কবিকেই শেষমেশ নিতে হবে সংগ্রামের ভার হৃদয়ের গান ভুলে, অবশেষে গাইতে হবে এই যুদ্ধনীতি শান্তিনীতি। কে জালিম শান্তি কাড়ে কার- তার সমাধানও বুঝি দিতে হবে আজ কবিকেই। কবি ছাড়া এ-জমিনে আর কেউ শান্তিবাদী নেই কবি ছাড়া মানুষের নেই কেউ মুক্তিদাতা আর; আজ তাই অস্ত্রহীন, কৃশকায় কবির ’পরেই পৃথিবীর বাঁচামরা, সভ্যতাকে বাঁচানোর ভার। হঙরের মতো আসে মরণাস্ত্র, খেতে মজলুম- কবির তো কিছু নেই শুধু এক ভাঙা মসি ছাড়া; তবু এই মসি জানে পাথরেরও ভেঙে দিতে ঘুম, ঝটিকার মতো দিতে পৃথিবীর খুঁটি ধরে নাড়া। আর তবে চিত্রকল্প, ছন্দ নয়, নয় অন্ত্যমিল আজ থেকে কাব্য হোক রাজপথ শ্লোগান মিছিল।
কে যেন দিয়েছে ফেলে অন্ধকার জাল এ শহর জালে পড়া কাতলার মতো; কখনও এখানে যেন আসেনি সকাল থইথই অন্ধকারে এ শহর ডোবা এ শহর রূপকথার যেন এক দ্বীপ; অন্ধকারে কারা যেন দানবের মতো তুলে নেয় কিশোরীর কপালের টিপ অতঃপর কটমট অস্থিমজ্জা খায় দানবের মতো যেন কারা শেষমেশ সভ্যতাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায় হাড়গোড় এখানে কি একজনও পীর দরবেশ আসেননি কোনো কালে, এই অন্ধকারে? তুমিই তবে হে কবি, নাও সেই ভার বাজাও এ অন্ধকারে আলোর গীটার
এখানে মৃত্যু, খুন, সন্ত্রাস, খিধে অষ্টপ্রহর খ্যালে ধ্বংসের খেলা; চুরি, হাইজ্যাক,অবিচার, অসুবিধে জীবনের খেতে ফলায় দুঃখঘাস এখানে জীবন পদ্মা নদীর মতো দু’পারে যে ধু-ধু বিষণ্ন বালুচর তবু তো জীবন দুঃখে হয় না নত পাহাড়ের মতো অবিচল হয়ে থাকে এখানে যে খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস দানবের মতো জীবনের লোভে আসে জীবনের ’পরে অতঃপর বারো মাস হামলা চালায় আজরাইলের মতো তবু এই দেশ কি-এক পাথরবীর দুঃখ-খরায় হয় না তো চৌচির!
পৃথিবীর মানচিত্র ধরে, ঝটিকার মতো এক মাতাল যুবক বলে, সব ভেঙেচুরে দেবো, শেষ করে দেবো… কাচের গ্লাসের মতো, মুঠের ভেতর পুরে আর্তনাদ হাহাকার সর্বনাশ শোক শুভেচ্ছা সাফল্য স্বাগতম ভালোবাসা করতালি সুখশয্যা কাম হতাশা ও আশা- অবিরাম বলে তার একমাত্র ভাষা: ভেঙেচুরে দেবো, শেষ করে দেবো… সুখদুঃখ জন্মমৃত্যু শোকসভা হরতাল রক্তপাত খুন- এইসব পুরোনো ‘নতুন’ চা-এর কাপের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন স্টলে স্টলে, অসংখ্য হাত আর অসংখ্য ঠোঁট; আর তাই মাতাল যুবক ধ্বংসাত্বক হাত নেড়ে নেড়ে ঝটিকার মতো দ্বিধাহীন বলে, সব ভেঙেচুরে দেবো, শেষ করে দেবো, করে দেবো সব কিছু উলট পালট… মূলত যুবক আজ আমাদের সুগভীর সত্তার ভেতরে যুদ্ধ করে, ভূমিকম্প করে, আটলান্টিসমুছে ফেলে অতলান্ত জলাশয় করে।
একটি বছর দু’চোখ ভিজিয়ে জলে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘ভাই, ছুটির ঘন্টা পড়েছে আমার, যাই।’ শুনে তার কথা ঘরের লোকটা ভাবে একদিন সেও তার মতো চলে যাবে। নতুন বছর দু’চোখে কাজল মেখে কপালে ও ঠোঁটে রঙিন নকশা এঁকে অঙ্গে ঝুলিয়ে গহনা ও দামি শাড়ি দরজায় কড়া নাড়ে এসে তাড়াতাড়ি। ঘরের লোকটা দরজাটা দিলে খুলে, উল্লাসে খুব, ঝড়ো হাসি মুখে তুলে নতুন বছর বললো, ‘হে গৃহবাসী, আসি?’ ঘরের লোকটা তার দিকে চেয়ে ভাবে সময় ফুরোলে এই হাসি মুছে যাবে।
গাছেরা গান গায় গাছেরা কাঁদে হাসে গাছেরা কথা বলে সেসব শোনে শুধু একটা বুনো হাঁস নদীর বুনো জলে জলেরা কথা বলে ছলাৎ ছল ছল হাঁসটি শোনে একা এবং চুপ করে অবাক চেয়ে থাকে দূরের বনে একা নদীর বুনো জলে বেড়ায় ভেসে একা একটি বুনো হাঁস উদাস দুটি চোখে কখনো চেয়ে দ্যাখে রূপসী নীলাকাশ আকাশ কথা বলে অসীম চুপকথা- শোনে সে কান পেতে সেকথা খেলা করে নদীর পাড়ে সব সবুজ ধানখেতে কোন্ ইডেন হতে ঈভের ডাক ছাড়ে কোন্ সে বুনোগাছ! শরীর নাচে শুনে তাধিন ধিন তা তা, হৃদয়ও জোড়ে নাচ উড়াল দেয় বুনো হাসঁটি শূন্যেতে যেনবা সে ঈগল নদীর বুনো জল কাঁপতে থাকে শোকে ছলাৎ ছল ছল
কিভাবে কুঁড়িগুলো উঠিল ফুল হয়ে, হইলো দিশেহারা বনের মৌমাছি! যা কিছু দেখি চোখে, যায় তা ভুল হয়ে সত্য হয় তা, যা চোখে না দেখিয়াছি। কুঁড়িরা ফুল হয়, ঝরিয়া যায় ফুল ভরিয়া যায় বন নতুন ফুলে ফের; যে ছিলো কিশোরী, সে প্রণয়ে মশগুল- ঘটিয়া যায় কত ঘটনা জগতের। আমরা এইখানে- সত্য যত না এ, সত্য তার চেয়ে আমরা কেউ নাই; নদীর ঢেউ নাচে নর্তকীর পায়ে, হয়তো আরো ঠিক কোথাও ঢেউ নাই। এই যে সভ্যতা, কাল তা জলরাশি এই যে জলরাশি, কাল তা সভ্যতা সেখানে মানবীরা বলিবে ভালবাসি ফুলের কানে কানে বলিবে ফুল কথা।
আমি যদি হতাম নদী সাগর দেখে আসতাম চাঁদ হলে ওই নীল আকাশে হাসিমুখে ভাসতাম মেঘ হলে যে খরার দেশে ধানপাটে জল ঢালতাম প্রদীপ হলে আঁধার ঘরের কোণে আলো জ্বালতাম যদি আমি শস্য হতাম সোনা হয়ে ফলতাম আগুন হলে অত্যাচারীর শরীর জুড়ে জ্বলতাম কিন্তু যদি ক্ষেপণাস্ত্র হতেই আমি পারতাম বিশ্বে যারা যুদ্ধ আনে তাদের আগে মারতাম।