‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়; বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়; বাংলার মানুষ অধিকার চায়'- বলে সিংহের কণ্ঠে যে-বীর ছাড়লো লোল বজ্রের হুংকার উনিশ শ একাত্তরে, তারিখ সাতই মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে- তাঁর চোখ- জুড়ে ছিলো প্রমিথিউসের স্বর্গ থেকে আগুনচুরির স্বপ্ন, আর বুকজুড়ে বাংলাদেশের সহস্র নদীর বুকে ভরা জোয়ারের মতো উথলে উথলে ওঠা লাঞ্ছিত বঞ্চিত বাঙালীর ব্যথা; যে-সবুজ মানুষটি তাতানো সূর্যের রুপোলি আলোয় স্নান করে রেসকোর্স ময়দানে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলে ডোরা কাটা বাঘের মতন উঠলো গর্জন করে উনিশ শ একাত্তরে, তারিখ সাতই মার্চ, তাঁর কণ্ঠে বেজেছিল একসাথে হাজি শরীয়তউল্লাহ, সোনারগাঁয়ের সিংহপুরুষ ঈশা খাঁ ও বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যাঘ্র কণ্ঠ; অশ্বত্থবৃক্ষের মতো সুশীতল ছায়া ফেলে চারদিকে, নজরুলের উন্নত শিরে ছুঁয়ে সুনীল আকাশ, যে-পুরুষ উনিশ শ একাত্তরে, অগ্নিঝরা মার্চে, ঘুমন্ত বজ্রের কণ্ঠ চুরি করে এনে ছাড়লো প্রলয়ঙ্করী হাঁক রেসকোর্স ময়দানে-তাঁর দীপ্র বিশাল ললাটে জ্বলে উঠতে দেখলো জনতা নক্ষত্রের মতো শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বায়ান্নের সমস্ত শহীদ সন্তানের রক্তাক্ত ফুলেল আত্মা; আমি তাঁর এক শোকার্ত সন্তান, শতাব্দীর শেষ কবি, জন্ম যার রামভদ্রপুরে, উপজেলা কেশবপুর ও জেলা যশোহর; ভাঙা মাটির কলসির মতো ভাঙা বুক নিয়ে দাঁড়িয়েছি এইখানে- ইচ্ছে, গাই তাঁরই জয়গান। তাঁরই জয়গান আমি গাবো, যাঁর নামে প্রতিদিন সারা দেশ জেগে ওঠে; যাঁর ডাকে আচমকা একদিন ভেঙে গিয়েছিল ঘুম সারা বাংলার; স্বাধীনতাসংগীত বেজে উঠেছিল ডানাভাঙা দোয়েলের ঠোঁটে ঠোঁটে, আর পৃথিবীর কাননে হঠাৎ ফুটেছিল রক্তস্নাত অবাক কুসুম-বাংলাদেশ; বাংলাদেশ- সুরূপসী স্বদেশ আমার- যুগ যুগ ধরে যার রূপকথা লেখা আছে কালের পৃষ্ঠায়, সোনার অক্ষরে।
জানি, গাছের পাতাও তোমার হুকুম ছাড়া নড়ে না, হে প্রভু; তোমারই নির্দেশে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৃথিবীর, সূর্য তার দিয়ে যায় আলো, ক্লান্তিহীন প্রতিদিন একভাবে; ফুলেরা ছড়ায় ঘ্রাণ, সমীরণে; বনে বনে পাখি গায় গান; তোমারই দয়ায় শশধর এত জ্যোতির্ময়ী, নদীগণ এত খরস্রোতা, হিমালয় এত ঋজু, জলবান এত, সাগরেরা; খুঁটিহীন আকাশ সুনীল, অরণ্য সবুজ, সুফসলা এ মৃত্তিকা তোমার কৃপায়; তোমার করুণারাশি ফুলকে করেছে সুন্দর আর ফলকে সুস্বাদু; তোমার ঊষ্ণ-অনুগ্রহ ছাড়া কার সাধ্য আছে কোথা, এক পা-ও ফ্যালে পৃথিবীর 'পর! তুমি যাকে দয়া করো, অমর অজর হয়ে সে-ই থাকে টিকে কালের পৃষ্ঠায়; বাকি সব নাম মুছে যায় অনায়াসে, সাগরের জলে লেখা হরফ যেমন। তুমি যদি মুখ তুলে চাও, ক্রীতদাসও, জানি, তবে হয়ে যায় দেশপতি; আর যদি রুষ্ট তুমি হও, রাজাবাদশারাও ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ঘুরে ফেরে পথে পথে। যেমন দিনের শেষে নুয়ে পড়ে দিননাথ ভীত-ত্রস্ত তোমার সিজদায়; আর পূর্ণিমার ভরা- চাঁদ যেভাবে রাতের শেষে ডুবে যায় অশ্রুসিক্ত, নত শিরে তোমার অসীমে, আমার সত্তাও আজ ঝড়ে ভাঙা কোনো সুপারি গাছের মতো পড়েছে হুমড়ি খেয়ে তোমার চরণে; তুমি যদি জ্যোতি দাও, আমি হই জ্যোতিষ্মান; সে-জ্যোতিতে আমার কবিতা তবে হেমন্তের শাদা জ্যোৎস্নার মতো দুচোখ ধাঁধিয়ে দেয় গোটা পৃথিবীর; তুমি যদি শক্তি দাও, আমারও কবিতা তবে মিল্টন, দান্তে ও হোমারের পথ ধরে মহাকালবক্ষ 'পরে করে হাঁটাহাঁটি; তুমি যদি রাজি থাকো, আমিও আমার পিতা মহাকবি মধুসূদনের হস্ত ধরে পাড়ি দেবো দুর্গম দুস্তর কবিতার পারাবার।
যে-পণ করেছি, হে মহামহিম, আজ প্রাতে, তুমি তা তো জানো; আর আমি জানি তোমার করুণা ছাড়া পূরণ হবার নয় কোনো আশা, সফল হবার নয় কোনো অভিযান; মহাদ্রাবিড় জাতির শ্রেষ্ঠ যে-সন্তান এক হাজার বছরে, পলাশীপ্রান্তরে আচমকা অস্ত যাওয়া স্বাধীনতাসূর্য যাঁর দীপ্ত ঘোষণায় উঁকি দিলো ফের বাংলার আকাশে, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে শত বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির মুহূর্তে ছিঁড়ে গিয়ে, মুক্তির আনন্দে নেচে উঠলো জাতি উনিশ শ একাত্তরে, ১৬ ডিসেম্বর, আমি তাঁর গাথা গাবো, যেভাবে বাল্মীকি অযোদ্ধার মহামতি রামের স্তুতিতে ভরে তুলেছিল বিশ্বের বাতাস, তুমি কণ্ঠে দাও সুর আর চিত্তে ঢালো তীব্র সাহসের রোদ্দুর, রাত্রির অন্ধকার চিরে চিরে যা ভূপৃষ্ঠে আনে মহাভোর; এবং দুচোখে ঢেলে দাও হে, নিশ্ছিদ্র দেশপ্রেমেমত্ত কবিতার মহাঘোর।
কার মা কুৎসিত পৃথিবীতে! সব মা-ই সব সন্তানের কাছে বেহেস্তের মতো পূত, মনোহর, প্রিয়; তেমনি সমস্ত জন্মভূমি বিশ্বময় মানুষের কাছে। কার না শীতল হয় বুক স্বদেশের মুখ দর্শনে! কার না দেশের দুর্দিনে দু'নয়ন ভরে যায় জলে মহাকষ্টে! বিশুষ্ক মরুর দেশে চরাতে চরাতে মেষপাল, গেয়ে ওঠে সবুজ রাখালও স্বদেশের সৌন্দর্যের গান; রুক্ষপ্রাণ পাহাড়ের পাদদেশে বিশীর্ণ শরীরে জুমচাষ করতে করতে নিরন্ন কৃষকও স্বভূমির স্তুতিগান গায়, ফুল্ল ¬মনে; হায়, কে সে পাষাণ, বিদেশবিভুঁইয়ে স্বদেশের কথা মনে করে যার চোখে কখনো আসে না পানি? কোন্ সে বর্বর, দেশমাতৃকার সতীত্ব হরণ করে পরদেশে ভ্রষ্টা পরনারীসনে করে পরকীয়া প্রণয়ের খেলা? একদিকে বাংলা-বিহার-ঊড়িষ্যার শেষ সূর্য, সু-নবাব সিরাজউদ্দৌলা; অন্যদিকে ঘসেটি বেগম, মীরজাফর, জগৎ শেঠ ও বৈদেশি জলদস্যু ক্লাইভের ষড়যন্ত্রজাল; চারদিকে বিপদের ঘনঘটা। সুজলা সুফলা সুঊর্বরা শস্যশ্যামলা ইডেনসদৃশ বাংলার রূপ আর ঐশ্বর্যই চিরকাল কাল হয়েছে যে তার, যেভাবে আপনা মাংসে হরিণা বৈরী ও রূপবতী নারীগণ পড়ে যায় নিজেদেরই সুন্দরের ফাঁদে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে, যুগে যুগে, এসেছে বর্গীরা লুটপাট করতে এর সর্বস্ব সম্পদ। এসেছে ধূর্ত মোগল; দস্যু মানসিংহ দিয়েছে সদলে হানা ঈশা খাঁর ধানখেতে। এবং নির্ভীক ঈশা খাঁরা শত্র'র খড়গ ভেঙে দিয়ে, দিয়েছে জবাব সগৌরবে। বাংলার সুপ্ত জনপদে ফের শ্বেত ভাল্লুকের আনাগোনা। বাঙালীর গোটা মানচিত্র ছিঁড়ে খেতে, হামলে পড়লো অবশেষে পলাশীপ্রান্তরে। বেজে উঠলো রৈ রৈ রবে যুদ্ধের দামামা। একদিকে আত্মত্যাগী স্বদেশপ্রেমীরা; অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী বুভুক্ষু বৈদেশি জানোয়ার একপাল; মাঝখানে কতিপয় স্বদেশী শকুন।
হায় বাংলা, রূপসী স্বদেশ আমার, পুণ্য মাতৃভূমি; এ-কি দুর্দশা বারবার নেমে আসে, হায়, তোমারই অদৃষ্টে শুধু! ছিলে তুমি কোন্ কালে শত্রুহীন? বৈরি দুর্ভাগ্যের বিষধর কালে, বলো কবে, কাটেনি তোমার পুত্র লখিনদরকে? কপালের কোন্ ফেরে পৃথিবীর তুমি দুখিনী দুহিতা এমন, রূপসী বঙ্গ? তোমার সন্তান, ছিলো যারা দুধেভাতে, আজ ফের অদৃষ্টের পরিহাসে হলো ক্রীতদাস। স্বাধীনতাসূর্য গেল ডুবে মহাকালসমুদ্রে, দুইশ বৎসর যার নীল গভীরতা। সিরাজের লাল রক্তের লজ্জায় সব মেঘ হলো কালো; রোদগুলো শোকে কালো কাফন পরে যে ঢুকে গেল গোরস্থানে; নিবিড় নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বসে মিউমিউ করে, আহা, কেঁদে উঠলো কয়েকটি কালো বিড়াল ও রাতের হুতোম। হায় বাংলা, রূপসী স্বদেশ আমার, পুণ্যা, মাতা-জন্মভূমি!
কে বাঁচতে চায় অন্ধ লোহার খাঁচায়? চায় না কে স্বাধীনজীবন? অরণ্যের পক্ষিরাও প্রিয় স্বাধীনতাগুপ্তধন বুকের গহিনে পুরে বাতাসে বাতাসে ছড়ায় শান্তির সুর; মহাসাগরের মৎস্যরাও ঘোরেফেরে আহা-কি স্বাধীন এক জলদেশ থেকে অন্য জলদেশে; নগণ্য যে-পিপীলিকা ভূ-পৃষ্ঠের 'পরে, সেও প্রাণপণ মেরুদণ্ড খাড়া করে বাঁচে এক কি-উন্নত স্বাধীন জীবন; বাঘের রাজত্বে থেকেও, রৌদ্রের মতো উচ্ছল জীবন নিয়ে পরম উল্লাসে ছুটোছুটি করে বনে সুকান্ত হরিণ! শুধু এই বাংলার মাটির মানুষ- গুলো অদৃষ্টের পরিহাসে টেনে চলে বলদের মতো পরাধীনতার ঘানি বারবার জীবনের ঘানিঘরে। তবু তাদের দুচোখ জুড়ে লেগে থাকে সেই কবে অস্ত যাওয়া রক্তরঙ স্বাধীনতা- অংশুমালীর আভা আর বক্ষজুড়ে অরফিয়ুসের প্রিয়া ইউরিডিসকে হারানোর ব্যথা। প্রণয়ের সেই ব্যথা ঘনীভূত হয়ে জমে উঠলো মেঘ সারা দেশে; সেই মেঘ ইস্রাফিলের শিঙার মতো ভেঙে পড়লে প্রচণ্ড গর্জনে, শুরু হলো অকস্মাৎ প্রলয়ংকরী ঝড়; সেই ঝড়ে ঝরা শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল বৃটিশরাজের মসনদ। মনে হলো মুক্ত হলো দেশ, স্বাধীনতা- সুবাতাসে দুলে উঠলো মহাজনতার জীবনের ডালপালা, কাণ্ড ও পল্লব। কিন্তু, হায়, কে জানতো ভ্রাতৃরূপ ধরে যারা ছিলো পাশে, ছিলো তারা দুশমন, ঘৃণ্য হন্তারক! হত্যা খুন লুটপাট নির্যাতন নিষ্পেষণে ভরে ফেললো তারা বাংলার বুক। অতিষ্ঠ মানুষ শেষে নেমে এল রাজপথে। এ কেমন দৈত্য এলো, হায়, - অর্থ খেয়ে, বিত্ত ও বৈভব খেয়ে, বাঙালির রক্ত আর রমণীর সম্ভ্রম খেয়েও যার মিটলো না ক্ষুধা; মানুষের বুক চিরে, চিত্ত চিরে চিরে খেতে চাইলো অবশেষে স্বপ্নসাধ তার, আবেগ, কল্পনা; জবানের ভাষা খেয়ে মারতে চাইলো দ্রাবিড় এ জাতিটিকে শরীরে-অন্তরে। নীলচক্ষু সেই ভাষা- খেকোদের বিষাক্ত নখরে ঊনিশ শ বায়ান্নে রক্তাক্ত হলো ফের রাজপথ।
এমনই দুর্দিনে কাণ্ডারীর অপেক্ষায় রইলো চাতকচোখে চেয়ে পথ, গোটা জাতি, যেভাবে ঝড়ের মধ্যে পড়ে ক্ষুব্ধ দরিয়ায় মাঝির মুখের দিকে চেয়ে থাকে যাত্রীগণ অসহায় চোখে, আর আল্লাহ আল্লাহ বলে করে আর্তনাদ; কিন্তু এ যেন উত্তাল এক নদী, ফুঁসে ওঠা তার মহাতরঙ্গরাশির 'পরে আছড়ে পড়েছে ঝড়, যার মধ্যে পড়ে টালমাটাল খাচ্ছে এক অসহায় তরী, আর যাত্রীগণ বাঁচাও বাঁচাও বলে করছে আহাজারি; কারণ কাণ্ডারী এর, আত্মঘাতী দুশমন এক। অবশেষে দিশেহারা বিপন্ন জাতির যিনি ত্রাতা, এলেন সহসা তিনি সম্মুখে, সিংহের মতো ছাড়লেন হুংকার, মনে হলো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো সারা দেশ, আর দুশমনদের কলুষিত কু-হৃদয় করে উঠলো দুরুদুরু, যেন বটপাতা। তিনি এলেন, যেভাবে বিভাবরী চিরে- চিরে অংশুমালী আসে পুবের আকাশে; তিনি এলেন, যেভাবে লম্বা, ভয়াবহ কোনো লোডশেডিং-এর পর ফিরে আসে বিদ্যুৎ, গ্রীষ্মের অসহ্য রাত্রিগুলোতে; তিনি এলেন, যেভাবে চৈত্রের দাবদাহে পোড়া মৃত্তিকার কঠিন বিদীর্ণ বুকে একছড়া বৃষ্টি আসে শীতল শান্তির মতো। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া আর কপোতাক্ষ পাড় হতে সুরমা, পুনর্ভবা, মেঘনা ও যমুনার সীমান্ত পর্যন্ত সমস্ত বাঙালি একসাথে মহোল্লাসে স্বাগত জানালো তাঁকে আনত মস্তকে মহুর্মুহু করতালি ও আগুনঝরা শ্লোগানে শ্লোগানে। অতঃপর কণ্ঠে তাঁর গেথে দিলো পুষ্পমাল্য, আর লিখে দিলো প্রশস্ত ললাটে স্বর্ণনাম-বঙ্গবন্ধু।
মুজিবনামা মহাকাব্যের ‘অভিষেক পর্ব'; নাম ‘প্রথম সর্গ'।