উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়ার পরিচিতির পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়া
তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়
দেশ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬ (মে ১৯৩৯) সংখ্যা থেকে।
পৌষ মাসে শস্যোত্সব উপলক্ষে বাঙলার সর্ব্বত্র কৃষকেরা আনন্দ-গান করিয়া থাকে | পল্লীবাসীর সে
আনন্দোত্সবে সহজতম আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায় | পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সে সব উত্সবে
ভাটা পড়িয়াছে, কিন্তু একেবারে অন্তঃসারশূন্য হইয়া যায় নাই |
উত্তরবঙ্গের পল্লী অঞ্চলে বালক ও যুবকেরা পৌষ মাসের প্রথম রাত্রি হইতে সংক্রান্তির রাত্রি পর্য্যন্ত গৃহস্থের
বাড়ী ঘুরিয়া গান করিয়া বেড়ায় | উত্তরবঙ্গের প্রায় সর্ব্বত্র তাহাকে সোনারায়ের গান বলে | উক্ত ছড়া-গান
উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার প্রভৃতি জেলা হইতে প্রসারলাভ করিয়া পাবনা,
রাজসাহী, মালদহ, প্রভৃতি জেলা পর্য্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে | মালদহ ও রাজসাহীতে উহা নাকি
শাঁখবোল নামে পরিচিত ; তবে তাহার মধ্যে সোনারায় ঠাকুরের নামোল্লেখ আছে | শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ দাশ
মহাশয় মালদহ জেলা হইতে যে শাঁখবোল সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহার একটি বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করিতেছি |
দে দান যাই বরাতে,
সোনারায়ের পূজা দিতে |
ও সোনারায় কর কি ?
সোনার লাঙ্গল পড়েছি |
সোনার লাঙ্গল রূপার ফাল,
ভাত ডাঙ্গায় বহাছি হাল --- ইত্যাদি
উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলা হইতে আমি কয়েকটি সোনা রায়ের ছড়া সংগ্রহ করিয়াছি | তাহার সামান্য কিছু
উল্লেখ করিবার প্রয়োজন বোধ করিতেছি | তত্পূর্বে আমরা “সোনা রায়ের গানে” র কিম্বদন্তী
সম্বন্ধে আলোচনা করিব | বহুদিন পূর্ব্বে রংপুর, কুচবিহার প্রভৃতি জেলার কোন পল্লীতে নাকি তিন ভাই বাস
করিতেন ;-- তাহাদের নাম যথাক্রমে সোনা রায়, মাণিক রায়, ও রূপা রায় | তাঁহারা তিনজনেই নাকি
খুব বীর ছিলেন | তখন উত্তরবঙ্গের পল্লী অঞ্চলে বাঘের ভয় ছিল, শীতকাল পড়িতেই পাহাড় হইতে বাঘ
নামিয়া আসিয়া লোকের শস্য ক্ষেতের মধ্যে আস্তানা গাড়িত | সোনা রায় বাঘ শিকারে বিশেষ ওস্তাদ
ছিলেন, এমন কি তিনি বাঘকে বশীভূত করিয়া তাহার পিঠের উপর উঠিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেন | মাণিক রায়
মহিষের পৃষ্ঠে এবং রূপা রায় হস্তী কিংবা অশ্বের পৃষ্ঠে উঠিতেন | এখনও উত্তরবঙ্গের পল্লী অঞ্চলে গৃহস্থেরা
সোনা রায়, মাণিক রায় ও রূপা রায়ের মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করাইয়া পূজা করিয়া থাকে | কিন্তু লক্ষ্যের বিষয়,
সোনা রায়ের ছড়ার মধ্যে আমরা শুধু সোনা রায়, মাণিক রায়ের নাম পাই, রূপা রায়ের কোন নাম পাই না |
সম্ভবত, তাহা বিশেষ কল্পনাপ্রসূত | এস্থলে আমরা সোনা রায়ের কয়েকটি ছড়ার উল্লেখ করিতেছি |
উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়ার পরিচিতির পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
. ( ১ )
. জন্ম খন্ড
কৃষ্ণ বলাম দোঁহে
লইয়ে ধেনুর পাল |
বোনে বোনে চরাইনু
. যতেক রাখাল ||
বলরাম বলে কৃষ্ণ শুনহ বচন
সোনা রায় মাণিক রায় হব দুইজন ||
বাঘের পৃষ্ঠে চড়ি তুমি হও সোনা রায় |
ভইসের ( ১ ) পিষ্ঠে চড়ি আমি হব মাণিক রায় ||
ইহা বলে দুই ভাই করিলে গমন ||
গরু চরায় রাখালগণ
. তাহার নাগ্য ( ২ ) পায়
আইস আইস বলি তবে
. সোনা রায় ডাকায় ||
ঘরে ঘরে কর তোমরা
. সোনা রায়ের গান |
সোনা রায়ের নামে ভিক্ষা
. সবাই দিবে ধান ||
এই ঠাকুর সোনা রায় গায়,
. রোস্তক ( ৩ ) দিলে বর
ধনে বংশে বাড়ুক গিরি
. চন্দ্র দেবোকর |
(১)ভইস—মহিষ, (২) নাগ্য—নাগাল, (৩ ) রোস্তক—গৃহস্থকে
. ( ২ )
. ঝেচু খন্ড
ঝেচু করে ঝিলি মিলি,
. কুকিলায় করে রাও |
শ্বেত কাকা উঠিয়া বলে
. রজনী প্রভাও ||
রজনী প্রভাত কালে,
. পূবে উদয় ভানু |
মা যশোদা ডেকে বলে
. উঠ রাম কানু ||
ছড়ছান দিয়া কন্যা
. হরষিত মন |
সোয়ামির সাক্ষাতে যাবা
. কি বলে বচন ||
সোয়ামি না বল তোক্,
. প্রাণের ইশর |
আজ্ঞা কর যাই স্বামী ধন
. দিগি সরবর ||
খইলা খারো নইলে কন্যা
. কস্তুরী চন্দন |
সঙ্গে আছে সখীগণ
. নিয়া করহ গমন ||
# # #
ইহাক্ ছাড়িয়া কন্যার
. চিজ-এ গমন |
সরোবর পখ্ রী যাআ
. দিলে দরশন ||
# # #
জলেতে নামিয়া কন্যা
. হাটু করলে সুর |
ধর্ম্মের দিকে দাগে কন্যা
. দেও পুত্রবর ||
এখন ছিলান করিয়া কন্যা,
. করিলেন গমন |
আপনার গৃহে আসি দিলে দরশন ||
. (৩ )
. গোয়ালিনী খন্ড
মহিষ চরায় নন্দের ছাইলা,
. বেলা হইল দুপোর |
খেদেয়া তুলিলে ভইস,
. বাতানের উপর |
কাকো বান্দে কাকো ছান্দে,
. কারো ছেকে দুধ |
কালো গাভীর ধবল বাছুড়,
. ছেক্ তে বড় সুখ |
এলুয়া ( ৪ ) উকুরিয়া নন্দ,
. পাকাইলে বেড়ুয়া (৫)
তাহাতে তুলিয়া দিলে
. দুধের তলুয়া || ( ৬ )
বাতানেতে ধূলা ধূসর,
. কর্ লে অন্ধকার |
বান্ধন ছান্দ্ নের দড়ি,
. উবায় (৭ ) ভারে ভার ||
বাতানেতে যাইয়া কৃষ্ণ
. বাঁশিতে দিলে সান,
যত আছে অরণ্যে মৈষ (৮ )
. করিলে গোঠান || ( ৯ )
# # #
যেইনা ঘাটে গোয়ালের নারী,
. জল আইন্তে যায় |
পশু-পক্ষী না খায় জল,
. গন্ধেতে পলায় ||
যেইনা বাড়ী গোয়ালিনী
. আগুন আইন্তে যায় ||
জলম আট্ কুড়া বলে,
. কোয়ারি ঝাপায় ||
শ্রীখলার হাটে দধি করে বেচাকেনা |
. শ্রীখলার লোকে বলে বাঞ্জি আটকুড়া |
আটকুড়া বলিয়া দধি কেহই না নেয় |
মনের গুমানে দধি ঢালিয়া ফেলায় ||
. শ্রীখলার দোকানে যাইয়া দোকানে দিলে সারি
রাধে বিকায় দধি-দুগ্ধ, কানাইয়া গণে কড়ি ||
৪ | এলুয়া—আইলের ঘাস, ৫| বেড়ুয়া –মোড়া, ৬| তলুয়া—হাঁড়ির তলা ৭| উবায়—বহন করে ৮| মৈষ্য—মহিষ,
৯| গোঠান—একত্র |
উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়ার পরিচিতির পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উপরি উক্ত ছড়া-গানের মধ্যে সোনারায়, মাণিকরায়কে শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের অংশস্বরূপ কল্পনা করা হইয়াছে |
উহার মধ্যে আমরা শ্রীকৃষ্ণ-লীলার বিবরণ পাই | উক্ত ছড়াকে কৃষ্ণধামালী ( ? ) গানের অন্তর্ভূক্ত করা চলে
কিনা, তাহা বিচার সাপেক্ষ | বাঙলায় পৌষ মাসের শস্যোত্সবে শ্রীকৃষ্ণ লীলার বিষয়বস্তুর সন্ধান
অনেক মিলে | দক্ষিণ বঙ্গের পল্লী অঞ্চল হইতে সংগৃহীত “ধলই গানের” মধ্যে আমরা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার
নিদর্শন পাই | আমরা এস্থলে তাহার কিছু উল্লেখ করিতেছি ---
ননি খালো কে রে গোপাল, ননি খালো কে ?
--- আমি ত খাইনি ননি, খাইছে বলাই দাদা |
তুমি ত খাইছ রে ননি ভান্ড কইরা ছেঁদা ||
হাতে ছড়ি নন্দরাণী যায় গোপালের পিছে |
লাফ দিয়ে উঠ্ ল রে গোপাল কদম্বিকের গাছে ||
ওলা (১০ ) ওলারে গোপাল পাড়ে দেব ফুল |
ডাল ভাঙ্গে পড়িবি গোপাল, মজাইবি দুই কুল ||
মধ্য বঙ্গের নদীয়া জেলা হইতে সংগৃহীত “হোলবোল” ছড়ায় আমরা শ্রীকৃষ্ণের অন্ত্য-লীলার বিবরণ পাই |
শ্রীকৃষ্ণ যখন অনন্ত শয়ন করিলেন, তখন মানুষ, পশু-পক্ষী কাঁদিয়া আকুল | তাহা উপভোগ্য রূপে বর্ণিত
হইয়াছে |
ওপারে তেরপুণি (১১) গাছটি পাতা ঝুরঝুর করে |
তার তলায় কৃষ্ট ঠাকুর সদা নৃত্য করে ||
গোপ কাঁদে, গোপিনী কাঁদে, কাঁদে তরুলতা |
সকল তলা বেড়িয়ে এল কৃষ্ট গিয়েছেন কোথা ||
কৃষ্ট গিয়েছেন বিষ্টুপুর আমায় না বলিয়ে |
কোথা থেকে এলেন কৃষ্ট পাচন হারায়ে ||
ডান হাতে তেলের বাটি কানে কঙ্কের ফুল |
চান করিতে যায় গো কৃষ্ট কালীদহের কূল ||
কালীদহের কূলে কৃষ্ট এলায়ে দিলেন কেশ |
কেশের পানে চাইতে চাইতে তনু হ’ল শেষ ||
এখন সোনারায়ের ছড়া লইয়া একটি বিতর্ক পেশ করি | আমি পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি যে, সোনারায়ের ছড়া
উত্তর বঙ্গের প্রায় সর্ব্বত্র প্রচলিত | শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ দাশ মহাশয় ১৩৪৫ সালের ১১শ সংখ্যা “দেশে”, উত্তর
বঙ্গের শাঁখবোল বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন উহা যে সোনারায়ের ছড়া তাহা নিঃসংশয়ে বলা চলে |
শ্রীযুক্ত নলিনেশ মৌলিক এম-এ মহাশয়, ১৬ সংখ্যা দেশে সুরেনবাবুর উক্তি কিছু খন্ডন করিয়াছেন, এবং
কিছু নব সংযোজনা করিয়াছেন | তিনি বলিয়াছেন যে, মুর্শিদাবাদ জেলারও নাকি শাঁখবোল প্রচলিত আছে |
সুরেনবাবু নাকি তাহা শোনেন নাই | অন্যপক্ষে নলিনেশবাবু বলিয়াছেন যে, উত্তরবঙ্গ বলিতে রংপুর,
দিনাজপুর জেলাও বুঝায়, কিন্তু সে সব জায়গায় শাঁখবোল আছে বলে তিনি শোনেন নাই | সুরেনবাবু নাকি
এরকম কথা বলেন নাই | তবে উত্তর বঙ্গের দিনাজপুর জেলায় সোনা পীরের গান আছে বলিয়া তিনি
জানেন | উভয়ের এরূপ জানা-শোনার মধ্যে একটু গন্ডগোল আছে বলিয়া মনে হয়| মুর্শিদাবাদ জেলায়
শাঁখবোল থাকিলে মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইবে না, আর দিনাজ-পুর জেলায় সোনা পীরের গান পাওয়া
গেলে অভিনব কিছু পাওয়া গেল বলিয়া ধারণা করা অন্যায় হইবে |
পৌষমাসে রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় মুসলমান বালকেরা সোনাপীর, মাণিকপীর, রাখালপীরের গান
করিয়া বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করিয়া বেড়ায় | উক্ত সোনাপীর, মাণিকপীর যে সোনা রায়, মাণিক রায়ের নামান্তর
মাত্র তাহা ধারণা করা চলে | পল্লী-গীতি কিম্বা ছড়ার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বলিয়া কিম্ভুত-কিমাকার বস্তুর
সন্ধান আমরা খুব কম পাই | হিন্দু-মুসলমান সকলেই পৌষের আনন্দোত্সবে যোগদান করে | তবে দুঃখের
বষয় অধুনা সম্প্রদায়িকতা বিদ্বেষ প্রচারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যের সে সংযোগ সূত্র ছিন্ন
হইতে বসিয়াছে | এখনও অনেক মুসলনানের বাড়ী হিন্দু যুবকেরা সোনা রায়ের গান করিয়া ভিক্ষা পাইয়া
থাকে | কেহ কেহ আবার এখন বাদ্যের পক্ষপাতী নন, তবে ভিক্ষা দিয়া তাহাদিগকে বিদায় করেন |
সোনা রায়, মাণিক রায় প্রভৃতি নাম সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিবার উপায় নাই—কিম্বদন্তীর উপর সব সময়
নির্ভর করা চলে না | ক্ষেত্রে উত্পন্ন শস্যের দ্বারা কৃষকেরা সুখে সংসার যাত্রা নির্বাহ করে –
তাহাই তাহাদের নিকট সোনা., রূপা, মাণিক রতন বিশেষ | ‘সোনার লাঙ্গল’ কিম্বা ‘রূপার ফালের’ উল্লেখ
থাকিলেও তাহা কল্পনার পরিপোষক মাত্র |
উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়ার পরিচিতির পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
. মধ্য বঙ্গের নদীয়া জেলা হইতে সংগৃহীত একটি ছড়ার মধ্যে আছে |
ধান থাক্ তে দিল কড়ি |
তার দুয়ারে সোনার দড়ি ||
সোনার দড়ি পাক পাড়া |
তিনশ আঠার ঘোড়া ||
ঘোড়ায় ঘোড়ায় বুঝব |
চাল কাঠা দুই কুটব ||
চাল করে আজিগুজি |
সোনার লাঙ্গল পেড়েগুজি ||
থো থো থো লাঙ্গল থো |
গাড়ুর জলে হাত পা ধো ||
কেটে আনগে মানের পাত |
তাতে দেব অম্বল ভাত |
অম্বল ভাতে নাইকো নুন |
শত্রুর মুখে কালি চূন |
. ( হোল বোল ) ইত্যাদি | উক্ত ছড়ায় আমরা সোনার লাঙ্গলের কথা পাই | ধান্যই যখন
একমাত্র সোনার ফসল, তখন লাঙ্গলও যে সোনা বিশেষ হইবে, তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু নাই | উক্ত ছড়া
গানে আমরা ঘোড় দৌড়ের সন্ধান পাই | পৌষ মাসে যখন ক্ষেতের ধান ঘরে আসে, তখন মাঠের মধ্যে
ঘোড়-দৌড়ের প্রতিযোগিতা হইতে দেখা যায় | এখনও দক্ষিণ-বঙ্গ, পূর্ব-বঙ্গ, মধ্য-বঙ্গের অনেক অঞ্চলে ঘোড়-
দৌড়ের প্রচলন আছে | দৌড় প্রতিযোগিতায় যাহার ঘোড়া জিতিয়া থাকে, তাহাকে সাধারণত একটি কলস
উপহার দেওয়া হয় | দক্ষিণ-বঙ্গের খুলনা জেলা হইতে সংগৃহীত ধলইগানের মধ্যে আমরা ঘোড়-দৌড়ের
সামান্য কিছু উল্লেখ পাই |
বোল বোলা বোল ছাড়ে ঘোড়া |
ঘোড়ার আগে ঘুড়ী যায় |
গিরির শত্রুরে বাঘে খায় |
খায় আর কড়মড়ায় ||
দক্ষিণ-বঙ্গের ছড়ার উল্লেখ করিতে গিয়া বাঘের কথা আসিয়া পড়িল | ইহা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও এ বিষয়ে
একটু আলোচনা করা প্রয়োজন | শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ দাশ মহাশয় ২১শ সংখ্যা দেশ পত্রিকায় বাঘ পূজার
কথা উল্লেখ করিয়াছেন | বাঘ পূজার সঙ্গে নাকি শাঁখবোল কিম্বা পৌষের শস্যোত্সবের কোন সম্পর্ক নাই |
সম্পর্ক না থাকিলেও পৌষ মাসে যে বাঘ-পূজা অনুষ্ঠিত হয় তাহা তিনি স্বীকার করিয়াছেন |
তাঁহার উক্তিতে আমরা বাঘ পূজা সম্বন্ধে ভাসা ভাসা কিছু পাইতেছি, কিন্তু যুক্তি পাইতেছি না | দক্ষিণ-বঙ্গের
পল্লী অঞ্চলে কৃষক বালকেরা পৌষ মাসের প্রথম দিন হইতে সংক্রান্তি পর্য্যন্ত বাঘের মূর্ত্তি লইয়া গৃহস্থের
বাড়ী ঘুরিয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়ায় | দক্ষিণ-বঙ্গের ধলই গানের মধ্যে যে বাঘের উল্লেখ আছে, সে
বাঘ গৃহস্থের শত্রুকে নিধন করিবার জন্য কল্পিত হইয়াছে | আশ্চর্য্যের বিষয় সুরেনবাবু পৌষ মাসের
শস্যোত্সবের সঙ্গে বাঘ পূজার যে যোগ আছে, তাহা স্বীকার করিতে দ্বিধা করিতেছেন |
এখন সোনা রায়ের নাম সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাউক | এই সোনা রায় ব্যাঘ্র দেবতা বিশেষ কিনা
তাহা বিচার করা যাউক | আমি রংপুর জেলা হইতে যে সোনা রায়ের ছড়া সংগ্রহ করিয়াছি, তাহার মধ্যে
বাঘের কথা আছে এবং তাহাতে সোনা রায়কে ব্যাঘ্র-দেবতারূপে কল্পনা করা হইয়াছে | উত্তর-বঙ্গের যে
স্থানেই সোনা রায়ের মূর্ত্তী দেখিয়াছি, তাহার বাহন একমাত্র ব্যাঘ্র | পল্লীবাসী সোনা রায় ঠাকুরকে ব্যাঘ্র
দেবতা বলিয়া জানে | শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ দাশ মহাশয় মালদহ জেলা হইতে যে শাঁখবোল সংগ্রহ করিয়াছেন,
তাহার মধ্যেও বাঘের উল্লেখ আছে | এস্থলে তাহা উদ্ধৃত করিতেছি |
পালারে ছাইলা পিলা হুম্মা এসাছে |
হুম্মার মাথায় লাল টুপি দাদা দেখাছে ||
দাদার হাতে তীর কাম্ টা মাইরা ফেলেছে |
দুইটা চিত্ হল মাছ ভাইসা উঠেছে || ইত্যাদি |
হুম্মার অর্থে যখন বাঘ বুঝায়, তখন বাঘ পূজা যে এই শাঁখবোলের অন্তর্ভুক্ত তাহা ধারণা করিতে বাধা
নাই | হুম্মাকে দেখিয়া পাড়ার ছেলেরা পলাইয়া যাইতেছে | উত্তর-বঙ্গের সোনা রায়ের যে তিনটি ছড়ার
আমি উল্লেখ করিয়াছি তাহার সহিত উপরি-উক্ত ছড়াটির অপূর্ব্ব সাদৃশ্য আছে | এস্থলে তাহার কিছু
পুনরুল্লেখ করা আবশ্যক মনে করি –
গরু চরায় রাখালগণ
. তাহার নাগ্য পায় |
বাঘ দেখিয়া রাখালগণ
. পলাইয়া যায় ||
আইস আইস বলি সবে
. সোনা রায় ডাকায় ||
মালদহ জেলার “শাঁখবোলে” ও “সোনা রায়ের পূজা” দিবার কথা আছে | এই সোনা রায়ই যে ব্যাঘ্র-
দেবতাবিশেষ তাহা ধারণা করা চলে | যাহা হউক , পূর্ব্বে এমন একটা সময় আসিয়াছিল, যখন দেশের
অরাজকতা বিরাজ করিতেছিল – লোকাবাসগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছিল | সেজন্য সে সব জঙ্গলে
বাঘের প্রাদুর্ভাব একটু বেশী হইয়া ছিল | এখন আর সে ভয় নাই., তবে ছড়াগুলি অনেকটা অবিকৃতভাবে
এখনও আছে | এস্থলে আমরা ঐতিহাসিক আলোচনা করিব না | কারণ ভাসা ভাসা রূপ অনুমানের উপর
নির্ভর করিয়া ইতিহাসের প্রকৃত তথ্য নির্ণয় করা যায় না | তাহাতে অন্তর্দৃষ্টির বিশেষ প্রয়োজন, আমাদের
দেশের শিক্ষিতদের মধ্যে তাহার বড় অভাব |
উত্স - তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ “উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়া”, দেশ পত্রিকার
. জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬ (মে ১৯৩৯) সংখ্যা।
. এই পাতার উপরে. . .
উত্তরবঙ্গের সোনা রায়ের ছড়ার মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
মিলনসাগরে এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২৭.৫.২০১৬
...