কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
|
জেলখানার দেশে
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
“লক্ষ চোখের সামনে” (১৯৭৩) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। পুলক চন্দ সম্পাদিত “রক্তে ভাসে
স্বদেশ সময়” (১৯৭৭) কাব্যসংকলনে পরে প্রকাশিত হয়।
জেলখানার দেশ
হাতে তোমার পাথর বেড়ী, পায়ে তোমার . . .
আমার পায়েও, আমার হাতেও . . .
কী উল্লাসে ঘুরে বেড়ায় সশস্ত্র পোশাক
বিন্দু দিয়ে গড়া, রক্ত বিন্দু
কার ?
জেলখানার দেশ
. জেলের ভেতরে মানুষ
জেলের ভেতরে জেল
. তার ভেতরে মানুষ
জেলের ভেতরে খুন
. গারদ ভাঙার শব্দ
জেলের ভেতরে জেল, তার ভেতরে খুন
. গারদ ভাঙার শব্দ
গারদ ভাঙার শব্দ চতুর্দিকে।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
তুমি আমার মাটি, আমার জননী
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবির নিজের সম্পাদিত “স্পন্দন পত্রিকা (১৯৭৪) তে প্রথম প্রকাশ। পুলক চন্দ সম্পাদিত
“রক্তে ভাসে স্বদেশ সময়” (১৯৭৭) কাব্যসংকলনে পরে প্রকাশিত হয়।
এই আমি ধরে রাখছি তোর হাতের ওপর
তোর ঘন নিশ্বাসে এই তপ্ত মুখ এ-মুল্লুক থেকে সে-মুল্লুক
ছুটে ছুটে হয়রান মাথা রাখে শ্রান্ত কপালে তোর
ঘুমের দেশের ভিতর শতরঞ্জ দৃশ্য দেখে---
এই দ্যাখ এক এক ক’রে মুছে যাচ্ছে তোর সমস্ত নীল স্বপ্ন
জেলখানায় পিটিয়ে মারা লাশ দেখে তোর ঘুরে যাচ্ছে মাথা
বেয়নেটের খোঁচায় তোর মাটি, তোর রত্নগর্ভা মাটি হয়ে যাচ্ছে পর্যুদস্ত
আকাশের হাজার চাঁদ তাক্ করে উঁচিয়ে আছে বন্দুকের নল
তুই ডাইনে ফিরতে পারিস না, বাঁয়ে না, এমন কি ঊর্ধ্বমুখ হওয়াও নিষিদ্ধ
তোকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে নতমুখে।
তোর বুকের ওপর প্রতিবাদ মিছিল
মিছিলে প্রতিবাদ, তাই নিহত যুবক
এমন কি সন্তানের নিহত শরীরও ফিরে পায় না জননী
ফিরে আসে, শূন্য হাতে ফিরে ফিরে আসে . . .
আর স্বাধীন দেশের মহান শান্তি রক্ষায় অবিচল
কর্মনিষ্ঠ পুলিশের পোশাক-আষাক।
তুমি আমার মাটি, আমার জননী, মুখ থুবড়া পড়ে আছো।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
বন্দী
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
রচনা জুন ১৯৭৫। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “ব্রাত্য পদাবলী” (১৯৮০)
কাব্যসংকলনে প্রকাশিত।
জিভ উপড়ে নেওয়া হবে, হাত পা কেটে
ঠুঁটো জগন্নাথ
কোনো কথা নয়
অধিকার নিয়ে কোনো কথা নয়, কোনো
লোখাপত্তরও চলবে না
কলমের নিব্ বাঁকিয়ে ফ্যালো
না হ’লে
কলমের নিব্ তোমারই কণ্ঠনালীতে
ফুটিয়ে দেওয়া হবে
না, কোনো কথাবার্তা নয়
সেলাই করো, ঠোঁট দুটে সেলাই করে রাখো
বেঁচে থাকতে চাও স্বাধীন!
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছড়া কিছু আজগুবি : ভূমিকা
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
রচনা ১৯৭১। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “ব্রাত্য পদাবলী” (১৯৮০) কাব্যসংকলনে
প্রকাশিত।
. ১
কি যে ছিল মনে মনে নিজে সে কি জানতো?
ছিল না কিছুই মান তবু সবে মানতো
. একদিন ঝোপ বুঝে যেই
. দিল কোপ, এমনি সবেই
দিল ঝাড়, সেই থেকে বসে বসে কাঁদতো॥
. ২
দেশে এত বেকার কেন?---যেই না বলা অমনি দ্যেখে
চতুর্দিকে ফিসফিসানি, ‘এসব কথা বলিস কাকে ?
. ধরবে যখন পুলিস বাবু
. মরবি তখন foolish বাবু
দ্যাখ না দেখি চালাক মানুষ সবাই কেমন চুপটি থাকে?’
. ৩
চুপটি থাকা চালাক-বাবু হঠাৎ দেখি চোঁচা দৌড়
থামলে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে সে সামনে যখন দেখল গৌড়
. ‘কি হয়েছে ?’ যেই না তাকে বলা
. ---‘আমাদের ওই পুলিস বাবুর চেলা
চুপটি থাকায় সন্দ করে, তাই দিয়েছি সোজা দৌড়।’
. ৪
ভাবছি তো বসে বসে চেঁচানোটা মুশকিল
এখন তো আরও দেখি চুপচাপ ঘরে খিল
. দিয়ে বসে আর কোনো লাভ নেই
. খুব বেশী চুপচাপ দেখলেই
দরজা জানলা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে মারে কিল।
. ৫
‘সুতরাং, চুপ থেকে লাভ নেই
বেশা চেঁচানোর সাথে ভাব নেই।’
. এই বলে বোকাদের রাজা
. বলে আরো, ‘দামামাটা বাজা
যুদ্ধটুদ্ধ ছাড়া জান দিয়ে লাভ নেই।’
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
জেলখানার প্রভাবে
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
রচনা এপ্রিল ১৯৭৬। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “ব্রাত্য পদাবলী” (১৯৮০)
কাব্যসংকলনে প্রকাশিত।
চার দেওয়ালের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সেই শরীর
আমরা যাদের জানি না---
চার দেওয়ালের ভেতর কেউ আদিমন্ত্র উচ্চারণ করে?
আমরা তাও জানিনা।
এই বাইরের লোক, আমরা
কোনো দেওয়ালেই আটকে থাকতে পারি না
সেই জন্যেই আজকাল ঠিকঠাক চুপচাপ থাকি
আর চুপচাপ থাকা শুনি ভালো, যেমন জ্যেষ্ঠেরা বলেন।
অথবা সমস্ত শরীর নিয়ে টলায়মান খানাখন্দে শুয়ে থাকি
এইভাবে খানাখন্দে পড়ে থাকা অবশ্য খুব খারাপ---
যেমন জ্যেষ্ঠেরা বলেন।
আর আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক চলে যায় কোনো না কোনো
দেওয়ালের ভেতর
চলে গিয়ে মাঝে মাঝে ফিরে আসে কারো কারো বুকের কাছে
কারো কারো মুখের কাছেও
তখনই আরম্ভ হয়হৈ চা, পরিষ্কার রক্তপাত, আরেকটি গাথা।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
দূষণ
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি মেঘ বসু সম্পাদিত “আবৃত্তির কবিতা কবিতার আবৃত্তি” (২০০৯)
কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।
পাহাড়বনের ভেতর থেকে চশমা-বাঁদর আসেন
শহরপথে চলতে-ফরতে খুকখুকিয়ে কাশেন
এমনি-বাঁদর এমন দেখে এমনি ক’রে বলে---
এখানকার সব আমরা-বাঁদর কাশতে-কাশতে চলে।
ধুলোয়-ধোঁয়ায় ঠাসা থাকে খাশা এমন শহর
এই আমাদের রপ্ত এখন কাশাখাশির বহর!
কিন্তু ভায়া, তুমি তো সেই বনেই ভালো ছিলে
চশমাচোখে এ-বন ও-বন ভালোই বেড়াচ্ছিলে---
হঠাৎ তোমার এ আগমন, বন থেকে শহরে?’
চশমা-বাঁদর শুনেই কাঁদে---‘বলব কী আর ভায়া!
কাঠ কোটে সব বনই উধাও, মিলছে না আর ছায়া।
পাল্টে যাচ্ছে বাতাসহাওয়া অরণ্যে পাহাড়ে
বদলে তবু হচ্ছে মরু, আরেকটা সাহারা!
কিন্তু তোমার শহর জুড়ে একটুও নেই স্বস্তি
যেদিকে যাই, দেখছি কালো ধোঁয়াধুলোর বস্তি!
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আকাশ কাঁপে তারায়
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত “গণসংগীত সংগ্রহ” (১৯৯০) কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।
আকাশ কাঁপে তারায় যের পাখীর আলো ছাড়ায়
দুয়ার খুলে অবাক মুখ ফাঁসীর দড়ি দ্যাখে
অমল বুক অরুণ কাঁপে বুকের থেকে হারায়।
রক্তে কাঁপে বাতাস
ভক্তজনে উত্ফুল্ল ভক্তিহীনে হতাশ
হতাশ-ভেঙে ভক্তিহীনে চমকে চেয়ে দ্যাখে
অমলমানুষ সাগরতীরে নতুন বাড়ি গড়ে
. পুরনো বাড়ি ভাঙায়
স্থবির বসে থাকতে কেন বলো আর!
অমলমানুষ ধরলো হাতে তলোয়ার।
রক্ত কাঁপে আকাশে, বাতাসে . . .।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
কয়েদখানার কবিতা
কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়
অর্জুন চক্রবর্তী সম্পাদিত “রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা” (২০০৫) কাব্যসংকলন থেকে
নেওয়া।