স্বাগত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।
গ্রাম উঠে গিয়েছে শহরে— শূন্য ঘর, শূন্য গোলা, ধান-বোনা জমি আছে পড়ে | শুকনো তুলসীর মঞ্চে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে, আগাছায় ভরেছে উঠোন | সূর্য পাটে বসেছে কখন | রাখালের দেখা নেই – কোথাও গরুর পাল ওড়ায় না ধুলো ; ঢেঁকিতে ওঠে না পাড়, একটি কলসীও জল ওঠায় না ঘাটে | বুনো ঘাসে পথ ঢাকে, বিনা শাঁখে সন্ধ্যা হয়, সূর্য বসে পাটে | তাঁতি বোনে না কো তাঁত, কলু আর ঘোরায় না ঘানি ; কুমোরের ঘরে চাবি, ঝাঁপ বন্ধ নিরূদ্দেশ হয়েছে দোকানি, হাতুড়ি বিকিয়ে হাটে ভস্ম মেখে পড়ে থাকে বেকার হাপর | যে পথে কামার গেছে কে জানে সে পথের খবর ? শীতের আমেজ আসে ; জ্বলে না আগুন চণ্ডীমণ্ডপের কোলে | হাতে হাতে ঘোরে নাকো হুঁকো চুলোচুলি হয় নাকো মোড়লে মোড়লে | নিশুতি রাত্রিতে কারো চৌকি শুনে কুকুর ডাকে না, দিগন্তের বনস্পতি হাত নাড়ে, মাঠের সোনালি ধান গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ে | দুচোখে প্রতীক্ষা তার স্বপ্ন তাকে করাঘাত করে | ডাক ওঠে শহরে শহরে | রাস্তার শ্মশানে থেকে মৃতপ্রায় জনস্রোত শোনে, মাঠের ফসল দিন গোনে |
প্রতিজ্ঞাকঠিন হাতে একে একে তারা সব চোখের শোকাশ্রু মুছে ভাবে— ঘরে ঘরে নবান্ন পাঠাবে | পথে পথে পদশব্দ ওঠে, আকাশে নক্ষত্র ফোটে ; নদী করে সম্ভাষণ, পাখি করে গান –
ঘোষণা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৪১-১৯৪৬।
এ দেশ আমার গর্ব, এ মাটি আমার কাছে সোনা | এখানে মুক্তির লক্ষ্যে হয় মুকলিত আমার সহস্র সাধ, সহস্র বাসনা | এখানে আমার পাশে হিমাচল, কন্যাকুমারিকা | অলঙ্ঘ্য প্রাচীর ঐক্য প্রতিক্ষা পরিখা |
দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ, রক্তচক্ষু রাজার শাসন— শকুনি বিশ্বস্ত বন্ধু, মুঠোয় শিথিল সিংহাসন ; সর্বাঙ্গে চিহ্নিত মৃত্যু শবের গলিত গন্ধ ছোটে | প্রজাপুঞ্জ ওঠে ; আগুন লেগেছে ঘরে, খরসূর্য মাথার উপরে | ভাণ্ডারে উধাও খাদ্য, শূন্য পেটে চাষবাস চুপ কারখানায় পড়েছে কুলুপ | দোকানে দ্বারস্থ অক্ষৌহিণী পিছনে করুণমূর্তি পথের কাহিনী গহন আরণ্য আরাকান ; স্খলিত পায়ের ছন্দে স্পন্দিত শ্মশান | সর্বশান্ত চোখে পড়ে বার বার হাতের শৃঙ্খল— পলাতক প্রাণের সম্বল |
বিড়ম্বিত জীবনে আবার কুরুক্ষেত্র করাঘাত করে পালাবার নেই কোনো গোপন দুয়ার | সম্মুখে প্রতীক্ষমাণ সবুজ প্রন্তরে শায়িত বল্লম ; পায়ে পায়ে রুদ্ধগতি বিদ্যুৎ কদম, ঘুম ভাঙে সম্মিলিত মুঠি ; অগ্নিবর্ণ চোখের ভ্রুকুটি মুহূর্তে হারায় দম্ভ, দর্প তার হয় কুটি কুটি |
ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত | আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে তারপর খুলে--- মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে তারপর তুলে--- যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে যেন না ফেরে |
গায়ে-হলুদ-দেওয়া বিকেলে একটা দুটো পয়সা পেলে যে হরবোলা ছেলেটা কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত --- তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো |
লাল কালিতে ছাপা হল্ দে চিঠির মতো আকাশটাকে মাথায় নিয়ে এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল ---
ঠিক সেই সময় চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি ! তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ | অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে দড়িপাকানো সেই গাছ তখনও হাসছে ||
বিলক্ষণ রাগ দেখিয়ে পরমুহূর্তেই শাশুড়ির দাঁত চোখ ঘাড় চোয়াল যে যার জায়গায় ফিরে এল | তারপর সারা বাড়িটাকে আঁচড়ে আঁচড়ে কলতলায় ঝমর ঝম খনর খন ক্যাঁচ ঘ্যাঁষঘিঁষ ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ উঠল | বাসনগুলো কোনোদিন তো এত ঝাঁঝ দেকায় না— বড় তেল হয়েছে |
ঘুরতে ঘুরতে মালাটা দাঁড়িয়ে পড়ল | নোড়া দিয়ে মুখ ভেঙে দিতে হয়— মালাটা একবার ঝাঁকুনি খেয়ে আবার চলতে লাগল |
নাকে অস্ফুট শব্দ ক’রে থলির ভেতর পাঁচটা আঙুল হঠাৎ মালাটার গলা টিপে ধরল— মিন্ সের আক্কেলও বলিহারি ! কোথ্বকে এক কালো অলুক্ষণে পায়ে খুঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধরে এনে ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল | কেন ? বাংলাদেশে ফরসা মেয়ে ছিল না ? বাপ অবশ্য দিয়েছিল থুয়েছিল— হ্যাঁ, দিয়েছিল ! গলায় রসুড়ি দিয়ে আদায় করা হয়েছিল না ?
এবার মালাটাকে দয়া করে ছেড়ে দেওয়া হল | শাশুড়ির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে এই সময়ে কী যেন তিনি লুকোচ্ছিলেন | একটা জিনিস— ক’মাস আগে বউমা মরবার জন্যে বিষ খেয়েছিল | ভাশুরপো ডাক্তার না হলে ও-বউ এ-বংশের গালে ঠিক চুনকালি মাখাত | কেন ? অসুখ করে মরলে কী হয় ? ঢঙি আর বলেছে কাকে !
হাতে একরাশ ময়লা কাপড় নিয়ে কালো বউ গটগট গটগট করে সামনে দিয়ে চলে গেল |
নাঃ, আর বাড়তে দেওয়া ঠিক নয় | ‘বউমা---’ ‘বলুন |’ উঁহু, গলার স্বরটা ঠিক কাছা-গলায়-দেওয়ার মতো নয়, বড্ড ন্যাড়া | হঠাৎ এই দেমাক এল কোথ্বেকে ? বাপের বাড়ির কেউ তো ভাইফোঁটার পর আর এদিক মাড়ায় নি ? বাড়িটা যেন ঝড়ের অপেক্ষায় থমথম করছে | ছোট ছেলে কলেজে ; মেজোটি সামনের বাড়ির রোয়াকে ব’সে রাস্তায় মেয়ে দেখছ্ ফরসা ফরসা মেয়ে বউদির মতো ভূষণ্ডি কালো নয় | বালতি ঠনঠনিয়ে বউ যেন মা-কালীর মতো রণরঙ্গিনী বেশে কোমরে আঁচল জড়িয়ে চোখে চোখ রেখে শাশুড়ির সামনে দাঁড়াল |
শাশুড়ির কেমন যেন হঠাৎ গা ছমছম করতে লাগল | তাড়াতাড়ি থলির মধ্যে হাতটা লুকিয়ে ফেলে চোখ নামিয়ে বললেন আচ্ছা থাক, এখন যাও | বউ মাথা উঁচু ক’রে গটগট গটগট করে চলে গেল !
তারপর একা একা পা ছড়িয়ে ব’সে মোটা চশমায় কাঁথা সেলাই করতে করতে শাশুড়ি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে ভাবতে লাগলেন বউ হঠাৎ কেন বিগড়ে গেল তার একটা তদন্ত হওয়া দরকার | তারপর দরজা দেবার পর রাত্রে বড় ছেলের ঘরে আড়ি পেতে এই এই কথা কানে এল—
বউ বলেছে : ‘একটা সুখবর আছে |’ পরের কথাগুলো এত আস্তে যে শোনা গেল না | খানিক পরে চকাস চকাস শব্দ, মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিল | কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার— বউয়ের গলা, মা কান খাড়া করলেন | বলছে : ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে |’ এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত | ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছে : ‘কী নাম দেব, জান ? আফ্রিকা | কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে ||’
মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যত দূরেই যাই কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনাকাল ১৯৬২।
১ আরে ! মুখুজ্যে মশাই যে ! নমস্কার, কী খবর ? আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত | তা বেশ | কিন্তু দেখো মুখুজ্যে, আমার এই ডানদিকটাকে বাঁদিক আর বাঁদিকটাকে ডানদিক ক’রে আয়নায় এভাবে ঘুড়িয়ে দেওয়া— আমি ঠিক পছন্দ করি না | তার চেয়ে এসো, চেয়ারটা টেনে নিয়ে জানলায় পা তুলে বসি | এককাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে ?
দেশলাই ? আছে | ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে | তোমার কপালে আর করে খাওয়া হল না দেখছি | বুঝলে মুখুজ্যে, জীবনে কিছুই কিছু নয় যদি কৃতকার্য না হলে |
২ আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ--- ঢালবে | কিন্তু ভয়ের কিছু নেই যুদ্ধ না হওয়ার দিকে | আমাদের মুঠোয় আকাশ; চাঁদ হাতে এসে যাবে |
ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালোবাসা | পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে— দেখো, আফ্রিকার কোলে সাত রাজার ধন এক মানিক স্বাধীনতা | পাজির পা-ঝাড়াদের আগে যারা কুর্নিশ করত এখন তারা পিস্তল ভরছে | শুধু ভাঙা শেকলগুলো এক জায়গায় জুটে এই দিনকে রাত করবার কড়ারে ডলারে ফলার পাকাবার ষড়যন্ত্র আঁটছে |
পুরনো মানচিত্রে আর চলবে না হে, ভূগোল নতুন ক’রে শিখতে হবে | আর চেয়ে দেখো, এক অমোঘ নিয়মের লাগাম-পরা ঘটনার গতি পাঁজির পাতায় রাজজ্যোতিষীদের দৈনিক বেইজ্জত করছে |
ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ আত্মহত্যা | দড়ি আর কলসি মজুত এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয় |
পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো, ক্রুশ্চেভের গলায় |
নির্বিবাদে নয়, বিনা গৃহযুদ্ধে এ মাটিতে সমাজতন্ত্র দখল নেবে | হয়তো একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে কিন্তু যখন হবে তখন খাতা খুলে দেখে নিও অক্ষরে অক্ষরে সব মিলে যাচ্ছে |
৩ দেখো মুখুজ্যে, মাঝে মাঝে আমার ভয় করে যখন অমন সুন্দর বাইরেটা আমার এই আগোছালো ঘরে হারিয়ে যায় |
যখন দেখি ঠিক আমারই মতন দেখতে আমার দেশের কোনো ভাই উলিডুলি ছেঁড়া কাপড়ে আমাকে কাঁদাতে পারবে না জেনেও বলে বলে দুঃখের কথাগুলোতে ঘাঁটা পড়ায়-- আমার লজ্জা করে |
পাঞ্চেতের এক সাঁওতাল কুলি দেখতে দেখতে ওস্তাদ ঝালাইমিস্ত্রি হয়েছিল— এখন আবার তাকে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে পেটভাতায় পরের জমিতে আদ্যিকালের লাঙল ঠেলতে হচ্ছে | এক জায়গায় রুগী ডাক্তার অভাবে মরছে, অন্য জায়গায় ডাক্তার রুগী অভাবে মরছে | কেন হয়? কেন হবে ?
আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধ’রে আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ--- ভালো কথা | কলে তৈরি হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন--- খুব ভালো মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে ইস্পাতের শহর বসেছে--- আমরা সত্যিই খুশি হচ্ছি |
কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি--- যার হাত আছে তার কাজ নেই, যার কাজ আছে তার ভাত নেই, আর যার ভাত আছে তার হাত নেই | তবু যদি একটু পালিশ থাকত | তা নয়, মুচির দোকানের লাশে-চড়ানো জুতোর মতো মাথার ওপর ঝুলছে |
গদিতে ওঠবস করাচ্ছে টাকার থলি | বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে হাতে হাতে ঝনঝন করে ফিরুক | বুঝলে মুখুজ্যে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না আড় হয়ে লাগতে হবে |
৪ যারা হটাবে তারা এখনও তৈরি নয় | মাথায় একরাশ বইয়ের পোকা কিলবিল করছে : চোখ খুলে তাকাবার মন খুলে বলবার হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার--- মুখুজ্যে, তোমার সাহস নেই |
আগুনের আঁচ নিভে আসছে তাকে খুঁচিয়ে গনগনে করে তোলো | উঁচু থেকে যদি না হয় নীচে থেকে করো |
সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিল আবার তাকে ফিরিয়ে আনো, যে চক্রান্ত ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে নখের ডগায় রেখে পট্ করে একটা শব্দ তোলো ||
আমি ভীষণ ভালোবাসতাম আমার মা-কে --- কখনও মুখ ফুটে বলিনি | টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু --- শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভরে উঠত আমার ভালোবাসার কথা মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি |
হে দেশ, হে আমার জননী--- কেমন করে তোমাকে আমি বলি |
যে মাটিতে ভর দিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি --- আমার দু-হাতের দশ আঙুলে তার স্মৃতি |
আমি যা কিছু স্পর্শ করি সেখানেই, হে জননী, তুমি | আমার হৃদয়বীণা তোমারই হাতে বাজে |
হে জননী, আমরা ভয় পাই নি | যারা তোমার মাটিতে নিষ্ঠুর থাবহা বাড়িয়েছে আমরা তাদের ঘাড় ধরে সীমান্ত পার করে দেব | আমরা জীবনকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছিলাম--- আমরা সাজাতে থাকব |
হে জননী, আমরা ভয় পাই নি | যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা বিরক্ত |
মুখ বন্ধ করে, অক্লান্ত হাতে--- হে জননী, আমরা ভালোবাসার কথা বলে যাব ||