কবি সৃজন সেন-এর কবিতা
*
মে ডে’তে কিছুতেই আর কবিতা লিখতে পারি না
কবি সৃজন সেন
রচনা জুলাই ১৯৮৬। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কবি অতীন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত “মে-
দিনের কবিতা” (মে ১৯৮৬) কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।


ডাসহৌসি জুট মিলের জঙ্গী শ্রমিক
কমরেড বিশ্বনাথ
আমার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বলেছিল---
‘মে-ডে’কো লেকর আচ্ছা একঠো পোয়েট্রি লাখ দিয়ে কমরেট,
হামলোগ পোষেটার বনা কর কাল
কারখানা গেট মে সাঁট দেগা!’

একাত্তরের ভারতবর্ষের রক্ত-উন্মাদনা নিয়ে
মজদুর মহল্লার একটি ছোট্ট ঘরে লুকিয়েছিলাম,
সত্তর দশকের মধ্যে ভারতবর্ষকে মুক্ত দেখার স্বপ্নকে বুকে
আঁকড়ে ধরে
আমার সামনে ছট্ ফট্ করছিল কমরেড বিশ্বনাথ,
আমি দু’লাইনের একটি কবিতা তার হাতে লিখে
দিয়েছিলাম,
কমরেড মহা উত্সাহে ভাঙা ভাঙা বাংলায়
চিত্কার করে সেই লাইন দু’টি পড়েছিল---
‘এবার বোসন্তে গোর্জায় মেঘ,
আসমান লালে লাল,
মে-ডে এবার যুদ্ধ জোয়ের
বদলা নেবার কাল!’
এবং ‘বহুত আচ্ছা হুয়া’ বলে বিশ্বনাথ
একবার হেসে কবিতাটি নিয়ে
উল্কার মত
রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল।

তার পরদিন
পয়লা মে।
ভোর হোতে না হোতেই শ্রমিক মহল্লাতে ছড়িয়ে পড়েছিল
একটা চাপা আনন্দ,
সমস্ত সিকিউরিটির চোখকে ফাঁকি দিয়ে
ম্যানেজারের হলুদ কোয়ার্টারের ছাদের ওপরে
কে বা কারা উড়িয়ে দিয়েছিল
একটি লাল পতাকা,
কারখানা গেটে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল একটি লাল পোষ্টার,
আর, সন্ধ্যাবেলা
কারখানার গেটের সামনে
প্রকাশ্য রাস্তায়
বলি দে’য়া মোষের মত
রক্ত মেখে ছট্ ফট্ করতে করতে
স্থির হয়ে গিয়েছিল
কোম্পানির কুখ্যাত দালাল,
বহু শ্রমিকের গুপ্ত ঘাতক---
সর্দার গোপাল সিং।

সে রাতে মিল মহল্লা হয়ে উঠেছিল
গেষ্টাপো অধিকৃত
যেন কোনো জার্মান শ্রমিক অঞ্চল।
পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিণীর আক্রমণে
জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল
কমরেড বিশ্বনাথের ঘর ও তত্সংলগ্ন বস্তি,
চলেছিল অবাধ লুটতরাজ,
খুন হয়েছিল সাত সাতজন শ্রমিক,
আর নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল
শ’খানেক নারী-পুরুষ আর শিশুকে।

তিনদিন পরে এক রাত্রিতে
সাত মাইল দূরের এক গ্রামের ঘরে
সারা অঙ্গে অন্ধকার জড়িয়ে
বিশ্বনাথ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
তার চোখেমুখে নিঃসব্দে হা হা করছিল যুদ্ধজয়ের হাসি,
বিশ্বনাথ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল---
‘কৈ নয়া পোয়েট্রি লিখা হায় কমরেট?’
আমি ওর মুখের দিকে তাকাতেই
ওর চোখে দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল ক্রোধের আগুন,
দাঁতে দাঁত চেপে ও আমাকে বলেছিল---
‘বহুত কমরেটকো মার দিয়া কুত্তালোগ!
হামলোগকো বদলা লেনা হি পড়েগা।’

দুরন্ত নদীতে বাঁধ দিয়ে
আসন্ন প্লাবন রুখবার আকাঙ্খা নিয়ে
আমি বিশ্বনাথকে বলেছিলাম---
‘খুন কা বদলা খুন নেহি ভাই,
জমানাকো বদল ডালো!’
আমার মুখে ঐ কবিতা শুনে
বিশ্বনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছিল,
আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
আমার মুখের মানচিত্রকে ভালো করে পড়বার
চেষ্টা করেছিল,
তারপর ম্লান অথচ দৃপ্তকণ্ঠে সে আমাকে বলেছিল---
‘শান্তি-বুলি মত বোলো ভাই,
দুষমনকো মৎ ডরো!’
এবং তারপরেই হো হো করে হেসে
আমার পিঠে সজোরে এক চাপড় মেরে বলেছিল---
‘চলতা হ্যায় কমরেট,
ফির মিলেঙ্গে!’

সেই বিশ্বনাথ ফিরে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে
কোনোদিন আসেনি।
চারপাঁচ দিন পরে
শ্রমিক মহল্লারই কোন এক বাড়ীতে
সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিণীর আক্রমণে
অভিমন্যু হয়ে গিয়েছিল বিশ্বনাথ
আর ধরা পড়ে আমি গিয়েছিলাম জেলে।

জেলখানায় তারপর
তিন তিনটে মে-ডে’কে আমি অতিক্রম করেছি,
জেলের কৃষ্ণচূড়া গাছটার বুকে
ফুল ফোটা ও ফুল ঝরা দেকেছি তিন তিন বার,
একবার কালবৈশাখীতে
ফুলশুদ্ধু ভেঙে পড়তে দেখেছি
সে গাছের বিরাট এক ডালকে।
তারপর একদিন জেলের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম
পরিত্যক্ত রণভূমিতে
আহত নিহত যোদ্ধাদের হাড়মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে
অসংখ্য ঘেয়ো কুকুর,
---আনন্দে যারা দিশেহারা!

ঠিক সেই সময়,
এক ফুটন্ত বৈশাখী দুপুরে,
কমরেড বিশ্বনাথের বৌ পার্বতীয়া আমার সঙ্গে
দেখা করতে এসেছিল,
দু’চোখে এক নদী স্নেহ মায়া ভালোবাসা নিয়ে  
সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল
আমার আর অন্যান্য কমরেডদের সমাচার।
তারপর ধীরে ধীরে সেই নদীতে ঝড় উঠলো,
ফুলে উঠলো সে নদীর জল,
পার্বতিয়ার দু’চোখে জ্বলে উঠলো প্রতিহিংসার আগুন,
আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে
পার্বতিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো---
‘কমরেট, কাল মে-ডে হ্যায় না?
লিখা হ্যায় কৈ নয়া কবিতা?’
পার্বতিয়ার সেই জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে
আমি কেমন নিষ্পদ হয়ে গিয়েছিলাম,
আমার গলা দিয়ে কোন স্বর উচ্চারিত হচ্ছিল না,
পার্বতিয়া আমার দু’কাঁধে হাত দিয়ে
প্রবল ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলেছিলো---
‘কাল তো মে-ডে হ্যায় কমরেট!
খুন কা বদলা খুন নেহি লেগা কাল?
কমরেট কো খুন কা বদলা?’

এবং তারপর দিন মে-ডের বিকেলে
গরমতলাও বস্তির রাস্তায়
এক তরুণের হাতে গর্জে উঠেছিল একটি পাইপ গান,
লাফ দিয়ে ছুটে পালিয়ে বেঁচেছিল
কমরেড বিশ্বনাথের হত্যাকারী যমুনা সিং,
আর ডাকু ডাকু চিত্কার আর হৈ-হট্টগোলের মধ্যে
ইনকিলাব ধ্বনি দিতে দিতে
চিরকালের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল
অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎ,
কমরেড বিশ্বনাথের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ,
---শহীদ বাপ্ কা লেড়কা বনে গিয়েছিল
দোসরা শহীদ!

অতীনদা, আপনার সঙ্গে বীরেনদার সম্পাদিত
মে-দিনের কবিতা সংকলনের জন্য
আমার কাছে দেবার মত কোন কবিতা নেই,
মে-ডে’কে নিয়ে সেই দিন থেকে আমি আর কোন কবিতা
লিখতে পারি না,
কেননা
প্রতিটি মে দিবসে
কালবৈশাখীর আলুথালু মেঘের চুল নিয়ে
আমার সামনে এসে দাঁড়ায়
শহীদ জায়া ও শহীদ জননী পার্বতীয়া,
আমার দুকাঁধে হাত রেখে
প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিতে দিতে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে---
‘আজ তো মে-ডে হ্যায় না কমরেট?
লিখা হ্যায় কৈ নয়া কবিতা?
বদলা লেনেকা কবিতা?’

অতীনদা, আমি সেই কবিতা কিছুতেই লিকতে পারিনা,
কোন্ কবিতা লিখবো আমি---
বদলা নেবার কবিতা
না
জমানা বদলের কবিতা?

.             ***************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঝম্ ঝম্ ঝম্ কেবল বৃষ্টি
কবি সৃজন সেন
কবি মেঘ বসু সম্পাদিত “আবৃত্তির কবিতা কবিতার আবৃত্তি” (২০০৯)
কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।

ভরা বাদলের কবিতা

.             ********************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বন্দীর বন্দনা : শহীদ সাথীর স্মৃতিতে      
কবি সৃজন সেন
কবি অর্জুন গোস্বামী সম্পাদিত  “রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা” (২০০৫) কাব্যসংকলন
থেকে নেওয়া।


দাশ নগরের শ্রমিক ভাই
হট্ নগরের চাষী
রায়দীঘিতে ছড়িয়ে গেলে
রাঙা ফুলের রাশি!

দেশপ্রেমে রাঙা সে ফুল
বুকের রক্তে তাজা
সব চাষীদের হৃদয়পুরে
আজকে সাথী রাজা!

সাথীর স্মৃতি ঝল্ সে ওঠে
টাঙ্গি বল্লম বন্দুকে
শোষকশ্রেণীর পরাণ-পাখী
লুকাবে কোন্ সিন্দুকে?

শহীদ-জায়া ফুল্লরা বৌ
কাঁদছো কেন? না, না---
অশ্রুকে আজ বারুদ করো
কান্না যে আজ মানা!

মাগো তোমার বুকের মানিক
কাড়লো আজি যারা
রক্ত নিতে সেই খুনেদের
হাতে নাও আজ খাঁড়া!

অন্ধ কারা বেঁধেছে আমায়
ঠাণ্ডা লীতল ঘরে
তোমার পাশে মাগো আমি
যাবোই পৌঁছে ভোরে!

সাথীহারা বেদনাতে
উঠছে ফুলে আমার ক্রোধ
বুকের রক্ত আমিও দেবো
শীতের দেশে আনবো রোদ!

.          ********************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছড়া          
কবি সৃজন সেন
(সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কবিতা)
এই কবিতাটি ১৪৪, জজবাগান, কলকাতা থেকে কবি অরুণ ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশিত,
"আন্দোলনের সাথী" পত্রিকার ২৫ বৈশাখ ১৪১৪ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |


১.
দেশের মধ্যে গড়ছে বিদেশ
হচ্ছে দখল দেশের মাটি,
"শিল্পায়ন", "উন্নয়ন" ---
সবই সোনার পাথর বাটি |
এ রাজ্যে সেই আজব বাটি
করছে যারা ফেরি,
দ্রুত চিনছে তাদের মানুষ,
হবে না বেশী দেরী |

২.
দেশটাকে বেচে যারা
কমিশন খায়
দিকে দিকে কৃষকের
যারা রক্ত চায়,
তাদের সমর্থন
বলুন তো আপনারা
কভু করা যায় ?

৩.
"জমি দেবো না" বলছে যারা
তাদের মেরে গুড়িয়ে দাও,
অবাধ্য সব গ্রামগুলোকে
ঘিরে ফেলে পুড়িয়ে দাও,
তারপরে সব জমিগুলো
সালিম-টাটায় বিলিয়ে দাও,
শিল্পায়নের রক্ত ধ্বজা
চতুর্দিকে উড়িয়ে দাও |

৪.
ক'টাকা পাস্ এই চাষারা
চাষ করে?
টাটা-সালিম পাদপদ্মে
সব জমিটা দে ধরে |
সুদখোরেরা যেমন করে
জীবনটাকে ভোগ করে
তেমনি তখন্ কাটাবি জীবন
তোরা সবাই মৌজ করে |

.          ********************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছড়া
কবি সৃজন সেন
(সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কবিতা)
এই কবিতাটি 'আকিঞ্চন' পত্রিকার আশ্বিন ১৪১৪ (অক্টোবর ২০০৭) এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল।

|| ১ ||

নেতা তিনি বর্ষীয়ান,
ঐতিহাসিক ভুলের জন্য
হন্ নি দিল্লীর গদিয়ান |

খুন খারাবি হোল যখন
তখন তিনি নিদ্রা যান,
সব ঘটনার শেষে তিনি
প্রেস কে ডেকে দেন নিদান |

অর্ধেক কথা বলেন তিনি,
অর্ধেক কথা গিল্লা খান |

|| ২ ||

খাঁটি যারা বুদ্ধিজীবী
লিখবে তারা গদ্য-পদ্য
করবে তারা নাচা-গানা

নন্দীগ্রামে কে মারলো,
কে মরলো, কে ভাগলো
নাক গলাতে তাদের মানা

--- বলেছেন বাম মন্ত্রীসভার
তিন নম্বর ছাগলছানা !

.        ********************  
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর