সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
স্বাগত
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।

গ্রাম উঠে গিয়েছে শহরে—
শূন্য ঘর, শূন্য গোলা,
ধান-বোনা জমি আছে পড়ে |
শুকনো তুলসীর মঞ্চে
নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে,
আগাছায় ভরেছে উঠোন |
সূর্য পাটে বসেছে কখন |
রাখালের দেখা নেই –
কোথাও গরুর পাল ওড়ায় না ধুলো ;
ঢেঁকিতে ওঠে না পাড়,
একটি কলসীও জল ওঠায় না ঘাটে |
বুনো ঘাসে পথ ঢাকে,
বিনা শাঁখে সন্ধ্যা হয়,
সূর্য বসে পাটে |
তাঁতি বোনে না কো তাঁত,
কলু আর ঘোরায় না ঘানি ;
কুমোরের ঘরে চাবি,
ঝাঁপ বন্ধ নিরূদ্দেশ হয়েছে দোকানি,
হাতুড়ি বিকিয়ে হাটে
ভস্ম মেখে পড়ে থাকে বেকার হাপর |
যে পথে কামার গেছে
কে জানে সে পথের খবর ?
শীতের আমেজ আসে ;
জ্বলে না আগুন চণ্ডীমণ্ডপের কোলে |
হাতে হাতে ঘোরে নাকো হুঁকো
চুলোচুলি হয় নাকো মোড়লে মোড়লে |
নিশুতি রাত্রিতে কারো
চৌকি শুনে কুকুর ডাকে না,
দিগন্তের বনস্পতি হাত নাড়ে,
মাঠের সোনালি ধান গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ে |
দুচোখে প্রতীক্ষা তার
স্বপ্ন তাকে করাঘাত করে |
ডাক ওঠে শহরে শহরে |
রাস্তার শ্মশানে থেকে মৃতপ্রায় জনস্রোত শোনে,
মাঠের ফসল দিন গোনে |

প্রতিজ্ঞাকঠিন হাতে
একে একে তারা সব
চোখের শোকাশ্রু মুছে ভাবে—
ঘরে ঘরে নবান্ন পাঠাবে |
পথে পথে পদশব্দ ওঠে,
আকাশে নক্ষত্র ফোটে ;
নদী করে সম্ভাষণ, পাখি করে গান –

মাঠের সম্রাট দেখে মুগ্ধ নেত্রে
ধান আর ধান ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ঘোষণা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।

এ দেশ আমার গর্ব,
এ মাটি আমার কাছে সোনা |
এখানে মুক্তির লক্ষ্যে হয় মুকলিত
আমার সহস্র সাধ, সহস্র বাসনা |
এখানে আমার পাশে
হিমাচল,
কন্যাকুমারিকা |
অলঙ্ঘ্য প্রাচীর ঐক্য
প্রতিক্ষা পরিখা |

দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ,
রক্তচক্ষু রাজার শাসন—
শকুনি বিশ্বস্ত বন্ধু,
মুঠোয় শিথিল সিংহাসন ;
সর্বাঙ্গে চিহ্নিত মৃত্যু
শবের গলিত গন্ধ ছোটে |
প্রজাপুঞ্জ ওঠে ;
আগুন লেগেছে ঘরে,
খরসূর্য মাথার উপরে |
ভাণ্ডারে উধাও খাদ্য,
শূন্য পেটে চাষবাস চুপ
কারখানায় পড়েছে কুলুপ |
দোকানে দ্বারস্থ অক্ষৌহিণী
পিছনে করুণমূর্তি পথের কাহিনী
গহন আরণ্য আরাকান ;
স্খলিত পায়ের ছন্দে
স্পন্দিত শ্মশান |
সর্বশান্ত চোখে পড়ে
বার বার হাতের শৃঙ্খল—
পলাতক প্রাণের সম্বল |

বিড়ম্বিত জীবনে আবার
কুরুক্ষেত্র করাঘাত করে
পালাবার নেই কোনো গোপন দুয়ার |
সম্মুখে প্রতীক্ষমাণ সবুজ প্রন্তরে
শায়িত বল্লম ;
পায়ে পায়ে রুদ্ধগতি বিদ্যুৎ কদম,
ঘুম ভাঙে সম্মিলিত মুঠি ;
অগ্নিবর্ণ চোখের ভ্রুকুটি
মুহূর্তে হারায় দম্ভ,
দর্প তার হয় কুটি কুটি |

গঙ্গার জোয়ারে এসে লাগে
ভল্ গার তীরের স্পর্শ
চোখে নব সূর্যোদয় জাগে
মুক্তি আজ বীরবাহু
শৃঙ্খল মেনেছে পরাভব ;
দিগন্তে দিগন্তে দেখি
বিস্ফোরিত আসন্ন বিপ্লব !

এখানে বিচিত্র স্রোত
মুক্তির একাগ্র লক্ষ্যে আসে ;
আজকের তুরঙ্গ ইতিহাসে
দেশপ্রেম বল্গা ধরে |
পদক্ষেপ কেবলি চঞ্চল |
গ্রামে গঞ্জে শহরে বাজারে
দুর্জয় সংকল্প নেয় হাজারে হাজারে |
মৃত্যুকীর্ণ পথে হই জড়ো ;
নতুন জন্মের ডঙ্কা বাজে,
বেদনায় পৃথ্বী থরো থরো |

এ দেশ আমার গর্ব
এ মাটি আমার চোখে সোনা |
আমি করি তারি জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
অগ্নিকোণ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
অগ্নিকোণ কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪৮।

অগ্নিকোণের তল্লাট জুড়ে দুরন্ত ঝড়ে তোলপাড় কালাপানি
খুন হয়ে যায় সাদা সাদা ফেনা
ঘুমভাঙা দলবদ্ধ ঢেউয়ের
ক্ষুরধার তলোয়ারে |

বনেজঙ্গলে ঝটপট করে প্রতিহিংসার পাখা |
কাঁধের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
ধনুকের মতো বাঁকা পিঠগুলো
টান করে ঘুরে দাঁড়ায় –
পেরাকে পেনাঙে টিনের খনিতে
রবারের বনে
মশলার দ্বীপে
সোনাফলা ইরাবতীর দুধারে
উপত্যকায়
বদ্বীপে, নীলকান্তমণির
ঝিকিমিকি দেশে
শ্যামে, কম্বোজে
অনামী পাহাড়ে
মেকং নদীর বানডাকা জলে
ঘুম-ভেঙে-ওঠা অগ্নিকোণের মানুষ |
রক্তের পাঁকে শত্রুকে পুঁতে
অন্ধকারের বুকে হাঁটু দিয়ে দুহাতে উপ্ ড়ে আনে
দুঃশাসনের ভিৎ |
মেঘে মেঘে তারা চকমকি ঠুকে
পথের নিশানা করে |
বজ্রের সুরে বেঁধে নেয় গলা | হাঁকে---
.                দিন এসে গেছে, ভাই রে—
.                রক্তের দামে রক্তের ধার
.                শুধবার |
.                দিন এসে গেছে, ভাই রে—
.                বিদেশিরাজের প্রাণ-ভোমরাকে
.                নখে নখে টিপে মারবার |
.                দিন এসে গেছে
.                লাঙলের ফালে আগাছা উপড়ে
.                ফেলবার |
.                দিন আসে ভাই---
.                কাস্তের মুখে নতুন ফসল
.                তুলবার |

কুঠিয়াল এক সাহেবের লাশে
শকুনিতে খায় ছিঁড়ে
লুন্ঠনকারী পঁচিশটা যুগ
সাম্রাজ্যের নেশাতুর চোখ থেকে |
সে দৃশ্য দেখে—
যার বংশের বাতি
নিভে গেছে মারীমড়কের হাওয়া লেগে |
দেশের মাটিতে গড়াগড়ি যায়
সুলতান, রাজারাজড়া, উজির, শিখণ্ডীদের মাথা |

অত্যাচারী পাড়ায় পাড়ায়
ত্রাহি  ত্রাহি হাঁক ওঠে,
দলে দলে ত্রাণকর্তা বিমান
বাতাসে বারুদ ঠেসেঠুসে দিয়ে
কামানের মুখে মৃত্যুর ঝড় তোলে |
দুধের শিশুকে বুকেতে আঁকড়ে ধ’রে
মরে শত শত শহর-গাঁয়ের
অগ্নিকোণের মানুষ |
সে আগুনে পথ চেনে
বঞ্চিতদের দিগন্তজোড়া মিছিল |
রক্তে রক্তে ভিজে ওঠে লাল নিশান |
জঙ্গলে জলে পাহাড়ের কোলে
ঝটপট করে প্রতিহিংসার পাখা |

মৃত্যুর ঝড় ঠেলে
অন্ধকারের গলা টিপে ধ’রে
রক্তের নদী উজিয়ে এগোয়
অগ্নিকোণের পোড়খাওয়া যত মানুষ |

ব্যারাকে ব্যারাকে বিদ্রোহী সেনা জাগে |
অস্ত্রাগারের দ্বার খুলে তারা
জনতার পাশে দাঁড়ায় |
লক্ষ লক্ষ পায়ের আওয়াজে
কেঁপে কেঁপে ওঠে মাটি |
ছত্রভঙ্গ দস্যুর দল
আগুনে আগুনে রাজ্য পুড়িয়ে দিয়ে
ল্যাজ তুলে ছোটে জাহাজে আকাশযানে |

লক্ষ লক্ষ হাতে
অন্ধকারকে দু-টুকরো ক’রে
অগ্নিকোণের মানুষ
সূর্যকে ছিঁড়ে আনে |
কোটি কন্ঠের হুঙ্কার লাগে
বজ্রের কানে তালা |

পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত ওঠে জেগে ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সালেমনের মা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
ফুল ফুটুক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৫১-১৯৫৭।

পাগল বাবরালির চোখের মতো আকাশ |
তার নীচে পাঁচ ইস্টিশান পেরনো মিছিলে
বারবার পিছিয়ে প’ড়ে
.        বাবরালির মেয়ে সালেমন
.             খুঁজছে তার মাকে |

এ কলকাতা শহরে
অলিগলি গোলকধাঁধায়
কোথায় লুকিয়ে তুমি,
.        সালেমনের মা ?

বাবরালির চোখের মতো এলেমেলো
.        এ আকাশের নীচে কোথায়
.             বেঁধেছ ঘর তুমি, কোথায়
.                সালেমনের মা ?

মিছিলের গলায় গলা মিলিয়ে
.        পিচুটি-পড়া চোখের দুকোণ জলে ভিজিয়ে
.            তোমাকে ডাকছে শোনো,
.                 সালেমনের মা ---

এক আকালের মেয়ে তোমার
আরেক আকালের মুখে দাঁড়িয়ে
তোমাকেই সে খুঁজছে ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ফুল ফুটুক না ফুটুক
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
ফুল ফুটুক কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৫১-১৯৫৭।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ               
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে |

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত |
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে---
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে---
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে |

গায়ে-হলুদ-দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
--- তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো |

লাল কালিতে ছাপা হল্ দে চিঠির মতো
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল ---

ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ !  পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ |
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখনও হাসছে ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
মেজাজ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
যত দূরেই যাই কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬২।


থলির ভেতর হাত ঢেকে
শাশুড়ি বিড়বিড়  বিড়বিড় করে মালা জপছেন,
বউ
গটগট গটগট করে হেটে গেল |

আওয়াজটা বেয়াড়া, রোজকার আটপৌরে নয় |
যেন বাড়িতে ফেরিঅলা ডেকে
শখ করে নতুন কেনা হয়েছে |

সুতরাং
মালাটা থেমে গেল ; এবং
চোখ দুটো বিষ হয়ে
ঘাড়টাকে হেলিয়ে দিয়ে যেদিকে বউ যাচ্ছিল
সেইদিকে ঢলে পড়ল |
নীচের চোয়ালা সামনে ঠেলে
দাঁতে দাঁত লাগল |

বিলক্ষণ রাগ দেখিয়ে
পরমুহূর্তেই শাশুড়ির দাঁত চোখ ঘাড় চোয়াল
যে যার জায়গায় ফিরে এল |
তারপর সারা বাড়িটাকে আঁচড়ে আঁচড়ে
কলতলায়
ঝমর ঝম খনর খন ক্যাঁচ ঘ্যাঁষঘিঁষ ক্যাঁচর ক্যাঁচর
শব্দ উঠল |
বাসনগুলো কোনোদিন তো এত ঝাঁঝ দেকায় না—
বড় তেল হয়েছে |

ঘুরতে ঘুরতে মালাটা দাঁড়িয়ে পড়ল |
নোড়া দিয়ে মুখ ভেঙে দিতে হয়—
মালাটা একবার ঝাঁকুনি খেয়ে
আবার চলতে লাগল |

নাকে অস্ফুট শব্দ ক’রে
থলির ভেতর পাঁচটা আঙুল হঠাৎ
মালাটার গলা টিপে ধরল—
মিন্ সের আক্কেলও বলিহারি !
কোথ্বকে এক কালো অলুক্ষণে
পায়ে খুঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধরে এনে
ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল |
কেন ? বাংলাদেশে ফরসা মেয়ে ছিল না ?
বাপ অবশ্য দিয়েছিল থুয়েছিল—
হ্যাঁ, দিয়েছিল !
গলায় রসুড়ি দিয়ে আদায় করা হয়েছিল না ?

এবার মালাটাকে দয়া করে ছেড়ে দেওয়া হল |
শাশুড়ির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল
থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে এই সময়ে
কী যেন তিনি লুকোচ্ছিলেন |
একটা জিনিস—
ক’মাস আগে বউমা
মরবার জন্যে বিষ খেয়েছিল |
ভাশুরপো ডাক্তার না হলে
ও-বউ এ-বংশের গালে ঠিক চুনকালি মাখাত |
কেন ? অসুখ করে মরলে কী হয় ?
ঢঙি আর বলেছে কাকে !

হাতে একরাশ ময়লা কাপড় নিয়ে
কালো বউ
গটগট গটগট করে সামনে দিয়ে চলে গেল |

নাঃ, আর বাড়তে দেওয়া ঠিক নয় |
‘বউমা---’
‘বলুন |’
উঁহু, গলার স্বরটা ঠিক কাছা-গলায়-দেওয়ার মতো নয়,
বড্ড ন্যাড়া |
হঠাৎ এই দেমাক এল কোথ্বেকে ?
বাপের বাড়ির কেউ তো
ভাইফোঁটার পর আর এদিক মাড়ায় নি ?
বাড়িটা যেন ঝড়ের অপেক্ষায়
থমথম করছে |
ছোট ছেলে কলেজে ;
মেজোটি সামনের বাড়ির রোয়াকে ব’সে
রাস্তায় মেয়ে দেখছ্
ফরসা ফরসা মেয়ে
বউদির মতো ভূষণ্ডি কালো নয় |
বালতি ঠনঠনিয়ে
বউ যেন মা-কালীর মতো রণরঙ্গিনী বেশে
কোমরে আঁচল জড়িয়ে
চোখে চোখ রেখে শাশুড়ির সামনে দাঁড়াল |

শাশুড়ির  কেমন যেন
হঠাৎ গা ছমছম করতে লাগল |
তাড়াতাড়ি থলির মধ্যে হাতটা লুকিয়ে ফেলে
চোখ নামিয়ে বললেন  আচ্ছা থাক, এখন যাও |
বউ মাথা উঁচু ক’রে
গটগট গটগট করে চলে গেল !

তারপর একা একা পা ছড়িয়ে ব’সে
মোটা চশমায় কাঁথা সেলাই করতে করতে
শাশুড়ি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে ভাবতে লাগলেন
বউ হঠাৎ কেন বিগড়ে গেল
তার একটা তদন্ত হওয়া দরকার |
তারপর দরজা দেবার পর
রাত্রে
বড় ছেলের ঘরে আড়ি পেতে
এই এই কথা কানে এল—

বউ বলেছে :  ‘একটা সুখবর আছে |’
পরের কথাগুলো এত আস্তে যে শোনা গেল না |
খানিক পরে চকাস চকাস শব্দ,
মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিল |
কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার—
বউয়ের গলা, মা কান খাড়া করলেন |
বলছে : ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে |’
এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত |
ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছে :
‘কী নাম দেব, জান ?
আফ্রিকা |
কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে ||’

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
যত দূরেই যাই কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬২।


আরে ! মুখুজ্যে মশাই যে ! নমস্কার, কী খবর ?
আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত |
তা বেশ | কিন্তু দেখো মুখুজ্যে,
আমার এই ডানদিকটাকে  বাঁদিক
আর বাঁদিকটাকে ডানদিক ক’রে
আয়নায় এভাবে ঘুড়িয়ে দেওয়া—
আমি ঠিক পছন্দ করি না |
তার চেয়ে এসো, চেয়ারটা টেনে নিয়ে
জানলায় পা তুলে বসি |
এককাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে ?

দেশলাই ? আছে |
ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে |
তোমার কপালে আর করে খাওয়া হল না দেখছি |
বুঝলে মুখুজ্যে, জীবনে কিছুই কিছু নয়
যদি কৃতকার্য না হলে |


আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ---
ঢালবে |
কিন্তু ভয়ের কিছু নেই
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে |
আমাদের মুঠোয় আকাশ;
চাঁদ হাতে এসে যাবে |

ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির,
অন্ধকারের চেয়ে আলোর দিকেই
পাল্লা ভারী হচ্ছে |

ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালোবাসা |
পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে—
দেখো, আফ্রিকার কোলে
সাত রাজার ধন এক মানিক
স্বাধীনতা |
পাজির পা-ঝাড়াদের আগে যারা কুর্নিশ করত
এখন তারা পিস্তল ভরছে |
শুধু ভাঙা শেকলগুলো এক জায়গায় জুটে
এই দিনকে রাত করবার কড়ারে
ডলারে ফলার পাকাবার
ষড়যন্ত্র আঁটছে |

পুরনো মানচিত্রে আর চলবে না হে,
ভূগোল নতুন ক’রে শিখতে হবে |
আর চেয়ে দেখো,
এক অমোঘ নিয়মের লাগাম-পরা
ঘটনার গতি
পাঁজির পাতায় রাজজ্যোতিষীদের
দৈনিক বেইজ্জত করছে |

ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা |
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয় |

পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো,
ক্রুশ্চেভের গলায় |

নির্বিবাদে নয়, বিনা গৃহযুদ্ধে
এ মাটিতে
সমাজতন্ত্র দখল নেবে |
হয়তো একটু  বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে
কিন্তু যখন হবে
তখন খাতা খুলে দেখে নিও
অক্ষরে অক্ষরে সব মিলে যাচ্ছে |


দেখো মুখুজ্যে, মাঝে মাঝে আমার ভয় করে
যখন অমন সুন্দর বাইরেটা
আমার এই আগোছালো ঘরে হারিয়ে যায় |

যখন দেখি ঠিক আমারই মতন দেখতে
আমার দেশের কোনো ভাই
উলিডুলি ছেঁড়া কাপড়ে
আমাকে কাঁদাতে পারবে না জেনেও
বলে বলে দুঃখের কথাগুলোতে ঘাঁটা পড়ায়--
আমার লজ্জা করে |

পাঞ্চেতের এক সাঁওতাল কুলি দেখতে দেখতে
ওস্তাদ ঝালাইমিস্ত্রি হয়েছিল—
এখন আবার তাকে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে পেটভাতায়
পরের জমিতে আদ্যিকালের লাঙল ঠেলতে হচ্ছে |
এক জায়গায় রুগী ডাক্তার অভাবে মরছে,
অন্য জায়গায় ডাক্তার রুগী অভাবে মরছে |
কেন হয়?
কেন হবে ?


আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধ’রে
আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ---
ভালো কথা |
কলে তৈরি হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন---
খুব ভালো
মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে
ইস্পাতের শহর বসেছে---
আমরা সত্যিই খুশি হচ্ছি |

কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি---
যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই |
তবু যদি একটু পালিশ থাকত |
তা নয়,
মুচির দোকানের লাশে-চড়ানো জুতোর মতো
মাথার ওপর ঝুলছে |

গদিতে ওঠবস করাচ্ছে
টাকার থলি |
বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে
হাতে হাতে ঝনঝন করে ফিরুক |
বুঝলে মুখুজ্যে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না
আড় হয়ে লাগতে হবে |


যারা হটাবে
তারা এখনও তৈরি নয় |
মাথায় একরাশ বইয়ের পোকা
কিলবিল করছে :
চোখ খুলে তাকাবার
মন খুলে বলবার
হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার---
মুখুজ্যে, তোমার সাহস নেই |


আগুনের আঁচ নিভে আসছে
তাকে খুঁচিয়ে গনগনে করে তোলো |
উঁচু থেকে যদি না হয়
নীচে থেকে করো |

সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিল
আবার তাকে ফিরিয়ে আনো,
যে চক্রান্ত
ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে
তাকে নখের ডগায় রেখে
পট্ করে একটা শব্দ তোলো ||

দরজা খুলে দাও,
লোকে ভেতরে আসুক |

মুখুজ্যে, তুমি লেখো ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
জলছবি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
কাল মধুমাস কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬৬।

ক্যালেন্ডারে হাত দিস নে,
যা ভাগ্,  বোকা হাবা !

চেয়ার খালি |  জানলা খোলা |
নিরক্ষর হাওয়া
বারে বারে একই বইয়ের
ওলটাচ্ছে পাতা |

ঘড়ির কাঁটায় হাত দিস নে,
সময় গোনাগাঁথা |

বারান্দায় ফুলের টব,
মেঝেয় ছাড়া চটি,
বসে বসে শুঁড় নাড়াচ্ছে
মাটির প্রজাপতি |

টেবিলঝাড়া পাখির-পালক
ঘরের মধ্যে ওড়ে
খাটের তলায় ছেঁড়া চিঠিটা
বেড়ায় নড়ে-চড়ে |

পা আকাশে, হাত নামানো—
রেলিঙে সার বেঁধে
শুকোয় কাপড় | রঙিন ঘুড়ি
তারে রয়েছে বেধে |

আলো নেভানো | চোখ  বন্ধ |
দেখতে পাচ্ছি সবই |
কাঠের বাক্সে পোকায় কাটছে
পুরনো গ্রুপছবি |

একটিবার দৌড়ে এসো
ও নদী, ও স্মৃতি—
ঘরের এই দেয়াল ধরে
দাঁড়াও না, লক্ষ্মীটি |

দরজায় কে পর্দা ঠেলছে ?
বাইরে যাই |  ফিরি |
পায়ের শব্দে নেমে যাচ্ছে
অন্ধকার সিঁড়ি ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
জননী জন্মভূমি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
কাল মধুমাস কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬৬।


আমি ভীষণ ভালোবাসতাম আমার মা-কে
--- কখনও মুখ ফুটে বলিনি |
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু
--- শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভরে উঠত
আমার ভালোবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি |

হে দেশ, হে আমার জননী---
কেমন করে তোমাকে আমি বলি |

যে মাটিতে ভর দিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি ---
আমার দু-হাতের
দশ আঙুলে
তার স্মৃতি |

আমি যা কিছু স্পর্শ করি
সেখানেই,
হে জননী,
তুমি |
আমার হৃদয়বীণা
তোমারই হাতে বাজে |

হে জননী,
আমরা ভয় পাই নি |
যারা তোমার মাটিতে নিষ্ঠুর থাবহা বাড়িয়েছে
আমরা তাদের ঘাড় ধরে
সীমান্ত পার করে দেব |
আমরা জীবনকে নিজের মতো করে
সাজাচ্ছিলাম---
আমরা সাজাতে থাকব |

হে জননী,
আমরা ভয় পাই নি |
যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটেছে বলে
আমরা বিরক্ত |

মুখ বন্ধ করে,
অক্লান্ত হাতে---
হে জননী,
আমরা ভালোবাসার কথা বলে যাব ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ফোঁটা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
কাল মধুমাস কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬৬।


ভাই আমাকে বকুক ঝকুক
.        দিক গে যতই খোঁটা---
যমের দুয়োরে কাঁটা দিচ্ছি,
.        ভাইয়ের কপালে ফোঁটা |

ভাইয়ের সঙ্গে আড়ি আমার,
.        ভাইয়ের সঙ্গে ভাব---
সেলাই করি তারই মাপে
.        রাজার কিংখাব |

কাঠ কুড়োচ্ছি বনে,
ভাই রয়েছে রণে---
নিজের হাতে বেঁধে দিয়েছি
.        তরোয়ালের খাপ |

ভাইয়ের হাতে সেই সে অসি
.                ঝলমল করে !
অন্ধকারের সিংহাসন যে
.                টলমল করে !

দিনের স্মৃতি বুকে রেখেছি,
.        স্বপ্ন চোখের কোলে---
কখন যে ভাই ঘরে ফিরবে
.        ঘুমে পড়ছি ঢলে |

ফুল তুলেছি বনে,.        
দেখে রেখেছি কনে---
হাত পুড়িয়ে রেঁধে রেখেছি
.        ভাইকে দেব বলে |

শেকলগুলো ভাঙছে কোথায়
.        ঝন্  ঝন্  করে !
নিশান ওড়ে, রথের চাকা
.        বন্  বন্  ঘোরে !

ভাই এনেছে লক্ষ্মীর ঝাঁপি,
.        খুলে ফেলেছে ডালা
দেখো ও ভাই, তোমার জন্যে
.        গেঁথে রেখেছি মালা |

ভাই আমাকে নাই বা দেখুক,
.        মারুক লাফি ঝাঁটা—
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
.        যমের দুয়ারে কাঁটা ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর