পাথরের ফুল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর লেখা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। (আমরা কৃতজ্ঞ কবি রাজেশ দত্তর কাছে এই কবিতাটিকে আমাদের কাছে পাঠানোর জন্য।)
১
ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও, আমার লাগছে।
এখন আর আমি সেই দশাসই জোয়ান নই। রোদ না, জল না,হাওয়া না-- এ শরীরে আর কিছুই সয় না।
মনে রেখো এখন আমি মা-র আদুরে ছেলে-- একটুতেই গলে যাবো।
যাবো বলে সেই কোন সকালে বেরিয়েছি-- উঠতে উঠতে সন্ধে হল। রাস্তায় আর কেন আমায় দাঁড় করাও?
অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর গাড়ি এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে। মোড়ে ফুলের দোকানে ভিড়। লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?
২
ঠিক যা ভেবেছিলাম হুবহু মিলে গেল। সেই ধূপ , সেই ধুনো, সেই মালা,সেই মিছিল-- রাত পোহালে সভা-টভাও হবে। ( একমাত্র ফুলের গলা-জড়ানো কাগজে লেখা নামগুলো বাদে) সমস্তই হুবহু মিলে গেল। মনগুলো এখন নরম-- এবং এই হচ্ছে সময়। হাত একটু বাড়াতে পারলেই ঘাট-খরচাটা উঠে আসবে।
এক কোনে ছেঁড়া জামা পরে শুকনো চোখে দাঁতে দাঁত দিয়ে
ছেলেটা আমার পুঁটুলি পাকিয়ে ব'সে। বোকা ছেলে আমার, ছি ছি,এই তুই বীরপুরুষ? শীতের তো সবে শুরু-- এখনই কি কাঁপলে আমাদের চলে?
ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই। তার চেয়ে আমার পছন্দ আগুনের ফুলকি যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।
ঠিক এমনটাই যে হবে, আমি জানতাম। ভালোবাসার ফেনাগুলো একদিন উথলে উঠবে এ আমি জানতাম। যে-বুকের যে আধারেই ভরে রাখি না কেন ভালোবাসাগুলো আমার আমারই থাকবে।
রাতের পর রাত আমি জেগে থেকে দেখেছি কতক্ষনে কিভাবে সকাল হয়; আমার দিনমান গেছে অন্ধকারের রহস্য ভেদ করতে। আমি এক দিন , এক মুহূর্তের জন্যেও থামি নি। জীবন থেকে রস নিংড়ে নিয়ে বুকের ঘটে ঘটে আমি ঢেলে রেখেছিলাম আজ তা উথলে উঠল।
না। আমি আর শুধু কথায় তুষ্ট নই; যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে যেখানে যায় কথার সেই উৎসে নামের সেই পরিনামে, জল-মাটি-হাওয়ায় আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই।
কাঁধ বদল করো। এবার স্তুপাকার কাঠ আমাকে নিক। আগুনের একটি রমনীয় ফুলকি আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা ভুলিয়ে দিক॥
৩ শ্রীমতী, আমার অরণ্য-স্বাদ মেটে এখানেই | লেকে সন্ধ্যায় গোচারণ ঘাসে প্রার্থী যুবক | কমণ্ডলুতে কারণ, তাইতো ওঁ তৎসৎ,--- প্রলাপ মানেই | ফরাসি রাজ্য ভাল লাগে, তাই সংসার-ত্যাগ | লাল ত্রাসে কাঁপে গ্লেসিয়ার দিন | পেশোয়ারিদের করকমলেই ভবলীলা শেষ |
৪ ( উঞ্ছজীবী ডাস্টবিন নির্জন বলেই ) অনেক আগ্নেয় রাত্রে নিষিদ্ধ আমারা দেখেছি বৈষ্ণব বেনে অকৃপণ হাত দেয় পণ্য যুবতীকে | অবশ্য নেপথ্যে চলে নিরামিষ নাচ আর গান | কখনো নিষ্ঠুর হাতে তারা কিন্তু মারে না কো মশা একটিও | ( আমরা কয়েকটি প্রাণী, -- দু-চোখে ঘুমের হরতাল | ) মাঝে মাঝে শোনা যায়, ভবঘুরে কুকুরের ঠোঁটে নতুন শিশুর টাটকা রক্তিম খবর !
( তন্বী চাঁদ ক্রোড়পতি ছাদের সোফায় ! ) চীনা লাবলসৈনিকের শরীরে এখন নিবিড় নির্বাণ-বিদ্যা বীক্ষণ করে কি বেয়নেট ? বোমাত্মক এরোপ্লেন গান গায় দক্ষিণ সমীরে— মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান |
সুপুষ্ট ঈশ্বর সুনি উষ্ণীষ আকাশে পুঁজি রাখে আমাদের অর্জনের রুটি— ( সাদা মেঘ তারি কি স্বাক্ষর ) মৌমাছির মতো বসে কতিপয় নক্ষত্র নাগর নিশাচর ফুর্তির চূড়ায় | উচ্চারিত ক্ষোভে তাই বিস্ফোরক দিন ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিলে বিপ্লব ঘোষণা করে গেছে | তবুও আড্ডায় চলে মন-দেয়া-নেয়ার হেঁয়ালি | প্রতিদ্বন্দ্বী সব্যসাচী ডবল-ডেকারে ( চাক্ষুষ আমার দেখা ) ফাল্গুনী কবিরা অর্ধেক চাঁদের মতো কী করুণ চ্যাপ্টা হয়ে গেছে |
অহিংসা পরমো ধর্ম নীলবর্ণ শৃগালের দলে | টাকার টঙ্করে শুনি : মায়া এ পৃথিবী | জীবের সুলভ মুক্তি একমাত্র স্বস্তিকার নীচে | সংগ্রাম সন্ধিতে আজ কী চক্রান্ত চৌদিকে ফেঁদেছে !
আজকে এপ্রিল মাস, --- ( চৈত্র না ফাল্গুন ? ) ভ্রষ্ট নোগুচির নিন্দা চড়াইয়েরা ভণে |
৫ অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায় এক দ্বিতীয় বসন্ত | আর গলিতনখ পৃথিবীতে আমরা রেখে যাব সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস | ততদিন আত্মরক্ষার প্রাচীর হোক প্রত্যেক শরীরের ভগ্নাংশ |
মেরুদণ্ডের কাছে ঈপ্সিত খাড়া ইস্পাত . বোম্বেটের টুঁটি যেন পায় জিঘাংসু হাত . বীর্যবানের বিজয়ের পথে খোলা সব লোক . দিকে দিকে শ্যেনদৃষ্টিকে, দেখো, মেলে সাধু বক |
দিশাহীন ঝড়ে, জানি, তুমি যুগবিপ্লবী মেঘ . তড়িৎ কাটুক তোমাদের দ্রুত চলবার বেগ . উজ্জ্বল ইতিহাসে নিষ্ফল পশ্চাৎ শোক . লোকান্তরেই নেবুলার সাথে সন্ধিটা হোক !
৫ ভাঙল চিবুক-ঠেকানো হাতের নিদ্রা— বাগানে শুক্ নো কঙ্কালসার বৃক্ষ খিড়কির পথে পালাবে কি কলাবিৎরা ? --- গ্রামে ও নগরে ভিড় করে দুর্ভিক্ষ | হৃদয়বিহীন সময়ের দুর্বৃত্ত তোমার আমার মধ্যে দাঁড়াল আজ যে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেয় আজ ভীরু চিত্ত কাপুরুষ ভয় আনব না মোটে গ্রাহ্যে | বুঝেছি দগ্ধ জীবনের দৃষ্টান্তে— প্রাণ বাঁচানোর নেইকো সহজ পন্থা, বজ্রমুঠিতে শৃঙ্খল হবে ভাঙতে, আমাদের ফাঁকা ভাঁড়ার প্রেমের হন্তা |