সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
উড়ো চিঠি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


বসে রয়েছি পা ছড়িয়ে
খরায় স্মৃতির নৌকো আটকে আছে
হাঁটুজলের চড়ায়

শুকনো ডালে হল্ দে পাতার
মাটিতে চোখ
যেখানে রক্ত, ছিন্নভিন্ন

পাখির পালক

হৃদয়ের লাল ডাকবাক্ সে
ফেলা চিঠিতে
নাম লিখেছি, ভুলে গিয়েছি
ঠিকানা দিতে

বসে রয়েছি কালবোশেখি
ঝড়ের আশায়
ভালোবাসা বাড়াচ্ছে হাত
নীলকন্ঠ পাখির বাসায় ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
এখন কে যায় ?
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


ফুলকপি  শেষ  হয়ে আসছে
উঠবে উঠবে করছে নতুন পটল
.           দূর ! এখন কে যায় ?

তোমার কথা মনে হলেই
মাটির তলা দিয়ে তলা দিয়ে
.              ঠেলে উঠব
.                   এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়োয়
দু-দিকের দুই সুড়ঙ্গ
.         শুধু  জুড়তে যা সময় |

মাঝগঙ্গায় আর একটু শুধু ফাঁক
.        বাড়ানো দু-হাত এক করতে পারলেই
.             ওপারে আমার মেজো মেয়েকে দেখে
.                টুক করে গিয়ে টুক করে
.                    চলে আসতে পারব

মেঝেয় সাদা কাগজ চিতিয়ে
.    রঙের বাক্ স খুলে বসেছে
.        আমার দুই নাতনি
.     তারা কী আঁকে না দেখে
.               আমি নড়ছি না |

কাল আমার ডানদিক দিয়ে
.          একদল মড়া নিয়ে গিয়েছে
.                  আজ ডান চোখ নাচছে
কিছু একটা ভালো না হয়ে যায় না |

কুড়ি  পেরিয়ে একুশে পা দেবে
আমাদের বড় আদরের এই শতাব্দী
.              আমি উনুনে চড়িয়েছি
.                     তার জন্মদিনের পায়েস

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিরা
.      বুকের বাঁ দরজায় যতই
.             ঠকঠক করুক

এমন মজার খেলাঘর ছেড়ে
দূর ! এখন কে যায় ?

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সখা হে
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

থামাও রথ,  কেশব !
দিয়েছ  আমায় তত্ত্বজ্ঞান যেসব
ফুরিয়ে গেছে
.           দিন তার !
নারকী এই কুরুক্ষেত্র ছেড়ে
চাই এবার
.             পায়ের নীচে মাটি

রাজ্যলোভ, রক্ত, কাটাকাটি
আর নয় |
নরোত্তম, তোমার হাত ধ’রে
ভুবন ভ’রে
দর্শন দিক
.      সমন্বয়,
.         সুখশান্তি,
.           যোগক্ষেম.
.               প্রেম |

কুরুক্ষেত্রে জন্ম নিক
সখা  হে,
আজ এই পুণ্যাহে
দুঃখহরণ চপলচরণ
হৃদয়-বৃন্দাবন |

থামাও রথ, কেশব !
আমার তুমি দিয়ে এসেছ
.              তত্ত্বজ্ঞান যেসব
ফুরিয়ে গেছে দিন তার |
পদ্মআঁখি ?
তাকিয়ে দেখো নতুন পথ
.               খুলে গিয়েছে চিন্তার |

সরিয়ে  ফেলে  পাঞ্চজন্য
ওষ্ঠে নাও বাঁশি
ফোটাও মুখে আবার ভুবন-
.            ভোলানো সেই হাসি,
.                 জীবন হোক ধন্য ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ধর্মের কল                
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ধর্মের কল” ( ১৯৯১ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।



বাসুদেব :
‘হে ধনঞ্জয় ! যারা রাজারাজড়া আর দৈত্যদানবদের হারিয়েছে, তাদের না দেখেও
আমি বেঁচে আছি | যে সাত্যকি আর প্রদ্যুম্ন ছিল তোমার প্রিয় শিষ্য, বৃষ্ণিবংশের
জাঁহাবাজ বীর,  এমন  কি  খোদ বাসুদেবেরও  প্রিয়পাত্র – তাদেরই দুর্নীতিতে
যদুকুলের এই ক্ষয় |’

সময়টা সুবিধের নয়
কিছু না ক’রে
যে পারে সেই হাতিয়ে নিচ্ছে
খোলা মঞ্চে
চোখের পর্দাটুকুও না ফেলে
বহুরূপীরা
ঘড়ি ঘড়ি নিজেদের রং বদলাচ্ছে
কার হাত,  কিসের হাততালি
কিসেরই বা জয়জোকার
মুখ দেখে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না  

শুনি নাকি রাত্রে
দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে যায়
এক ন্যাড়ামুন্ডি
কালো-কটাসে কালপুরুষ

আমি শুধু এইমাত্র দেখেছি
মর্গে
ময়না-তদন্তের জন্যে অপেক্ষা করছে
লাইনবন্দী লাশ

রাতদুপুরে গেরস্থের ঘরে ঢুকে
ধেড়ে ইঁদুরের দল
ঘুমন্ত মানুষের চুল ও নখ
কেটে নিয়ে যাচ্ছে

হাম্বাগুলো শোনাচ্ছে ঠিক হালুমের মতো
ছাগলেরা রপ্ত করেছে
হায়েনার হাসি

ঘোড়ার পেট থেকে বেরোচ্ছে গাধা
ভিক্ষের ঝুলি থেকে যক্ষের ধন
নামাবলীর ভেতর থেকে নেপালা

নগর-সঙ্কীর্তনে
এখন হরিবোলের জায়গায়
বলোহরির রমরমা

মা-লক্ষ্মীদের জন্যে কাটা হচ্ছে
লক্ষ্মণের গণ্ডি
তার বাইরে পা দিলেই রাক্ষসে ধরবে

‘ভো ভো, পুরবাসিনীরা |
দ্বারকায় এখুনি এসে পড়বেন তৃতীয়পাণ্ডব
মা ভৈঃ !  মা ভৈঃ !’

