সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
যা রে কাগজের নৌকো
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“যারে কাগজের নৌকো” ( ১৯৮৯ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |


বদর, বদর ব’লে,  ও  ভাই
নোঙর নিই তুলে
যা  রে কাগজের নৌকো
হাওয়ায় হেলে দুলে

ক্ষীরনদীর কূলে নয়
কলুটোলার বাগে
ঢোলসমুদ্র রাস্তা রোখে
দমকলের আগে

মা-কালী  কলকাত্তাওয়ালি
ঠন্ ঠনের মোড়ে
জলে ডুবুক যে ঠোঁটকাটা
কলকাতাকে খোঁড়ে

বাজার বন্ধ, ট্রাম-বাস বন্ধ
পরোয়া নেই কিছুরই
এই বাদলায় জমবে ভালো
মুসুরডালের খিচুড়ি

.        যা রে কাগজের নৌকো

সর্বনাশী এলোকেশী
চিলেকোঠার মাথায়
আলটাক্ রায় শব্দ ক’রে
বিষম ভয় দেখায়

মেঘের গায়ে গা ঢেকে
কোন গুণিন, হা রে
আঙুল মট্ কায় চোখ মচ্ কে
.        জল পড়ে আর

.        থেকে থেকে
.           বান মারে

.        যা রে কাগজের নৌকো

টেলিগ্রাফের তারে ঝোলে
ছেঁড়া ঘুড়ি
হাঁটুজলে পা ডুবিয়ে
গাছের গুঁড়ি

আজ বাদে কাল
বিশ্বকর্মা
বৈঠকখানায়
.  পৌঁছয় ফর্মা

দালানকোঠা
বন্ধ ঝাঁপ
জলছবিতে
উল্টো ছাপ
কাগের ঠ্যাং আর
বগের ঠ্যাং
লিখে দিয়েছি---
ড্যাডাং ড্যাং

.        যা কাগজের নৌকো



টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর
বাজছে কারও পায়ের নূপুর

ও আমার বোন মেঘ্ রাণী
হাত-পা ধুয়ে ফেলায় পানি

কলের সিঁড়ি চ’ড়ে
তাকে আন আদর ক’রে              

.        যা কাগজের নৌকো



পড়ে  না কিছু মনে---

সেই যে কবে ঢেউয়ের দোলায়
সাগরমন্থনে
জলের বুকে জন্মেছিল
জীবন স্পন্দমান

.        বহুযুগের ওপার থেকে আষাঢ় এল নেমে

আজও কি তাই ঋতুমতীর
তরঙ্গময় অঙ্গে
চন্দ্রকলার
অমোঘ সেই টান ?

.        ও আমার চাঁদের আলো

মনে পড়ে না,  মনে পড়ে না
মনে পড়ে না কিছু
যতই কেন ছুটে বেড়াই
হারানো সব দিনের পিছু পিছু

যখন  আমি জন্ম নেব বলে
জল ভাঙছি,  জল  ভাঙছি ,
জল ভাঙছি, জল

মা নিদারুণ ব্যাথায় তখন
ক্লিষ্ট

মনে পড়ে না কেমন ক’রে       
ল্যাজ খসিয়ে
হেঁটমুণ্ডে
হয়েছিলাম কী কুস্বরে
এই আমি ভূমিষ্ঠ

.        গভীর কোন্ অন্ধকার হয়েছ তুমি পার

বনগাঁবাসী মাসিপিসি
আজ ষেটেরা
খুত্কুড়ি দাও ছেলের বুকে
নজর না দেয় হিংসুটেরা

মাটির দোয়াত
খাগের কলম
বুড়ো বিধাতা
চোখে দেখে কম

.        আড়াল করে সবাই দাঁড়ায় কাছাকাছি

মেঘ করছে গুড়গুড়
আকাশ বেজায় কালো
আটকৌড়ে বাটকৌড়ে
ছেলে আছে ভালো ?

বৃষ্টি পড়ে ঝমাঝম
ঢেঁকিতে কোটে চিঁড়ে
দমাদ্দম পেটাতে পেটাতে
কুলো গেছে ছিঁড়ে

তিলের নাড়ু ফুরিয়ে গেছে
বাতাসা তাও এইটুকু
বলি
খোকা, না খুকু

ঘুঘুসইয়ের দিন গিয়েছে
হাঁটি হাঁটি  পা  পা
দেয়াল ছেড়ে চৌকি থেকে
মেঝের উপর লাফা

.        যাস  নে  গো তোরা যাস্ নে ঘরের বাহিরে

ঝড় উঠল অগ্নিকোণে
ঝড় উঠল ঝড়
কচুর পাতায় নুন এনেছি
একটি আম পড়

অম্বুবাচী গেলে বাঁচি
হচ্ছে বৃষ্টি ছাড়ছে না
ফসল এ সন ভালো হবে
শোধ হবে সব ধারদেনা

উনুনে মোটে আঁচ পড়েনি
হবে না আজ রান্না
ভিজে গায়ে মাটি-মায়ের
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না

.        এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে



বৃষ্টি পড়ছে ? তবে তো এক্ষণি---

যেতে হবে রথের মেলায়
যাবি তুই ?
সঙ্গে গেলে তোকে দেব রথের পার্বনি |
হেঁটে যাব |  রাজি ?

নদী থাকলে, নৌকো থাকলে হত ভালো
তবে কি জানিস ?
বদ্ধস্রোত
নদীতে এখন শুধু ঝাঁঝি |

আমি যাব খালি পায়ে, তুই জুতো প’রে ;
কারণ তো জানিস—
জীবাণুরা ওৎ পেতে থাকে এ শহরে |
গণ্ডারের চামড়া গায়ে আছে
আমার হয় না কিছু
পেরেক বা কাঁচে |
পাওয়া গেলে কিনে দেব তারপাতার ভেঁপু—
যাবি দাদু, যাবি ?

চোখে ছানি, শুনি কম
একটা কান একেবারে কালা
নেই দম
ফোলানো বেলুন কিনি, নিজে আমি দিতে পারি নে ফুঁ |
তালপাতার ভেঁপু পেলে
আমার কানের কাছে মুখ এনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে
খুব জোরে একবার বাজাবি ?

বৃষ্টি পড়ছে ? তবে তো এক্ষনি
যেতে হয় রথের মেলায় |
আমি যাচ্ছি | তুই যাবি ?

ভিজলে কারও হয় কিছু ? ছাই হয় |
মা-বাবারা বলতে হয় বলে—
তাও শুধু নিজের ছেলেকে |
ভয় দেখায়, ভয় |

একটু শুধু মর্চে-পড়া, তা নয়তো—
দ্যাখ্ দাদু
আমার এ লোহার শরীর |
আমি জানি জাদু,
রোদ জল শীত গ্রীষ্ম সবই
আমার স্ববশ |

মা কেমন ছিল তোর জানি না ছোটোতে
যেরকম বকে তোকে সারা বেলা
মনে হয়,
বড্ডই মুখরা |
তবে তোর বাবাকে তো জানি—
ফেলে রেখে পরীক্ষার পড়া
খালি খেলা, খালি খেলা, সারাক্ষণ খেলা |
সেই তোর ডানপিটে দস্যি বাবা বড় হয়ে
আপিসে যাবার আগে রোজ
তোকে কিনা বলে—
খবর্দার, বেরোবে না জলে |

বড় হয়ে লোকে এত ভুলে যায়
নিজেদের ছেলেবেলাটাকে--
মাথাভর্তি টাকে হাত দিয়ে
ঢাকে, শুধু ঢাকে |

রথের মেলায় আমরা যাব ভিজে ভিজে
মজা হবে কী যে !
যখন ছিলাম আমি ঠিক তোর মতো
যতই ঝড়বৃষ্টি হোক
খেলা থাকলে বেরোতেই হত |
সারাটা দুপুর কাটত ছিপ হাতে বিলে |
ভিজে জামা, ভিজে জুতো
রোদ উঠলে গায়েই শুকুতো |
ছুটিটা মজায় কাটত ঠাকুর্দার কাছে
দেশের বাড়িতে |
বাবা লিখত :  এ করো-না,  সে করো-না খালি
ডুববে, সাপে কাটবে কিংবা করবে অসুখ-বিসুখ—
সব সময়
ভয় |
অন্ধকারে তুমি যদি দেখবে জোনাকি
হাতে কেউ লন্ঠন নেয় নাকি ?
ঝুঁকে পড়ে ইদারার জলে
দেখা যাবে কাকে ?
কথা বলে জানবে না একবার
কে সেখানে থাকে ?
নষ্টচন্দ্রে ফল চুরি করাই তো রীতি |
তাই ব’লে ছিলাম না অবুঝও
চাঁদসদাগর হয়ে দিতাম বাঁ-হাতে
মনসাকে পুজো |

ইয়া !
আমার মাথায় এক, দ্যাখ দাদু,
এসেছে আইডিয়া |
মা-র জন্যে কিনলে কিছু ফলফুলের চারা
গলে জল হয়ে যাবে
দেখিস বেচারা |

আর তোর বাবার জন্যে কী যে কেনা যায়
যা শেখাবে তাই শিখবে দাঁড়ে বসে
এমনি এক কথা-বলা পাখি,
নাকি
গলায় বগ্ লস দেওয়া লোম-অলা কুকুর
যারা হয় প্রভুভক্ত খুব |

আমাদের সব সাজা
হয়ে যাবে
তাতেই মকুব |

বৃষ্টি পড়ছে ? তবে তো এক্ষনি
যেতে হয় রথের মেলায় |
কি রে তুই,
যাবি ?



আমি রইলাম প’ড়ে
.           অজলে অস্থলে
মনপবনে  দেখ রে
.            ময়ূরপঙ্খী চলে
রওনা হয়ে
.            কাগজের নৌকো
আর ফেরেনি
.            বাড়ি মুখো
ভেসে গিয়েছে
.             আমার সৃষ্টি
চোখের কোণে
..             নামিয়ে বৃষ্টি ||

.        *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ছড়ানো
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ছড়ানো ঘুঁটি” ( ২০০১ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |

এ  জমজমাট আসর
.    গুলজার এই মজলিশ
.         ছেড়ে উঠে যাব,  ইস্—
নাইবা  থাকল  বয়সের  গাছপাথর

একাশি পেরিয়ে বিরাশি
.        আজও থেকে গেছে অজানা
.             কখন জন্ম,  কী রাশি
জ্যোতিষীরা ভূতভবিষ্যতের
.                    পায়  নি আদৌ ঠিকানা

যা ছিল পাওনা করেছি উশুল
.                  চক্রবৃদ্ধিহারে
.   জীবনের  রসে হয়ে গিয়ে মশগুল
.                মাথা বিকিয়েছে ধারে

ঘুম যদি পায়
.    চোখ বুজে শুয়ে মাটিতে
.            মনটাকে ভ’রে কানায় কানায়
.     পারি যেন নবজাতকটি  সেজে
.            ক্ষিতি-অপ্ –তেজে
.                     নিজেকে মিশিয়ে দিতে ||

.                     *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ছড়ানো ঘুঁটি
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
“ছড়ানো ঘুঁটি” ( ২০০১ )  কাব্যগ্রন্থের কবিতা |


সদর দরজাতে
রইল খিল-আঁটা

সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে চোখ
পেছনে দিই হাঁটা

সবুজ ঘাসে কনুইতে ভর দিয়ে
দেখছে আমায়
হলদে পাখির পালক

গাছের পাতা ঘোমটা তুলে তাকায়

সবারই সেই এক প্রশ্ন
কে যায়

যায় না তো কেউ
আসে
নতুন মুখ
ভিড় করে চারপাশে

গল্প করে বলতে হয়
বেঁচে থাকার কী সুখ

উঠে আসার সময় হঠাৎ
শিকড়ে পা বেধে
ছক উল্টে ছড়িয়ে পড়ে ঘুঁটি

সুখে দুচোখ জুড়ে আসছে
খুলে যাচ্ছে জীবনভর
.             পাকানো দুটো মুটি ||

.               *******************         
.                                                                             
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর