কবি টগর অধিকারী - একটি মতে, জন্মগ্রহণ করেন আসামের ধুবরি জেলার, আগমনী ডেভেলপমেন্ট
ব্লকের অন্তর্গত, খেরবাড়ী গ্রামের এক একনিষ্ঠ বৈষ্ণব পরিবারে। নিখিলকুমার চন্দ, "টগর অধিকারী" গ্রন্থে
জা
নিয়েছেন যে কবির ছোট ভাই, খেরবাড়ী গ্রামের বৃন্দাবন অধিকারী তাঁকে বলেছিলেন যে "মা নিজে কইছে
টগরের জন্মস্থান দেবগ্রাম। টগরের বিয়াও হইছে কিন্তু কোনো সন্তান নাই, টগরের পত্নীর নাম পদ্মেশ্বরী
অধিকারী তার একটা চকু অন্ধ আছিল।" এই বয়ান অনুযায়ী কবির জন্মস্থান অধুনা পশ্চিমবঙ্গের
কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত বারকোদালি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের দেবগ্রাম গ্রামে।

কবির পিতা শ্রীকান্ত অধিকারী ও মাতা কলামতি দেবী। চার সন্তানের মধ্যে টগরই জ্যেষ্ঠ।

কবিকে কানা টগর বলে সবাই ডাকতো কারণ তিনি অন্ধ ছিলেন। তিনি জন্মান্ধ ছিলেন না কিন্তু জন্মের দু-
মাস পরে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। তাঁর দাম্পত্য জীবন দুঃখের ছিল। বিবাহের দু-
বছরের মাথায় তাঁর স্ত্রী পদ্মেশ্বরীর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হয়।

তিনি সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন প্রথমে গিদাল (গায়ক) চামরু চারকিয়ার কাছে। তাঁর কাছে শেখেন দোতারা,
বীণা ও সারিন্দা বাজানো। এরপর গুরু প্রিয়নাথ রায় বা প্রিয়নাথ ওস্তাদের কাছে শেখেন তবলা,
হারমোনিয়াম, খোল, ঢোল, বেহালা ও সারিন্দা। গুরু প্রিয়নাথের সঙ্গে তিনি অবিভক্ত বাংলার উত্তরবঙ্গ,
গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জায়গায় সঙ্গীত পরিবেশন করে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি গুরু সুরেন রায়
বাসুরিয়ার সংস্পর্ষে আসেন। ভাওয়াইয়া গানের দিকপাল আব্বাসউদ্দীন আহমেদও এই গুরু সুরেন রায়
বাসুরিয়ার শিষ্য ছিলেন। এঁর কাছে টগর শেখেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও ভাওয়াইয়া গান। এরপর তিনি
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতিরও অভ্যাস করেন।

১৯৩৭ সালে সুরেন রায় বাসুরিয়ার দুটি গান রেকর্ড করা হয় কলকাতার এইচ.এম.ভি. স্টুডিওতে। টগর
অধিকারী এই দুটি গানেই দোতারায় সঙ্গত করেন। এই রেকর্ডটিই ছিল প্রথম কোনো ভাওয়াইয়া গানের
রেকর্ড, যা উত্তরবঙ্গ তথা লোয়ার আসামে যথেষ্ট সারা জাগিয়েছিল। এখানেই তাঁর দেখা হয়
কাজী নজরুল
ইসলামের সঙ্গে।

১৯৪১ - ৪২ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য কলকাতায় আসেন এবং গণনাট্য সংঘে অংশগ্রহণ করেন। তখন
তিনি কলকাতায়, ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রীটে অবস্থিত কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে আস্রয় পান। এই সময়ই
এখানে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য  যিনি টগর অধিকারীর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত
ছিলেন।

১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগেই তাঁকে বম্বে পাঠানো হয়,  “নিখিল ভারত যন্ত্র আউর কথা সঙ্গীত”
প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায়, যন্ত্র সঙ্গীতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বম্বেতে তিনি শচিন ও
মীরা দেববর্মণের আতিথ্য গ্রহণ করেন। বম্বেতেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গেও তাঁর আলাপ হয়। রবিশঙ্কর
টগরের দোতারা-বাদনের প্রশংসা করেন।

১৯৪৫ সালে "ফ্যাবিলিসিস" উত্সব উপলক্ষে কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি গণনাট্যের ব্যালে ট্রুপের
সদস্যপদ লাভ করেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সৌজন্যে ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানে
যোগদান করেন।

১৯৪৮ সালে মধু সেনের সঙ্গে কলকাতায় আসেন এবং অহল্যা নৃত্যনাট্যে, যন্ত্রসঙ্গীতে অংশ নিয়েছিলেন।
এখানে তাঁর পরিচয় হয়
সঙ্গীতকার ও কবি সলিল চৌধুরীর সঙ্গে যিনি অহল্যা নাটকের সঙ্গী পরিচালনার
দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৫২ সালে তিনি কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানে অনুষ্ঠিত,
All India Cultural Conference and Festival for
Peace
এ যোগদান করে “মানব দরদী শিল্পী”-র সম্মান লাভ করেন। এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে  মঞ্চস্থ করা  
হয় তুলসি লাহিড়ীর  নির্দেশনায়, রংপুরিয়া ভাষায়, নাটক “ছেঁরা তার”। অভিনয়ে ছিলেন
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র,
তুলসি লাহিড়ী প্রমুখরা। সঙ্গীত নির্দেশনায় ছিলেন সলিল চৌধুরী
টগর অধিকারী, রাগ বেহাগ বাজিয়ে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে তিনি রংপুরে গণনাট্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

টগর অধিকারীর জীবনের ছায়ায়
বিজন ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত নাটক “মরাচাঁদ” বিজনবাবু
নিজেই সে কথা জানিয়ে গিয়েছেন।

টগর অধিকারীর প্রিয় রাগ-রাগিণীর মধ্যে ছিল জয়জয়ন্তী, দরবারী কানাড়া, টোরী, বেহাগ প্রভৃতি। তাঁর গানে
ফুটে ওঠে অত্যাচারিত মানবজাতির আন্দোলন ও বিদ্রোহের কথা।

সুব্রত রুদ্র তাঁর গণসঙ্গীত সংগ্রহ সংকলনে জানিয়েছেন যে টগর অধিকারী ১৯৪৫ সালের ফ্যবলেশিস
উত্সবের সময় কলকাতায় এসে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

আমরা সব মিলিয়ে মাত্র চারটি গান হাতে পেয়েছি। নিখিলকুমার চন্দ তাঁর "টগর অধিকারী" গ্রন্থে
জানিয়েছেন যে ". . . শোনা যায় অনেকগুলো প্রচলিত গান টগরের, কিন্তু প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে তা
সংযোজন করা গেল না।" আমরা
মিলনসাগরে  কবি টগর অধিকারীর কবিতা গান তুলে আগামী প্রজন্মের
কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই প্রচেষ্টাকে সার্থক বলে মনে করবো।


কবি টগর অধিকারীর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন


উত্স - কোয়েস্ট (Qwest), ইন্ডিয়া ফোরামস্.কম ।    
.           
আনন্দবাজার.কম ।    
.           
সুব্রত রুদ্র, গণসঙ্গীত সংগ্রহ, ১৯৯০।
.           লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে প্রকাশিত,
.           নিখিলকুমার চন্দর "টগর অধিকারী" গ্রন্থ, ২০০৪।                  


আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


একটি কবিতা নিয়ে এই পাতা প্রথম প্রকাশ - ৩.৬.২০১৬
পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১৩.৬.২০১৬
...