কে আসবে ? তৃতীয়পাণ্ডব !
ধ্যুস,
উনি  যে গাণ্ডীব তুলবেন,  সে ক্ষ্যামতাও তো ওঁর আর নেই |


ব্যাসদেব :
‘হে পার্থ ! সময় সহায় হলে সুবুদ্ধি,  তেজ,  অনাগত দর্শন---যা হওয়ার সবই হয় |
আবার অসময়ে সবই খোয়া যায় | কালই জগতের বীজস্বরূপ | কাল বলবান হয়েও
ক্ষমতা হারায়,  প্রভু হয়েও হয় পরের আজ্ঞাবহ |  তোমার অস্ত্র তার স্বস্থানে ফিরে
গেছে | এবার তুমি মহাপ্রস্থানে যাত্রা করো |’

সব একসা হয়ে আছে---
জঙ্গলের মধ্যে ঘর
আর ঘরের মধ্যে জঙ্গল

এক  গোলগাল  গৃহস্থের মাথার চালে
ঘাড় কাত করে আছে
ধর্মের কল

মনে রেখো,  বাপসকল
লাঠিকে তোল্লা দিলে নিশান হয়
নিশানকে ওল্টালে লাঠি

কেতুর জোরে কাজ না হলে
রাহু আছে
গিলতে

ফুটপাথ খড়ি পাতা
যারা হাত বার করতে ভয় পায়
টুক করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে
একটা চড়াই
তাদের ভাগ্য গণনা করে দিচ্ছে

যারা কথা বলতে জানে না
তারা ভাষণ দেয়
যারা কোনো কথা কানে তোলে না
তারা শোনে
যারা দেখতেই পায় না, তারা দেয়াল লেখে

যারা কুটো ভেঙে দুখানা করে না
তারাই কল টেপে
হাততোলা হলে নুলোরাও
হাজিরার খাতায় টিক মারে

বনবাসে এলোচুলে
দুঃখিনী মা আমার ! আমি আসছি
হাওয়ার উজানে বুক টান ক’রে
মাটিতে পা টিপে টিপে |

বড় বেশি গায়ে-পড়া হয়ে আছে
কাঁটাগাছের ডালগুলো
তার মানে,
অনেকদিন কেউ এ-পথ মাড়ায় নি

যে বাউলের মধু আনতে গিয়েছিল
তারা ফেরে নি
বনবিবিকে পুজো-দেওয়া তাদের ঘটপট
এখনও ছড়িয়ে রয়েছে

আমি ওসব পুজোপাঠের মধ্যে নেই
হাওয়ার উল্টোমুখ
শক্ত করে মাটিতে পা টিপে টিপে চলেছি

ধূর্ত বাঘ যেন
.        পেছন থেকে কিছুতেই
.             আমার গন্ধ টের না পায় ||

.            *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
যা, অন্ধকার
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“একবার বিদায় দে, মা” ( ১৯৯৫ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |


এরপর আর টুং-টাং নয়,
দুম্ দুম্ করে শব্দ হবে |
সঙ্গে যার টর্চ নেই সে জানবে না
.    দরজায় কড়া লাগানো আছে---
.                    যা, অন্ধকার |

ছেলেবেলায় দেশের গাঁয়ে---
.   দিন থাকতে খেয়েদেয়ে
.            রাতটাকে আমরা মুড়িয়ে রাখতাম
.                  চোখের পাতায় |

নাকের জলে চোখের জলে হয়ে
.    মা রাঁধতেন কাঠের জ্বালে
.           তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে |

ফুটপাথে বকুল গাছ
.     গ্যাস আর কেরোসিনের হাহাকরে
.            ভয়ে কাঠ হয়ে আছে |

এক অদৃশ্য জঙ্গল  এগিয়ে আসছে
.      শহরটাকে গিলতে
.        আমরা যে যার গর্তে
.                অন্ধকারের নজরবন্দী |

টিম  টিম  করে  জ্বলছে কুপি
.      কেউ পাঁচিল টপকালে যাতে দেখা যায় |

দরজা খুলে বেরিয়ে এসো রাস্তায়
শহরে আকাশ ফাটিয়ে বলো---
.                        অন্ধকার,  যা
.                        অন্ধকার,  যা
.                        অন্ধকার,  যা |

.                 *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
একবার বিদায় দে, মা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“একবার বিদায় দে, মা” ( ১৯৯৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা |



মরি মরি
.    পুজোয় পাওয়া নীলাম্বরী
.            উঠে তোমার গায়ে
.                 আকাশে যে কী সুন্দর
.                        দেখাচ্ছে মা তোমায়

কলাপাতায়  আলতা-সিঁদুর
.   পাড়ে  রেখে সুয্যিঠাকুর
.           ঝাঁপ  দেন  জলে

মার কপালে কাঁচপোকার টিপ
.    চাঁদ  হিংসেয় জ্বলে

খোকার হাতে ছিপ
.    জলের গায়ে ছবি
.           ক্ষীর নদীর কূলে ব’সে
.                 হাই তুলতে তুলতে খোকা
.                        দেখতে পাচ্ছে সবই

কোথাও কারো ভুলে
.    ছবি উঠল দুলে
.           ঢেউ হারাল খেই
.                  কোথাও কিচ্ছু নেই
.                         সমস্তই  ভোঁ  ভাঁ

চোখের পাতায় মুড়ে
.      ঘুমের মধ্যে মা তুমি দিয়েছিলে
.                 স্বপ্ন  হয়তো বা

ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে
.     মাছ নিয়ে গেল চিলে

মা,  তুমি জল পাঠাও মরা গাঙে ||



আলটপ্ কা  আশ্বিনের ঝড়ে
হঠাৎ সব
.    টালমাটাল

মাথার ওপর হাঁকাচম্ কা আকাশ ভেঙে পড়ে
মাঝদরিয়ায় মাঝি ছেড়েছে হাল

গ্রামগঞ্জ শহরবাজার মাঠময়দান দিয়ে
শন শন শন সাঁই সাঁই সাঁই
বাতাস ছেটে
.    আগুন মুখে নিয়ে

