কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা
*
শ্রাবণ-বন্যা
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

সংকীর্ণ দিগন্ত-চক্র ; অবলুপ্ত নিকট গগনে ;
পরিব্যাপ্ত পাংশুল সমতা ;
অবিশ্রান্ত অবিরল বক্রধারা ঝরিছে সঘনে ;
হাঁকে বজ্র বিস্মৃত মমতা ;
প্লাবিত পথের পাশে আনত বঙ্কিম তরুবীথি
শিহরিছে প্রমত্ত ঝঞ্ঝায় ; নিমজ্জিত প্রহরের বৃতি ;
ভেদ নাই উষায় সন্ধ্যায় ||

পথস্থ কুটিরদ্বারে ভয়ে পান্থ নিয়েছে আশ্রয় ;
সিক্ত গাভী ছুটে চলে গোঠে ;
কপোত কুলায় কাঁপে ; দাদুরী নীরব হয়ে রয় ;
পুষ্পবুকে অশ্রু ভ'রে ওঠে ;
নিষিক্ত স্তব্ধতা ভেদি, প্রলয়ের হুংকার-রণনে,
পরিপ্লুত নদীর কল্লোলে,
উন্মাদ শ্রাবণবন্যা ছুটে আসে ভৈরব নিঃস্বনে,
অবরুদ্ধ পরান-পল্বলে ||


.             ***************************              
.                                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
উটপাখি
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি ?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে ?
কোথায় লুকোবে ? ধু-ধু করে মরুভূমি ;
ক্ষ'য়ে-ক্ষ'য়ে ছায়া ম'রে গেছে পদতলে |
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ |
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম'জে নেই ;
তুমি বিনা তার সমুহ সর্বনাশ |
কোথায় পালাবে ? ছুটবে বা আর কত ?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা |
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা ||

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে ?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া |
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে ?
কেবল শূণ্যে চলবে না আগাগোড়া |
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও ;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদপ্রাজ্ঞ নও |
নব সংসার পাতি গে আবার, চলো
যে-কোনো নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে |
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্শনে ||

ল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ'ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা ;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা |
ভূমিতে ছড়ালে অকারি পালকগুলি
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে ;
উধাও তাহার উড্ডীন পদধূলি
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজবো না অমারাতে |
তোমার নিবিদে বাজাবো না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে ;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় সে উনতিরিশে ||

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশিদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের 'পরে দেনা শোধবার ভার |
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি |
অন্ধ হ'লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি |
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে |
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক'রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি :
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নাম
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

চাই চাই আজো চাই তোমারে কেবলি |
আজো বলি,
জনশূণ্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি আজো বলি---
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যত বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ |
নিরাশ অসীমে আজো নিরেপক্ষ তব আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দী ক'রে রেখেছে, প্রেয়সী,
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি'
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে |
আমার জাগর স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারি স্মরণ ||

তবু মোর মন
চাহে নাই মোহের আশ্রয় |
জানি তুমি মরীচিকা ; তোমা সনে প্রাণ বিনিময়
কোনোদিন হবে না আমার |
আমার পাতালমুখী বসুধার ভার,
জানি, কেহ পারিবে না ভাগ ক'রে নিতে ;
আমারে নিঃশেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে
এক দিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম ||

জানি ব্যর্থ., ব্যর্থ সেই সন্ধ্যা নিরুপম
যবে মোর আননে নেহারি
অগাধ নয়নে তব ফলদা স্বাতীর পূণ্য বারি
উঠেছিল সহসা উচ্ছলি |
জানি সেই বনপথে, চিরাভ্যস্ত প্রেম নিবেদনে
আপনারে ছলি,
পশিনি তোমার মর্মে, নিজের গহনে
জমিয়েছিলাম শুধু মিথ্যার জঞ্জাল |
জানি, কত তরুণীর গাল
অমনি অধৈর্যভরে শতবার দিয়েছি রাঙায়ে ;
অনুপূর্ব পথিকার পারে
বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত
ক্ষণিক পুষ্পের লোভে | ক্রমাগত
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে, ঝড়ে ;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও জানি, সেই মতো হারাবে ধুলায় ||

তবু চায়, প্রাণ মোর তোমারেই চায় |
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে ;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম---
নাম---শুধু নাম---শুধু নাম ||


.             ***************************              
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সমাপ্তি
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

বরষাবিষন্ন বেলা কাটালাম উন্মন আবেশে |
জনশূণ্য হৃদয়ের কবাট উদ্ঘাটি',
স্মরণে চলাচল করিলাম সহজ, সরল |
দৃষ্টিহারা নেত্রপাতে দেখিলাম সন্নত আকাশে
এইমতো আর-এক দিবসের ছবি |
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির বিলাপে
শুনিলাম সে কণ্ঠের স্নেহসম্ভাষণ |
অর্গলিত বাতায়নে ঝটিকার নিরর্থ আক্রোশে
বিচ্ছেদবিধ্বস্ত হিয়া বাখানিলো ক্ষুব্ ধ  অক্ষমতা
নির্বিকার, নিরুত্তর, রুক্ষ বিধাতারে ||

এলো সন্ধ্যা রক্তবরিষণ ;
দিনান্তের মুমূর্ষু বর্তিকা
প্রাকনির্বাপণ দীপ্তি প্রজ্বলিত করিল সহসা
প্রাণের অন্তিম শক্তিব্যয়ে ;
তার পর অন্তরে বাহিরে
অন্ধকার বিস্তারিল শবপ্রাবরণী ||

মনে হ'লো আশা নাই
মনে হ'লো ভাষা নাই পিঞ্জরিত ব্যর্থতা বলার |
মনে হ'লো
সংকুচিত হ'য়ে আসে মরণের চক্রব্যূহ যেন |
মনে হ'লো রন্ধ্রচারী মুষিকের মতো
শটিত জঞ্জালকণা কুড়ায়েছি এতকাল ধ'রে
কৃপণের ভাণ্ডারে ভাণ্ডারে ;
এইবার ফুরায়েছে পালা,
ঘাতক যন্ত্রের কারা অবরুদ্ধ হ'লো অবশেষে ;
এইবার উত্তোলিত সম্মার্জনীমূলে
পিষ্ট হবে অচিরাৎ অকিঞ্চন উঞ্ছবৃত্তি মম ||

.             ***************************              
.                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
শাশ্বতী
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রান্ত বরষা অবেলার অবসরে
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলোছায়া |
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে ;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী |
কুহেলিকলুষ দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে ;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে |
মিলনোত্সবে সেও তো পড়েনি বাকি,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা :
পশ্চাতে চায় আমরই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা ||

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে---
মনে হয় যেন শত জনমের আগে---
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে |
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগল্ ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ'রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত ক'রে ||

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে |
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুলিত তার হৃদি
দিব্য শিশিরে তারই স্বেদ অভিষেকে |
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখিসম ;
সে-রোমরাজি কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;
আজ সে কেবল আর কারে ভালবাসে |
স্মৃতিপিপিলিকা তাই পুঞ্জিত করে
অমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা ;
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিবো না ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রার্থনা
কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা” ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


হে বিধাতা,
অতিক্রান্ত শতাব্দীর পৈতৃক বিধাতা,
দাও মোরে ফিরে দাও অগ্রজের অটল বিশ্বাস |
যেন পূর্বপুরুষের মতো
আমিও নিশ্চিন্তে ভাবি ক্রীত, পদানত,
তুমি মোর আজ্ঞাবাহী দাস |
তাদের সমান
মণ্ডুকের কূপে মোরে চিরতরে রাখো, ভগবান |
কমঠবৃত্তির অহংকারে
ঢাকো ক্ষণভঙ্গুরতা | তাদের দৃষ্টান্ত-অনুসারে
আমিও ধরাকে যেন সরা জ্ঞান করি |
মর্যাদার ছিদ্রিত গাগরি
জোড়ে যেন বারংবার ডুবে আত্মপ্রসাদের স্রোতে |
রৌদ্র-জ্যোতি হ’তে
আবার ফিরাও মোরে তমসার প্রত্ন দায়ভাগে |
ঘুণধরা হাড়ে যেন লাগে
উঞ্ছপুষ্ট জ্যেষ্ঠদের তৈলসিক্ত মেদ ;
মরে যেন উদ্বন্ধনে অপজাত হৃদয়ের খেদ ||

পিতৃপিতামহদের প্রায়
তোমার নামের গুণে তীর্ণ হ’য়ে দশম দশায়
মূঢ়, মূক গড্ডলেরে দিই যেন বলি
রক্তপিপাসিত যূপে |
বাচাল বিদ্রূপে
হুংকারিলে দুর্বৃত্তের উদ্ধত দম্ভোলি,
গুরুজনদের মতো করি যেন সাষ্টাঙ্গ প্রণাম
শক্তির উচ্চল পায়ে ;  আর্তির সংক্রাম
কেটে গেলে কালক্রমে জনাকীর্ণ রাজপথ থেকে,
স্ফীত বুকে অপ্রতিষ্ঠ পৌরুষের ঝেড়ে
হাসিমুখে হাত নেড়ে
পলাতক সধর্মীরে ডেকে,
প্রমাণিতে পারি যেন সবই তব ইচ্ছা, ইচ্ছাময় ||
এলে পরে লাভের সময়,
সদসৎনির্বিচারে, সকলই তোমার দান ব’লে,
নিঃস্বের স্বেদাক্ত কড়ি হাতায়ে কৌশলে
আমিও জমাই যেন যক্ষসংরক্ষিত কোষাগারে |
শ্রুতিধর মান্ধাতার উক্তির উদ্ধারে
লুকায়ে ইন্দ্রিয়াসক্তি ; অবিমৃশ্য জন্মের জঞ্জলে
বিষায়ে সংকীর্ণ সৌধ ; জলে, স্থলে, নভে
বিরোধের বীজ বুনে ; নিরন্তর নিষ্কাম প্রসবে
ভগ্নস্বাস্থ্য গর্ভিণীর ক্লিন্ন অন্তকালে,
তোমার প্রতিভূ সেজে, উন্নরক স্বর্গের আশ্বাসে
সাধ্বীর সদ্ গতি যেন করি |
ঊর্ধ্বশ্বাস উত্সবের উদ্বায়ী উচ্ছ্বাসে
তোমারে পাসরি,
দারুণ দুর্দিনে যেন পূজা মেনে বিস্ময়ে শুধাই,
“স্মরণে কি নাই,
দয়াময়, আশ্রিতেরে স্মরণে কি নাই ?”

ভগবান, ভগবান
অতীতের অলীক, আত্মীয় ভগবান,
অভিব্যাপ্ত আবির্ভাবে আজ
আমার স্বতন্ত্র শূন্যে করো তুমি আবার বিরাজ |
শকুনির ক্ষুধানিবারণে
শস্যশ্যাম কুরুক্ষেত্রে মায়াবাদ ভ’নে,
সূচ্যগ্রমেদিনীলোভী যুযুত্সুরে ক্ষমিতে শেখাও
অপরের অপঘাত | তুলে নাও,
আমার রথাশ্বরজ্জু, হে সারথি, তুলে নাও হাতে |
স্বার্থের সংঘাতে
বিতর্ক, বিচার হানো | মর্মে-মর্মে, মজ্জায়-মজ্জায়
জাগাও অন্যায়, শাঠ্য |  হিংস্র অলজ্জায়
পুণ্যশ্লোক সগোত্রের তুল্য মূল্য দাও, দাও মোরে |
অপ্রকট সততার জোরে
আমার অন্তিম যাত্রা, অতিক্রমি’ সুমেরুর বাধা,
হয় যেন নন্দনে সমাধা,
যেখানে প্রতীক্ষারত সুরসুন্দরীরা
সুকৃতির পুরস্কারে পাত্রে ঢেলে অমৃতমদিরা,
নীবিবন্ধ খুলে,
শুয়ে আছে স্বপ্নাবিষ্ট কল্পতরুমূলে ||

কিন্তু যেথা সর্পিল নিষেধ
স্বপুচ্ছের উপজীব্যে সাধে আত্মবেদ
প্রমিতির বিষবৃক্ষে, অমিতির অচিন্ত্য অভাবে ;
অন্তরঙ্গ জনতার নিবিড় সদ্ভাবে
হয়নি বাসোপযোগী অদ্যাবধি যে-নিস্তাপ মরু ;
পশুপতি বাজারে ডমরু
মোর গোষ্ঠিপতিদের নাচায়নি যার ত্রিসীমায় ;
নিরালম্ব নিরালোকে যেথা
দেব-দ্বিজ-প্রবঞ্চিত ত্রিশঙ্কু ঝিমায়,
মৌনের মন্ত্রণা শোনে মৃত্যুবিপ্রলব্ধ নচিকেতা ;
সেখানে আমার তরে বিছায়ো না অনন্ত শয়ান,
হে ঈশান,
লুপ্তবংশ কুলীনের কল্পিত ঈশান ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নরক
কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা” ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


অন্ধকারে নাহি মিলে দিশা ||
দীর্ঘায়িত নিশা
বয়ঃস্ফীত বারাঙ্গনা-পারা
দুর্গম তীর্থের পথে হ’য়ে সঙ্গীহারা \
ঘুমায়ে পড়েছে যেন আতিথেয় অজানার পাশে
দুর্মর অভ্যাসে |
কেশকীটে ভরা তার মাথা
লুটায় আমার কাঁধে, পরনের শতছিন্ন কাঁথা
বিষায় জীবনবায়ু সংকীর্ণ কুটিরে,
তাহার বিক্ষিপ্ত বাহু ধরিয়াছে মোর কন্ঠ ঘিরে,
ক্ষণে-ক্ষণে
অজ্ঞাত দুঃস্বপ্ন তার সন্ত্রস্ত কম্পনে
সঞ্চারিত হয় মোর জাতিস্মর অবচেতনায় ||

অতন্দ্রিত চক্ষু কিছু দেখিতে না পায় ;
শুধু মোর সংকুচিত কায়া
অনুভব করে যেন নামহীন কাহাদের ছায়া
শিয়রে সংহত হ’য়ে উঠে ;---
কোন জাদুঘর হ’তে দলে-দলে পাশে এসে জুটে
অবলুপ্ত পশুদের ভূত
কুৎসিত, অদ্ভুত |
অমূর্ত আকাঙ্ক্ষা হানি’, নিরাকার লজ্জা অসন্তোষ,
অসিদ্ধ দুরাশা দম্ভ, নিষ্ফল আক্রোশ
কানাকানি করে অন্তরালে |
রন্ধ্রহীন বিস্মৃতির প্রতন পাতালে
অতিক্রান্ত বিলাসের, অস্থাবর প্রমোদের শব
অনুর্বর সাম্প্রতেরে করিবারে চায় পরাভব
জোগায়ে জীয়নরস অপুষ্পক বীজে ||

অয়ি মনসিজে,
কোথা তুমি কোথা আজ এই স্থূল শরীরী নিশীথে ?
তোমার অতল, কালো, অতনু আঁখিতে
তারকার হিম দীপ্তি ভ’রে
তাকাও আমার মুখে | অনাত্মীয় অসিত অন্বরে
এলাও অস্পৃশ্য কেশ সূক্ষ্ম, নিরুপম,
স্বপ্নস্বচ্ছ বরাভয়ে আত্মত্যাগী বেরেনিকে-সম
হেমন্ত হাওয়ার নিমন্ত্রণে
অনঙ্গ আত্মারে মোর ডাক দাও নীহারশয়নে
দুস্তর নাস্তির পরপারে ;
দাঁড়ায়ে যে-নির্বানের নির্লিপ্ত কিনারে
নিরিদ্বেগ নচিকেতা দেখেছিলো অধোমুখে চাহি
সম্ভোগরাত্রির শেষে ফেনিল সাগরে অবগাহি
কষিতকাঞ্চনকান্তি নগ্ন বসুন্ধরা
তারই প্রলোভনতরে সাজায়িছে যৌবনপসরা
রূপে, রসে, বর্ণে, গন্ধে, কামাতুর রামার সমান,
হে বৈদেহী, করো মোরে সেখানে আহ্বান ||

পণ্ডশ্রম, নাহি মিলে সাড়া ;
শূন্যতার কারা
অগোচর অবরোধ ঘিরে মোর আর্ত মিনতিরে ;
যতই পালাতে চাই অভেদ্য তিমিরে
মাথা ঠুকে রক্তপঙ্কে পড়ি,
অগ্রজের মৃতদেহ যায় গড়াগড়ি
ক্রিমিভোগ্য দুর্গন্ধে যেখানে,
চরে যেথা ক্ষয়স্তূপে ভোজ্যের সন্ধানে
ক্লেদপুষ্ট সরীসৃপ, স্বেদস্রাবী বক্র বিষধর,
পঙ্কিল মণ্ডূক আর মূষিক তস্কর,
বজ্রনখ পেচক, বাদুড় ||

বমনবিধুর
আমার অনাত্ম্য দেহ প’ড়ে আছে মৃন্ময় নরকে |
মৌন নিরালোকে
ভুঞ্জে তারে খুশিমতো গৃধ্নু নিশাচর |
দুস্তর, দুস্তর, জানি, শান্তি মোর দুঃসহ, দুস্তর |
মনে হয় তাই
আত্মরক্ষা হাস্যকর, সুসংকল্প মৌখিক বড়াই,
জীবনের সার কথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া,
নির্বিকারে, নির্বিবাদে সওয়া
শবের সংসর্গ আর শিবার সদ্ ভাব |
মানসীর দিব্য আবির্ভাব,
সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে, জাগরণে আমরা একাকী ;
তাহার বিখ্যাত রাখি,
নে নহে মঙ্গলসূত্র, কেবল কুটিল নাগপাশ ;
মলময় তাহার উচ্ছ্বাস
বোনে শুধু উর্ণাজাল অসতর্ক মক্ষিকার পথে ||

অমেয় জগতে
নিজস্ব নরক মোর বাঁধ ভেঙে ছড়ায়েছে আজ ;
মানুষের মর্মে-মর্মে করিছে বিরাজ
সংক্রমিত মড়কের কীট ;
শুকায়েছে কালস্রোত, কদমে নিলে না পাদপীঠ |
অতএব পরিত্রাণ নাই |
যন্ত্রণাই
জীবনে একান্ত সত্য, তারই নিরুদ্দেশে
আমাদের প্রাণযাত্রা সাঙ্গ হয় প্রত্যেক নিমেষে ||

ব্যাপ্ত মোর চতুর্দিকে অনন্ত অমার পটভূমি ;
সবই সেথা বিভীষিকা, এমনকি বিভীষিকা তুমি ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সংবর্ত
কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা” ( ১৯৪০ ) থেকে নেওয়া |


এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে |
প্রাদেশিক শ্যমলিমা যেই পাংশু সাধারণ্যে ঢাকে,
অমনই সে আসে,
রোখারিক্ত ভাবচ্ছবি  অবচ্ছিন্ন স্মৃতির উদ্ভাসে
লাক্ষণিক,---নেত্রসার,  কপোলপ্রধান
প্রাক্ প্রচ্ছদ নটী যেন | সঙ্গে-সঙ্গে ঘোচে ব্যবধান
দৃশ্য ও দ্রষ্টার মধ্যে :  ভুলে যাই
উত্তরচল্লিশ আমি ; উদ্ গ্রীব হ’য়েও যদি চাই,
তবু গলকম্বলের থর
মুকুরের অধিকাংশ জোড়ে ; নতোদর
লুকায় পায়ের ডগা অধোমুখে কচিৎ তাকালে ;
স্থানবিনিময় করে চাঁদিতে কপালে,
চুলের প্রলেপ ওড়ে নামমাত্র বাতাসে যখন |
বীমাই জীবন
বুঝি বটে, কিন্তু ঠিক মাসে-মাসে কিস্তির যোগান
দিতে গিয়ে বাজারখরচে পড়ে টান
অথচ ডাক্কতারে বলে তন্তুক্ষয়
এ-বয়সে নিতান্ত নিশ্চয় ;
পুষ্টিকর পথ্য বিনা অতএব গত্যন্তর নেই ;
এবং যেকালে আজও রয়েছি বেঁচেই,
তখন কী ক’রে মরি, মৌরসের উচ্ছেদ না হোক,
অন্তত চৌধুরীদের ভদ্রাসনক্রোক
স্বচক্ষে না দেখে :
তাতে যদি দুলালেরা নম্রতা বা কাণ্ডজ্ঞান শেখে ||

বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে ভুলি সে- সকলই
এ-বাড়ির অনুমিত গলি
মনে হয় অগ্রণীর পদপার্থী পথ,
যার প্রান্তে মুদ্রিত জগৎ
স্ফুর্তির প্রতীক্ষা করে |
তখন থাকে না মানে---- দিগন্তরে
উচ্ছিষ্ট উঞ্ছের বাটোয়ারা
হিংসার প্রমারা,
স্থগিত মারীর বীজ শস্যশূন্য মাঠে ;
চ’ড়ে বসে নিহত বা নির্বাসিত স্বৈরীদের পাটে
প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বেসর্বা যত ; নিরর্থক
পূষার একর্ষি নাম, অসূর্যের পুরাণ ঝলক,
হিরন্ময় পাত্র ঠেলে ফেলে,
দেয় মেলে
অন্ধতম অতিপ্রজ বল্মীকে-বল্মীকে,
বিমানের ব্যূহ চতুর্দিকে,
মাতরিশ্বা পরিভূ কবির কন্ঠশ্বাস |
মূল্যহ্রাস
সর্বত্র সর্বথা
আবশ্যিক, --- বোঝে না  সে-সোজা কথা
শুধু যার ভূসম্পত্তি আছে ;             
উদয়াস্ত ভেবে মরি,---খেয়ে-প’রে নেহাৎ যা বাঁচে      
নির্ভয়ে তা খাটাতে পারি না |
অথচ প্রত্যহ শুনি চার্চিলের স্বেচ্ছাচার বিনা
অসাধ্য সাম্রাজ্যরক্ষা, অব্যর্থ প্রলয়,
এবং যে-ব্যক্তিস্বত্ব সভ্যতার সম্মত আশ্রয়,
তারও অব্যাহতি নেই অপখাত থেকে :
একা হিটলারের নিন্দা সাধে আজ বাধে কি বিবেকে ?

কিন্তু তার দিব্য আবির্ভাবে
প্রেতার্ত অভাবে
জাগে যেন প্রজ্ঞাপারমিতার অভয় ;
ক্লেদ-মেদ-খেদের আলয়—
জঘন্য জান্তব দেহে দেশ-কাল-সংকলিত মল
সংসক্ত থাকে না আর ;  তন্মাত্রাসম্বল
হয় তনু আচম্বিতে |
নির্বিকার স্বপ্নের নিভৃতে,
বিয়োগান্ত নাটকের উদ্যোগী নায়ক, আমি পাতি
যৌবরাজ্য.--- ব্যোমযান, কামান, পদাতি
যে-রাস্ট্রের অঙ্গ নয় ; ন্যায়, ক্ষমা, মিতালি, মনীষা
যার মুখ্য অবলম্ব, জিজীবিষা
সামান্য লক্ষ্মণ ;
শ্বাপদসংকুল নয় যেখানে কানন,
দুরাক্রম্য নয় গিরিচূড়া,
পরিস্রুত সুরা
নিদাঘের অফুরন্ত দিন,
সুবর্ণধারার শষ্পশ্যামল পুলিন
উৎপিঞ্জর তারুণ্যের লাস্যময় লীলায় মুখর,
গন্ধবহসমার্জিত স্বরাট্  অম্বর
দেয় ফিরে
অবরোহী সন্ধ্যার শিশিরে
অনুপূর্ব মানুষের অভ্যুদিত চিত্তের প্রসাদ ;
জয়যুক্ত স্ট্রেসেমান্-ব্রিয়াঁর সংবাদ ||

হয়তো তখনই
উপশয়ী সংবর্তের আড়ালে অশনি
লেলিহান করবালে ধার দিতে শুরু করেছিলো |
প্রবাদের ধুয়ো ধরেছিলো
তত্পূর্বে অন্তত
মুসোলীনি যুদ্ধগামী বর্বরের মতো ;
এবং উদ্বাস্তু  ট্রটস্কি ইতিমধ্যে দেশে-দেশান্তরে
ঘুরে মরেছিলো, পুরাকালীন শহরে
গলঘন্ট কুষ্ঠরোগী যত দ্বার সব বন্ধ দেখে
যেমন নির্জনে যেতো ভিক্ষাব্যতিরেকে |
কিন্তু তার
বভ্রু কেশে অন্তগত সবিতার উত্তরাধিকার,
সংহত শরীরে
দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি, নীলাঞ্জন চোখের গভীরে
তাচ্ছিল্যের দামিনীবিলাস,
গ্যেটে, হোল্ ডার্লিন, রিল্ কে, টমাস মানের উপন্যাস
দেওয়ালের খোপে-খোপে, বাখের সনাটা
ক্লাভিয়েরে, শতায়ু ওকের পাটা
তেজস্ক্রিয় উৎকোণ পটলে ;
বায়ব্য অঞ্চলে
রক্ষিত মঙ্গলদীপ, অনাদি নগরী,
মালা জ’পে, কাটায় শর্বরী
স্বপ্নাবিষ্ট সভ্যতার নিশ্চিন্ত শিয়রে |
লেগেছিলো হাস্যকর স্বভাবত সে-সবের পরে
কূটাগার থেকে দেখা স্বস্তিকলাঞ্ছন
বালখিল্য নাট্ সীদের সমস্বর নামসংকীর্ত্তন
মশালের ধূমার্ত আলোকে :
বরঞ্চ বৃষ্টির দিনে স্তব্ধ শোকে
নির্বাক বিদায়
স্মরণীয় স্বস্থ মর্যাদার ||

অবশ্য বুঝেছি আজ এ-সিদ্বান্ত নিতান্তই মেকি,
কারণ অন্বয়ব্যতিরেকী
সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত,
এবং সে-নিত্যবিপরীত
দ্বন্দ্বসমাসের সঙ্গে তুলনীয় মেরুবিপর্যয়
বিকল্পস্বভাব ক্ষেত্রে |  নিঃসংশয়
উপরন্তু এও
বিশ্বামিত্র দস্যুরাই ব্যক্তিনামধেয়
যদিচ প্রাজ্ঞের মতে, তবু ব্যষ্টিসংকল্পের ঝোঁকে
প্রাগুক্ত দোলকে
কখনও বিলম্ব ঘটে, কদাচিৎ দ্রুতি |
তবে কেন ভক্ষোলে প্রতিশ্রুতি ?
বারোটা উত্তীর্ণ, কিন্তু টেলিফোন করে কই লীলা ?
অথচ রঙ্গিলা
নয় সে দীপ্তির মতো ; অন্তত সে জানে
সমাজের ঘুম নেই, শ্রুতি আছে দেওয়ালের কানে ;
গোপন সুযোগ
নিতান্তই দুর্লভ তাই, উপভোগ
পরিণামচিন্তায় ব্যাহত |
তাহলে কি অসময়ে ফিরেছে প্রমথ
নিন্দুকের প্রেরণায় ?  এত দিনে সফল নতুবা
সে-বাচাল যুবা
যার পেশা কৃতীর সম্ভ্রমহানি ?
ইচ্ছার সামর্থ্য নেই মানি ;
তথাপি টাকার আজ্ঞা প্রলয়েও লঙ্ঘনীয় নয় :
বন্ধকীর নিলামে বিক্রয়
মারোয়াড়ীদের গ্রাসে তুলে দেয় বাঙালির দায় |
সুতরাং সে মাঝারিবয়সীকে চায়
সে নিশ্চয় প্রকৃতিভিখারী,
নচেৎ, বিকারী ||

বৃথা স্বপ্ন ; সংকল্প অক্ষম ;
মতিভ্রম
বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে
কিংবা শুধু মৌখিক বিদ্রোহে
নিঃসঙ্গ জরার আর্তি ভোলার প্রয়াস |
কিন্তু মানবেতিহাসে মাঝে-মাঝে আসে মলমাস,
কর্মচ্যুত পৃথিবী যখন
উম্মার্গ ঘুমের ঘোরে, নাক্ষত্রিক সহযাত্রীগণ
সে-অপচারীকে ভুলে ছোটে লোকাতীতে ;
নির্বাণ নিশীথে
কারারূদ্ধ আয়ুব মিয়াদ,
রোমন্থ বিস্বাদ,
বিষায়িত ভবিষ্যের ধ্যান,
অভিজ্ঞান
শকুন্তের স্পর্শকলুষিত |
প্রমাবিরহিত
অন্ধ বিশ্বাসের বশে তখন মানুষ খোঁজে ফের
অশক্ত বা অসম্পৃক্ত অধিদৈবতের
পুরাতন পদপ্রান্তে সংগতি বা পৈতৃক অমিয়,
কার্যত যদিও
ঐকান্তিক শূন্য তাকে করে বিশ্বম্ভর,
কারণ তখন বায়ু অনিলে মেশে না, অবস্কর
ভস্মান্ত হয় না, অনুব্যবসায়ী ক্রুতু
বোঝে সন্তাপেও ব্যাপ্ত ব্রহ্মাণ্ডের বীতাগ্নি বেপথু |
অন্তর্হিত আজ অন্তর্যামী :
রুষের রহসে লুপ্ত লেনিনের মামি,
হাতুড়িনিষ্পিষ্ট ট্রট্ স্কি, হিটলারের সুহৃদ স্টালিন,
মৃত স্পেন, ম্রিয়মান চীন,
কবন্ধ ফরাসীদেশ | সে এখনও বেঁচে আছে কি না,
তা সুদ্ধ জানি না ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুঃসময়
কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত
সুকুমার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ১ম খণ্ড (১৯৯১ ) থেকে নেওয়া |


মোদের সাক্ষাৎ হল অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায়
সমুদ্যত দৈবদুর্বিপাকে |
আধো-জাগা অগ্নিগিরি আমাদের উদ্ধত হেলায়
সান্দ্রস্বরে কী অনিষ্ট হাঁকে ;
বিচ্ছেদের খর খড়্গ কোথা যেন শাণায় অসুরে,
তারই প্রতিবিম্ব হেরি মুহুর্মুহু  আকাশ মুকুরে,
বজ্রধ্বজ প্রভঞ্জন রথ রাখি অলক্ষ্যে, অদূরে
ফুৎকারিছে দিদ্বিজয়ী শাঁখে ;
আসে নাই সন্ধিলগ্ন, তমা তবু কবরী এলায়
বৈধব্যের অকাল বিপাকে ||

জানো না কি, নিঃশঙ্কিনী, যদিও বা সত্য হয় আজ
আমাদের অবোধ স্বপন,
যদিও মার্জনা করে ঈর্ষ্যাপর ক্লীবের সমাজ
যুগলের অমর্ত্য মিলন,
তথাপি নিষ্ফল সবই | -- আমাদেরই দুর্মর অতীত
অতর্কিত ভূকম্পনে বিনাশিবে বিশ্বাসের ভিত ;
প্রেতাকুল ব্যবধানে সঞ্জীবনী বাহুর নিবীত
ছিন্ন, ভিন্ন হবে অনুক্ষণ ;
অহৈতুক অপব্যয়, অনুচিত অর্চনার লাজ
আস্ফালিবে স্তব্ধ দুঃস্বপন ||

তবুও ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে,
কায় মনে তোমারেই চাই |
জানি স্বর্গ মিথ্যা কথা, তথাপি অলীক বিধাতারে
রাত্রি-দিন মিনতি জানাই |
উন্মথি হৃদয়সিন্ধু সৃজনের প্রথম প্রভাতে
অভুঞ্জিত সুধাভাণ্ড অর্পিলাম মোহিনীর হাতে ;
মৃত্যুর মাধুরী কিন্তু বাকি আছে, এসো আজ তাতে
আমাদের আমরা সাজাই |
অসাধ্য সিদ্ধির যুগ ফিরিবে না, জানি, এ সংসারে ;
তবু রুদ্র ভবিষ্যতে চাই ||

আঁধার ঘনায় চোখে,  তুমি ছাড়া কেউ নেই পাশে,
অন্তরীক্ষে জমে বিভীষিকা |
লুব্ধ ভবিতব্যতারে রুদ্ধ করো দৃপ্ত পরিহাসে,
হাতে হাত রাখো সাহসিকা |
তোমার মাভৈ শুনে হয়তো বা লজ্জিত নিয়তি
ফিবারে অভ্যাস ভুলে, ঐকান্তিক সময়ের গতি,
মৃত্যুর বিক্ষিপ্ত জাল দিবে বুঝি মোরে অব্যাহতি,
শাপমুক্ত হবে অহমিকা ;
নবজাত ভগবান বিরচিবে কৃতজ্ঞ উল্লাসে
আমাদের নব নীহারিকা ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সোহংবাদ
কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ২য় খণ্ড (১৯৯৩ ) থেকে
নেওয়া |


নিখিল নাস্তির মৌনে সোহংবাদ করেছি ধ্বনিত :
বলেছি আমি সে-আত্মা, যে উত্তীর্ণ দূরান্ত তারায়
উধাও মনের আগে ;  মাতরিশ্বা নিয়ত ধারায়
ফলায় যে-কর্মফল, তা আমারি বুভুক্ষাজনিত ;

যেহেতু প্রশ্রয়ী আমি, তাই আজও নয় অপনীত
হিরণ্ময় পাত্র, তথা দুর্নিরীক্ষ্য পূষার কারায়
স্বরাট্ স্বরূপ লুপ্ত ; দেশ-কাল আমাতে হারায়,
অথচ অন্বিষ্ট তীর্থে, পলে পলে আমি অগণিত ||

অতিক্রান্ত সন্ধিলগ্ন :  শূন্য দৃষ্টি স্বতই স্বগত ;
অসহায় অন্ধকারে কিন্তু কোথা আত্মপরিচয় ?
গচ্ছিত জাড্যের ভারে অনিকাম জঙ্গম জগৎও ;
জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত অতীন্দ্রিয় ভাবনানিচয় ||

ক্ষেত্রনিরপেক্ষ প্রমা প্রতিকারী প্রমাদের গুণে ;
সংক্ষিপ্ত চেষ্টাই রটে অপৌরুষ বিবর্তের দুনে ||

.             ***************************              
.                                                                              
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*