কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
|
অমৃত
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, আষাঢ় ১৩৫০ (জুলাই ১৯৪৩) থেকে নেওয়া।
ছিন্নভিন্ন বসুধার খণ্ডে খণ্ডে যুদ্ধবদ্ধ যারা,
হিংস্রক দ্বিপদ পশু, মৃগয়া করিছে পৃথিবীরে,
তাদের শৌর্য্যের ছলে ভুলিও না, হে সর্বস্বহারা
সন্ন্যাসিনী জন্মভূমি। জীবনের মহাসিন্ধুনীরে
পশ্চিমী করঙ্গাঘাতে ভগ্ননীড় কোটি অকল্যাণ
ফেনিল বিদ্বেষভরে বিকীর্ণ করিছে হলাহল
---কালান্তের পূর্ব্বাভাষ। তুমি জান শ্রেয়ের সন্ধান,---
উত্তাল-তরঙ্গতলে মহাসিন্ধু স্তব্ধ অচঞ্চল,
ধ্যান-সমাহিত, শান্ত। যূথবদ্ধ স্বার্থপরতার
সমাসন্ন নাভিশ্বাস। প্রলয়-পয়োধিজলতলে
মৃত্যুমুখী মানবের অবিনাশী জীবনসুধায়
---ধ্যানের, জ্ঞানের, স্নেহপ্রণয়ের, পূতহোমানলে
ক্ষরণ চলিছে নিত্য। অবলূপ্ত ক্ষত্রিয়-শাসনে,
বিশ্বের কল্যাণে যারা তপশ্চারী কণ্টক-আসনে।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছোটর ঋণ
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, চৈত্র ১৩৫১ (এপ্রিল ১৯৪৫) থেকে নেওয়া।
ছোট ছোট যারা আমার দুয়ারে ভীরু বস্ন্ত-পবনের মত এল,
আমার মনের কঠিন পাষাণে পড়ে নি তাদের রেখা,
তবু আসে ছোট ছোট---
অজানা বনের নামহীন ফুলদল---
আমার বুকের পাষাণ ফলকে তাহাদের নিশ্বা
শিশিরের মত, অশ্রুর মত অম্লান সুন্দর।
বড় বড় যারা আমার দুয়ারে কালবৈশাখী বজ্রের মত এল,
বহ্নিরেখায় আমার পাষাণে তাদের চিহ্ন আঁকা ;
শিশিরের মত, অশ্রুর মত ছোটদের নিশ্বাস
তাদের দহনে ম্রিয়মাণ পলাতক।
তবুও আমার অজানা বনের নামহীন ফুলদল
সুরভি-স্নিগ্ধ নিশ্বাস-বায়ে নিবায় আমার জ্বালা
বাতাসের মত অভিমানহীন ছোটদের ভালবাসা
আমার বুকের দিনের সঞ্জীবনী।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
নেতা
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, শ্রাবণ ১৩৫৫ (আগস্ট ১৯৪৮) থেকে নেওয়া।
টাকাকড়ি লোকজন করিয়াছ জড়ো,
শহীদ হইয়া সবে দেশকর্ম কয়।
হাসিল হইলে কাজ জয়ধ্বনি দিয়া,
শোভাযাত্রা ক’রো মোরে পুরোভাগে নিয়া।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রোগ
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৫৫ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) থেকে নেওয়া।
কানাকাড়ি দাম নেই, এ জীবন তবু ভাল লাগে,
সমুদ্র ক্ষরে না মধু, মধু নয় পৃথিবীর ধূলি,
ব্যবস্থাপত্র
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, আশ্বিন ১৩৫৫ (অক্টোম্বর ১৯৪৮) থেকে নেওয়া।
বেদান্তের বালাপোষে ঢেকে রাখো পীড়িত আত্মাকে,
কখন ঝাপ্টা দেবে ভবসমুদ্রের জলো হাওয়া,
ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। যদি বা সত্যের সূর্য ঢাকে
জীবনের কুয়াশায়, শঙ্করাচার্যের কাছে পাওয়া
মোক্ষম দাওয়াই আছে ; মাঝে মাঝে করিও সেবন।
ধর্মসাক্ষী ক’রে যদি ব্যর্থ ব’লে জানাও নালিশ,
চতুর্গুণ খেসারত---চারিখণ্ডে বেদান্তদর্শন,
উপরন্তু বিনামূল্যে কবিরাজ প্লেটোর মালিশ।
আত্মাকে বাঁচানো চাই, কেন না আতেমার মৃত্যু নাই---
মৃত্যু যার নাই তাকে কোনক্রমে বাঁচাতেই হবে ;
অমৃতের পুত্রকন্যা, স্থির যদি করেছ নাচাই,
আজানু ঘোমটা দিও---শ্যাম-কুল সব ঠিক রবে।
অনেক অমর আত্মা হেলায় মরেছে যুগে যুগে,
সাবধানে থেকো তুমি, বোকারা মরুক ভুগে ভুগে।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
নিষ্ফলের স্বপ্ন
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, আষাঢ় ১৩৫৭ (জুলাই ১৯৫০) থেকে নেওয়া।
. ১
তোমরা ধরেছ ঠিক : কথার জাহাজ নিয়ে আমি
জীবন-বন্দরে কোন্ বিনিময় করেছি প্রত্যাশা
সে কথা ভুলিয়া গেছি---সমুদ্রের জল গেছে নামি,
চড়ায় বেধেছে পোত ; জোয়ারে ভাটায় যাওয়া-আসা
কতশত তরণীর ; মহার্ঘ পণ্যের প্রলোভনে
বাণিজ্যে-বাহিনী লক্ষ্মী নিত্যনব মহাবণিকের
গলে দেন বরমাল্য---আমি শুধু নিশ্চেষ্ট নয়নে
চেয়ে দেখি লোকযাত্রা, শেষ নেই ক্লান্ত নিমেখের।
চেয়ে দেখি আর শুধু অন্যমনে বালুকা-বেলায়
ছড়াই বিফল পণ্য---শিশুরা শুক্তির অন্বেষণে
কিছু নিয়ে যায় এসে, সমুদ্র কিছু বা নিয়ে যায়---
ছড়াই বিফল পণ্য---চেয়ে দেখি ঈশানের কোণে।
ঝড়ের আশায় থাকি। সমুদ্রের তরঙ্গ-আঘাতে
রুদ্ধগতি তরণীর মুক্তি হবে, আমি যাব সাথে।
. ২
সেই ঝড় এল বুঝি ; নিবে গেল অকস্মাৎ
দ্বিপ্রহরে ; কালো মেঘ আঁধারের জয়ধ্বজা তুলে
মুছে দিল মহাকাশ ; কালান্তের পৈশাচিক রাত
বিষাক্ত ফুত্কারে তার নিবাইল প্রাণের দেউলে
বিশ্বাসের সন্ধ্যাদীপ---বিদ্যুৎ-কটাক্ষে বার বার
কে যেন ছলনা করি অট্টহাসে গেল বজ্র হানি---
চূর্ণ চূর্ণ পৃথিবীর দেহশেষ প্রলয় ঝঞ্ঝার
প্রেতোত্সবে মিশে গেল ; রুদ্ধগতি মোর করীখানি
মাটির বন্ধন ছিঁড়ে পেল অকূল সাগর ;
জীর্ণ সে তরণী---সিন্ধু-শ্বাপদের শিকার-খেলাতে
ছিন্নভিন্ন হ’ল আর অকস্মাৎ অবনী-অম্বর
বলসি উঠিল যেন প্রলয়ের শেষ বজ্রাঘাতে।
তারপর জেগে দেখি সন্ন্যাসী মৃত্যুর কোলে শুয়ে
নব সূর্যালোকে মোর আঁধার আকাশ গেছে ধুয়ে।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
শুষ্কং কাষ্ঠং
কবি শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৫৭ (সেপ্টেম্বর ১৯৫০) থেকে নেওয়া।
মরা অতীতের ভস্মে রেখেছি ঢেকে
প্রায়োপবেশনে মুমূর্ষু প্রাণ-বহ্নি
কোথা ইন্ধন! সুরভির স্নেহ মেখে
কোথায় অরণি! এ যে শুধু কাঠ, তন্বি।
. ***************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর