কবি শশাঙ্ক শেখর রায়ের কবিতা
*
অচেনা বাংলার মুখ
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
কবির “মেঘ ভাঙা রোদ” ( মহালয়া, ২০১৩ ) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া |

বাংলার মুখ---
রূপসী বাংলার কবি দেখেছিলো
সৌম্য শান্ত রূপসী মরম-ময়ী তিলোত্তমা রপ
তাঁরা ভালবেসেছিলো সোনার বাংলাকে ;
যার ভাষা বাংলাভাষা, যেন মুক্তধারা
মনমোহিনী অপরূপ
সেই তো বাংলার মুখ |

এখন সে মুখ আর চোখেও পড়ে না
আজ এ বাংলার মুখ নিতান্ত অচেনা
কতনা সোনালী সূর্য উঠেছে ডুবেছে
কত রং কত বর্ণ ছাড়ায়েছে সীমা
বাংলার রূপের ছিলো অজস্র গরিমা |

আজ এ বাংলার মুখ নিতান্ত অচেনা
রাখালিয়া বাঁশী তার হারায়েছে সুর
মাঝি মল্লা ভুলে গেছে ভাটিয়ালি গান
আজ এ বাংলার মুখ
সন্তান হারানো কোন ক্রন্দসী মায়ের মুখ
হাড় জিরজিরে দেহ দুঃখের সোপান |

গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে
যেখানে গিয়েছি আমি
খুঁজেছি বাংলার সেই তিলোত্তমা মুখ
স্বপ্নে কিংবা কল্পনায় চেয়েছি সে মুখ দেখি
খুঁজেছি খেপার মত
কিন্তু হায় ! হতাশায় ভরে গেছে বুক
এ মুখে অজস্র দুঃখ আঘাতের দগদগে ক্ষত
বাংলার মুখ আজ বীভত্স ভয়াল
আধপোড়া ঝলসানো বেগুনের মত
এ মুখ দেখতে বড় ভয়, আতঙ্কে আঁতকে ওঠে প্রাণ
এ মুখের চারিদিকে প্রেতাত্মারা কাঁদে শতমুখে
আকাশে বাতাসে ভাসে শবযাত্রার অশ্রুভেজা গান |

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
আর নয় স্বপ্নবিলাস  
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৭.১.২০২১।

শুনেছি তোমার মুখে
তুমি নাকি রাতভোর স্বপ্ন দেখো ঘুমের ভিতরে
জানিনা কেমন তুমি, কোন যোগমায়া বলে
দেখতে পাও চোখ বন্ধ করে ;
তুমি দেখো চিত্রিত ছবি বিচিত্র ক্যানভাসে
যা তোমার স্বপ্নের আবর্তে ভেসে আসে
রূপকথার নায়ক-নায়িকা ঠাকুরমার গল্পভরা ঝুলি
চাঁদের জোছনা মেখে রূপালী ডানায় উড়ে যায়
নানা রংয়ে প্রজাপতি ছোট ছোট ফুলপরিগুলি
চলে যায় দুস্তর আকাশ পারে কোনো অজানায়
তুমি নাকি দেখেছো মৈনাক চূড়া, চাঁদের পাহাড়,
কমল কাননে ভরা মানস সরোবর
দলে দলে রাজহাঁস জল কেলি করে নিরন্তর
তুমিই দেখেছো মন্দাকিনী কুলকুল বহে দেবলোকে
সেখানে ঊর্বশী মেনকা আত্মগতা স্নানকতা
স্বর্গগঙ্গা খরস্রোতে রূপবতী অজান্তেই
হারিয়েছে অঙ্গবাস সমস্ত সম্ভার
চঞ্চল তরঙ্গমালা চুমে যায় তন্বীতনু তার
এলায়িত কেশদাম বক্ষদেশে করেছে আশ্রয় আনমনে
সম্মুখের অঙ্গপাশ সংরক্ষণ করেছে যতনে
এই চিত্ররূপগুলি তোমারই স্বপ্নের অনুগামী
আপন অস্তিত্ব ভুলে আর তুমি থেকোনা ঘুমঘোরে
রাত্রিশেষে সব কিছু বাধা পাবে তোমারই আবদ্ধ পরিসরে
চোখ খোলা, জেখো ওই সম্মুখে বাস্তব
স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক অনেক
তুমি নারী, দায়িত্ব ও বেড়াজালে দুর্গম জীবন যাত্রা
অস্তিত্ব আর জীবনের মূল্য পেতে বিস্তর লড়াই
প্রতিবাদী সংগ্রামই জীবন, এই যুদ্ধে জিততে হবে তাই।

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিষময় দু-হাজার বিশ
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৭.১.২০২১।

দু-হাজার বিশ, উনিশের ধান্দাবাজ উত্তরাধিকারী,
গোপনে এনেছো তুমি সর্বনাশা বিষের ভাণ্ডার
ভাণ্ডারে এনেছো ভরে করোনা ভাইরাস  -- কোভিড--১৯
অঙ্গে বিষ, সঙ্গে বিষ, বিষবাষ্প তোমার নিঃশ্বাসে
আবর্ত গড়েছো এক বিষময় মৃত্যু পরিবেশে
ভাইরাস ছড়িয়ে দিলে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে প্রতি ঘরে ঘরে
এনেছো নিশ্চিত মৃত্যু ভয়ানক অতিমারী যাকে স্পর্শ করে
দাঁত -নখ -চোখ-মুখ হিংসা আর জিঘাংসায় মাখা
নিয়ে এলে ঘরে ঘরে নিদারুণ মৃত্যুর যন্ত্রণা
হায়নার দুষ্টু খিদে নিয়ে সারাক্ষণ থেতে চাও মানুষের লাশ
রক্তের আঁচড়ে আঁকো মৃত্যুর আল্পনা, একি সর্বনাশ
এতেও মেটেনি সাধ, আবার এনেছো তুমি দুরন্ত “আমপান”
লণ্ডভণ্ড সমাজ সংসার, গৃহহারা-অন্নহারা বিপন্ন জীবন
প্রেমপ্রীতি ভালবাসা শেষ হয়ে গেছে, হারিয়েছে ছন্দ লয় গান
পৃথিবীটা প্রেতপুরী যেন, পেতনীরা অট্টহাসে বিকট চিত্কারে
পৃথিবী আতঙ্কে থরথর চারিদিকে মৃত্যুভয় ভীতি
এরই মাঝে দাপিয়ে চলেছে দেখি ঘৃণ্য রাজনীতি ;
এসে গেছে দু-হাজার একুশ, এনেছে খবর
বিজ্ঞানিরা পেয়ে গেছে কোভিড খোঁজার অস্ত্রাগার
সন্ধান পেয়েছে তার দু-হাজার বিশের সেই “কালা--যাদুঘর”
বহুখুঁজে পেয়ে গেছে বিষের নিদান অস্ত্র করোনা -ভ্যাকসিন
আমি জেগে আছি অন্ধকারে, সুদিনের আশায় আশায়
আমার প্রত্যয় -- অশুভ বিদায় হবে, আসবে সে দিন
শুভশক্তি পারে বিশ্বে আকাঙ্খিত জয়।

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
“জীবনের অবশেষে”
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৭.১.২০২১।

বেলা যে গড়িয়ে গেছে, এখন অবেলা
রঙীন গোধুলি ; সূর্য চায় দিগন্তকে ছুঁতে
স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে সীমানার কোলে
যেন কোন চিত্রপটে রামধনু আঁকা---
ক্ষণিকের উপস্থিতি দিনান্তের আঁধারে মিলাবে
ফেলে আসা জীবনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়
জমে আছে অনুভবে পাললিক শিলার মতন ;
ভাবনা আর বাস্তবের ফারাক অনেক
দেনা পাওনায় সাযুজ্য মেলে না
মাটির পৃথিবী দেখি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে পাথরে
বিবর্তন মাথা তুলে যাতায়াত করে শুধু ভবিষ্য আবহে
বয়স এগিয়ে চলে সময়ের সাথে শেষবেলা পথে
দিনপঞ্জী জমা হয় অন্ধকার ঘরে
কর্ত্তব্যে ছিলো না অবহেলা দায়যত হয়েছে সাধন
অংক কষা শেষ হলে রাফখাতা হারায় সম্মান ;
সামাজিক ব্যবধান বারে দিনে দিনে ‘বছরে বছরে’
আত্মার আত্মীয় করে কেউ আর রাখে না আদরে
সংকীর্ণ হয়েছে ক্রমে ব্যপ্ত পরিসর, প্রশস্ত হয়েছে বিভাজনে
সমাজে ও পরিবারে প্রয়োজনহীন অসুস্থ জঞ্জাল
আলোক পেরিয়ে গেছে অন্ধকার ঢেকে গেছে দিক
এ সমাজে অখ্যাত এখন পরিচিতি লুপ্তপ্রায়
প্রবীন বয়স্ক নাগরিক।
জীবনটা কত মূল্যহীন, হাসি কান্না রুদ্ধ আজ সুপ্ত অভিমানে
আত্মিক সম্পর্কগুলো ভেসে যায় কালের উজানে
জীবনের আশাগুলো উরে যায় কর্পূরের মত
প্রশ্নগুলো ,সমাধান পায়নি কখনও
অংকগুলো রেখে গেলো অসংখ্য অমিল ভাগশেষ
সবই হারিয়ে গেছে, হারায়েছে জীবনের দাম
তাইতো আশ্রয় খোঁজে, তৃষ্ণার্ত প্রবীন--বয়স্ক-নাগরিক
বৃদ্ধাশ্রম অথবা কোনো অনাথ আশ্রম।

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সময়ের জিজ্ঞাসা
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৭.১.২০২১।

অবসর জীবনের অলস সময়
সময়ের ব্যস্ত যাতায়াত, দাঁড়াতে চায়না বেশীক্ষণ
গড়ে দিয়ে চলে যায় স্পস্ট ব্যবধান
কালক্রমে মাথাতোলে কাঁচের দেওয়াল
এরপরে অতীত যায় ওপারে চলছে বর্তমান
দৃশ্যগুলো ঝাপসা কিছু বড়ই জটিল বেমানান।

দিশাহারা শিক্ষিত বেকার, কর্মহীন উদভ্রান্ত যৌবন
বৃত্তিচ্যুত বিপন্ন মানুষজন, ক্ষুধার্ত সংসার
সমাজে লাঞ্ছিত নারী, নিরন্তর চলে ব্যভিচার
মাতৃ জঠর থেকে সময়ের সাথে সাথে বড় অসহায় নারী
চৈত্রশেষে দমকাঝড়ে, লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় জীবনের আশা
হারায় অকালে সব হীন আশঙ্কায় হয়েছে ধর্ষিতা
সব সত্য হারায় স্বীকৃতি, নির্বিকার বিচারের বানী
বিবেক-চেতনাগুলো পসরা বাজারে-চলে বিকিকিনি
নীতিহীন রাজনীতি অভিনয় করে চলে ভণ্ড দরবারে
অদ্ভুত সমঝোতা চলে দৃশ্যের আড়ালে
বিত্তমুখি দলতন্ত্র রাজ করে সমাজ সংসারে।

এ এক অচলায়তন, কারো কোনো হেলদোল নেই
নেই কোন সত্য প্রতিবাদ, আছে শুধু ব্যর্থ আর্তনাদ
ভয়ার্ত মানুষ, শ্মশাণের শান্তি পেতে চায়
অস্তিত্ব  হারায় অন্তরালে, ভুলে যায় আত্ম পরিচয় ;
কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন ক্রমশই দীর্ঘতর ---
উত্তরের প্রতিক্ষায় আজও ব্যগ্র অলস সময়।

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রতিবাদে নারী
কবি শশাঙ্ক শেখর রায়
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৭.১.২০২১।

আমার চেতনা আজও খুঁজে ফেরে তোমাকেই
এ আকালে দুর্গা তুমি, একালের নারী
তোমাতেই দেখি আমি প্রজ্ঞা তারকা অরুন্ধুতী
দেখি আমি দেবলোকে ঊর্বশী মেনকা
সরলা আশ্রম কন্যা শকুন্তলা কন্ব-তপোবনে
মা হারা হরিণ শিশু এখনও আঁচল ধরে টানে
এ দৃশ্যের অন্যপারে চোখে পড়ে বিধ্বস্ত পৃথিবী
নিমেষে হারিয়ে যায় সব স্বর্গ সুখ
কান্না নামে হৃদয় গভীরে, দুঃখে ভাসে বুক
অনাথ দ্রৌপদী যজ্ঞ জন্মা আজন্ম যুবতী
বস্ত্রহরণ তারও রাজসভা মাঝে, নেতৃত্বে কৌরব
ভীষ্ম দ্রোন কর্ণ সহ পঞ্চ পাণ্ডব উপস্থিত
নারীত্ব লাঞ্ছিত, আর্তনাদে কেঁপে ওঠে পাথুরে প্রাচীর
বিচারক বিদ্বজন রাজনীতি কারবারিরা তবু অচঞ্চল
নির্য্যাতিতা দ্রৌপদীর অশ্রুজলে ভাসে সভাস্থল।

নারীত্বের লাঞ্ছনা বঞ্চনা অপমান
জন্মলগ্ন থেকে শুরু জীবনের সীমান্ত অবধি
সমাজের জান্তব স্বভাবগুলো সমানেই চলে
নির্ভয়ারা হয়েছে লাঞ্ছিত, আরও অভাগী কতশত
নারী অঙ্গ লালসায় রিপুমত্ত পাশব শিকার
অস্তিত্বের চরম সংকট, পরিচয় লুপ্ত হয়ে যায়
এ আকালে সর্বত্রই জমে যায় দুর্লঙ্ঘ জঞ্জাল
পৌরুষ দামাল, কোথাও সামাল নেই কোন
বেই কোন শোধনের ডাক, নেই প্রতিবাদ।

তুমি এ কালের নারী, তুমি হও সমাজের জাগ্রত প্রহরী
এ কালের দুর্গা হও, হও তুমি কালিকা-কৌশিকি
বৃত্তের বাইরে এসো, হাতে নাও জ্বলন্ত মশাল
অন্যহাতে তীক্ষ্ম তরবারে অশুর নিধন করো
রক্তে নদী বয়ে যায় যাক, চিতাকুণ্ডি পড়ে থাক ছাই
বিদ্রোহের আগুন জ্বালাও, হোক দাবানল, বাধুক লড়াই,
নতুনের আলো নিয়ে রাত্রিশেষে  জাগুক পৃথিবী ।

.                     ***************                         
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর