কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় - খ্যাতিমান শক্তিশালি বামপন্থী কবি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার
কৃষ্ণনগরে, তাংর মাতুলালয়ে। পিতা ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতা যামিনী দেবী। তিনি ১৯৩৭ সালে
কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান
করে সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে কবি কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে
দর্শনে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন।

কবি এম.এ. পড়ার সময় ১৯৪২ সালে, সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনে
(Quit India
Movement)
এবং দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান। সেই সময়ে সদ্য গঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী
সংঘের কাজে তত্পর হয়ে ওঠেন। এই সময়ে দু-দফায় তাঁর কয়েক বছর কারাবাস হয়।   

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক প্রকাশিত হয় বি.এ. পাশ করার আগেই, ১৯৪০ সালে। এই কাব্যগ্রন্থটি  
প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলা কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। একদিকে যেমন তাঁর কাব্য ছিল
রাজনৈতিক মতবাদের বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট প্রকাশ, অন্যদিকে ছন্দের বিচিত্র পরীক্ষা ও প্রতিমা সৃষ্টির অভিনবত্ব
ছিল তাঁর কবিতার প্রধান আকর্ষণ। “অগ্নিকোণ” ( ১৯৪৮ ) ও “চিরকুট” ( ১৯৫০ ) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তাঁর
রচনাভঙ্গির ক্রমবিকাশ। তাঁর কাব্যে একটা বড়ো পরিবর্তন দেখা দিল “ফুল ফুটুক” ( ১৯৫৭ ) কাব্যগ্রন্থে।
আগের কবিতার প্রচারধর্মিতার পরিবর্তে দেখা দিল সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চেতনা এবং গভীরতর অনুভূতি।
প্রেম, সংগ্রাম, প্রকৃতি, সামাজিক অনাচার, জীবনের ব্যর্থতা ও আশা নিরাড়ম্বর ভাষায়, কথ্যছন্দে,
জীবনমুখী প্রতিমায় নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিল। এখানে যে গদ্যছন্দ ব্যবহার করলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় তা
হয়ে উঠল তাঁর পরবর্তী কাব্যে প্রধান ( যদিও একমাত্র নয় ) বাহন। “যত দূরেই যাই” ( ১৯৬২ ), “কাল
মধুমাস” (১৯৬৬), “এই ভাই” ( ১৯৭১ ), “একটু পা চালিয়ে ভাই” ( ১৯৭৯), “জল সইতে” ( ১৯৮১ ), প্রভৃতি
গ্রন্থে তাঁর কাব্যসৃষ্টি ক্রমশই গভীর এবং নিবিড় হয়ে এসেছে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন শক্তিশালী অনুবাদক ছিলেন। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য তাঁর হাফেজ,
বা পাবলো নেরুদা বা নাজিম হিকমতের কবিতা। এছাড়া রয়েছে “গাথা সপ্তশতী”, “অমরু শতক” প্রভৃতি।

রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং শ্রমিক আন্দোলন ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর প্রথম
পর্বের কবিতা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গদ্য রচনার পরিমাণ এবং বৈচিত্র্য বিপুল। “আমার
বাংলা” ( ১৯৫১ ), “ডাকবাংলার ডায়েরি” ( ১৯৬৫ ), গ্রন্থ দুটি তাঁর অসামান্য গদ্যরচনার নিদর্শন |
“হাংরাস” ( ১৯৭৩ ) নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে
জেলের  অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। “অন্তরীপ” বা “হ্যানসেনের অসুখ”, “ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন” বা
চিঠি জুড়ে জুড়ে “চিঠির দর্পণে”-র মতো ছক ভাঙা উপন্যাসেও তিনি তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখে গিয়েছেন।
নিজে বেড়াতে ভালোবাসতেন তাই কিছু ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছিলেন।  

কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখাতেও সুভাষ মুখোপাধ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। লিখেছেন "মিউ-এর জন্য ছড়ানো
ছিটানো", "এলেম আমি কোথা থেকে" প্রভৃতি।

তিনি সম্পাদনা করেছেন “লোটাস”, “সপ্তাহ”, “পরিচয়” (১৯৫১-৫২ ও ১৯৬৬-৬৭) ও সত্যজিত রায়ের সঙ্গে
“সন্দেশ” পত্রিকা (১৯৬১-৬৩)। তিনি “স্বাধীনতা” পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গেও কিছুকাল যুক্ত ছিলেন। এছাড়া
তিনি সংক্ষিপ্ত আকারে সম্পাদনা করেন “বাঙালির ইতিহাস”, সংকলন করেন “দেশ-বিদেশের রূপকথা”।

কবি ভূষিত হয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬৪), আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৪), উল্টোরথ পুরস্কার
(১৯৮৭), সোভিয়েত ল্যাণ্ড নেহরু পুরস্কার (১৯৮৪), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৯২) প্রভৃতি সহ বহু পুরস্কার ও
সম্মাননায়।

পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ী আন্দোলনকে কবি সমর্থন করেননি। “কে কোথায় যায়” উপন্যাসে এই
আন্দোলনের প্রতি তাঁর বিরূপতা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি সমর্থন করছিলেন ১৯৭৭ সালে, প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীর জারি করা জরুরী অবস্থাকে। এই সময়েই অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সমিতির কাজের চাপে ট্রেড
ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসতে থাকেন কবি। ১৯৮১ সালে রণকৌশল ও অন্যান্য কিছু
রাজনৈতিক প্রশ্নে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এরপর থেকেই বামপন্থী
রাজনীতির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

শেষ দিকে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে। সেই সময়কার বিরোধী নেত্রী
শ্রীমতী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
লাভ করেন তাঁর সান্নিধ্য। স্রোতের বিপরীতে চলে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের
কাছে অপছন্দের হয়ে ওঠেন তত্কালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কবি কোনো দিন ক্ষমতাবানদের সঙ্গে থেকে
আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেননি বলে আর্থিক অনটন তাঁর শেষদিকের সঙ্গী ছিলো। শেষ দিকে কেউ
দেখা করতে গেলে কবি নাকি তাঁকে বলতেন কিছু কাগজ দিয়ে যেতে, লেখার জন্য। যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের
অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর কলকাতায় তাঁর প্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী
ছাড়াও তাঁর তিন পালিতা কন্যাকে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার, তাঁর শেষ যাত্রার আয়োজন,
শ্রীমতী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
দায়িত্বে সঁপে দেন।

আমরা
মিলনসাগরে  কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।


উত্স - ডঃ শিশিরকুমার দাশ, সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী, ২০০৩।     
.            অঞ্জলি বসু সম্পাদিত সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান দ্বিতীয় খণ্ড, ২০০১।



কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন



আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতা প্রথম প্রকাশ - ২০০৫
পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১৮.২.২০১৬

...