কবি সাধন গুহ - বছরের ছ’মাস তাঁকে শুয়ে থাকতে হোত হাঁপানি রোগের জন্য। তারই মধ্যে ছিলো
নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য রোজগারের চেষ্টা।
সাধন গুহ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর আকুপাংচারের হাত
ছিল অসাধারণ। ইলেকট্রনিক বা যে কোন ধরণের যন্ত্রপাতি সারাতেন অক্লেশে। আকুপাংচারের প্রয়োজনীয়
চার্জার তৈরী করে দিয়েছিলেন কোনো কোনো কমিটিকে। শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি জায়গায় সাধন গুহের
জনপ্রিয়তা ছিলো ঈর্ষা করবার মতো।
সত্তর দশকের দাবানল তখন বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে | নকশালবাড়ীর আদর্শে দীক্ষিত নেতা ও
কর্মীরা অনেকেই হয় শহীদ হয়েছেন নয়তো কারাগারে | মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিপ্লবী কর্মী ও সমর্থক
প্রতিবিপ্লবের ধাক্কায় ছত্রভঙ্গ ও সন্ত্রস্ত জনতাকে ফের সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নানা গণসংগঠন গড়ে তোলার
প্রয়াস চালাচ্ছেন | বন্দীমুক্তি ও গণদাবী প্রস্তুতি কমিটি এবং ডাঃ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটির জন্ম এই
প্রক্রিয়াতেই |
সাধন গুহ কোটনিস কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন ডাঃ কোটনিসের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী
কমিউনিস্ট আদর্শকে দেখে। তখন তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল এক মহান অঙ্গীকার, এক মহান স্বপ্ন
“এসো আমরা কোটনিসের পথ অনুসরণ করি”। বস্তুতপক্ষে তিনিই উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন
নকশালবাড়ীর পথই কোটনিসের পথ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কমিটির কর্তৃত্বে যাঁরা আসীন ছিলেন তাঁরা
কখনই এটা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেন নি। প্রথম মতবিরোধ শুরু হলো, যখন কোটনিস কমিটির পত্রিকা
‘অঙ্কুরে শুরু’ প্রকাশ আরম্ভ হলো। সেখানে দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সামন্তবাদ বিরোধিতার
স্লোগানগুলিকে কর্মসূচীতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে না ; অজুহাত দেখানো হচ্ছে যে একটা সংগঠন এই ধরণের
কর্মসূচী নিতে পারেনা। আসলে কর্তাব্যক্তিরা যা আসলে চাপা দিতে চাইছলেন তা হলো কোটনিসের এই
আদর্শ কমঃ মাও-এর জনগনের সেবা করো --- এই আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোটনিসের আদর্শের
উল্লেখ করে পত্রিকায় যখন লেখা হলো “রোগীদের আসবার অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না, আমাদেরই
যেতে হবে রোগীদের কাছে”। তখন মোবাইল চিকিত্সার লাইনটাকে প্রধান ধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার
আপ্রাণ চেষ্টা চালালেন সাধন গুহ। বেশ কিছু কর্মীকে এ ব্যাপারে যুক্ত করা গেলেও এটাতে বাদ সাধলেন
দলের কর্তাব্যক্তিরা।
আসলে পেশাগতভাবে চিকিত্সক কর্তাব্যক্তিরা চাইছিলেন আকুপাংচারকে জনপ্রিয় করতে আর নিজেদের
বাজার তৈরী করতে। এই কায়েমী উদ্দেশ্য আরও প্রকট হয়ে পড়ল আকুপাংচার-এর অ্যাডভান্স কোর্স
করতে চীনদেশে প্রতিনিধি পাঠানোকে কেন্দ্র করে। প্রতিনিধি নির্বচনের ক্ষেত্রে সাধন গুহ প্রবলভাবে মত
দিয়েছিলেন সাধারণ অচিকিত্সক চিকিত্সা কর্মীদের বাছাই করার পক্ষে। এমনকি তাঁর নিজের নামও তিনি
এক কথায় বতিল করে দিয়ে বলেছিলেন “নতুনদের সুযোগ দেওয়া হোক”। কর্তাব্যক্তিরা সে প্রস্তাব নাকচ
করে দিলেন এবং নিজেদের কেরিয়ার গুছানোর জন্য নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত করলেন। এখনতো সবাই
জানেন, বর্তমানে এইসব কর্তাব্যক্তিরা কেউ চীনফেরত আকুপাংচারিস্টের তকমা এঁটে রমরমা ব্যবসা
চালাচ্ছেন, কেউ বা আকুপাংচারের অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করছেন, কেউ কেউ আবার দুটোই করছেন।
সাধন গুহ কোটনিস কমিটিতে মহিলা অচিকিত্সক কর্মীদের দ্রুত স্ত্রীরোগ এর ব্যাপারেও জরুরী ছোটখাটো
অপারেশনের এর ব্যাপারে দক্ষ করে তোলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। তাদের কাছে তাঁর
বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন “আমাদের দেশে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ও শহরের
বস্তিগুলিতে মহিলারা বিভিন্ন রকমের স্ত্রীরোগের শিকার এবং একই সঙ্গে তাঁরা প্রচণ্ডভাবে শোষিত ও
নির্যাতিত হন। একদিকে এঁদের রোগমুক্তিতে সাহায্য করে আমরা যেমন তাঁদের আপনজন করে নিতে
পারবো, অন্যদিকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে টেনে আনতেও সক্ষম হবো। মনে রেখো, আমাদের চিকিত্সা ও
অপারেশনের দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্য কিন্তু বিপ্লবী সংগ্রামের সৈনিকদের সেবা-শুশ্রুষা করা”। এই বৈপ্লবিক
উদ্দেশ্যটি যখনই কর্তাব্যক্তিরা ধরতে পারলেন, তখনই তাঁরা এই উদ্যোগটিকেও বানচাল করার জন্য
উঠেপড়ে লাগলেন। এ ব্যাপারে যে জঘন্য হীন কৌশল তাঁরা অবলম্বন করেছিলেন তা অনেকেই জানেন।
তাঁরা সাধনদার মত একনিষ্ঠ বিপ্লবী কর্মীর নামে অপবাদ দিয়েছিলেন যে উনি মহিলা কর্মীদের নিয়ে কাজ
করতে বেশী পছন্দ করেন। এই অপমান ও অপবাদ তাঁকে অনেকখানি আঘাত দিয়েছিল। তিনি কোটনিস
কমিটি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তাঁর বিপ্লবী উদ্যমে কোন ভাটা পড়েনি। অন্যত্র অন্য ক্ষেত্রে তাঁর বিকাশ
হয়েছিল।
সাধন গুহ সাংস্কৃতিক কার্যকলাপকে নিছক সংস্কৃতিচর্চা হিসাবে দেখতেন না। তিনি এটাকে সমাজ
পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবেই দেখতেন। ‘৬৬-র চীনের “মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব” ও কমরেড মাও-
এর আহ্বানই তাঁকে টেনে এনেছিল ১৯৬৭-এর নকশালবাড়ীর মহান আন্দোলনের মধ্যে। তাই গণ-সংস্কৃতিকে
তিনি দেখতেন সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটা অংশ হিসাবেই। মূলত শারীরিক কারণে এবং কিছুটা
পারিবারিক কারণে সাধন বাবু ৮০ দশকের গোড়াতেই প্রত্যক্ষ সাংগঠনিক কার্যকলাপ থেকে সরে যেতে
বাধ্য হন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুরেশ বিশ্বাস, পরেশ ধর, প্রতুল মুখার্জীর গান পছন্দ
করতেন। প্রথমত গণসঙ্গীতের পরিবেশ তৈরীর ব্যাপারে সাধনদার একটা সহজাত দক্ষতা ছিল। অজস্র
গানের সংগ্রহ এবং সুর মনে রাখার ব্যাপারে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।
পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন মেরিন ইঞ্জিনীয়ার। বাস্তবে জানা না থাকলে অনেকেই তাঁকে দক্ষ
চিকিত্সক বা দক্ষ গায়ক বা একজন দক্ষ ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনীয়ার ভেবে প্রায়সই ভুল করতেন। এসবের
প্রয়োজনীয় ডিগ্রী না থাকলেও তিনি এর প্রত্যেকটাতেই দক্ষতার শীর্ষে ছিলেন। এইসব দক্ষতা ও গুণাবলী
সবটাকেই লাগাতেন প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবায়।
দুরারোগ্য জণ্ডিসে ১৯৯৫ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর একটি ছবি এবং তাঁর জীবন সম্বন্ধে আরও তথ্য আমাদের পাঠালে আমরা প্রেরকের নাম এই পাতায়
আমাদের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রকাশিত করবো।
আমরা কবি রাজেশ দত্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, কবি সাধন গুহর এই পাতাটি তৈরী করার সবরকম
তথ্য, আমাদের দেবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। আমরা আরও কৃতজ্ঞ শ্রী চিররঞ্জন পালের
(+৯১৯৪৩৪৫১৬৮৯৮) কাছে তাঁর নানাভাবে এই পাতাটি তৈরী করতে সাহায্য করার জন্য। স্বপন
দাসাধিকারী সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ০২.০৬.১৯৯৭ তারিখে প্রকাশিত “যুদ্ধ জয়ের গান”, গ্রন্থ থেকে
তথ্যাদি নেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ।
আমরা মিলনসাগরে কবি সাধন গুহর গান ও কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে
পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স - কমলেশ চৌধুরী, আগুন পাখি নীরব হলো, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত যুদ্ধ জয়ের গান, ১৯৯৭।
কবি সাধন গুহর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ০২.১২.২০১৫
...