর তার পরিচয় পাই না
প্যাঁচবিশিষ্ট জিলিপি সুস্বাদু হলেও
মানুষের প্যাঁচাল বিরক্তই লাগে;
ছাগলের বর্ণমালা পড়া হয় নাই
কিন্তু মানুষের বর্ণমালা জটিল
বলেই কি ছাগলের নাম ছাগল
আর মানুষের নাম মানুষ
-পাঠোদ্ধার করতে পারিনা।

কোন কোন মানুষের মুখশ্রী দেখলে মনে হয়
একুশ বছর অন্ধকারে ডুবে থাকা
ইউরেনাসের চেয়েও অন্ধকার,
কোন কোন মানুষের অবয়ব দেখে মনে হয়
বন্য আওরোচ ষাঁড়ের ভয়ানক কামক্রোধ,
কোন কোন মানুষের লম্ফ-ঝম্প দেখে মনে হয়
লেজবিহীন প্রকনসুই বানর বা সিলভারব্যাক গরিলা
যারা এখনও সভ্যতার আদিস্তরে,
কোন কোন মানুষের চুল দেখে মনে হয় বুনো মাসট্যাং ঘোড়া
যারা কেবল দৌড়ানোতেই উপযোগী,
কোন কোন মানুষের উদর দেখে মনে হয়
হুইয়ুকের কামদেবী
যার ধ্যান-জ্ঞান শুধুই কাম,
কোন কোন মানুষের শীর্ষদেশ যেন গজমস্তক
বুদ্ধের বোধিতে ব্যাধি সঞ্চারী আপ্রাণ কৌশুলী
অপদেবতা এরা,
আবার কেউবা গণপতি
পতি নয় যেন সাক্ষাৎ দেবতা
কারো কারো খাদ্যাভাসে মনে হয়
কিলবিল করা একরাশ বিষ্ঠাবিটল
ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের প্রখরতায় এরা জগদ্বিখ্যাত
আর কারো কারো বিশেষত্ব শক্তির অবিনাশিতাবাদ
খাদ্য ও উচ্ছিষ্টে এদের গলধঃকরণ
শ’য়ে শ।

কোন কোন মানুষের হাসি দেখে পেয়ে বসে
স্মাইলোডন বিড়ালের ভয়ংকর দাঁত আতংক
কিন্তু এ দাঁতের হিংস্রতা থেকে বাঁচতে
দলবদ্ধ মানব সম্প্রদায় খুঁজতে গিয়ে আমি বড় একা-
কারণ আমি মানব সমাজচ্যুত;
মানব উদরের জটিল আন্ত্রিক প্যাঁচ ভালো না বলে
আমি ভালো বলেছি প্যাঁচালো ফিডলহেড ফার্ণ
আর এর প্রস্ফুটিত অপূর্ব শৈলিকে-
তাই কোন কোন মানুষের দৃষ্টিতে
অকর্ম্মণ্য হিসেবেই আমি মানানসই।

মানুষের ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য অনস্বীকার্য
তাই মানুষ মানুষকে ছাগল বলে
এবং ছাগলও মানুষকে মানুষ ভাবে না
ভাবে অস্বাভাবিক কিম্ভূতকিমাকার জানোয়ার।

.                ******************               
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
কবি রেহানুল হক-এর কবিতা
*
প্রেম ও বিপ্লব
কবি রেহানুল হক

বজ্রপাতের মত তোমার চুল
প্রমত্তা নদীর মত ভাঙ্গে বুকের পাঁজর
বাঁকা চাঁদের মত তোমার ভ্রু
ছড়িয়ে পড়ে কোষের কানায় কানায়
চিত্র-বিচিত্র  চিতার মত তোমার প্রতি পদক্ষেপ
আশংকা জাগায় যেন ভীতু হরিণের
চিরুনিক্সের মত স্বচ্ছ থলথলে তোমার দেহপল্লব
শিহরণ জাগায় ভয়ংকর জ্বালাময় বাঁকা অনুভূতির
তবু এগিয়ে চলা সান্নিধ্যে তোমার দূরন্ত অন্ধকারে
হাতড়ে ফিরি অ্যাংলারের কামনায়।
আবিষ্কার করি নাক্ষত্রিক পতন- তবু অভিযাত্রা
বৈচিত্রের প্রতি পর্বে দেখি এক বিপ্লবের অভ্যন্তর
বিপ্লব ঝরে পড়ে ঝড়ের অন্ধকারে ঝরে পড়া পাখির মত
কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেয় এঁর ফাঁকা প্রকোষ্ঠ
যা বাষ্পীভূত হয় অ্যাংলারের সুতীব্র পিপাসায়
              দিগন্তময়ী মেঘেদের মাঝে।

.                ******************               
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
অনুরাগ
কবি রেহানুল হক

কক্ষচ্যুত ইলেকট্রনের ন্যায়
উদভ্রান্ত, বিস্ফোরিত কণার মতই দিগভ্রান্ত
গ্যসীয় কণার মত অস্থির
আকাশের চেয়ে দূরন্ত, সুরভীর চেয়ে প্রাণবন্ত
ঘন আঁধারের প্রজ্ঞা আর সীমান্তের মনোহারী প্রহেলিকাময়
আমার অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে শুধু একটি ছায়া
যে ছায়া তোমার চেয়েও সত্য
যা তুমি লালন করেছ আজন্ম।

.                ******************               
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভালোবাসার মারকিউরি
কবি রেহানুল হক

বিলিয়ন নক্ষত্র যখন হাতছানি দেয়
আমি ভাবি তোমার কথা
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে ক্ষণিক দেখা-
তুমি মারকিউরি; পরিভ্রমনরত শতধায় সঞ্চিত গতি
কন্ঠনালীর নিচে চাপা পড়ে শব্দ
গ্রাফ আঁকে মুক্তির
টগবগ ফুটে নিউরন বিলিয়ন
রচে যায় শবসংগীত চুপিচুপি
আমি মৃদু হাসি-

ঝরে পড়ে পাতা খেয়ালহারা সংগীতের তানে
সপ্নেরা ধুসর বর্ণ গায়ে পাড়ি দেয়
সীমানার লাল উৎসব-
ডেকে উঠে পাখী
ঘুম ভাঙ্গে তিথী
ঘড়ির কাঁটা এক-এ দু’বাহুর কৌণিক নিবেদন
তোমার অবস্থান সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে
হোক না যত ক্ষণিকের
তোমার সৌন্দর্য- সে তো আমারি ভুবন।

.                ******************               
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
এক জীবণ ঋণ
কবি রেহানুল হক


বৃক্ষপত্রগুলো প্রথমে হলদে হলো,
অতঃপর পাতাগুলো ঝরে পড়লো শীতে।
জানলাম ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হয়েছিল,
আরো জানলাম রসাল্পতায় পাতাগুলো বিবির্ণ হয়ে ঝরেছে
কিন্তু গাছগুলো আমি ভালোবেসেছি এসব না জেনেই।
ওদের মত করে উর্ধবপানে চেয়ে দেখেছি ঐ নীলাকাশ
বিশেষতঃ শরতে পুরোটাই যখন এক নিখুঁত শিল্পীর ক্যানভাস!
যেখানেই হাত বুলিয়েছেন শিল্পী সেখানেই
প্রস্তুত হয়েছে বিশাল সব চিত্রকর্ম ;
দিবালোকের ক্রান্তিতে যা ফুটে উঠে
অগণিত সব তারায়।
এদের কোনটি সূর্য, কোনটি হারকিউলিস বা বার্ণাডি
চিত্রা, শবনম বা মীরা
না বুঝেই, না চিনেই ভালোবেসেছি আমি।
জড়িয়ে থাকতে চেয়েছি ওদের সাথে।
মহাকালের এবং মহাস্ফীতির চরে দাঁড়ানো
এ ক্ষুদ্র জীবের ক্ষুদ্র আর্তিটুকু কেউ জানলো কিনা
বুঝার সকল প্রচেষ্টাতেই মনে হয়েছে এ অব্যক্ত।

এখানকার শিশিরের স্বাদ, ধানের গায়ের প্রতিটা আলোড়ন,
প্রতিদিনকার সূর্য হতে এক চিলতে রোদ,
পাখীর কাকলী, দখিনা বাতাসের সুরঝঙ্কার,
পানা পুকুরের দু’তরঙ্গ মাঝে এক কনা
যেন আমারই চেতনা ও কম্পন,
অতঃপর সর্বাঙ্গব্যাপী আলোড়নে এক শিহরণ।

আমি ছোঁয়া পেয়াছি এখানকার শিশিরভেজা ঘাসের,
ঘ্রাণ নিয়েছি পঁচা কাদার তীব্র গন্ধের,
শুনেছি পাখিগুলোর ডানা ঝটপট,
অনুভব করেছি কামুক প্রাণীদের,
স্বাদ নিয়েছি ফ্রুক্টোজ, এসিড, খনিজ ও ভিটামিনের।
ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসগুলো তেমনটা চোখে পড়েনি
কিন্তু কল্পচোখে দেখেছি এদের।
দেখেছি এদের সাম্রাজ্য ও দৌরাত্ব,
এন্টার্কটিকার নিচে দশলক্ষ বছরের অটুট যৌবনময়ী প্রাণিগুলো!
আর ভ্যারিওলা ও ইনফ্লুয়েঞ্জার তো কথাই নেই-
মাঝে মাঝেই হাতাহাতি হয়।
পাখিদের প্রতিটা ফাঁকা প্রকোষ্ঠ দেখেছি;
কারলিউ হয়ে একদিন উড়েছিলাম
খাদ্যহীন, বিশ্রামহীন, আশ্রয়হীন দূর্গম দীর্ঘ পথযাত্রায়
বারে বারে মনে হয়েছে এ পৃথিবীকে।
এখানকার উদার হাওয়া, অথৈ জল,
ধূ ধূ মাঠ, বিস্তৃত সবুজ
দিগন্তের বুক চিরে উঠে দিগন্ত পানেই মিশে যাওয়া সূর্য
সাগরের উত্তাল ঢেউ আর বজ্রপাতের প্রতিটা আওয়াজে
মনে হয়েছে- আমি কে?

উত্তর খুঁজতে খুঁজতে প্রতিটা বিজলিতেই মিলেছে তা।
চারিদিকে নিকষ কালো, সাড়াশব্দহীন,
মাঝে মাঝে আলো-আঁধারী,
কদাচিৎ গোধূলী বা ঊষা,
মাঝে আমি ক্ষীণ এক আলোক ধারা।
আমার পূর্বে,পরে-অন্ধকার!
তবে এ অন্ধকার শুন্য নয়, পূর্ণ অনেক কিছুতেই।
প্রচন্ড মাধ্যাকর্ষণ নিষ্পেষণে চে সেমাই বা মার্বেল
যেটাই হই না কেন ;
টানেলের অপর পারে পৌঁছেছি বিশাল এক মহাজগতে।

এপারের ইউগ্লিনা, অ্যামিবা বা নারীর যোনিদেশ
ওপারেও আছে।
তবে এ স্বাদ মিলেনি ওপারে,
কারিশমা মনে হয়েছে আমার এখানেই।
এখানকার প্রতিটা লিচুর এরিলের স্বাদ,
সাগর গভীর হতে উদ্ভূত ম্যাগমার সবেগ স্ফূরণ,
চারদিক ছাপিয়ে উঠা বুদবুদের উদগীরণ,
৭০° উত্তর ও দক্ষিণের অপূর্ব জ্যোর্তিময়ী আকাশ,
রেডিও তরঙ্গ বা ইলেক্ট্রিক ওয়েভ,
গ্রেট ব্যারিয়ার রীফের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য,
মক্ষিকা রাণীর পোলেন ভক্ষণ-
তাদের নাচের প্রতিটা তাল ও লয়,
ক্যারোলিনা বেইজ-এর যতসব বিস্ময়!
উষ্ণমন্ডলীয় চিরুনিক্সের অতিক্ষুদ্র টেন্টেকলের মজা
বা কোন এক বুয়াজা ডারাটের প্রবল ঘূর্ণি ;
মনমাঝে উঁকি দেয়া যতসব প্রাচীণ-
সেই পিরামিড, সেই আজটেক,
সিন্ধু, ইজিয়ান বা ব্যাবিলোনিয়ান ;
যাদের শেষবিন্দু অটুট আজো।
৪৯০ ফুটের শিঅ্পস, তার (ক্ষেত্রফল÷ ২) × উচচতা-য়
এক π (২২/৭), ঘোর যদিও একটি ব্লক
তবু পেয়েছি তাতে সিলিকা বা লাইম।

উৎকর্ষের চূড়ায় ১০০ বিলিয়িন কোষের মস্তিষ্ক
হারিয়েছে যদিও, হারায়নি সেই কীর্তিনাশা!
যে রুপে রুপে ছিল যুগে যুগে, আছে আজো
বিচরণ যার অতীত, ভবিষ্যতহীন সদা বর্তমানে।
সে শক্তিতেই মিশে গিয়ে ঋণ শুধতে চাই আমি
এখানকার প্রতিটা শিশির, শীতের মিষ্টি রোদ,
পঁচা কাদার গন্ধ, দৃষ্টির প্রতিটি বিস্ময়,
গাছের প্রতিটি হলুদ পাতা,
জানা-অজানা সব কল্পনা
আর কালো অক্ষরের প্রতিটা ঋণের।

.                ******************               
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*