পায়ের নীচে বাসুকি নড়ে ওঠে

শাঁখ বাজছে শাঁখ
দূরে অদূরে ঘরেদুয়োরে
শাঁখ বাজছে শাঁখ
.    একের পর এক

কেবলি  থেকে  থেকে
আমার মা-র মতন করে
.    আমার নাম ধরে
.            কে  ডাকে  কে
.                   আকুল আর্তনাদে

আমি যে কী করি
বাঁচালে বাঁচান
মারলে মারেন  হরি
.          বলতেও  যে  বাধে

মনে  পড়ল  মায়ের  ডাকে
.     ক্ষুদিরাম তো
.                বলেনি মা যাই
গলায় দিয়ে ফাঁসি
বলেছিল
.  মা, আসি ||



বর্গাচাষীর  মুখের হাসি
.   মিলিয়ে যায়
.   বিঘে দুই ভুঁই ভাগ হতে ভাগ হতে
.         দুই বিঘতে
.                এসে ঠেকেছে প্রায়

যে না বলবে হাঁ-জী
সে দুশমন পাজি
দল বেঁধে তার ভিটেয় ঘুঘু চরাও
ধান পাকলে
.    ক্ষেতে হও সব চড়াও

হা  রে রে রে রে রে
রা  কাড়ছিস  কে রে

জোয়ানগুলো হন্যে হয়ে
ঘুরে  মরছে  কাজের জন্যে
.             কারখানাতে কুলুপ

লালদীঘিতে রঙের তুরুপ
পিটিয়ে নেয় সমস্ত পিঠ
মা,  জননী  ছেঁড়া  মেঘের
.             কাপড়ে  দেন গিঁট ||



নামিয়ে মুখ তাকিয়ে দেখি  এ কী
সামনে আমার স্বর্গীয় মা-র মতন অবিকল
দাঁড়িয়ে আছে  মাটিতে মা-সকল
লজ্জা ঢাকতে লজ্জা পাচ্ছে পরনে ছেঁড়া শাড়ি
চোখের কোলে জল থই থই
যতই চাইছে বাঁচতে ততই
ছেড়ে যাচ্ছে নাড়ি
শুকনো মুখ রুক্ষ চুল সর্বাঙ্গে খড়ি
দু-হাত করে খাঁ খাঁ
আঁচলে মোছা সিঁথির সিঁদুর
মাটিতে ভাঙা শাঁখা
মিথ্যে দেনমোহর সাতপাক
পোড়া কপালে বিধির মার পণ তালাক
.           তালাক  পণ  তালাক

হাতেপায়ে হাতাবেড়ি
বাঁদীকে কড়া নজরে রাখে চেড়ি

চোখের নীচে ক্ষিধেয় রাত জাগার ভুসোকালি
ঠোঁটের  কোণে রক্ত গড়ায় খালি
বুকে পিঠে
দগদগে কালশিটে
সারাটা গায়ে আঁচড়ানো কামড়ানো

মাথায় তোলা দৈত্যদানো
পরোয়া করে থোড়াই
মুখোশ খুলে আজ তারাই রাজাউজিরকোটালকে দাঁড়
করায় কাঠগড়ায়
পাবে না কেউ ছাড়
কাউকে নেই ক্ষমা

কারো জননী কারো কন্যা কারো বা প্রিয়তমা
কানে আঙুল দিলেই শোনে সমস্ত ক্ষণ
রাবণের সেই চিতায়
জ্বলছে চরম অপমানের আগুন ধিকি ধিকি

মা, তুমি দেখোনি কি
দুঃখশোক বাষ্প হয়ে কীভাবে চোখ ফোটায়
সাগর থেকে
কেমন করে আকাশে মেঘ ওঠায় ||



আমার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে | কাকে বলি? লেখক তার মনের
কথা সহৃদয় পাঠক ছাড়া আর কাকেই বা বলবে ?  যে লোকটা সারা
জীবন ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে এসেছে,  এমন দিন আসে যখন ফুল
কুড়োতে কুড়োতে তার হাঁফ ধরে | মালা গাঁথবে কী, ছুঁচে সুতো পরাতে
গিয়ে হিমসিম খায় | তখন পাঠকই তার অন্ধের যষ্টি | সে চায় পাঠক
এসে তার হাত ধরুক | সব কিছু তুলে বেছে নিজের মতন করে সাজিয়ে
নিক | থুড়ি, কবির হাত নয়— কবিতার হাত | শুধু নিজ গুণে সাজিয়ে
নেওয়া নয়, এমন কিছু করা যাতে কথায় কাজ হয়, কবির সাধ মেটে |
কবির সঙ্গে পাঠকের পিঠোপিঠি সম্পর্ক | তাকে সামনাসামনি আনা যায়
না জেনেও সেই অসম্ভবের পায়েই আজ আমি মাথা কুটে মরছি ||



হেলিকপ্টার হেলিকপ্টার
বিকট শব্দে উড়ে যাচ্ছে
মেঘের গা ফুঁড়ে

রঙিন স্বপ্ন দেখছেন কে
গদিতে হেলান দিয়ে
শেষ অঙ্কের পর্দা পড়বে
মাটিতে পা পড়ে না তবু গর্বে
নীচে তাকালে জল থই থই বন্যা
ক্ষেত জ্বলছে খরায়
চুনি কোটালের মা দাঁড়িয়ে
নেহারবানুর কন্যা
সারি সারি বন্দুকধারী
সেলাম দেয় বুলেটপ্রুফ গাড়ি
হেলিকপ্টার পায়ের ধুলো
দিল যখন দীঘায়

জানো কি মা, ঠিক তখনই বাউলগুলো
দুয়োরে এসে কী গায়—



একবার বিদায় দে মা ব’লে
ঘুরে আসা নয়
ঘুরে দাঁড়ানোর
দিন এসেছে এবার

বিদায় নেবার দিন গিয়েছে
দিন এসেছে
.          বিদায় করার

অন্ধকার থেকে আলোয়
নিয়ে যাবে ঠিক
ঐ তো সামনে সব-পেয়েছির চুড়ো
মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল
সিন্দবাদ নাবিকের সেই বুড়ো

গলায় তার সাঁড়াশি পা
নামে না ? কী জ্বালা
সবার হাতে হাত মিলিয়ে
নামিয়ে দিয়ে বুড়োকে ঘাড় ধরে
শুরু হচ্ছে নতুন করে
দিনবদলের পালা ||

.         *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
যত দূরেই যাই
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“যত দূরেই যাই” ( ১৯৬২ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা |


আমি যত দূরেই যাই
.            আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালা-গাঁথা
এক নদীর নাম---

আমি যত দূরেই যাই |

আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোনে
সারি সারি
.           লক্ষ্মীর পা

আমি যত দূরেই যাই ||

.         *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ছেলে গেছে বনে
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ছেলে আছে বনে” ( ১৯৭২ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা |
( সুগত মৈত্র-কে )



রাম তো গেলেন বনে
দশরথ বাপ
দুঃখ যা পেলেন মনে
ছ’ রাত্রেই সাফ

ভাবতেও আশ্চর্য লাগে,  এই কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সাতকাণ্ড বানিয়ে
কী করে গেলেন তরে কঠিন এ সংসারে বাল্মীকি !
আমি যদি লিখি,
নিয়তিকে করতে আজ্ঞাবহ,
মিথ্যে অন্ধ মুনিকে টানব না |
লেখা বলতে, মনে পড়ল, ছিল বটে একদা বাসনা
লেখক হবার
শব্দবেধে ছিল দুরাগ্রহ
( তখন তো আমারও কৌমার ! )

রাম  রাম,  এ ছি !
মার্জনা করবেন, প্রভু, অধীনের এ অবিমৃশ্যতা |
শব্দবেধ--- এই কথা
নিতান্তই মুখ ফসকে বলেছি |

জল ভরবার শব্দে বাণ ছুঁড়ে আমি নই ভুলক্রমে খুনী ;
আমাকে দেয় নি শাপ
শোকগ্রস্ত কোনো অন্ধ মুনি |

বুক খুলে দেখাই না লোক ডেকে ডেকে চোখের জলছাপ |
আমি নই স্ত্রীর বশ
ইক্ষাকু বংশের সেই ভগ্নস্নায়ু দ্বিধাদীর্ণ মেনিমুখো রাজা |
মুখ বুঁজে সগৌরবে আমি বই কালের এ সাজা |

আমার যখন এল বানপ্রস্থে যাওয়ার বয়স—
ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে
ছেলে গেছে বনে |
আমি তবু পদাতিক ; হাতে বাজছে রণবাদ্য দ্রিমিক দ্রিমিক—

কাছে এসো রত্নাকর, দূর হটো বাল্মীকি ||



কপালে মিন মিন করছে ঘাম |
সময় দাঁড়িয়ে আছে
মাথার ওপর তার ছিঁড়ে
যেন বন্ধ ট্রাম |

ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে
মুক্তির লড়াই লড়বে বলে
ছেলে গেছে বনে |
পাশের টেবিলে একটা লোক
একেবারে টুপভুজঙ্গ |
সোডার বোতলে আমি ঠিক রাখছি চোখ,
কিছুতেই মাত্রা ছাড়াব না |
পুরনো স্মৃতির সঙ্গ
নেব আজ ঝেড়ে ফেলে সব দুর্ভাবনা |

নাও যদি মেলে গাড়ি—
কাগজের নৌকো ঠেলে
জুতো হাতে হেঁটে যাব বাড়ি |

ঝরাতে ঝরাতে যাব সারা রাস্তা মাঠের শিশির,
বড় বড় ঠেউ তুলে যতই দেখাক ভয়
পাড়-ভাঙা নদী
ফিরে পেতে চাই সেই বাল্যের বিস্ময়,
যে-রোমাঞ্চ অন্ধকারে যেতে হাতে-ঝোলানো লন্ঠনে |

ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে
ছেলে গেছে বনে |

পাবে না জেনেও কাল রাত-দুপুরে বন্দুক উঁচিয়ে
দু-গাড়ি পুলিশ
সারা বাড়ি খুঁজে গেল তন্ন তন্ন করে |
পেরিয়ে চল্লিশ
যে আগুন প্রায় নিবন্ত, ওরা তার তুলছে আঁচ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে |

এখনও মিছিল গেলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াই রাস্তায়
যে কোনো সভায় গিয়ে শুনি
কে কী বলে |
কেউ কিছু ভালো করলে দিই তাতে সায় |
সংসারে ডুবেছি, তাই জ্বালাই না ধুনি |

ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে
ছেলে গেছে বনে |
অথচ তারই হাতে দেখছি মুক্তপাখা
যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত
আমারই পতাকা ||

.         *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
কাল মধুমাস
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“কাল মধুমাস” ( ১৯৬৬ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |


বার বার ফিরে আসা নয় |
পারাপার
নয় |

শুধু যাওয়া |

এখন কথাটা হল,
কখন কী ভাবে
যাবে---
আকাশের কেমন আবহাওয়া |

মনে  রেখো,
এ নদীতে একবার
শুধুই  একবার
একটি মাত্র খেপ |

তা নিয়ে আক্ষেপ
করবার
পাত্রই  আমি নই |

একবার
একবারই সই |
কথাটা, কী ভাবে
যাবে----
ক্ষণে ক্ষণে
মরতে মরতে ?
না কি বেঁচে
নেচে নেচে
ঢেউয়ের  মাথায় ?

হালে পানি, পালে হাওয়া
না লাগে লাগুক---
কী আনন্দ, কী সুখ

যায় দিন, যায় ||



যদিও আবাল্য চোখে দেখে আসছি কম
ইদানীং ডান কানে
ইস্ ,
একমাত্র শুনছি না---
দ্রোণাচার্য তুচ্ছজ্ঞানে
নেন নি ভাগ্যিস
বাল্যে বুড়ো-আঙুল দক্ষিণা |

পারলে তাই দেখাতে ভুলি না
যখন যেখানে যাকে
দেখানো দরকার |

যৌবন বিদায় নিয়ে
এতক্ষণে পৌঁছে গেছে যেখানে যাবার |
মিষ্টি হেসে
হাত নেড়ে তাকে বলেছিলেম, বিদায়!
মেয়েলি ঈর্ষায়
প্রৌঢ়ত্বও করছে যাব-যাব |
এবার তাই ঠিক করেছি, যাবার সময়
দুহাতে লাল-নীল দুটো রুমাল ওড়াব |
তারপর টুকটুক করে বাড়ি ফিরব শনৈঃ শনৈঃ
সময় তো জানই---
নয় ব্যাকরণের অব্যয় |
যখন যে পদে থাকে
সেইমতো আকার |
সময়ের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধ পাতাই
ছোট, বড়,  গোল,  চৌকো নানান মাপের |
সময়টা এক নয়—
এর  ওর  তার |
তোমার সময় দিয়ে তাই
বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার |

তুমি বসে কাজ করো |

আমি উঠি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কোথায় আকাশটা খুব বড় |
দেখে আসি পড়ো-পড়ো
কোথায় কখন কোন্ খুঁটি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কী বীজ বুনছে মাঠে চাষী |

তুমি কাজ করো |

আমি কিন্তু
যখনকার কাজ ঠিক তখন না করে---
দাঁড়াব রাস্তার মোড়ে ;
যেখানে বিস্তর লোক একেবারে পৃথক কারণে
এক স্থানে এক কালে জড়ো |
সেখানে আমিই একা অহেতুক ;
ভেবে দেখব মনে মনে
জীবনের এ আবার কোন এক রহস্যকৌতুক !

খুব জোর বৃষ্টি আসছে ;
আকাশ মিশকালো |
আলো জ্বালো ;
জানলা-দরজা দাও বন্ধ করে |
বন্দ শার্সিটার গায়ে
বুনে নাও এই বেলা
খালি হাতে
যত ইচ্ছে আকাশকুসুম |

আমি যাই |
আজ বছরের এই প্রথম মরশুম
গায়ে এসে বিঁধবে যেন বর্শার ফলক
আকাশটা দুখানা করবে
বিদ্যুৎ ঝলক |
নেব না বর্ষাতি কিংবা ছাতা |

আমার স্বভাব নয়, তাই
বাঁচাই না মাথা
----রোদে না, জলে না |

যাই
কিছুক্ষণ গিয়ে বসি
যে-পুকুরে মাছগুলো
জলের গভীরে দিচ্ছে ঘাই |
ফাৎনায় বেঁধানো থাকবে চোখ
পাশে বসে থাকবে হয়তো বুড়োমতো লোক---
পরক্ষণে মনে হবে, আরে রাম রাম
লোকটা তো আমারই বয়সী |

ঘেঁষটে ঘেঁষটে যাচ্ছে ট্রাম |
আমাদের গলি দিয়ে যাওয়া এক
বিকলাঙ্গ ভিখিরির মতো
দুর্বিষহ মর্মন্ত্তদ কর্কশ আওয়াজ |

বিকেলে মিছিল থাকলে আজ
ছোকরাদের সঙ্গে যাব পাল্লা দিয়ে হেঁটে
সারিবদ্ধ দুটো হাত দোলাতে দোলাতে |
পরদিন পড়ে নেব,  এই যুক্তি এঁটে---
সভায় যা বলা হবে না-শুনে সাক্ষাতে
দল বেঁধে দোকানে চা খাব |

আর যদি সেইসঙ্গে ভাগ্যে যায় জুটে
তবে বাড়ি-গাড়িও হাঁকাব |

ততদিন ঘুরে ঘুরে এ-ফুটে ও-ফুটে
এর ওর তার সঙ্গে
জমাব আলাপ |
হেসে  বলব : কী খবর ? কেমন আছেন ?
হাতে খুঁজব হাতের উত্তাপ |

কে হে লোকটা ? এক হাতে বোঁটাসুদ্ধ চুন,
অন্য হাতে কোঁচা ?
যেতে যেতে দিয়ে গেল খোঁচা ?
‘কী মশাই,  লিখছেন না কেন ?
লিখুন ! লিখুন !’

লোকটার বরাত ভালো ;
চলে গেল |
নইলে ও নির্ঘাৎ হত খুন ||



চলেছে রাত্রের ট্রেন
বাইরে নিকষ অন্ধকার |

জানালা টপকে ছুটে আসে উল্টোমুখে
আলোয় কিম্ভূতকিমাকার
মূর্তি সব |
সারা কামরা নিস্তব্ধ নিঝুম |

জেগে একা বসে আছে শিশু---
চোখে নেই  ঘুম |
সমানে চলেছে বাইরে
পৈশাচিক  কী এক উত্সব |
ডাকলে কেউ উঠবে না সে জানে----
দাদা দিদি কাকা বাবা সব পিপুফিশু |

সে জানে না কোথায় চলেছে
মনে সে যা নিয়েছিল এঁচে
মিলছে না কিছুই |


এই অন্ধকার তার ছিল না হিসেবে
স্বপ্নে তার ছিল না স্তব্ধতা |
এই ভয়ংকর ভয়
ডেকে তুলে কাকেই বা দেবে |

শেষ রাত আন্দাজ
হঠাৎ সবাইকে ডেকে তুলে দিল
শূন্যতা ভরাট করা
গুম গুম আওয়াজ |
মা বললেন : দ্যাখ্ দ্যাখ, পদ্মা ঐ দূরে---
সাড়া ব্রিজ এই |
আমরা জয় মা কালী বলে
দিলাম সজোরে পয়সা ছুঁড়ে
যে তিমির
সেই তিমিরেই |

তারপর সেই শিশু আবার ঘুমুল |
স্বপ্নে দেখল :  ছাদের যেখানে চাঁদ থাকে
তার পাশে ফণিমনসার টবটাতে
বসে আছে ফের সেই হুলো |

মাকে যেই সে ডাকতে যাবে
মা তার আগেই
ডেকে তাকে ট্রাঙ্কটা খুললেন ---

ট্রাঙ্ক থেকে কী বেরুল বলো |

দুটো তুবড়ি আর দুটো লাল-নীল দেশলাই |
তখন অনেক রাত,
পাড়াসুদ্ধু বাড়িসুদ্ধু  ঘুমোচ্ছে সবাই |

তারপর কী যে মজা হল ||



সেও এক ব্রিজ-ই
ওপরে টমটম যায় গুড়-গুড় গুড়-গুড়,
নীচে চাও যদি---
হিজিবিজি  হিজিবিজি
নদী নৌকো নদী নৌকো নদী |

নাম নওগাঁ ;
অজ মফস্বলে এক নগণ্য শহর |
বৃষ্টিপাত বেশ ক-ইঞ্চি বেশি,
নেহাত নগণ্য নয়
সেখানকার শীতের বহর |

দু-পাশের রেনট্রি গাছে ছায়ায় ছায়ায়
দিগন্তের কোন্ অন্তরালে
জানতাম না কোথায় রাস্তা যায়--

কোন্ সে দুবলহাটি, দিঘাপতিয়াই বা কোথায় ?
রান্নাঘরে জানলা দিয়ে দেখা যেত দূরের রাস্তায়
গলায় দুলিয়ে ঘন্টা হাতি,
দুল্ কি চালে কখনও বা উট |
দৈনিক সকালে ঠিক কাঁটায় কাঁটায়
রানারের ছুট |

বাইরে বোতামফুল বেল জুঁই, ব্যস্—
ভেতরের ছোট্ট উঠোনে
তুলসীমঞ্চ কাঠগোলাপ হাস্নাহানা দোপাটি টগর
করবী  মোরগঝুঁটি ফুল ; তিনটে হাঁস ;
পেঁয়াজ, উচ্ছের মাচা ; লক্ষ্মীগাই  থাকত এক কোণে---
দুধ দিলে ডিম পাড়লে যা হত রগড় |
শীতকালে সার্কাস আসত ;
ইস্কুলের মাঠে পড়ত তাঁবু |
কী মুশকিলে পড়তেন যে হারাধনবাবু---
কাছে হবে মনে ক’রে
ছোট্ট তিনফুট উঁচু ঢিবিটায় উঠে তিনি রোজ
আকাশের তারা দেখে দেখে
খাতা ভরে কী সব টুকতেন |
সেই ঢিবি একদিন সার্কাসের তাঁবু দিত ঢেকে |

কুড়কুড় কুড়কুড় ক’রে বাজনার বোলে

ঘোড়ার গাড়িটা যেত লাল নীল সবুজ হলুদ
কত কী সুখের পায়রা ওড়াতে ওড়াতে |
আমরা এইটুকুটুকু আধভাঙা খুদ
স্বেচ্ছায় দিতাম ধরা তাদের কবলে |
সারাদিন আমাদের মহানন্দে খুঁটে খুঁটে খেত----

শেষের সপ্তাহে রোজ অদ্য-শেষ-রজনী বুঝিয়ে
সারাটা শহর কানা করে দিয়ে
জানি না কোথায় উড়ে যেত |

পাশের বাড়িতে থাকত আমার যে-বন্ধু, তার এক ছিলেন পিসিমা---
তিনি এলে ঘরে বসত মা-মাসিদের আসর
ঝুলিতে গল্পের তাঁর ছিল নাকো সীমা পরিসীমা
জিভে তাঁর কিছুই বাধত না |
কোন্ এক জেলার কোন্ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব
কবে কোন্ ট্রেনের কামরায়—
রসসিক্ত হয়ে উঠত বক্তার রসনা
---- মেমকে আদর করে বসালেন কোলে |
ছোটদের শুনতে নেই--- কী হল তারপর
শুনেছি | কারণ, তাতে বিস্কুট ছিল ব’লে |
কামরায় আর যারা ছিল কচর মচর
খেতে লাগল সাহেবের টিন থেকে দামি দামি বিলিতি বিস্কুট
ছোটদের দুর্বোধ্য ছিল
মধ্যে মধ্যে থাকত যা ব্যাসকূট |

বলতে বলতে হঠাৎ তিনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে
চিত্পাত হলেন তক্তপোশের ওপর
মা কালী করতেন তাঁকে ভর |
না থেমে গড়গড় করে যা বলতেন তিনি
শুনে সারা গায়ে দিত কাঁটা—

নরকের যত সব ডাকিনী প্রেতিনী
তাঁকে দিচ্ছে সাজা,
বেঁধাচ্ছে গরম লোহা,  উপ্ ড়ে নিচ্ছে চোখ
তেলের কড়াইতে করছে ভাজা---

তাঁর বর্ণনার কাছে
এখনকার পাপবিদ্ধ কবিতা কিছু না |
মনে মনে ওঁর জন্যে ঠাকুরকে ডাকতাম :
হে ঠাকুর, কেন ওঁকে শান্তি দাও না ? কেন ওঁকে কর না করুণা !
সকালে শীতের ভোরে তারের বেড়ায়
ঝুলে ঝুলে থাকত যেন নাকের নোলক |
বিকেল বেলায়
সূর্য ডুবে গেলে করত কী মন কেমন |

ছিল একটা খেলনার ঢোলক
ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলতাম চত্বরে |
কখনও কখনও খুব নরম হাত ধরে
কোনো কিছু না ভেবেই হয়তো বলতাম :
তোর এই আয়মন নাম,
নামের মানেটা কী রে ? আয় মন, আয় মন, নাকি ?
বাঃ, কী সুন্দর গন্ধ,
হাতে বুঝি মেহেদির রং ?

চড়কের আগে আসত সং---
কাছের গ্রামের এক বহুরূপী ; বছরে একবার |
মেসবাড়িতে তার চেয়েও আসত লোক হরেক রকম |
এক আসত শীল্ডে খেলতে নানা জায়গাকার
নামী নামী অনেক প্লেয়ার |
তাদের পা টিপতে গিয়ে আমাদের নিক্ লে যেত দম |

এক এসেছিল শিল্প-প্রদর্শনী নিয়ে
সরকারের লোক এক ; তারই টেবিলে
কাঁচের কাগজচাপা দেখে
জীবনে প্রথম সেই কী-যে হয়েছিলাম স্তম্ভিত !
এজন্যে নয় যে, সেটা কাঁচ |
আসলে কাগজচাপা বসে ছিল দিব্যি সেই কাঁচের মধ্যে গিলে
শ্যামপত্রশোভাসমন্বিত
সম্পূর্ণ একটি গাছ |

আর এসেছিল
বন্যার্ত অঞ্চল থেকে হাতি চড়ে
এক জমিদার, তার দলবলসহ |
সন্ধেবেলা তার ঘরে
বইত রোজ ফুর্তির ফোয়ারা |
দরজায় পর্দা থাকত,
কালোয়াতি গানের গমক,
ঘুঙুরের বোল আর অদৃশ্য ঠমক
উপ্ চে পড়ত মাঝে মাঝে বাইরের মাঠে |

বন্যা নেমে যাওয়ার ঠিক মুখে---
গিন্নি-মা উঠলেন খাটে
সিঁদুর-চন্দনে রাজরাজেশ্বরী সেজে
কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আহাম্মক ঝিটাই---

মা, তোমার গৌরবর্ণ নীল হল কিসে !

‘কিসে’ শুনতে লোকে নাকি শুনেছিল ‘বিষে’---
সেই দোষে ঝি হল ছাঁটাই |
ব্যাপারটা সকলেরই নাকি জানা
কিছুই জানি নি আমরা কী বৃত্তান্ত---
ছোটদের জানবারও কথা না |

খেতালচাষীরা আসত পাট্টা নিতে ;
তখন সামনের মাঠে পা ফেলা যেত না |
ঘটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে জল দিতাম আমি আর দাদা |
শুধু শুকনো ঐটুকু পানিতে
কী করে যে মিলে যায় খোদাতালার এত দোয়া |
--- সেটা ছিল ধাঁধা |
কিছুতে নিতাম না হাতে গুঁজে দিলে কেউ লজেঞ্চুস |

আবগারি-দারোগা হয়ে বাবার যে নামডাক এক—
দাদা বলত, কী জন্যে বল্ তো ?
কারণ, নেনে না বাবা ঘুষ |
জল দিয়ে লজেঞ্চুস
এক রকম ঘুষ |

কাঁথিতে কোথাও কোনো সমুদ্রের ধারে
নুন তৈরি করতে গিয়ে পুলিশের বুটের কাঁটায়
ঝাঁঝরা হয়েছিল যার পিঠ---
সে এল স্ট্রেচারে |

সমস্ত শহর ক্ষুব্ধ ; ফেটে পড়ছি রাগে
আমরা সবাই |
মাঝে মাঝে হাঁক উঠছে : জোর্ সে বলো, ভাই---
বন্দে  মাতরম্ |
সারাটা শহর করছে থমথম |
গুপ্তকক্ষে বসে বসে নিজের অস্থিতে
বজ্র যেন বানাচ্ছে দধীচি |
এমন সময়
হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি যাই পাতাল তলিয়ে---
ভিড়ের ভেতর থেকে ও  কে বলল : ছি, ছি,
তোর বাপ সরকারি চাকুরে !

সন্ধেবেলা একদিন বাপু রে,
মহকুমা হাকিমের কুঠিতে কী ভিড়---
রেডিও শোনাবে এস্-ডি-ওর জামাই |
সকলেই আমন্ত্রিত :
এসেছে সবাই |
মাস্টার, মুনসেফ, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, উকিল, মোক্তার
সিভিল সার্জেন, সোডাকলের মালিক,
থানার দারোগা, সাব-রেজিস্ট্রার, পশুর ডাক্তার---
সবাই এলেন |
একে এস্ –ডি-ওর জামাই
তদুপরি শোনাবে রেডিও |
সুতরাং সবাই হাজির
শহরের মশামাছিটিও |

এদিকে সময় যায় বয়ে |
তার-আলো আলো-তার, এ-কল, সে-কল
এ ছুঁই, তা ছুঁই---
গলদ্ ঘর্ম এস্ –ডি-ওর জামাই বেচারি :
হয় নাকো কিছুতে কিছুই |
শেষকালে শব্দ এল অবিকল
--- হ্যাঁ,  হ্যাঁ, একেবারে অবিকল---
কী কাণ্ড, সামনে ডাকছে একগাদা কুকুর-বেড়াল |
এস্-ডি-ওর থোঁতা মুখ ভোঁতা হতে দেখে
একদল কী খুশী !
এস্-ডি-ওর বরাবরে উকিলরা দিল
সরকারকে দুয়ো |
আরেকজন বলল,  ঐ  জামাতাটি ভুষি |
শেষের দলটি বলল, এ থেকেই বোঝা যায়
রেডিও ব্যাপারটাই ভুয়ো |
বাঁ-দিকে মার্জিন-টানা বালির কাগজ,
গঁদের আঠার শিশি, চাবি আর তালা
লাল-হলদে সুতোর বাণ্ডিল,
শিলমোহর, গালা
---এই নিয়ে ছিল
বাবার টেবিল |

আর ছিল পেন্সিল কাটার একটা ছুড়ি

একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি
হৈ হৈ ব্যাপার |
পেন্সিল কাটার সেই ছুড়ি হাতে, এ কী---

উঠোনে দাঁড়িয়ে মেজো খুড়ি |
বাবার মতলব ছিল নাকি
নিজের গলায় বসাবার |
খাটো করে গলা
‘ওতে কি পেন্সিল ছাড়া’ যেই বলা
আর যায় কোথা !
প্রচণ্ড ধমক অমনি : বড্ড হচ্ছ পাকা |

দিদির শাশুড়ি নাকি লিখেছেন  যা  তা
দেনাপাওনা এখনও ঢের বাকি |
অথচ দেনার দায়ে
বাবার বিকিয়ে আছে মাথা |

এদিকে চালের দাম উঠেছে আট টাকা |

লোকে বলছে
লাগল বলে আবার লড়াই ||



লিখি নি,  ভাগ্যিস !

মা বলতেন : শুনে নে, লিখিস্ ---
পালকি এসে পৌঁছুল দেউড়িতে
সে পেয়েছে শিবতুল্য বর
বুকের ভেতরে করে আনা
আশা তার মেলে দেবে ডানা---

আলো এল, ঘোমটাও সরাল
কে  যেন ককিয়ে উঠল : কালো !
দাঁতে  দাঁতে  কড়মড় কড়মড় |
সেই  থেকে  সে রাক্ষসপুরীতে |

ভাগ্যিস, লিখি নি |

নইলে শিব গড়তে গিয়ে
হয়ে যেত নিশ্চয় বাঁদর |

মাকে মনে পড়ে |
মা আমাকে বলতেন বাঁদর |

কিন্তু তবু যখনই বৃষ্টিতে ঝড়ে
.        চমকাত বিদ্যুৎ
পাশে এসে মা বলতেন হেঁকে
.                 জয়মণি ! স্থির হও |

যে-মন্ত্রে ঘেঁষে না কাছে ভূত
সে-মন্ত্র তো মার কাছেই শেখা |

আজ তাই শ্মশানে মশানে
কৃষ্ণপক্ষে ভয়ংকর যে-কোনো জায়গায়
যেতে পারি একা |

জলে কিংবা ঝড়ে
এখনও মেঘের দিকে যখনই তাকাই
মনে পড়ে মাকে |

কেন মনে পড়ে ?
মা ছিলেন মেঘবর্ণ |
শুধুই কি তাই ?



দুয়ে আর দুয়ে আপনি ঠিক বলছেন চার ?

দেখুন, আমার একটা কুষ্ঠির দরকার |
ভবষ্যৎটা একটু ভালো করে
জেনে নিতে চাই |
যা যা জানি বলে যাচ্ছি
আপনি তো গণক---
ফাঁকগুলো নিজগুণে ভরে
বানিয়ে দিন না একটা ছক !

প্রথম যুদ্ধের ঠিক পরে |
কত সাল
সেইটাই  তো জানি না |

বার বুধ |
ভুলি নি, কারণ---
মা বলতেন : বুধবারে নখ কাটা
আমার বারণ !

রাশিটা বিচারাধীন |
আপনি রায় দিলে
তবেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে রাশি |
দিদি বলেছিলেন একবার---
যতদূর মনে পড়ছে মীন |
হতেও বা পারে
যে রকম মাছ ভালোবাসি !

মাঘের সংক্রান্তি তিথি |
অকাট্য নির্ভুল |
আরেকটু বলি |
তারপর ইতি |
কী করে জানি  না---
আমার মনের মধ্যে জন্মগত ছবি একটা আছে,
একেবারে শীতের শেষদিন |
পাতা নেই গাছে |
দুটি ঠোঁট শব্দ তুলে অন্য দুটি ঠোঁটে
বলে ওঠে :
‘মনে নেই ? কাল মধুমাস’ !

বলেছিল আর কেউ,  আমার মা নন |

বললাম তো কারণ---
মা তখন আমাকে নিয়ে যন্ত্রণায় নীল ||

.         *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
জল সইতে
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“জল সইতে” ( ১৯৮১ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |



দেখে যাতে তোমাদের কষ্ট না হয়
চোখে যাতে ভালো লাগে

তার জন্যে

আমার বুকে-বেঁধানো সমস্ত কাঁটায়
আমি গুঁজে দিয়েছি
একটি করে ফুল---

তোমরা হাসো |

শুনে যাতে তোমাদের দুঃখ না হয়,
কানে যাতে ভালো ঠেকে

তার জন্যে

আমার বুক-ভাসানো সমস্ত কান্নায়
আমি জুড়ে দিয়েছি
একটি করে সুর---

.        তোমরা হাসো গো,
.        আনন্দ করো |

আগুনে তো অনেক পুড়েছি
এবার যাব জল সইতে |

নঙর তুলে ফেলেছি
গাঙ থেকে দরিয়ার দিকে
ফেরানো আছে
আমার গলুইয়ের মুখ |

তোমরা এবার
আমার মনপবনের নাওটাকে
পায়ের ডগা দিয়ে একটু ঠেলে দিলেই
হৈ হৈ করে পালে বাতাস লাগবে ||



চালের বাতায় গুঁজে রেখে এসেছি
গাজীর পট

শিকের ওপর তোলা রইল
গুপীযন্ত্র

কালের হাত সেখানে পোঁছুতে না পৌঁছুতে
আমি ফিরে আসব |

সঙ্গে নিয়েছি চালচিঁড়ে
হুঁকোতামাক
আর মাছ ধরার জাল

আপাতত ওতেই চলুক |

ফুলছে ফুঁসছে ঢেউ---

একবার তুলছে মাথায়
একবার ফেলছে পায়ে |

.          ও মাঝির পো,
.          দরিয়া আর কতদূর ?

.          ঘর-বার সমান রে বন্ধু
.          আমার ঘর-বার সমান
.          পায়ের নীচে একটুকু মাটি
.          পেলাম না তার সন্ধান
.          আমার সেই পোষা পাখি
.          আকাশের নীল রঙে আঁকি
.          যত্নে বুকে করে রাখি

.          তবু কেন সে করে আনচান
.          আমার ঘর-বার সমান



দিন আসে রাত আসে এইভাবেই যায়
দিন আসে রাত আসে এইবাবেই যায়

.           জল সইতে যাই
.           একবার এ-চরে
.           একবার ও-চরে |

একটু করে ঘটে ভরি
আর কাপড়ের খুঁটে গেরো দিই |

পিটুলিতে-গড়া সুখসোহাগের ছিরিছাঁদে
সব-পেয়েছির নয়
সবাই-পেয়েছির দেশ গো !

মোহনার ঠিক মুখে
বিদ্যুতের বাঘনখে
আশমানে চেরাই হচ্ছে যখন আবলুশ কাঠ
ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে যখন তারার দল

ঠিক তখনই ধেয়ে এল বান ---

.        ও মাঝির পো,
.        ভাটি ছেড়ে নাও কি যায়
.        উজানে ?
.        তবে তাই সই
.        দরিয়া থেকে গাঙে ফিরে
.        এবার পট নাচিয়ে
.         চৌদুনে
,        কি রকম চব্বর বাধিয়ে দিই দেখো ||

.             *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর