কবি শাহজাহান পারভেজ রনির কবিতা
*
বিশেষ সংশোধনী
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি
কাব্যগ্রন্থ "জীবন ও জবানবন্দি" থেকে নেওয়া।

রাস্তাটা আর যারই হোক না কেন
ওই উলঙ্গটার নয়
যে ফুটপাতে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে
নির্বুদ্ধের মতো বিড়ি ফুঁকেছিল,
রাস্তাটা আর যারই হোক না কেন
ওই ভিক্ষুকটার তো নয়-ই
যে কিনা থালা লুকিয়ে উঁকি মেরে দেখেছিল
রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে মন্ত্রীর গাড়িবহর।
রাস্তাটা নির্বুদ্ধ উলঙ্গটার নয়,
রাস্তাটা ভিক্ষুকটার নয়, রাস্তাটা.....
এমনকি আমাদেরও নয়;
যারা মানুষ বলতে কেবল ভোটার বোঝেন
যারা কল চাপলেই কালো পুলিশ সাদা পুলিশে ছেয়ে যায় দেশ
চাইলেই সারতে পারেন লাস ভেগাসে জোৎস্না স্নান,
রিলিফের চালে বাজার জমিয়ে যারা
নিজে খান বাসমতি চালের ভাত,
ইতিহাস বলে রাস্তার মালিক তারা-ই।
তবুও একদল আহাম্মক হেঁটেই চলে
আর মনে মনে বলতে থাকে....
এই রাস্তা , এই শহর এবং এই দেশ
আমার তোমার এবং সবার!

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কবিকে আমি বেশ্যা বলেছি
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

ফারমায়েশী কবি হওয়ার চেয়ে
রাস্তার ভিখীরি হওয়া অনেক ভালো
ও শালা তকমার আশা করেনা।
পদক প্রাপ্তি দোষের কিছু নয়
যারা পাচ্ছেন তারা আরো পান, আপত্তি নেই
কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়
ব্যাপার হলো দরে পোষালে পতিত মেয়েটার মতো
কবিরও কাপড় খুলতে আপত্তি থাকেনা কোন।
সুতরাং কবিকে বেশ্যা বলার জন্য
আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই।

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কর্মসূত্রে
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি
কাব্যগ্রন্থ "জীবন ও জবানবন্দি" থেকে নেওয়া।

কর্মসূত্রে আমি কখনোই তাদের খবর রাখতে পারিনি
তবে চেয়েছি যার যেটুকু পাওনা ; সেটুকু বুঝে পাক।
ফড়িংগুলোর জন্য একটা ঘাসফুলের বাগান।
ধলাবকের জন্য একটা নিরেট আকাশ
ঘরের সামনে খুকুর জন্য সু-প্রশস্ত খেলার মাঠ।
চেয়েছি, বড়পুষ্কুনীটায় বড়দের পাশাপাশি
জায়গা পাক রাজহাঁসের সদ্যসাতারু বাচ্চাগুলো।
কর্মসূত্রে, আমি কখনোই তাদের জীবন দেখিনি
তবে চেয়েছি যার যেটুকু আছে, সঞ্চয়ে থাক।
উদ্বাস্তু মাজরা পোকার সঠিক পূনর্বাসন।
রোদপোঁড়া পেয়ারাপাতায় সবুজ বিপ্লব
জল ইদারার উপর ঝুঁকে পড়া ডালিমের ডাল।
চেয়েছি, রেলবস্তির খোঁড়া রোদ্দুর ভুলিয়ে দিক
ভিখীরির ছেঁড়াচট, ফেলে আসা শৈত্য সহবাস।
কর্মসূত্রে আমি কখনোই কাঠগোলাপে চোখ রাখিনি
তবে চেয়েছি, যে যেখানে আছে অন্তত দাঁড়িয়ে যাক।
কর্মসূত্রে, আমি কখনোই আগুনে হাত রাখিনি
তবে চেয়েছি, যার যতটুকু হিস্যা, ফিরে পাক বুঝে পাক।

.                     ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভেতরে মানুষ এক
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি
এই কবিতাটি মিলনসাগরের দেয়ালিকা-৩ এর পাতায়ও তোলা হয়েছে।
সেই পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন 

আমার শত্রু যখন আমি, তখন মিত্র বলবো কাকে
আমার জন্ম যখন জলে, তখন ভয় কি কাদা-পাঁকে!
আমার বিরান গেরস্থালী, আমি নিজেই গোরস্থান
আমার জন্মগত দায়ে, আমার আমিই পিছুটান।
আমার এক হাঁটুজল কাদা, আমার বাধায় বাঁধা হাত
আমার দিনান্ত দিন দেনায়, কিনি করাত কাটা রাত।
আমার থালায় বাড়া ভাত, আমি ভাতের পূজাচারী
আমার নগদ প্রয়োজনে, বাকী বায়বীয় কান্ডারী
আমার পূণ্যি আমার পাপ, আমার পূন্যি পোড়ায় পাপে
আমার জন্ম যখন শাপ তখন ভয় করিনা সাপে!

.                     ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
চোখ
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

মাফ করবেন
আমায় মা ডেকে কাজটা মোটেও ঠিক করেননি
যদিও আমি আপনার মেয়ের বয়েসী।
স্ত্রীলোকের মতোই সুসজ্জিত শরীর আমার
মায়ের সাথে শরীরের পার্থক্যটা সামান্যই
আর তাই ঘরে বাইরে সে সুযোগটা-ই
আপনি হররোজ কাজে লাগান ।
ভুল বুঝবেন না
ওটা বাদে যে কোন সম্বোধনে ডাকুন আপত্তি নেই
কিন্তু মা ডাকবেন না
যদিও আপনি আমার পিতার বয়েসী।
পিতার বয়েসী বলে
ছেলে ছোকরাদের ডিঙিয়ে অমন করে তাকাতে
আপনিই পারেন।
কেবল আপনিই পারেন চোখ দিয়ে আমায়
এমন গিলে খেতে
মাফ করবেন
অমনধারা চোখ কখনোই আমার পিতার নয়
পিতার চোখ সে অন্যরকম!

.                     ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রত্যয়নপত্র
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

আর দশ জনের মতো তাকেও মানুষ বলা হয়
সেও দু:খ পেলে কাঁদে
কখনো কদাচিৎ মিসির আলির মতো হয়ে ওঠে ভীষণ রহস্যময়।
মাটিতে মুখ গুজে রোজ তাকেও ঘর ছাড়তে হয়
পা বাড়াতে হয় জীবিকা এবং জনস্রোতে।
প্রিয় বেনসনের ঘ্রাণ মাড়িয়ে
যখন সে হাতে তুলে নেয় সস্তা একখোল ডারবি সিগারেট
আমরা তখন অভাবী মানুষ বলি তাকে।
আর দশজনের মতো তাকেও মানুষ বলা যায়
তার বুকেও রাত বিরাতের হামাল ওঠায়
হালের সানি লিওন ।
আবাদের আভাস পেলে
নিরস চৈত্রতেও যার ভেতর
নড়ে ওঠে বহুদিনের জং ধরা ইশ
মধ্যরাতের বালিশ তোষকের,
তাকেও আজকাল গতানুগতিক মানুষ ভাবা যায়।
তথাপি, শহরতলীর অন্যসবার মতো
সুযোগ পেলে তাকেও ছাড় দেয়না কার্তিকের ক্ষ্যাপা কুকুর।
মানুষটা দেখতে সত্যি সত্যিই মানুষের মতো।
মানুষের মতো চুল বাড়ে, দাঁড়ি বাড়ে
সপ্তাহান্তে হেসেল ঘরের শুন্য বিরান শবজির ঝুড়ি দেখে
বুকের ভেতর আচানক দু:খ বাড়ে।
যেহেতু পাড়ার ছা'পোষা বাকী খদ্দেরগুলোর মতো
তার নামেও খাতা চলে মোড়ের মুদীখানায়
সেহেতু, চলনে বলনে সোজাসাপ্টা এই মানুষটাকে
নেতান্ত মানুষ বলেই মনে হয় আজকাল।
শহরতলীর দশটা পাঁচটা দিনখাটুনে অভাবীর মতো
তারও আজকাল খিদে পায়।
অগুনতি লোহালক্কড়ের ভীড়ে তাকেও মানুষ বলা যায় শেষতক;
যদিও লিখতে বসলেই কবিদের মতো
তার বুকেও জেগে ওঠে দুধ চায়ের সাথে
বেলা বিসকুটের অদম্য নেশা।

.                     ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কমিটমেন্ট
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

স্বামীটা প্রবাসে যাবার আগে যে হাতদুটোতে স্ত্রী তার
বুকের আঁচল ফেলে লজ্জায় লাল হয়েছিলো
যে মেয়েমানুষ ভাঁজ ভাঙ্গা শাড়ীর মতো কুঁকড়ে যেতে যেতে
অনুভূতির মুখে হাত চেপে বলেছিলো-
শব্দ করোনা, সবাই জেগে আছে
যে স্ত্রী ভিজে কাপড়ে ঘরে উঠতে গিয়ে দশবার দেখে নিতো
স্বামীর হাতে গড়া লাউশাক পুঁইয়ের মাচান
যে প্রোষিতভর্তৃকা জল বর্ষা ডিঙ্গিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত
গরম রেখেছিলো ন্যাকড়ার ভাপাপুলি।
ক'মাস বাদে সেই মানুষটা-ই হয়ে উঠেছিল
বারুদঠাসা দেয়াশলাই।
এখন আঁচল সরলেই তার বুক থেকে সস্তা আতরের গন্ধ বেরোয়
একদিন যে চ্যাংড়াটা বড়শিতে টোপ গেঁথে
বড়ো মিরগেলটার জন্য বসে থাকতো
রাত এলে সেই মিরগেলটা-ই এখন,
ছিপের আঁধার গেলার জন্য হা করে থাকে।
দ্যাখো দেকিনি কি কান্ড!
অবশ্য আমাদের পিতম্বরের বেলায় এমন ঘটেনি
দেশ ছাড়ার আগেই ওর বউটা পোয়াতি হয়েছিলো।

.                     ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উপপাদ্য
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

সুন্দরবনে কোন হায়েনা নেই
এ বনে কোন সিংহও থাকেনা
থাকার মধ্যে যে কয়টা বাঘ আছে
তারাও এসবে নাক গলায় না
ক্ষিধে পেলে হরিন মেরেমুরে যতটুকু সময় পায়,
সেটা বাদড় দাবড়াতেই চলে যায় তাদের।
শহরে কোন মানুষ নেই
শহরে কোন পুরুষ থাকেনা
যে কজন পুলিশ আছে তারাও ব্যস্ত থাকে লুডুর গুটিতে
রাজার পুকুরে জল খেলে বাঘ এবং জোচ্চোর,
ছাপোষা দাঁড়কো'র কিছুই করার থাকেনা এতে
পোদ ভাসিয়ে সে কেবল সাঁতার কাঁটতেই শিখেছে।
জঙ্গল বাড়তে বাড়তে ছেয়ে যায় গোটা দেশ
আফ্রিকান হায়েনার ঔরশে জন্মায় মানুষ
অত:পর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়
গাঙ্গেয় বদ্বীপে গহীন জঙ্গল ছিল একদিন।

.                   ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পিতার ইশকুল
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

জন্মের পর থেকে প্রচুর মিথ্যে শিখেছি আমরা
ঘুমোতে গিয়ে, ভাত খেতে গিয়ে
মুখস্ত করেছি অজস্র অসংখ্য মিথ্যেকথা।
অবশ্য এতে আমার দু:খ নেই কোনো
কেননা আমি আমার সন্তানকে কেবল সত্যটা-ই শেখাবো
নি:সঙ্কোচে জানিয়ে দেবো
দেশভাগ ইস্যু নিয়ে আমাদেরও কিছু বলবার ছিলো।
আমি আমার সন্তানকে আধখানা চাঁদ অখবা
চরকা বুড়ির চরকা চেনাবোনা
শিশুতোষ অবাধ্যতাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে
ছোট্ট মনের ভেতর মিথ্যে ভুতুমের ভয় ছেটাবোনা
আমি চাই হোঁচট খেলে ও যেন একটু কাঁদতে পারে
মন এবং মগজে বিশ্বাস রাখতে পারে
গণি কাকাদের মাটির নিচে
কখনোই হাড়া ভর্তি মোহর ছিলোনা
বরং জানতে পারুক ,কোদাল চালাতেই সেখান থেকে উঠে এসেছিলো
অগুনতি নরকংকাল।
বেড়ে ওঠার আগেই আমি ওকে জানিয়ে দিতে চাই
ক্ষমতা এবং গোশত রুটির ব্যাপারে আমার অনাগ্রহের কথা।
আঠারোতে পৌছুনোর আগেই সে যেন জানতে পারে
পাচ সনা বিভৎস দাসপ্রথার কথা।
এরপর যদি এসেই যায় কাঁটাতার অথবা শত্রুতার প্রসঙ্গ,
দ্বিধাহীন বলে যাবো একদল আদম আলীর কথা,
যাদের পরিচয় আজো ওপার ফেরত রিফিউজি।

.                          ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অপারেশন ক্লিন হার্ট
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি

অথচ
কাপড় তুললেই হতো,
দাঁড়িয়ে গিয়ে সন্ধ্যের হাঁটুজলে
খুলে ফেললেই হতো ময়লা থানের নিচে ব্লাউজ এবং পেটিকোট
ভুলে গেলেই হতো,
এই জন্মপথ দিয়েই গত কুড়ি বছরে হাত পা চোখওয়ালা
তিন তিনটে মানুষের জন্ম দিয়েছি।
নাহ, হলো না, কিছুই হলোনা এর,
আদতে তার কোনটাই হয়ে উঠলো না বলে
জলপাই কিছু আদিম বেয়নেটের কাছে হেরে যায়
অগুনতি শুকুরের মা।
টেনে ধরলেই হতো
গুনে গুনে মাত্রই কয়েকটা মিনিট
থেমে গেলে বায়বীয় ঘড়ির কাঁটা
ঘেন্নাতেই মরে যেত অমোল বাচ্ছাটা,ওকে মারতে হতোনা।
ভাবতে অবাক লাগে, ভেবে যারপরনাই অবাক হই
এ যুগের শয়তান কতটা সেকেলে
কতটা আদিম আজ বঙ্গিয় ফিরাউন।
অথচ
ঘুরে দাঁড়ালেই হতো
উগ্র ঘোড়ার খুঁরে খুঁড়ে চললে মাটি
বোঝা যেত
আদৌ কোন মানুষের গর্ভে ওরা
জন্ম নিয়েছিল কি না!

.              ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর