সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
পাথরের ফুল
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর লেখা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা।
(আমরা কৃতজ্ঞ কবি রাজেশ দত্তর কাছে এই কবিতাটিকে আমাদের কাছে পাঠানোর জন্য।)
   



ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।

এখন আর
আমি সেই দশাসই জোয়ান নই।
রোদ না, জল না,হাওয়া না--
এ শরীরে আর
কিছুই সয় না।

মনে রেখো
এখন আমি মা-র আদুরে ছেলে--
একটুতেই গলে যাবো।

যাবো বলে
সেই কোন সকালে বেরিয়েছি--
উঠতে উঠতে সন্ধে হল।
রাস্তায় আর কেন আমায় দাঁড় করাও?

অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর
গাড়ি এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে।
মোড়ে ফুলের দোকানে ভিড়।
লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?




ঠিক যা ভেবেছিলাম
হুবহু মিলে গেল।
সেই ধূপ , সেই ধুনো, সেই মালা,সেই মিছিল--
রাত পোহালে
সভা-টভাও হবে।
( একমাত্র ফুলের গলা-জড়ানো কাগজে লেখা
নামগুলো বাদে)
সমস্তই হুবহু মিলে গেল।
মনগুলো এখন নরম--
এবং এই হচ্ছে সময়।
হাত একটু বাড়াতে পারলেই
ঘাট-খরচাটা উঠে আসবে।

এক কোনে ছেঁড়া জামা পরে
শুকনো চোখে
দাঁতে দাঁত দিয়ে

ছেলেটা আমার
পুঁটুলি পাকিয়ে ব'সে।
বোকা ছেলে আমার,
ছি ছি,এই তুই বীরপুরুষ?
শীতের তো সবে শুরু--
এখনই কি কাঁপলে আমাদের চলে?

ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।




ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি
যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।

ঠিক এমনটাই যে হবে,
আমি জানতাম।
ভালোবাসার ফেনাগুলো একদিন উথলে উঠবে
এ আমি জানতাম।
যে-বুকের
যে আধারেই ভরে রাখি না কেন
ভালোবাসাগুলো আমার
আমারই থাকবে।

রাতের পর রাত আমি জেগে থেকে দেখেছি
কতক্ষনে কিভাবে সকাল হয়;
আমার দিনমান গেছে
অন্ধকারের রহস্য ভেদ করতে।
আমি এক দিন , এক মুহূর্তের জন্যেও
থামি নি।
জীবন থেকে রস নিংড়ে নিয়ে
বুকের ঘটে ঘটে আমি ঢেলে রেখেছিলাম
আজ তা উথলে উঠল।


না।
আমি আর শুধু কথায় তুষ্ট নই;
যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে
যেখানে যায়
কথার সেই উৎসে
নামের সেই পরিনামে,
জল-মাটি-হাওয়ায়
আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই।

কাঁধ বদল করো।
এবার
স্তুপাকার কাঠ আমাকে নিক।
আগুনের একটি রমনীয় ফুলকি
আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা
ভুলিয়ে দিক॥

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সকলের গান
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে নেওয়া |

কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না ?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে |
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা—
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না ?

আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি ?
ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া—
আমরা তো নই প্রজাপতি-সন্ধানী !
অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া |

কুঁজো হয়ে যারা ফুলের মূর্ছা দেখে
পৌঁছয় না কি হাতুড়ি তাদের পিঠে ?
কিংবা পাঠিয়ো বনে সে-মহাত্মাকে
নিশ্চয় নিঃসঙ্গ লাগবে মিঠে !

আমাদের থাক মিলিত অগ্রগতি
একাকী চলতে চাই না এরোপ্লেনে ;
আপাতত চোখ থাক পৃথিবীর প্রতি
শেষে নেওয়া যাবে শেষকার পথ জেনে ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
প্রস্তাব : ১৯৪০
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৩৮-১৯৪০।

প্রভু, যদি বল অমুক রাজার সাথে লড়াই
কোনো দ্বিরুক্তি করব না ; নেবো তীর ধনুক |
এমনি বেকার ; মৃত্যুকে ভয় করি থোড়াই ;
দেহ না চললে, চলবে তোমার কড়া চাবুক |

হা-ঘরে আমরা ; মুক্ত আকাশ ঘর, বাহির |
হে প্রভু, তুমিই শেখালে পৃথিবী মায়া কেবল—
তাইতো আজকে নিয়েছি মন্ত্র উপবাসীর ;
ফলে নেই লোভ ; তোমার গোলায় তুলি ফসল |

হে সওদাগর, -- সেপাই, সান্ত্রি সব তোমার |
দয়া করে শুধু মহামানবের বুলি ছড়াও—
তারপরে, প্রভু, বিধির করুণা আছে অপার ;
জনগণমতে বিধিনিষেধের বেড়ি পরাও |

অস্ত্র মেলেনি এতদিন ;  তাই ভেঁজেছি তান |
অভ্যাস ছিল তীর-ধনুকের ছেলেবেলায় |
শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান ---
বলব, ‘বত্স ! সভ্যতা যেন থাকে বজায় !’

চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান ||

.                   *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
বধূ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৩৮-১৯৪০।

গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল
পুরানো সুর ফেরিওলার ডাকে,
দূরে বেতার বিছায় কোন্ মায়া
গ্যাসের আলো-জ্বালা এ দিনশেষে |

কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলেছি মৃদু চালে
হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা
পড়ল মনে, খাসা জীবন সেথা |

সারা দুপুর দীঘির কালো জলে
গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া |
ছিপে সে-ছায়া মাথায় কর যদি
পেতেও পার কাৎলা মাছ, প্রিয় |

কিংবা দোঁহে উদার বাঁধা ঘাটে
অঙ্গে দেব গেরুয়া বাস টেনে
দেখবে কেউ নখ বা কেউ জটা
কানাকড়িও কুঁড়েয় যাবে ফেলে |

পাষাণ-কায়া, হায় রে, রাজধানী
মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে ;
তেজারতির মতন কিছু পুঁজি
সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে |

ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে—
দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন
আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারি
ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে |

ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও ; লোকলোচন উঁকি মারে—
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
লেকের কোলে মরণ যেন ভালো |

বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা ; তাই
কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলেছি মৃদু চালে
গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল ||

.                *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
পদাতিক
( সুরেন্দ্র নাথ গোস্বামী-কে )
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৩৮-১৯৪০।


যেখানে আকাশ চিকন শাখায় চেরা
চলো না উধাও কালেরে সেখানে ডাকি,
হা ! হতোস্মি-সড়কে বেঁধেছি ডেরা
মরীচিকা চায় বালুচারী আত্মা কি ?

লাল মেঘ গুহা পাবে না হয়তো খুঁজে
নিজেরে নিখিল মিছিলে মেলাও যদি,
চলো তার চেয়ে মরা খড়ে ঘাড় গুঁজে
হব অপরূপ অপরাহ্নের নদী |

হরিণ সময় লাগামে বাঁধতে পার ?
বিশ শতকেও ফুলের বেসাতি করি,
অতল হ্রদের মিতালি হৃদয়ে গাঢ়
হিংসুক হাওয়া দেহে আঁকে চক্ খড়ি |

প্রতিবেশী চাঁদ নয় তো অনাত্মীয়
রামধনু-রং দেশেও জমাব পাড়ি,
মাঠের শিশির ঝরবে না একটিও
ক্রীতদাস ছায়া গোটাবে না পাত্ তাড়ি |


জানি ; পলাতক পাখায় নভশ্চারী
খোঁজা নিষ্ফল নক্ষত্রের ঘাঁটি ;
ফাঁকা ভাঁড়ারের ওস্তাদ সংসারী—
আর কতদিন ঢাকবে ধোঁকার টাটি ?

পিরামিডে থাক পিরীতি কফিন-ঢাকা,
অহল্যা হোক পিচ্ছিল হাতছানি,
প্রগল্ ভ যুঁই মেলুক বন্ধ্যা শাখা,
চাঁদের চোখেতে পড়ুক অন্ধ ছানি |

উপবাসী রাত অক্ষম অভিনেতা |
হৃদয়ে হাঙর-যক্ষ্মাই ঠোকরাবে |
ফসলের দিন সামনে, কঠিনচেতা—
অবৈতনিক বেডেই তা টের পাবে |

বুঝেছি, ব্যর্থ পৃথিবীর পাড় বোনা ;
স্বপ্নের ভাঁড় সামনেই ওলটানো |
তামাসা তো শেষ ; পারের কড়িও গোনা—
কঙ্কালখানা কালের স্কন্ধে টানো |


শ্রীমতী, আমার অরণ্য-স্বাদ
মেটে এখানেই |  লেকে সন্ধ্যায়
গোচারণ ঘাসে প্রার্থী যুবক |
কমণ্ডলুতে কারণ, তাইতো
ওঁ তৎসৎ,--- প্রলাপ মানেই |
ফরাসি রাজ্য ভাল লাগে, তাই
সংসার-ত্যাগ | লাল ত্রাসে কাঁপে
গ্লেসিয়ার দিন | পেশোয়ারিদের
করকমলেই ভবলীলা শেষ |


( উঞ্ছজীবী ডাস্টবিন নির্জন বলেই )
অনেক আগ্নেয় রাত্রে নিষিদ্ধ আমারা
দেখেছি বৈষ্ণব বেনে অকৃপণ হাত দেয় পণ্য যুবতীকে |
অবশ্য নেপথ্যে চলে নিরামিষ নাচ আর গান |
কখনো নিষ্ঠুর হাতে তারা কিন্তু মারে না কো মশা একটিও |
( আমরা কয়েকটি প্রাণী, -- দু-চোখে ঘুমের হরতাল | )
মাঝে মাঝে শোনা যায়, ভবঘুরে কুকুরের ঠোঁটে
নতুন শিশুর টাটকা রক্তিম খবর !

( তন্বী চাঁদ ক্রোড়পতি ছাদের সোফায় ! )
চীনা লাবলসৈনিকের শরীরে এখন
নিবিড় নির্বাণ-বিদ্যা বীক্ষণ করে কি বেয়নেট ?
বোমাত্মক এরোপ্লেন গান গায় দক্ষিণ সমীরে—
মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান |

সুপুষ্ট ঈশ্বর সুনি উষ্ণীষ আকাশে
পুঁজি রাখে আমাদের অর্জনের রুটি—
( সাদা মেঘ তারি কি স্বাক্ষর )
মৌমাছির মতো বসে কতিপয় নক্ষত্র নাগর
নিশাচর ফুর্তির চূড়ায় |
উচ্চারিত ক্ষোভে তাই বিস্ফোরক দিন
ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিলে
বিপ্লব ঘোষণা করে গেছে |
তবুও আড্ডায় চলে মন-দেয়া-নেয়ার হেঁয়ালি |
প্রতিদ্বন্দ্বী  সব্যসাচী ডবল-ডেকারে
( চাক্ষুষ আমার দেখা ) ফাল্গুনী কবিরা
অর্ধেক চাঁদের মতো কী করুণ চ্যাপ্টা হয়ে গেছে |

অহিংসা পরমো ধর্ম নীলবর্ণ শৃগালের দলে |
টাকার টঙ্করে শুনি :  মায়া এ পৃথিবী |
জীবের সুলভ মুক্তি একমাত্র স্বস্তিকার নীচে |
সংগ্রাম সন্ধিতে আজ কী চক্রান্ত চৌদিকে ফেঁদেছে !

আজকে এপ্রিল মাস, --- ( চৈত্র না ফাল্গুন ? )
ভ্রষ্ট নোগুচির নিন্দা চড়াইয়েরা ভণে |


অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায়
এক দ্বিতীয় বসন্ত | আর
গলিতনখ পৃথিবীতে আমরা রেখে যাব
সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস |
ততদিন আত্মরক্ষার প্রাচীর হোক
প্রত্যেক শরীরের ভগ্নাংশ |

জীবনকে পেয়েছি আমরা, বিদ্যুৎ জীবনকে |
উজ্জ্বল রৌদ্রের দিন কাটুক যৌথ কর্ষণায়
দুর্ঘটনাকে বেঁধে দেবে কর্মঠ যুবক
নিখুঁত যন্ত্রের মধ্যতায় |
অরণ্যকে ছেঁটে দেবার দিন এসেছে আজ |

তবে, যুদ্ধ আজ |
রাজন্যের অনুকম্পা নেই,
প্রজাপুঞ্জের স্বপ্ন-ভঙ্গ |
বণিকপ্রভু চোখ রাঙায়,
কারখানায় বন্ধ কাজ |
( ইতিহাস আমাদের দিক নেয় | )

উদাসীন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি
আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে ?

.                *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
অতঃপর
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৩৮-১৯৪০।


সম্পাদক সমীপেষু,
.                মহাশয়, ইতস্তত ভূসম্পত্তি আছে নিম্নস্বাক্ষরকারীর |
এ-দুদৈর্বে জমিদারি রক্ষা দায় | বংশপরম্পরাগত কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভুবনে
ঈশ্বর চালান, চলি |
.                পেয়াদারা বশম্বদ   :    প্রবঞ্চক আদায়ের প্রত্যেক ফিকির
তাদের কন্ঠস্থ আজো | অথচ বকেয়া খাজনা প্রজারা দেয়নি গত দুই তিন সনে |
আদালতে ফল অল্প |
.                যত্সামান্য আয় আজো বন্ধকিতে | ভিক্ষাপাত্র নির্ঘাৎ নতুবা |
বিদ্যার্থী দুলাল শেখে নৈশবিদ্যা কলকাতায় | বোতলে আগ্রহ তার অবশ্য অগ্রিম---
পৈতৃক বলাও চলে |
.                বিপদ একাকী নয়কো ! --- সচ্চরিত্র, কিন্তু ক’টি বুদ্ধিহীন যুবা
নিরক্ষর চাষাদের বক্তৃতায় মুগ্ধ করে | দুশ্চিন্তায় আমাদের হাত-পা সব হিম |
( সাম্যবাদী দল এরা ? )
             এতৎসত্ত্বেও  হয়তো  গুরুভাগ্যে  ঘুরে  যাবে অদৃষ্টের চাকা |
ইংরেজপ্রভুর নেত্রে সর্ষেফুল?আমাদের হাতে আসবে রাজ্যভার? চমত্কার কিবা !        
ধনীদের তো পোয়া বারো |
.                 বিশেষত.---- ভারতবর্যে একচেটিয়া নেতা গান্ধী | গৌরীসেনী টাকা   
ভবিষ্যৎ ভাবে ধ্রুব | মহাশয়, ---- জমিদারি যায় যাক ! বণিকের মৌলিক প্রতিভা
দেশি শিল্পে মুক্তি পাবে |
.                 এ বিষয়ে পত্রপাঠ মুক্তি চাই |
.                                                         ইতি ! বঙ্গচন্দ্র পাল। ঢাকা  ||

.                              *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
চীন : ১৯৩৮
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৩৮-১৯৪০।

জাপপুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি, জ্বলে হ্যাঙ্কাও
.   কমরেড, আজ বজ্রে কঠিন বন্ধুতা চাও
.     লাল নিশানের নীচে উল্লাসী মুক্তির ডাক
.        রাইফেল আজ শত্রুপাতের সম্মান পাক |

মেরুদণ্ডের কাছে ঈপ্সিত খাড়া ইস্পাত
.   বোম্বেটের টুঁটি যেন পায় জিঘাংসু হাত
.       বীর্যবানের বিজয়ের পথে খোলা সব লোক
.           দিকে দিকে শ্যেনদৃষ্টিকে, দেখো, মেলে সাধু বক |

দিশাহীন ঝড়ে,  জানি,  তুমি যুগবিপ্লবী মেঘ
.    তড়িৎ কাটুক তোমাদের দ্রুত চলবার বেগ
.       উজ্জ্বল ইতিহাসে নিষ্ফল পশ্চাৎ শোক
.           লোকান্তরেই নেবুলার সাথে সন্ধিটা হোক !

প্রান্তিক লোভে পরজীবীদের নিষ্ঠুর চোখ
.   প্রাক্ পুরাণিক গুহাকে ডাকল ক্ষুরধার নখ,
.       কমরেড, আশু অশ্বের ক্ষুরে আনো লাল দিন
.          দম্পতি রাত ততদিন হোক উত্সবহীন |

দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে বাঁধবে না কেউ ?
.    ফসলের এই পাকা বুকে, আহা, বন্যার ঢেউ ?
.       দস্যুর স্রোত বাঁধবার আগে সংহতি চাই
.          জাপপুষ্পকে জ্বলে ক্যান্টন, জ্বলে সাংহাই ||

.                              *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
কাব্যজিজ্ঞাসা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।

সেদিনকার শাণিত ধার হারিয়েছি
হৃদয়ে শুধু স্মৃতির ভার, ভিড় শুধু
ঘুরে বেড়াই পাড়ায় আপন খুশিমতো
লঘু মেঘের মতন তনু মেলে যদি |
জন্মে আর জীবনে আর তৃপ্তি নেই
মরণে মধু সমাপ্তির ক্ষীণ আশা
সকলি মানি অলীক এই গ্রহলোকে
ইন্দ্রিয়ের ধাঁধায় বাঁধা শরীর মন |

নিরুদ্দেশে আকাশে বৃথা খুঁজি বাসা
আলোর কোনো চিহ্ন নেই চরাচরে
দিনের ভাঙা সেতুর শেষে পরপারে
সূর্য গেল,--- মুখর ফের পান্থনীড় |


নিজেই নিজের ছায়ার পাশে
চমকালে মিছে, নিজেকে চিনে
নামাও বল্গা পিপাসু ঘাসে,
রুক্ষ মাটিতে, মেঘলা দিনে |
শুধুই ধূম্র ইচ্ছাধীনে
কতকাল মেঘ আকাশে ভাসে ?
তাই বিষণ্ণ তোমাকে দেখে
হঠাৎ পেলাম ইশারা কোনো
হালকা-স্বভাব হৃদয় থেকে—
হে দিগ্ ভ্রাম্ত, আজকে শোনো
তোমাকে সঁপেছি শরীর, মনও
সেদিন চোখের মুকুরে রেখে |
ঘরছাড়া মন তোমার, কবে
চকিতে নিখোঁজ পালাবে মাঠে
তাই শঙ্কিত হৃদয় | তবে
দয়ালু বিধিও সঙ্গে হাঁটে ;
যদি কিছুকাল যুগলে কাটে
ঘরমুখো মন হবেই হবে |
হে দিগ্ ভ্রান্ত, আমি তো বুঝি—
তোমার জটিল হারানো পথে
বাতি যে ধরব, সেটুকু পুঁজি
আলেয়ার নেই | আমার মতে
এসো আজ এই জটিল পথে
ঠিকানা বদ্ লে প্রণয় খুঁজি |


ভেঙেছে সংসার-স্বর্গ ; কন্টকিত স্বপ্নের বিছানা,
পাঠাল নিষ্ঠুর সূর্য গলিত মৃত্যুর পরোয়ানা
আমাদের মোমের টুপিতে ;
ক্রমেই সংক্ষিপ্ত হয় আকাশের সুনীল বিষয়,
উদার সমুদ্র ডাকে –
ঢেউয়ের ইশারা গিলি অন্ধকার গলির রোয়াকে,
হাতে হ্রস্ব জীবনের জরিপের ফিতে |
চড়ানো দৃশ্যের মধ্যে কিছু নিয়ে কাব্যের জগৎ
রচনা করার ইচ্ছা ছিল বটে, ভেঙেছি শপথ---
বৃত্তি আজ একান্ত বিবাদী,
মনে মনে উড্ডীন আকাশে বাসা বাঁধি,
কেবলি নিষ্ফল বাদ্য ছিদ্রময় ঢাকে,
পুরনো অভ্যাসবশে চিরুনির পণ্ডশ্রম টাকে |
তবুও তোমার কাছে ঋণী
একদা আমার এই একচক্ষু হৃদয়-হরিণী,
তোমার উষ্ণতা দিল বাষ্পময় আমাকে শরীর
উচ্ছল পর্বতগাত্রে, ধর্ম তাই উদ্দাম নদীর ;
তবুও তুষারচক্রে পিঠে একি জরাগ্রস্ত কুঁজ—
দূরে দেয় হাতছানি সংঘবদ্ধ মাঠের সবুজ,
ছত্রভঙ্গ রৌদ্র হয় ফিকে
উদ্যত সঙিন দিকে দিকে |


জাগুন জাগুন           পাড়ায় আগুন
.             বাড়ে হুহু
মগজে প্রভূত       দম্ভ তবু তো
.              আহা উহু |
মনের মহল দিচ্ছে টহল
.              মিঠে কুহু
এখনো জাগুন      পাড়ায় আগুন
.               বাড়ে হুহু |


ভাঙল চিবুক-ঠেকানো হাতের নিদ্রা—
বাগানে শুক্ নো কঙ্কালসার বৃক্ষ
খিড়কির পথে পালাবে কি কলাবিৎরা ?
--- গ্রামে ও নগরে ভিড় করে দুর্ভিক্ষ |
হৃদয়বিহীন সময়ের দুর্বৃত্ত
তোমার আমার মধ্যে দাঁড়াল আজ যে,
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেয় আজ ভীরু চিত্ত
কাপুরুষ ভয় আনব না মোটে গ্রাহ্যে |
বুঝেছি দগ্ধ জীবনের দৃষ্টান্তে—
প্রাণ বাঁচানোর নেইকো সহজ পন্থা,
বজ্রমুঠিতে শৃঙ্খল হবে ভাঙতে,
আমাদের ফাঁকা ভাঁড়ার প্রেমের হন্তা |

বিদায় ! অলীক স্বপ্নের প্রজাপুঞ্জ !
বিদায় ! চাঁদের নিরুদ্দিষ্ট কুঞ্জ |


বাতাস পিঠে চাবুক হানে
আকাশ আনে বজ্র
শান্তি কবে ফুঁকছে শিঙে—
বেজায় ঢিমে কান তো !
শহরে গ্রামে নিকটে দূরে
নানান সুরে শুনছি—
পেয়েছি তার খানিক রস,
খানিক অস্পষ্ট :
একলা নই, মিলিত হাত
আজ আঘাত হানবে |
মুক্তিদাতা মজুর চাষা—
নতুন আশা সামনে |
চলো না কবি মিছিলে মিশি—
অসৎ ঋষিসঙ্গ
পতনে পত করেছে ঢালু,
গড়েছে বালুসৌধ |
আমরা দেব বোবাকে ধ্বনি,
খোঁড়াকে দ্রুত ছন্দ
লক্ষ বুকে রয়েছে খনি,
কুঁড়িতে ঢাকা গন্ধ |

আমরা নই প্রলয়-ঝড়ে অন্ধ ||

.             *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
জনযুদ্ধের গান
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।

বজ্রকন্ঠে তোলো আওয়াজ
রুখব দস্যুদলকে আজ,
দেবে না জাপানি উড়োজাহাজ
ভারতে ছুঁড়ে স্বরাজ |

এদেশ কাড়তে যেই আসুক,
আমরা সাহসে বেঁধেছি বুক,
তৈরি এখানে কড়া চাবুক,
চলছে কুচকাওয়াজ |

একলা তবু তো পাঁচ বছর
চীনের গোরিলা লড়ছে জোর,
তাই তো শহরে গ্রামে কবর
পাচ্ছে জাপ বহর |

আমরা নই তো ভীরুর জাত
দেব নাকো হতে দেশ বেহাত,
আজকে না যদি হানি আঘাত
দুষবে ভাবী সমাজ ||

.             *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
চিরকুট
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।

শতকোটি প্রণামান্তে
হুজুরের নিবেদন এই—
মাপ করবেন খাজনা এ সন
ছিটেফোঁটাও ধান নেই |

মাঠেঘাটে কপাল ফাটে
দৃষ্টি চলে যত দূর
খাল শুক্ নো, বিল শুক্ নো
চোখের কোলে সমুদ্দুর |

হাত পাতব কার কাছে কে
গাঁয়ে সবার দশা এক
তিন সন্ধে উপোস দিলাম
আজ খাচ্ছি বুনো শাক |

পরনে যা আছে তাতে
ঢাকা যায় না লজ্জা
ঘটি বাটি বেচেছি সব
আচে বলতে ছিল যা |

এ দুর্দিনে পাওনা আদায়
বন্ধ রাখুন, মহারাজ
ভিটেতে হাত দেয় না যেন
পাইক বরকন্দাজ |

আমরা কয়েক হাজার প্রজা
বাস করি ও মৌজায়
সবাই মিলে পথ খুঁজছি
কেমন করে বাঁচা যায় |

পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে
হুজুর, জেনে রাখুন
খাজনা এবার মাপ না হলে
জ্বলে উঠবে আগুন ||

.             *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর