সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
ভানুমতীর খেল
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“চইচই-চইচই” ( ১৯৮৩ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


সাদার গায়ে ছিটানো কিছু কালি ;
বিষয়আশয় বলতে সেই বুড়োর
আর আছে কী ?
.              এই নিয়েই তো খালি
যত রাজ্যের চাপান আর উতোর |

ইহকালের কাছে তো সেই বুড়ো
পাতেনি হাত ;
.      আপনি মিলেছে যা

তাতেই খুশি,  হোক না খুঁদকুঁড়ো
হোক কিছু তার চোখের জলে ভেজা |

ইহকালের ভয় নেই আর বুড়োর
ভয়টা শুধু পরকালের এখন
পড়েছে দাঁত গেছে চোখের নজর
মানে না দেহ আগের কড়া শাসন |

স্বর্গনরক পাপপুণ্য ওসব
দেয় না তাকে টান কিংবা ঠেলা
বেঁচে থাকার প্রত্যহই পরব
যা দেখে তাই ভানুমতীর খেলা ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
জল নেমে গেলে পলি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“চইচই-চইচই” ( ১৯৮৩ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

দেবতার থানে ধরে দিয়ে পাঁচসিকে
কিনে  নেব ত্রাণ---
.        আমরা  নই  সে চিজ

হানা  দিলে  বান
.              ডেকে তুলে পড়শিকে
চলে আমাদের তদন্ত তজবিজ

পেটে  পড়ে  টান,
.              পড়ুক---
উঁচুতে টাঙাই শিকে
পদ্মপাতায় ভালো করে মুড়ে
মাটির হাঁড়ির মুখ
.        হাতের নাগাল থেকে ঢের দূরে
.            তুলে রেখে দিই বীজ
এ দুর্দৈবে
অপূর্ব সব সাধনা ও সাধ যদি
.             হয় অন্তর্জলি

যদি  যায় নিবে
.             ফুত্কারে দীপাবলি---
ঝেড়ে  ফেলে  সব স্বখাতে ফিরবে নদী

জল  নেবে  গেলে  পলি
.              সে  ভার বইবে---
ঘটাবে  ভাঙা  ও  গড়ার সপ্তপদী ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
অগত্যা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“চইচই-চইচই” ( ১৯৮৩ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকা বুড়ো
সব পাতা ঝরে গেলে শীতে
ফুঁ দিয়ে স্মৃতিতে

একা সে আঁটকুড়ো
বসে বসে সারাক্ষণ ফোলায় ফাঁপায়
রঙিন বুদ্বুদ

যেখানে যা পায়
মাটিতে লাগিয়ে মুখ খুঁটে খায় খুদ
পাখিদের মতন হুবহু

এক থেকে
সেও হতে চেয়েছিল বহু
একা তাকে ফেলে রেখে গিয়েছে প্রত্যেকে

দাঁতে আরো জোর কমবে চোখে কমবে জ্যোতি
জিভ আরো বেশি করে চাইতে থাকবে নুন-ঝাল-টক
তখনই ফিরিয়ে নেবে বস্তু তার দেহ থেকে গতি

ভারী মোটা কম্বলের মতন কুয়াশা
ঢেকে দেবে আপাদমস্তক---
তার খুব আশা ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
বুড়ি ছুঁয়ে
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“বাঘ ডেকেছিল” ( ১৯৮৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


যে দেয়ালে বুড়ি দিত এতদিন ঘুঁটে
ভদ্রলোকের বেটারা সেখানে জুটে

তাতে নানা রং ফলিয়ে গিয়েছে লিখে
বুড়ি জানে নাকো কারা কোন দল কী কে

একই দেয়ালের ভাগ করে দুই পিঠে
দু-দলেই যায় দু-দলের ঢাক পিটে

ওরা বলে,  মুখে ধরব দুধের বাটি
ভাই, আমাদের ওঠাও আরেক কাঠি

এরা বলে, আরে | চুপচাপ বসে থাকো
কলেকৌশলে গরিবি হটাই, দেখো---

ভদ্রলোকের এক কথা খালি শুনে
মাজা পড়ে গেল দিন-গুনে দিন-গুনে

বুড়ি ভাবে, হাতে নিয়ে গোবরের ঝুড়ি—
আজাদির হল ক’বছর  দুই কুড়ি !
এক দেয়ালেই পিঠোপিঠি থেকে দুয়ে
বুড়িকে সরায়, থাকে তবু বুড়ি ছুঁয়ে ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
দৃশ্যত
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“যারে কাগজের নৌকো” ( ১৯৮৯ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


রাস্তা দিয়ে যেই যায়,  খোলা জানলা,  উঁকি মেরে দেখে---
কে একজন সারাক্ষণ গদি-আঁটা কাঠের চেয়ারে
টেবিলে দু-ঠ্যাং তুলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে |

চুলগুলো খোঁচা খোঁচা, ভাঙাগাল, দেখতেও চোয়াড়ে,
মাঝখানে সামান্য ভুঁড়ি, যে রকম হয় ভারি ট্যাঁকে----
বেড়া ভেঙে ভাবনা ঢুকলে সম্ভবত দেয় সে খোঁয়াড়ে |

চোখে যদি চশমা থাকত, হাতে যদি ধরা থাকত বই
কিছুটা আন্দাজ করা যেত হয়তো লোকটার স্বভাব
বাইরে থেকে কে কী বুঝবে ! কার সাধ্য পাবে তার থই ?

গড়গড়ার নল হাতে থাকলে তবু দেখাত নবাব
পাছে ধরা পড়ে যায়, রাখে না সে কোথাও টিপসই
তবে কি নিজের সঙ্গে চলে তার সওয়াল জবাব ?

সে খোঁজ রাখে না কেউ, লোকচক্ষে সে শুধু দৃশ্যই ||

.                     *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
এসো হে
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“যারে কাগজের নৌকো” ( ১৯৮৯ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


আমাকে চিনবে না |
অনেকটা রাস্তা উজিয়ে
আজ এই পড়ন্ত বেলায়
আমি আসছি |

মাথাভর্তি মাঠ ভাঙা ধুলো,
দুটো পা-য়
কাঁটায় কাটাছেঁড়ার দাগ |

বলি, চেনা লোকেরা সব
গেল কোথায় গা ?

গোধূলির শূন্য দাওয়ায়
এমন কেউ নেই
যে তার মুখ ঘোমটায় ঢেকে
পিঁড়ি পেতে দেয়,
কনুই ছুঁয়ে এগিয়ে দেয়
এক ঘটি তৃষ্ণার জল |

উঠোনে খেলে বেড়ায়
একা একা
হাতের লাঠির ঠক ঠক
আর গাছের পাতার
টুপটাপ শব্দ |

কই, এসো হে---
ঘরে-ফেরা পাখির কলরবে,
দূরাগত শাঁখের আওয়াজে
দিনাবসানের আজানে

আমার সেই ডাক
আর কাউকে না পেয়ে
মাথা নিচু ক’রে
আবার আমার কাছেই ফিরে আসে ||

.           *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সপ্তাহ প্রতিদিনই
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“যারে কাগজের নৌকো” ( ১৯৮৯ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

শিব  নেই ! ছি !  ছি !

সেই দুঃখে
দক্ষযজ্ঞে
যান নি দধীচি |

বৃত্রাসুর হানা দিলে
স্বর্গচ্যুত
হল দেবতারা---
খোদ ইন্দ্র রণে ভঙ্গ দেন |

তখন দধীচি ছাড়া
দেবগণ
অনন্য উপায় |

দধীচি দিলেন প্রাণ |
তবে দেবতারা পায়
তাঁর অস্থি থেকে
বৃত্রনিধনের বজ্র---

যাঁর জন্ম
একদা শান্তির গর্ভে
অথর্বমুনির ঔরসে
এবং প্রেমের গর্বে
সারস্বত পুত্রের পিতা যিনি |

বিনা নামে বিনা অর্থে
বিনা যশে
সে বজ্র বানিয়ে যায়
নিজের অস্থিতে

নেপথ্যে
.        সপ্তাহ
.               প্রতিদিনই ||

.           *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
গদির মধ্যে যদি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা |

গদি
তার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে থাকে
জী-হাঁর পিছে লুকিয়ে রেখে হাঁ-কে
শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট এক পশুরাজ
যদি
ঘাঁটি
যতই কেন আগলে রাখুক সদলে সবলে
কথার সঙ্গে কাজের অমিল মাত্রাছাড়া হলে
আস্তে আস্তে পায়ের তলায় সরে যাবেই
মাটি

হাঁড়ি
যেন না ফাটে হাটের মধ্যে হঠাৎ
দেখার জন্যে যথাস্থানে দেওয়া হয়েছে বরাত
তবুও ভয় কখন কী হয়ে ছেড়ে যেন যায়
নাড়ি
মালুম
হয়না যখন কোন্ খানে ঠিক ফারাক
সৎ-অসতের কোথায় থাকছে ফাঁক
ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়বে হ্যাঁকাচম্ কা
হালুম ||

.           *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
হাঁড়ি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

যেন না ফাটে হাটের মধ্যে হঠাৎ
দেখার জন্যে যথাস্থানে দেওয়া হয়েছে বরাত
তবুও ভয় কখন কী হয়ে ছেড়ে যেন যায়
নাড়ি
মালুম
হয়না যখন কোন্ খানে ঠিক ফারাক
সৎ-অসতের কোথায় থাকছে ফাঁক
ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়বে হ্যাঁকাচম্ কা
হালুম ||

.           *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
বুড়ি বসন্ত
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


ফুল থাক ফুলের মতো
খাঁড়া খাঁড়ার মতো

ফুল তুলে কেউ যেন আমাকে কাটতে
.        খাঁড়া তুলে কেউ আমাকে
.             যেন গন্ধ শোঁকাতে না আসে

যার যে জায়গা
.      সেখানেই সে যেন

.        মাটি  কামড়ে  পড়ে  থাকে
জল থাক জলের মতো
আগুন আগুনের মতো

এ  ওর  পা মাড়িয়ে দিয়ে
.        জল  যেন  জ্বালাতে
.             আগুন যেন জুড়োতে না চায়

নুন নিয়ে
এখন আমি পাকা ঘরে

এ বড় বাহারে খেলা
আমার চারদিকে আল দিয়ে রোখেছে
.           সময়

আল্ টপ্ কা হয়ে
.        যেদিকে দুচোখ যায়
.               যেতে ইচ্ছে করে
ছাড়ের মধ্যে বাঁধন
.        বাঁধনের মধ্যে ছাড়
.            দিনের মনে দিন থাক
.            রাত তার মনিহারি জিনিস ফেরি করুক
নুন নিয়ে
এখন আমি আমার পাকা ঘরে ||

.              *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর