কবি সায়ীদ আবুবকর-এর কবিতা
*
আশ্চর্য বালক
কবি সায়ীদ আবুবকর

জননীর কোল ছেড়ে যুদ্ধপোড়া পৃথিবীতে মেলে ত্রস্ত চোখ
নিষ্কলুষ একটি বালক
বললো বিষণ্ন স্বরে, ‘বলো হে, এ আমি কোথায় এলাম?’
আমি তাকে শোনালাম পৃথিবরি নাম।
বিস্মিত বালক পৃথিবীর আনাচে কানাচে তাকালো করুণ,
এবং ভয়ংকর দেখে দেখে লাশের শহর, পথভরা মর্মন্তুদ খুন
পুনরায় বললো আমাকে,
‘কি করে মানুষ বলো এ নরকে থাকে?’
আমি তাকে বললাম, ‘হায়,
এ নরকে মানুষ কোথায়?’

.                ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
স্বপ্নের দৌড়
কবি সায়ীদ আবুবকর


আমার স্বপ্ন তোমার পাহাড় বুক
আমার স্বপ্ন তোমার ঠোঁট ও চিত্ত
আমার স্বপ্ন দেহ মিলনের সুখ
এবং আমার সমগ্র অস্তিত্ব
আমার স্বপ্ন তোমাকেই শুধু পাওয়া
হয়ে থাকা শুধু তোমার প্রেমের ভৃত্য
তোমার স্বপ্ন রাজরানী হয়ে যাওয়া
আমার দু’হাতে রাজার মতন বিত্ত
তোমার স্বপ্ন আকাশে আকাশে ওড়ে
আমার স্বপ্ন তোমাকে ঘিরেই ঘোরে
আমার স্বপ্ন ঘুরতে ঘুরতে শেষে
তোমাকে ছুঁয়েই হয়ে গেল নিস্পন্দ
তোমার স্বপ্ন কোথায় যে কোন্ দেশে
খুঁজে খুঁজে ফেরে মায়াবী সুখ-আনন্দ!
আমার শান্তি তোমার একটি চুমায়
তুমি তো পাও না দেখতে শান্তি, অন্ধ
আমার নিবাসে দুঃখেরা যেন ঘুমায়
তুমি শুধু পাও দুঃখের দুর্গন্ধ
তোমার স্বপ্ন আকাশে মেলেছে পাখা
আমার দায় যে তোমাকেই ধরে রাখা!

.                ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
হে ইউসুফ
কবি সায়ীদ আবুবকর


কি করে নারীর টকটকে আমপাকা যৌবনকে অস্বীকার করে
অদৃশ্যের ‘পাওয়ার হাউজের’ দিকে একজন বুভুক্ষু পুরুষ
ছুটে যাওয়া যায় পুরুষত্বহীন এক অপূর্ণাঙ্গ মানুষের মতো?
রমণীর সর্বশ্রেষ্ঠ যৌবনের উনুনে দাড়িয়ে কয়লার মতো
যৌবনের জ্বালে জ্বলতে জ্বলতে কি করে বলতে হয়: ‘আমি ভয় করি
অদৃশ্যের সম্রাটকে’?
কি করে কাপুরুষের মতো রমণীর সমস্ত ঐশ্বর্য হাতের মুঠোতে পুরে
রক্তমাংস কোথায় লুকিয়ে, পালাতে হয় মহাশূন্যের বুকের ভেতর,
মুরগির বুকের ভেতর যেমন চিলের ভয়ে নিশ্চিন্তে পালিয়ে থাকে
সন্ত্রস্ত বাচ্চারা?
সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীর সুখসুখ সহবাস কি করে করতে হয় প্রত্যাখ্যান, ইউসুফ?
জুলেখার হাত সাঁড়াশির মতো এঁটে ধরলে তোমার শার্টের আস্তিন
কি করে বলতে হয় কাপুরুষের মতো হে?
আমি তো, হাঁসের মতো রমণী বাড়িয়ে দিলে তার
রোদভেজা ঠোঁট, না দিয়ে পারি না এক ঝুড়ি শামুক চুম্বন।
রমণী বাড়িয়ে দিলে তার ব্যথাতুর হাত, আমি তো পারি না, ইউসুফ,
নপুংসকের মতো প্রত্যাখ্যান করতে তাকে। এবং পারি না বলেই
জীবনডাঙায় কালবোশেখীর তান্ডবতা চলে প্রতিদিন
পৃথিবীর অমঙ্গল হয়
পৃথিবী ক্রমশ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মূলত আমিই বড় কাপুরুষ, ইউসুফ, মূলত আমিই বড়
যৌবনহীন, এবং আষাঢ়ি মেঘের মতো ইম যৌবনহীন বলেই
রমণীর যৌবন ভাগাড়ে শব হয়ে পড়ে থাকে আমার বিশ্বাস,
আমার আত্মার কংকাল। আষাঢ়ি মেঘের মতো আমি যৌবনহীন বলেই
রমণীর কামনার প্রাচীর ডিঙিয়ে আমি ছুঁতে পারি না শাশ্বত
অদৃশ্যের চূড়ো, হে ইউসুফ, তোমার মতো।

.                ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
হে রাখাল
কবি সায়ীদ আবুবকর


এক শ বছর আগে কোথায় ছিলে তুমি।
যখন তোমার মা দেবদারু বৃক্ষের মতো বাড়ন্ত কিশোরী এক
তখন কি বুঝতে পেরেছিল কেউ, এক কড়াই উত্তপ্ত রসের মতো উথলে ওঠা
এই মেয়েটির শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে এক সৌম্য পুরুষ?
কিংবা তোমার পিতা, সুদূর আকাশ থেকে পৃথিবরি মাঠে
গরুমরার গন্ধ পেয়ে শকুনের মতো, পেয়েছিল কি ঘ্রাণ তোমার অস্তিত্বের-
যৌবনের ঘুটঘুটে অন্ধকারে শাড়ীর ভাঁজের মতো খুলতে খুলতে
তোমার মায়ের শরীরের সব ভাজ?
তাহলে কোথায় ছিলে তুমি?
বিড়ির ধোঁয়ার মতো, একশ বছর পরে কোথায় বা তুমি থাকো?
যখন ছিলে না তুমি, তখনও পৃথিবীতে ভালোবাসা ছিল।
তখনও অন্ধকার কুস্তিগীরের মতো বৈরী আলোর সাথে
খেলতো রহস্যের খেলা। তখনও রমণীরা হৃদয়ের কথা বলে বলে
প্রেম-অন্ধ পুরুষের সাথে কাটাতো কামার্দ্র রাত।
যখন থাকবে না তুমি, তখনও আকাশে ফুটবে তারার ফুল;
তখনও রমণীরা দিগম্বর হয়ে থইথই রাতের সমুদ্রে
প্রমত্ত হাসের মতো কাটবে সাঁতার। অথচ তুমি ভাবো
তুমি না থাকলে পৃথিবীর কোনো নারী প্রসূতি হয় না আর,
তুমি না থাকলে পৃথিবীর সব খেলা অচল ঘড়ির মতো
চিরতরে যায় থেমে।
তুমি তো অমর বৃক্ষ দ্যাখোনি কোথাও, হে রাখাল;
দ্যাখোনি তো তুমি মৃত্যুহীন কোনো মেষ। তবে কেন পর্বতের মতো
থাকতে চাইলে মুঠ করে ধরে চিরকাল
আজন্ম ধর্ষিতা পৃথিবীর স্তন?

.                ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সুলতানা সিরিজ
কবি সায়ীদ আবুবকর


সুলতানা-১

সে এমন মেয়ে, যার নদীচোখে চেয়ে পৃথিবীর নদীগুলো লজ্জায় আরো বেশি নদী হয়ে যায়
সঙ্গীতের মতো যার গলার আওয়াজ পেয়ে প্রেমবাদী পাখিগুলো গানে গানে আরো বেশি
পাখি হয়ে যায়
সে এমন মেয়ে, যার ফুলঠোঁট দেখে পৃথিবীর ফুলগুলো লজ্জায় আরো বেশি ফুল হয়ে যায়
সুখাকাশ ছোঁয়া যার গিরিবুকে বুক রেখে প্রেম-অন্ধ কবি এই, ভালোবেসে আরো বেশি
কবি হয়ে যায়


সুলতানা-২

বললাম,
‘তুমি বুঝি পাকা কোনো আম,
বেহেস্তের বোঁটা ছিঁড়ে পড়েছে যা টুপ করে পৃথিবীতে খসে?’
বললো সে:
‘আলোয় ও অন্ধকারে, চুপচাপ,
গাছের পাতার মতো বেড়ে ওঠা আমি এক পাপ।’
আমি তাকে জ্বালানির মতো, টেনে নিয়ে সুখচুলা বুকের ভেতরে
বললাম- ‘আমাদের এই নীল বুকের ব্যথায়, তুমি এক, ভুল করে
খসে পড়া হুর;
নদী নদী চোখ যার, দেখে দেখে, দেখে দেখে, হয়ে যায় এভাবেই সকাল দুপুর।’


সুলতানা-৩

সমস্ত চোখ অর্ধেক চোখ, শুধু তার নীল ধানভরা বিল চোখ দুটো চোখ সম্পূর্ণ
সমস্ত ঠোঁট অর্ধেক ঠোঁট, শুধু তার লাল গাছপাকা ঝাল ঠোঁট দুটো ঠোঁট সম্পূর্ণ
সমস্ত বুক অর্ধেক বুক, শুধু তার শ্বেত কুমড়ার খেত বুকটাই বুক সম্পূর্ণ
সমস্ত নারী অর্ধেক নারী, সব নারীআম চেখে দেখলাম- সে-ই শুধু নারী সম্পূর্ণ

.                              ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রেমান্ধের ডাক
কবি সায়ীদ আবুবকর


ভালোবাসা সমুদ্রের ঢেউ। বুকে সেই ঢেউ নিয়ে সমুদ্রের মতো আমি
নদী নদী বলে ডাকি। মানবী হে, তুমি সেই ডাক শুনে
সাহসের নদী হয়েছিলে, এবং গঙ্গার মতো আকাশকে শুনিয়ে কঠিন
করেছিলে অঙ্গীকার: ‘ঘর ভেঙে এই দুরন্ত ফাল্গুনে
স্বপ্নের সমুদ্রে মিশে যাবো।’ অতঃপর ফেলে রেখে মুহূর্তেই পেছনের সব ঋণ
ছুটতে ছুটতে তুমি সমুদ্রের সঙ্গমে চাইলে তো মিশে যেতে একদিন।
এভাবেই সমুদ্র নদীকে ঘরছাড়া করে।
এভাবেই সমুদ্র নদীকে দিশেহারা করে।
ভালোবাসা সঙ্গীতের ঝড়। এক বুক ঝড় নিয়ে আমি
কোকিলের মতো কুহু কুহু বলে
ডাক দিয়েছিলাম। এবং শুকনো পাতার মতো
সেই ডাক শুনে তুমি চঞ্চল তোমার শাড়ির আঁচলে
বেঁধে নিয়ে এক মুঠো তেঁতুল বাতাস, বলে উঠেছিলে-‘জীবনের
এই হলো আজ ব্রত:
জড়বৎ পড়ে থাকা আর নয় পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে,
মায়াবী মেঘের মতো অপরূপ উড়বো এবার অসীম আকাশে।’
এভাবেই ঝড় ডাকে
পৃথিবীর শুকনো পাতাকে।
সমুদ্র ডাকলে বলো কি করে বিচ্ছিন্ন থাকে আর নদী?
এবং ডাকলে ঝড়, কি করে শুকনো পাতা পড়ে থাকে আর পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে?
আর মানবী হে, সমুদ্রের মতো এবং ঝড়ের মতো যদি
ভালোবেসে দেই আমি ডাক, কি করে তোমার প্রেমার্দ্র চোখের কবর নিবাসে
লাশের সুষুপ্তি নেমে আসে?

.                              ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রণয়ের প্রথম পাপ
কবি সায়ীদ আবুবকর


যে যা-ই বলুক, তুমি কেন বললে না ভালোবাসা পাপ নয়?
তুমি কেন প্রণয়ের এজলাসে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে বললে না একটিবারও:
যে ভালোবাসে সে খুনী হয়, অগ্নি হয়, ঝড় হয়, জলোচ্ছ্বাস হয়
পারো তাকে হত্যা করে ফ্যালো, নির্বাসনে দাও, কিন্তু কেউ পাপিষ্ঠ বোলো না তাকে।
হাবিল কি আমার চেয়েও বেশি পারতো তোমাকে ভলোবাসা দিতে, আকলিমা?
হাবিল কি আমার চেয়েও বেশি সুপুরুষ ছিলো, যুদ্ধবাজ, প্রেমবাদী?
হাবিল কি আমার চেয়েও প্রেমের কাঙাল?
আমি তো তোমার জন্যেই নির্মম, প্রস্তরের এক ঘায়ে
টুকরো টুকরো করে দিলাম কাচের গ্লাসের মতো সহোদরের মস্তক।
সহোদরের রক্তবৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে করে দিলাম শস্যের খেত।
এবং তোমার জন্যেই তো, আকলিমা, জীবনের কোলাহলে
দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলাম বর্বর ঘাতক মৃত্যুকে।
আমার কি দোষ বলো, তুমি কেন টসটসে আঙুরের মতো এত
লোভনীয় হলে? টুকটুকে আমের মতোই তুমি কেন উলঙ্গ সুন্দর হলে এত?
চোখে মুখে ঠোঁটে শ্বেত পায়ে সুন্দরের অগ্নি মেখে, উনুনের মতো কেন
উত্তপ্ত করতে থাকলে আমার যৌবনের তাওয়া, ঝলসাতে থাকলে নির্মম হৃদয়ের রুটি?
আমি তো তোমার জন্যেই অগ্রাহ্য করলাম পিতার আদেশ, আলো ও অন্ধকারের
রাজার হুকুম, অথচ হৃদয়হীন বলে কি-অদ্ভুত তুমি প্রত্যাখ্যান করলে আমাকে।
আমি তো তোমার জন্যেই রুদ্র হলাম, ঘাতক হলাম, অথচ পাতকী বলে
কি-আশ্চর্য তুমি জঞ্জালের মতো ছুঁড়ে মারলে আমাকে অন্ধকার ডাস্টবিনে।
আকলিমা; প্রণয় কি পাপ? প্রণয় কি কোনো নিষিদ্ধ গন্দম?

.                              ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
লিফলেট
কবি সায়ীদ আবুবকর


তবু তারা এঁটে দেয় হৃদয়ের খিল,
নিথর, লাশের মতো পড়ে থাকে স্বপ্নহীন, অদৃষ্টের খাটে।
সূর্যের এই তো নিয়ম, নেপথ্যে সারারাত ক্লান্তিহীন একা একা আরণ্যক অন্ধকার কাটে;
তবু তারা ভুলে যায় প্রভাতের কথা, ভুলে যায় আদিগন্ত আলোর মিছিল।
জাগো জাগো বলে আমি বাতাসে বাতাসে আপ্রাণ ছড়াই যেন ঘুগরার ডাক;
এক ঘর জেগে ওঠে, কোটি ঘর পড়ে থাকে নিশ্চল নির্বাক
অতলান্ত ঘুমের ভেতর। আজ তাই শণিতের অক্ষরে অক্ষরে
লিফলেট লিখি এই, সারা রাত ধরে।
তারা, যারা স্বপ্নভূক রাতের শ্মশানে সাপে কাটা লাশ;
তারা, যারা মৃত কোনো পশুর মতোই
ভাসতে ভাসতে চলো দুর্ভাগ্যের স্রোতে;
তারা, যারা মাথার উপর কোনো দ্যাখোনা আকাশ,
দ্যাখো নগ্ন অন্ধকার করে থইথই;
তারা, যারা অথই সে অন্ধকারে ডুবোতে ডুবোতে
জলবাদী হাঁসের শরীর, ভুলে যাও রৌদ্রদেশ, আলোকের ডাকঘর গ্রাম;
ভুলতে ভুলতে ভুলে যাও অনিবার্য শুভ্রতার নাম সর্বনাম-
মনে রেখো, দুর্বিনীত এই
কৃষ্ণতার উপর সুনীল আকাশ থাকেই,
দুর্বিনীত এই
কৃষ্ণতার উপর সূর্যের বসত থাকেই।

.                              ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর