কবি সেবাব্রত চৌধুরীর কবিতা
*
ক্যালেণ্ডার
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
নবেন্দু সেন সম্পাদিত অজন্তা কবিতা সংকলন (১৯৬২ - ২০০৭) থেকে নেওয়া। প্রথম
প্রকাশ ১৯৯৬।

দেওয়ালে যার ক্যালেণ্ডার দেয়ালে যার ঘড়ি
সময় তার হাতের পান সময় তার ছড়ি
যখন সাধ রাঙাবো ঠোঁট যখন সাধ ঘোরাবো
যখন চাই জমাবো আর যখন চাই ওড়াবো

সবার চাই বাঁধানো ছক সাজানো সংসার
দেয়ালে তাই ক্যালেণ্ডার ঝোলানো সার সার
দিনের রঙ রাতের রঙ দেয়ালে বদলায়
অঙ্কে রয় ক্যালেণ্ডার নীরব মহিমায়

একেক দিন মধ্যরাত ঝড়ের গর্জনে
মত্ততায় পাড়া মাতায় সাড়া জাগায় মনে
ছটফটায় ক্যালেণ্ডার ছড়ায় তার ডানা
অঙ্কহীন শঙ্কহীন মানে না কোনো মানা

ক্যালেণ্ডার ক্যালেণ্ডার জাগাবে প্রাণ সবারই তো
মুক্তি আর বন্ধনের লগ্ন হোক অবারিত।

.           ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শতকথা
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
নবেন্দু সেন সম্পাদিত অজন্তা কবিতা সংকলন (১৯৬২ - ২০০৭) থেকে নেওয়া। প্রথম
প্রকাশ ১৯৮৭।

মা নেই, মাসিও নেই, সগ্ গে গেছেন,
পড়ন্ত বিকেলে কে আর পরিপাটি ক’রে চুল বেঁধে দেবে,
দাওয়ার খুঁটিতে পিঠ রেখে কে আর দুই হাঁটুর ফাঁকে
আলতো ধরবে আমার শরীর এলানো মমতায়?

সারাদিন ফুটমরমাস খাটি, খেয়েদেয় পাটিতে ঘুমাই,
তন্দ্রার মধ্যে শুনি দু’বোনের গুন্ গুন্, আমার বিয়ের কথা,
জ্ঞান থেকে বিয়ের কথা শুনতে শুনতে
.                                ঢুলতে থাকি তন্দ্রায়,
পড়ন্ত বেলায় চুলের যত্নে নরম হয় আমার বাড়ন্ত শরীর।

একদিন একজন আসে, শতকথার প্রথম জন,
ডাগর চোখ, কৃষ্ণনগরের ঠাকুরটি,
ওঁরাই বললেন, নইলে আমি কি আর চিনতাম,
আমি তো হাবাগোবা কালীঘাটের পট।

যে যা বলে বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করলে নাকি ঠকে না,
পিসি রেণুবালা ভীষণ তর্ক করে, বলে সে দুঃখী,
শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে টিকতে না পেরে,
আমার শতকথার প্রথমজন বলে গেছে আবার আসবে।

এরপর আরো অনেকে এসেছে, আসা যাওয়া
সবার এক রকম নয়, সময় পটেও তো রঙ লাগায়,
শতকথার শেষ কথা এখনো শোনা হয়নি
পড়ন্ত বেলায় আজ হাঁটুতে থুতনি চেপে, এলোচুল,
.                                    দূরে চেয়ে থাকি।

.           ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
এই শহরে দুই বাঙলা
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
নবেন্দু সেন সম্পাদিত অজন্তা কবিতা সংকলন (১৯৬২ - ২০০৭) থেকে নেওয়া। প্রথম
প্রকাশ ১৯৯৮।

এই শহরে দুই বাঙলা মধ্যিখানে মা-জননী
ভাগের মা গঙ্গা পাননি যমুনা পেলেন মৃত্গড়নী
এ যমুনা কোন যমুনা বারমাস্যা শুখা-ভুখা
মাঝে মধ্যে বাঁধভাঙা জল ভাসায় তোমার ত্রিনয়নী

এক বাঙলায় বস্তি জুড়ে বাঙলা মায়ের পঞ্চভোজ
কাবাডি কাবাডি কাবাডি ছেলেরা খ্যাপা খুঁজে ফেরে কাবাডি রোজ
আরেক বাঙলায় সাহেব সুবা খোঁজের খ্যাপা পরশ পাথর
দুই বাংলায় দেখাদেখি নেই কে করে আজ তোমার খোঁজ!

তুমি সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলে শুখা-ভুখা যমুনা তীরে
মাটির শরীর শুষে নিচ্ছিল কাঁচা রোদ্দুর কাশের ভিড়ে
আদুর বাদুর ছেলেমেয়ে তোমায় ঘিরে খেলছিলো খুব
ঝুলছিলো মা ঝুলন ঝুলায় খুঁজছিল ডিম পাখির নীড়ে

এ কোন্ পথের পাঁচালি গান গুন্ গুন্ সারা ভুবনময়
দুখ-দারিদ্র্যে ভোটানযাত্রা শিশুসমেত অনিশ্চয়
জগত পারাবারের তীরে এই শিশুরা ছড়া কাটে
উপভাষার পঞ্চভোজে মায়ের আঁচল ছুঁয়ে রয়

মাকে তোরা ছেড়ে যাবি? কে নিবি মায়, আয়রে আয়
মা কি কেবল স্মৃতির কান্না, মা কি কেবল মাটির ঠাঁয়!
মা বিহনে তুই যে নাস্তি, ভাণ্ডারে মা ভবানী তোর,
ভুবনে আজ মা বিছানো ইকড়ি মিকড়ি বর্ণমালায়।

.                ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভাঙা ভাসমান
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
নবেন্দু সেন সম্পাদিত অজন্তা কবিতা সংকলন (১৯৬২ - ২০০৭) থেকে নেওয়া। প্রথম
প্রকাশ ২০০৩।

শোনো হ্যামলেট, ছিন্নভিন্ন সময়গ্রন্থি,
ঝর্নার জলে ওফেলিয়া, আজো ভাঙা ভাসমান,
গান গায় ফুল ছিন্ন আভায়
পাপড়ির গায়ে জল লেগে থাকে,
জলে লেগে থাকে ভাঙা সময়ের কথামালাগুলি,
কথার ভিতর কত নীরবতা,
উলুখাগড়ার স্বপ্নযুদ্ধে ভাঙে কত রাজ
পোড়ে দেবালয়,
দগ্ধ নগর,
ঝলে তরবারি
ছিন্ন রুধুর খুঁজে ফেরে কোন্ মজা খাতগুলি,
স্বপ্ন ভাঙছে কোন্ ঝর্নার---
সাগরকে ডাকে---
কোন্ ঝর্নায় ওফেলিয়া আজ ভেসে ভেসে যায়
জন্ম মৃত্যু তা তা থৈ থৈ
ভাঙা সময়ের তাতা থইথই।

.       ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
[ রচনা, ফেব্রুয়ারী ১৯৮২ ]
এই কবিতাটি আমাদের চয়ন করে পাঠিয়েছেন
কবি দিলীপকুমার বসু ও ডঃ নন্দিতা বসু।
তাঁদের ইমেল -
dilipnandita@yahoo.co.in     

আকাশ জুড়ে ধূসর রক্তিম টানাপোড়েন চলছে—
মেঘ, কুয়াশা আর উত্তুরে হাওয়ার ষড়যন্ত্র
বারবার ঢেকে দিচ্ছে হিরন্ময় সূর্যকে |
ফেব্রুয়ারির সকাল,
মেঘে-ঢাকা কুয়াশা-জড়ানো রবিবারের
রূপসী দিল্লি,
লোকে বলে এই শহরের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই---
সবই ধার-করা :
এর শীত-গ্রীষ্ম, ঝড়বৃষ্টি, তাপমাত্রার ওঠা-নামা,
নাকি এর পণ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, জৌলুস !
রাইসিনা স্কুলের মাঠে ফসল ফলাচ্ছে ছেলেমেয়েরা
রাশি-রাশি ভারা-ভারা রঙিন ফসল,
সবুজ মাঠের ক্যানভাসে নানা রঙের স্কুল-ইউনিফর্ম,
দুলে উঠছে ঢেউ |
সকাল থেকেই রঙের ভাষা উপচে পড়ছে
রঙে ও রেখায় উপচে পড়ছে ছেলেমেয়ের প্রাণ,
রূপের সঙ্গে ভাবের সংঘর্ষ
রঙের সঙ্গে রঙে
সংঘর্ষের ভিতরেই জন্ম নিচ্ছে এক-একটা রূপের আদল---
বিপরীতের প্রতিসাম্যে, আপাত সমঝোতায়, দ্বন্দ্বময়তায় |

ছবিগুলি জন্ম নিচ্ছে
যত্রতত্র
ছড়ানো-ছিটানো সতরঞ্চির ওপরে মানবশিশুরা,---
নানা রকম বসার ভঙ্গিতে গ’ড়ে উঠছে
নানা রকম কম্পোজিশন,
অলিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে উঠে আসছে
সচল দৃশ্যগুলি, স্বভাব-সঙ্গত,
কোনো লেখক বা পরিচালকের নির্দেশ ছাড়া-ই
জন্ম নিচ্ছে হাজারো ছবি---
শহরে গ্রামে গঞ্জে ফুটপাতে-বস্তিতে পাহাড়ে সমুদ্রে,
ছবি সুন্দর--- কাজের ছন্দে প্রাণের ছন্দ,
ছবি সুন্দর--- কাজের অবকাশে অবসরের গান,
ছবির ভিতরে জন্ম নিচ্ছে ছবিগুলি
এই মাঠে,
আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষে,
দেশে-দেশে,
অগণিত সূর্যখচিত অনন্ত আকাশে,

মহাজগতের ভিতরে আছে এই সৌরজগত,
সৌরজগতের ভিতরে পার্থিব জগত,
পৃথিবীর ভিতরে মানুষ,
অগণিত জীবকণা,
দৃশ্যহীনতা থেকে দৃশ্যের জন্ম,
দৃশ্যগুলি ভেঙ্গে যায় দৃশ্যহীনতায়,
বালির ওপরে শিশুহাতের ঘরবাড়ি আঁকিবুকি
ক্ষণে ক্ষণে মুছে যায়,
নির্জন ভাঙাবাড়ির ধূসর দেয়ালে আঁকা খড়িমাটির রেখাগুলির ওপর
অবিরাম ঝরতে থাকে বাত্সরিক বৃষ্টিধারা,
অনাবিস্কৃত অন্ধকার গুহাচিত্র সভ্যমানুষের কৌতূহলের প্রতীক্ষা করে,
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের
বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের
রূপের সঙ্গে অরূপের
আছের সঙ্গে নেই-এর
অন্তহীন দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে ওঠে, চরাচর জুড়ে,
বাস্তব আর কল্পনা রঙে রেখায় রূপ নিচ্ছে
এই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আসরে :
নানা রঙের নানা আকারের সূর্য উঠছে ক্যান্ ভাসে,
কয়লাখনি আর নিবিড় বন,
মসৃন কলাগাছ বেয়ে উঠছে বাঁদর না মানুষ,
লোভী না ক্ষুধার্ত ?
বন্যা আর বস্তি,
কর্মরত মজুর আর মা, আলাদা আলাদা,
যে মা সে-ই মজুর
কিংবা
মা ও মজুর --- এরকম নয়,---
রাস্তা, ব্রীজ ও বাড়ি উঠছে শহর জুড়ে,
শ্রমজীবী মানুষগুলির মধ্যে আছেন অনেক মা,
ছেলেমেয়েরা ভাঙাগড়ার ভিতরে ধুলোমাটির ভিতরে শৈশব কাটায়,
জীবন কাটায় ----
তারা সম্ভবত কোনো প্রতিযোগিতার আওতায় আসে না
কারণ, বিষয় দুটি আলাদা আলাদা ;

আলাদা-আলাদা বিষয় ওতথ্যকে মিলিয়ে
সত্যের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে চাই
প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রমের সঠিক যোগাযোগ,
বাস্তবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও মানবিকতা,

পদ্মের অর্ধেক পাপড়ি নীল আর অর্ধেক কমলা রঙের
আঁকছে ওই-যে শিশু শিল্পী,---
সে-ও মেলাবার চেষ্টা করছে,
রঙের দ্বন্দ্বে ফুটে উঠছে অবচেতন মনের সৃষ্টিছাড়া নতুন সৃষ্টি ;

মেলাতে হবে নিজেকেই
তার জন্য চাই জাগ্রত কৌতুহল, ভালোবাসা,
বাস্তবকে বোঝবার সচেতন চেষ্টা,
অন্যের চোখে নয়, দেখতে হবে নিজের চোখে ;

পাঁটটি কিশোর কেন একই ধাঁচে আঁকে :
একজোড়া লোক চলে কাঁধে হাত রেখে---
অন্ধকে সাহায্য করছে চক্ষুষ্মান্ যুবা,
কেননা আন্তর্জাতিক পঙ্গুবর্ষ হয়,

এই মুহূর্তে দিল্লির সড়কে যানবাহনের বিপজ্জনক চলাচলের ভিতরে,
প্রতিদিনের মতো,
সাতজন অন্ধ নিজেরাই হাত-ধরাধরি ক’রে রাস্তা পার হচ্ছেন,
বিচারাধীন মানুষ চোখ হারিয়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করছে কোথাও
অন্ধের মিছিলে লাঠিচার্যের ঘটনা নিয়ে
বিতর্ক ও ভাষণে,
অন্ধ বোঝে না অন্ধের দুঃখ |
এই সব তথ্যকে মেলাতেই হবে শিল্পে,
তার জন্য চাই স্বাধীন চিন্তা ও কল্পনা,
প্রচার মাধ্যম আর শিল্প মাধ্যম
মানুষের অনুভূতি আর কল্পনাকে ক্রমশ বিকৃত ক’রে দিচ্ছে ;
শিল্পকে সত্যের বাহন করতে হবে,
শিল্পকে পণ্যের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে |

মানুষের মুক্তি হলে তবেই শিল্পের মুক্তি হবে
শিল্পের মাধ্যমে হবে মানুষের অনন্ত বিকাশ |

জগত জুড়ে চলছে মুক্তি ও বিকাশের লড়াই,
জগত জুড়ে চলছে মেঘ ও রৌদ্রের প্রতিযোগিতা,
শিশুবর্ষে শিশুমজুরের সংখ্যা কমে না,
নারীবর্ষে নারী-নির্যাতন কমে না,
পঙ্গুবর্ষে চিকিত্সার অভাবে অপুষ্টিতে অঙ্গহানি কমে না,
ভ্রাম্যমান বস্তিগুলি কেবলই জায়গা বদলায়,
শিশুর রূপকথায় হানা দেয় সুপারম্যান
ফ্যান্টাসী, ফ্যান্টম----

ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে নতুন অবস্থার উদ্ভব,
অবস্থার ভিতরে আছে নতুন ব্যবস্থার দাবি ও সংকেত,
ছবি-আঁকার মাঠে প্রথমিক আয়োজনের সতরঞ্চির পাশে
নেমে পড়ে কানাত্, সীমানা নির্ধারণের ভূমিকা ছেড়ে,
শয়ে-শয়ে আগত শিশু শিল্পীদের ঠাঁই দিতে |
ডাকের মতো ডাকলে একলা চলতে হয় না,
সঠিক ডাকে সচল হয় আসমুদ্র-হিমাচল প্রাণ,
আপাতক্ষুদ্র সংগঠনেও বৃহত্তর ব্যঞ্জনা আসে,
এখন অবস্থা ও ব্যবস্থার মধ্যে হয়তো নড়বড়ে ভারসাম্য দেখা যাচ্ছে
কিন্তু আগামীতে আসবে আরো নতুন প্রাণ, মুক্তি আন্দোলনে
ভারসাম্য ভাঙতে থাকবে গুণগত রূপান্তরের দাবিতে,
রূপান্তরের দ্বন্দ্ব চলছে চরাচর জুড়ে
এটাই ইতিহাস, এটাই বর্তমান, এটাই ভবিষ্যত |

.               ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
হোলি
কবি সেবাব্রত চৌধূরী
[ রচনা, নভেম্বর ১৯৮২ ]
এই কবিতাটি আমাদের চয়ন করে পাঠিয়েছেন
কবি দিলীপকুমার বসু ও ডঃ নন্দিতা বসু।
তাঁদের ইমেল -
dilipnandita@yahoo.co.in       

চতুর্দশী কন্যা এক দিনদুপুরে ঝাঁপ দিয়েছে কুয়োর ভিতরে
বর্ণশাসিত জলে এখনো ঈষৎ নড়ছে অচ্ছুত্ বালিকা |

হোলির উত্সবে মত্ত রঙ্গময় পুণ্যভূমি
কাক-জ্যোত্স্নায় বাসে অপূর্ব সুন্দর পূর্বভারত
পূর্ণচাঁদের মায়া সকলি ডোবায় শোভায় ভরে আলোয় ছায়ায়
ধূ-ধূ মাঠ ভেসে যায় আলোর বন্যার খরায় মরায়
দেখো রে দেখো রে রঙ্ লেগেছে আলোকে মাটিতে জলে আকাশে বাতাসে
রঙে রঙে মাখামাখি এক জাতি এক প্রাণ একতা
নানা জাতি নানা প্রাণ ভাসে সমদর্শী চাঁদের বন্যায় |

আছে ভাঙ্গী হাজাম ধোবী, আছে দুসাদ ফ্যাসাদ নানা জাত,
আছে রাজপুত রাজা ছোটোবড়ো, আর্যাবর্তে জোতদার, আছে কৃষক,
তপশীলী আর বর্ণহিন্দু অন্ত্যজ আর আদিবাসী
দুরদর্শনে ধরবে দিল্লি মহামানবের সাগরতীর
শাদাকে শাদা কালোকে কালো শিল্পে এমন শাদাকালোর
সরস সহজ সমাধান যথেষ্ট নয় ব্যঞ্জনাময় জটীল,
নিত্যনূতন মুনাফার পরিকল্পনায়
নিত্য আত্মা মুক্তি চায়
পুরনো কাপড় থেকে বেরিয়ে
নতুন কাপড়ে যায় শরীর
আত্মা প্রবহমান, আত্মাই মুনাফা, পূঁজির গতি মুনাফায়
সদ্ গতির জন্য আত্মার হাহাকার রঙিন দূরদর্শন চায় |

হোলির উত্সবে মত্ত বুঝি আজ রঙ্গময় পুণ্যভূমি |

হাওয়া বইতে থাকে অগোচরে মৃদুমন্দ বা উথাল-পাথাল
কেউ নড়ে কেউ জগদ্দল পাষাণ সমান কেউ অনমনীয় দৃপ্ত গরীয়ান,
দেখো ওই পূর্ণিমার চাঁদ দোল খায় মেঘের ডালে
রূপসী রাত্রির হাসি ঝ’রে পড়ে প্রান্তিক বিহারের অগণ্য নগন্য গ্রামে
জ্যোত্স্নার মাখামাখি কালোকে কম কালো শাদাকে জমকালো আরো শাদা
নন্দনতত্ত্বের দিকে আনে,
শিল্পই জানে
সৌন্দর্যের ভিতরে আছে বিপরীতের ভারসাম্য দ্বন্দ্বের নিয়মে

ছিমছাম সাজানো সংসারে তুমি কেবলি সুন্দর চাও পরিপাটি
দরজায় পা-পোষ, স্মিতহাস্য অভ্যাগত, কলিং বেলে পিয়ানোর শব্দ,
১৪৪ ধারার বাইরে নির্ধারিত বিক্ষোভ মিছিল |
যা-কিছু অস্বস্তিকর আকারে প্রকারে বেমানান
তোমার ঘরে-বাইরের ব্যবস্থাপনায় ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই
তাকে নিয়েই সমস্যা,
কেননা তোমার শিল্পসম্মত জীবনযাপনে নতুন উপাদান
এসে আঘাত করছে, ভেঙে যাচ্ছে শিল্প আর জীবনের রূপরেখা,
জীবনসম্মত নতুন শিল্পের দাবি কিছুতে আর এড়াতে পারো না
এড়াতে পারো না চন্দ্রমায়ায় রহস্যময় অনমনীয় খেজুর গাছ

কুয়োর কিনারে ওই খেজুর গাছটিতে কবিতা ছিলো না প্রখর রৌদ্রালোকে
ছিলো অগ্নিময় জীবনের রুক্ষ গর্বিত ক্ষুধার্ত অহংকার,
ক্ষুধা আত্মা ক্ষুধা জীবন সর্বভূক্ অগ্নি ক্ষুধা আসক্তি
সৃষ্টির সকল মৌল উপাদান পঞ্চভূত ও ইন্দ্রিয়ের ভোগ্য ও ভোক্তা
বিশ্বচরাচরের অদেখা ও দৃশ্যমান্ খাণ্ডব তাণ্ডবের মাঝখানে
সর্বপ্রাণ ওই খেজুর গাছ বিহার-বসুন্ধরার মাতৃবন্ধনে শীর্ণকায় দীপ্ত
পেশীতে পেশীতে সত্তার পান করে মধ্যাহ্ন সূর্যের অগ্নি
মধ্যরাতে গড়ায় আত্মা ও শরীরময় অমৃতকরুণা |
খরার দেশে বর্ণহিন্দুর পবিত্র কুয়োর টলটল করে জল
অনেক নীচে, নীচতায় দখল করেছে ওরা জীবনের অন্য নাম,
কলঙ্কী চাঁদ সেখানেও মুখ দেখে মধ্যরাতে,
যেমন আজ, আজ কিঞ্চিৎ মুশকিল হয়েছে
ওখানে কুয়োর ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অসংস্কৃত জীবন
একটি ব্যক্তিগত ঝাঁপের মধ্যে ন’ড়ে উঠছে শত শত বছরের চালচিত্র
ভিত্ এবং কাঠামোশুদ্ধ থরথর ক’রে কাঁপছে চরাচর
স্থল কিংবা সূক্ষ্ম দৃশ্যমান্ বা অদৃশ্য ভাঙন ও নড়াচড়ায় চলছে
চেতনা ও বস্তুর রূপান্তর
ওই কম্পনের ভিতরেও আছে আজ রূপান্তরের লক্ষণ ও ইশারা
মধ্যরাতের পবিত্র কুয়োর পূর্ণচাঁদের ভাঙা মুখ জলের কাঁপনে কিঞ্চিৎ বিকৃত
কেন না বর্ণশাসিত জলে এখনো ঈষৎ নড়ছে অচ্ছুত্ বালিকা---
কবিতার মত্স্যকন্যা বারোঘন্টা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে ওই কালো মৃত্যুর গহ্বরে,
জলই জীবন, জল মৃত্যু, জল আত্মা, সর্বগামী অচল সচল বহতা
জলের ভিতরে ওই জন্ম দোলে মৃত্যু দোলে, দোলে মহাকাল

.                              ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বীতরাগ
সেবাব্রত চৌধুরী
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা” থেকে নেওয়া।
প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩৭৬, প্রকাশক বিভাসচন্দ্র বাগচী।


বাবা রোষে কুটি কুটি করে     সেই জাল ছিঁড়ে ফেলেছেন
মা আমার হাপুস হুপুস          কাঁদছেন আমারই ব্যথায়
আমি শুধু নিষ্পলক চেয়ে আছি পাথরপ্রতিম

সকলে বলেন, কাল নিশি-তে আমাকে পেয়েছিলো
হাওরে মাছের টানে ঘুম থেকে ডেকেছেন তাঁরা
সেই তাঁরা--- কায়াহীন ছায়াহীন ভয়াবহ তাঁরা সব নাকি

বাবার দারুণ রাগ বাড়ে, কেন আমি মাড়াইনে খেত
বাবার শঙ্কিত ভালোবাসা, কুটি কুটি জাল ছিঁড়ছেন
কেটেছে আমার মোহ সর্বনাশী নেশার কবলে

আবার ফিরবো আমি মাঠের সবুজে
দেখবো জীবন যেন শস্যকণা শিশিরের আলোকিত আভা
বাতাসীর বিয়ে হ’লে কাল
পেট ভ’রে নেমন্তন্ন খেয়ে আমি হাসিমুখে তুলবো ঢেকুর |

.                   ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমরা
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা” থেকে নেওয়া
প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩৭৬, প্রকাশক বিভাসচন্দ্র বাগচী

মায়ের মেঘলা দিনে হাসি ফুটতে দেখে
সারাক্ষণ ইস্কুলের মন-ভার বেলা
বিকেলে খুশিতে ভরে দামাল ছেলেটা
লাফাতে লাফাতে গেলো ময়দানের দিকে

কাকে ভালোবেসে যেন কখন অকালে
দুপুরের রিক্ত পথে উঁচু শূন্য গাছের কান্নায়
চলে গেছি একা

আজীবন ভালোবেসে গাঁয়ের নদীকে
দুঃখিনী মায়ের ছেলে মফিজ সারেঙ্
কেন দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের দোলায় দিন যাপে

দামাল ছেলের মনে মা’র হাসিমুখ       
মাফিজ সারেঙ্ দেখে ঢেউয়ের উল্লাস
আজীবন ভালোবেসে আজীবন ভালোবেসে  কাকে
চারিপাশে শুনি শুধু বাঘের গর্জন |

.                   ***************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বারমাস্যা
কবি সেবাব্রত চৌধুরী
গোপাল হালদার সম্পাদিত “পরিচয়” পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৭২ (নভেম্বর ১৯৬৫) সংখ্যায় প্রকাশিত।


হারানো রতন খুঁজে এসেছিলো যারা,
তারা যায় নিরাশায় আমাকে বাজিয়ে ;
শাদা পাথরের মতো                        গানগুলি অবিরত
সাজিয়ে রেখে ছে এক শহুরে সভ্যতা।

সাত দিন ঘুরে ফিরে মাটির মেজাজে
দেখি এক ফেরিওয়ালা হাঁকে, গঙ্গামাটি ;
তাহলে রেলের কাছে                         যে-যুবারা মরে আছে
তারাো পায় নি বটে মৃত্তিকার ঘ্রাণ।

মানুষের কাছাকাছি গাছের স্বভাব
রেখে চলা বড় দায়, কেননা মাছের
বাজারে মাছির ভারি                        উত্পাত উমেদারী,
সরিষা তেলের স্নেহ অদর্শনে বাড়ে।

অতএব কবিতারে বলি ডেকে, তুই যা রে
মুকুন্দরামের মতো ফুল্লরার জিভে।
হারানো রতন খুঁজে                        যারা আসে ঝোপ বুঝে
শাদা পাথরের গানে জানাবো সখ্যতা।

.                   ***************************  
                 
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর