কবি শিল্পী শিলাজিৎ এর গান
*
সীতা ওউর গীতা
কবি শিলাজিৎ

সীতা একা বসেছিলেন অশোক কাননে
আমি গেলাম হনু সেজে তোমরা জাননে

আমার বুকে ছবি লেজে ভর্তি কেরোসিন
সীতা গেলেন মূর্ছা দেখে অগ্নিকাণ্ড সিন,

তারপর যা হয়েছিল তোমরা জাননে
জানলে পরেও দাঁত দেখিয়ে তোমরা মাননে

বলছি শোনো দেখতে পেলাম অশোক গাছের ফাঁকে
মুকুট পরা একখানা মাল আটকে মধুর চাকে

দেঁতো হাসি হাতে বাঁশি বলল আমায় ডেকে
ওরে হনু ঘন্টু মনু বড্ড গেছিস পেকে

বুকের মধ্যে ছবির কপি লঙ্কা জুড়ে চিতা
কোঁচড় থেকে বের করল খান পঁচিশেক গীতা

বলল যখন এতই পারিস লাফ আর ঝাঁপ আর নীচে
পঁচিশ কপি দিলাম শুধু পারলে দেতো বেচে

সেদিন থেকে কামড় ভুলে ঘুঙুর পরে নাচি
সন্ধ্যা থেকে অ্যাকাডেমি লিটিল গীতা বেচি

সেদিন আমার কদর লম্বু ল্যাজে ভর্তি কেরোসিন
আজকে কাঁধে ঝোলা বেচি লিটিল ম্যাগাজিন

আমরা হনু দাঁত দেখিয়ে নিজের বুকেই চিতা
কৃষ্ণ আছেন মাথায়, আছেন সীতা ওউড় গীতা

.              **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
হেতমপুরের মাঠে
কবি শিলাজিৎ

হেতমপুরের মাঠে
কে একটা তোর মতো ঠিক হাঁটে
তার চলন বলন সব
যেন পাখির কলরব
যে পাখির নরম নরম ডানা
হয় তুই বা হাসনুহানা
যে হাসনুহানার নেশা
যেন তোর সুবাসেই ঠাসা
যে সুবাস আমি খুঁজি
যখন তোর বুকে মুখ গুঁজি

যখন তুই আমি ভঙ্গুর
দ্রাদিম দ্রিম দ্রিমা দুর দুর
দুর দুর দুরন্ত প্রাণ
সুখ স্বপ্নে সব আনচান

যে স্বপ্নে সাপ আর শিশির
শিশির অন্ধকারে ভিজে
যে অন্ধকারের রঙে
তুই তোর তুলনা নিজে

যে অন্ধকারের রসে
ভেজে জংলি মনের ফুল
যে জংলি মনের ফুলে
আজ বাতাস দোদুল দুল

সেই বাতাস আমার চেনা
সেই বাতাস আমায় ধরে
সেই বাতাস এতই সুখের
আমি ভুগি বাতাস জ্বরে

শরীর গরম শরীর কাঁপে
তখন বাতাসই জ্বর মাপে
তখন বাতাসই দেয় জল
তখন বাতাসই দেয় সাড়া

তখন বাতাসই ঝড় হয়
ঝড় ঝিলিক ঝম ঝম
সেই ঝিলিক যেন হাসি
তোর চোখের কোণে খেলে

যে খেলা খেলতে ভালোবাসি
যে খেলা না হয় যেন সারা
যে খেলায় না হার না জিৎ
যে খেলায় খসে পড়বে তারা

তারা পড়বে আমার বুকে
তারা পড়বে ঢেউয়ের সুখে
তারা পড়বে তুমুল টানে
তারা উল্কা হয়ে জ্বলে
পড়ে চিল্কা হ্রদের জলে
মিশিয়ে তারা বুকে
হ্রদ ঘুমিয়ে যাবে সুখে
সুখ ঝরা পাতার মতো
দুলবে হ্রদের কোলে কোলে

কালো জলের কোলে
টলটলিয়ে ঢেউ
যেন কাজল কাজল চোখে
ঝিলিক তোলে কেউ
সেই কাজল কাজল ঝিলিক
সেই শান্ত শীতল ঢেউ
যেন স্নিগ্ধ ছায়ার মতো
জলে আঁচল বেছায় কেউ

সেই আঁচল সুবাস মাখা
তাতে ভরা জাম কুড়োনোর বেলা
তাতে ভরা হেতমপুরের রোদ
তাতে ভরা পুতুল পুতুল খেলা

যে আঁচলে মনসাতলার পাশে
চাঁপা ফুল কুড়িয়ে দিতাম রেখে
যে আঁচল রঙিন মার্বেলে
ভরতাম অন্য আঁচল ভুলে

যে আঁচল থাকত যখন ফাঁকা
চোখে মুখে বুলিয়ে নিতাম আদর
যে আঁচল এখন হ্রদের জলে
ছলছল আমার জন্য রাখা

এ আঁচল --- আঁচল ? না কি আদর
আদর না মেঘ মেশানো চাদর
চাদরে তারার কারুকাজ
কারু কাজে লাগবে কি এ সাজ
এ সাজে সাঁঝের প্রদীপ জ্বালা
গোধূলির ধুলোয় মাখা মন
এ ধুলোয় তুলসি পাতার বাস
এ সুবাস ঘোমটা খুলে আসে

খুলে যায় বন্ধ পাখির ঠোঁট
খুলে যায় সুড়ঙ্গেরই পথ
চলে যাই পাথর পাথর পথে
যে পথে নিশিগন্ধা ফোটে

যে পথের পাশেই ধানক্ষেত
যে ক্ষেতের ঘাসের গায়ে ধুলো
যে ধুলো গন্ধে রঙে লাল
যে লাল দেখলেই মন নাচে
যে নাচে নাচতে থাকে তারা
যে তারা খসে পড়তে জানে
যে জানা অজানাকেই ডাকে
যে ডাকে এখনও  জ্বর আসে
যে জ্বরে বাতাস যাবে কেঁপে
যে বাতাস উড়িয়ে দেবে আঁচল
যে আঁচল ঝর্ণা হতে পারে
ঝর্ণার আঁচল থেকে আবার
তারাদের ঝর্ণা হতে পারে
যে তারার চোখের তারায় তারায়
সর্বনাশের খবর থেকে
যে খবর শুনতে পেলেই বুকে
দ্রিম দ্রিম দ্রাদিম  দ্রাদিম সুর
দূর দূর দূরের শালবনে
বাতাসের ফিসফিসানি সুর

যে সুরের বাঁধন মানা দায়
যে বাঁধন খুলতে ভালো লাগে
যে খোলা ভাঙার মতো খোলা
যে ভাঙার ছন্দ মনের মতো
যে ভাঙার ছন্দ মদের মতো
যে মদে ভর্তি হ্রদের কোল
যে হ্রদের ওপর গাছের ছায়া
মেঘ আর তার ছায়াতে মেশা
যে মেশায় মিশলে পরেই নেশা
যে নেশা ছিটকে নিয়ে যায়

গোধূলির হেতমপুরের মাঠ
যেখানে তোর মতো কেউ হাঁটে
তার চলন বলন সব
ঠিক যেন পাখির কলরব
যে পাখির নরম নরম ডানা
হয় তুই বা হাসনুহানা
যে হাসনুহানার নরম ঠোঁটে

প্রতিদিন সন্ধ্যাতারা ফোটে
ফোটে আর জ্বলে এবং জ্বালায়
সে জ্বালা জ্বলতে ভালো লাগে
জ্বলি তবু বলতে ভালো লাগে
এ জ্বলন বড্ড মিঠে জ্বলন

এ জ্বলন ছড়িয়ে দেব আমি
যেভাবে সূর্য ছড়ায় আবির
তোর মতো মেঘের চোখে মুখে

ধিকি ধিকি জ্বলবে শাল আর শিমূল
জ্বলবে আমার করা ভুলে
যে ভুলে পুড়বে কচি সবুজ
দ্রিম দ্রিম দ্রাদ্রিম দাবানলে

.         **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আলাপ   
কবি শিলাজিৎ

আমিই তো তোমাকে বসুন্ধরার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছি
সোনাদাদের বাড়ির বাইরের দিকে পোড়ো চানঘর
তার ছাদের ওপর ডুমুর গাছের বাস
নগেন বলে একটা ছেলে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে
ভর্তি করছিল ডুমুর
সবে তখন বাচ্চা পেড়েছিল সাদা হলদে বেড়ালটা
আমি আলাপ করাইনি ?
আমিই তো তোমাকে ডেকেছিলাম
জানালার শিকের ওপর হুমড়ি খেতে বাধ্য করেছিলাম |
কাজলকাকুর বাবার গরুটার নাম লক্ষ্মী
ঐ ডুমুর গাছের ফাঁক দিয়ে
এক চিলতে জংলা মাঠের ওপর
গর্ভবতী লক্ষ্মী প্ল্যাসেন্টা
আস্তে আস্তে বাছুরটা ভুমিষ্ট হল
উঠে দাঁড়াল
মা লক্ষ্মী চেটে খেল জীবাণু-বীজাণু

শ্যামপার্কে ছিটকে পড়ে গেলে
ছড়ে গেল হাঁটু
স্কুলের নীল প্যান্টটার ছিঁড়ে যাওয়া
ভয়---
কে ছিল তোমার সঙ্গে
গঙ্গা জলের নীচে পড়ে থাকা পলি
সেই পলি তুলে পুতুল গড়ার ব্যর্থ চেষ্টা
বাথরুমের জং ধরা ফ্লাশ-এর ওপর
গোলা পায়রা ---পালক ---ডিম
সারা দুপুর সবার ঘুমের সুযোগে
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে
পায়রা ধরা
একদিন লুকিয়ে খেলে নেভিকাট
মুখে কীরকম গরম লাগছিল
মনে হচ্ছিল পুড়ে যাবে
তবুও ছাড়োনি ----
ধোঁয়ার সঙ্গে প্রথম মোলাকাৎ
নিষিদ্ধ স্বাদ

সাধুপুরির ভগ্নস্তুপ
যে ভাঙা বাড়ির ওপর আগাছা
নাকি আগাছার ওপরেই বাড়িটা
বোঝা যেত না
কেন যে ওটার নাম সাধুপুরি
ভুলে গেছ ?
কিন্তু মনে আছে
টকটকে লাল একটা ফড়িং-এর পেছন পেছন
তাড়া করেছিলে চাটুজ্জেদের শিবমন্দির থেকে
ধাওয়া করতে করতে
পৌঁছে গেছিলে সেই হানা বাড়িটাতে
কী অসম্ভব সুন্দরী সেই ফড়িংটার
পিছু নিতে নিতে
ঢুকে পড়েছিলে সেই পোড়ো বাড়িতে
মাকড়সার জাল---অন্ধকার
অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছিল ফড়িংটা
বা আটকে গেছিল ---- মাকড়সার জালে
হঠাৎ গা ছমছম
একা মনে হয়েছিল তোমার
আমি কিন্তু ছিলাম
তোমার পা পড়ে গেছিল কাঁচা বিষ্ঠায়
অবাক হয়েছিলে ---- তালপুকুরের পাথরটার ওপর
কচলে কচলে পা ধুতে ধুতে
ভেবেছিলে কে এত নিশ্চিন্তে পায়খানা
করে এরকম ভুতুরে বাড়িতে

মেজমামুর বাড়ির গন্ধরাজ গাছটা
তার পাশেই বেঁটে জবা গাছটা
তার পাশেই চিনিচম্পা
আর তার পাশে সেই জোড়া পেয়ারা গাছটা
যা তোমার শয্যার মতোই নিরিবিলি ছিল

মগডালে বসে হেলান দিয়ে
কাঁচা পেয়ারার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে
চোখ চলে যেত ইলেকট্রিক পোল
বাঁকা খেজুর গাছটাকে পেরিয়ে

ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত
আর ছবির মতো একটা হলদেটে বাড়ি
কাউকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করনি
ওটা কী ?
একের পর এক লোক পেরিয়ে যেত
সাইকেলে, হেঁটে, ছাতা মাথায়

ততক্ষণে আইসক্রিমওলা হর্ন বাজাতে শুরু করত
লাল, সবুজ, হলদে, সাদা অমৃত
দশপয়সায় দুটো

কয়েক মুহূর্তের জন্য তুমি একবার হারিয়ে গেছিলে
ঘুরে দাঁড়িয়ে খুঁজে পাওনি কাউকে
বেলুনওলা, ওমলেটভাজা, নাগরদোলা
ছ্যাৎ করে উঠেছিল তোমার বুকের ভেতর
কান্না পায়নি ?
তখন তুমি একটা পাড়াও চেনো না
পৃথিবী তো দূরের কথা |
আজকে যখন বয়স্ক চোখে
গঙ্গার জলে ভাসতে থাকা
বয়ার গায়ে শ্যাওলা দেখো
কিংবা তীরের দিকে অদ্ভুত নোঙরা কিছু
যার নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে
এখন নোঙরা---- অজানা হয়ে গেছে
তারই পাশে শিকড়গাড়া
ক্যাপস্টানটা দেখো জং পড়েছে কি না

কিম্বা বাইপাসের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা
কালো কাচের সুমোর ভেতর
ঘনিষ্ঠতা প্রত্যক্ষ করো
মনে রেখো

আমিই তোমাকে পৃথিবীর সঙ্গে আলাপ
করিয়ে দিয়েছিলাম

.         **************************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর