কবি তৈমুর খান-এর কবিতা
*
উন্মাদ বিকেলের সান্ধ্যধারণা
কবি তৈমুর খান

উন্মাদ বিকেলের একটি সান্ধ্যধারণা
তোমাকে দিই
স্বচ্ছ বিবেক মুহূর্তগুলি কোথায় হারাল?
আজ আদিম তরবারি নিয়ে যুদ্ধ
যুদ্ধ সমস্ত রাত

রক্তাক্ত চৈতন্য ঘিরে নামে অন্ধঘোর
এপ্রান্ত ওপ্রান্ত জুড়ে ক্লান্ত বিশেষণ
জীবনের সরু হাঁটা পথ
স্বপ্নের মোড়ক খুলে দ্যাখে
শুকনো কিংশুক

তবু ফিরে ফিরে আসে পরাভব
শূন্য খাঁচায় পোষা জ্বর
সব আলো নিভে গেলে
বিকেলও নূপুর হারায়

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দাঁড়াবার জায়গা হয়নি
কবি তৈমুর খান

দাঁড়াবার জায়গা হয়নি
কী করে ফুল ফুটবে শস্যক্ষেতে?
কৃষকের বাড়ি বাড়ি হাওয়া ফিরছে
ভিখিরির মুখে প্রত্যয়ভিশান
জলদাগ এঁকেবেঁকে নদী বয়ে গেছে
আকাশ ছাপিয়ে গেছে সান্ধ্যমোহে
সব পথ আছে পথ পানে চেয়ে

একটু নিরভিমান আলো
দুর্গার মতন নিরুক্ত প্রতিমা
অসমাপ্ত খণ্ডৎ ত নিয়ে
শহর ছুটছে —
শহরের কয়েকটি শৃগাল
নিয়ত সাধুভাষা জানে

দেহাতি নদীর চরে
অঙ্ক ভুল করে
রোদনবিলাসী একা দাঁড়িয়ে আছি

হৃদয়ে বড়ো দরদ ছিল
সমস্ত দরদ আজ মুথাঘাস হয়ে ঝরে

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ফিরছি আবার
কবি তৈমুর খান

পাখির খুশিতে হাসছে নতুন দিন
বিষাদকে আজ কোথায় পাঠাব, বকুল ?
দিগন্ত জুড়ে তারার নষ্ট ফুল
উড়ছে হাওয়ায়

হাসপাতাল আজ ছুটি দিয়েছে
রক্তবমির পর আজই প্রথম
আলোবাতাসে খুঁজেছি আমার ঘর
মাদুর পেতে বলেছে মাটিতে —
একটু বসে যাও!

এত দহনের পর
গ্লাসে গ্লাসে ঠাণ্ডা জল
আহা জলও রাধা
নাচে রাধাজল!
আমার লুকোনো বীণাটি বেজে ওঠে তবে!

বকুল , তুমি ফুটে ওঠো দেখি
আমার হৃদয় আজ নতুন কিশোরী...

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্যঞ্জনায় ফিরে যাই
কবি তৈমুর খান

সঙ্গমের খোলা রাস্তায় বাজনা বেজে ওঠে
বিবাহ উৎসবে নেচে ওঠে রাত
টেবিলে টেবিলে উষ্ণ জল
কামুক কুয়াশার চাউনি
উঁকি দিচ্ছে সালঙ্কারা মেঘ

অসম্ভব লাল নীল ঠোঁটে
আমন্ত্রণলিপির উদ্বেগ
চেয়ে থাকি  , উদাসীন হই
শরীরকে শরীর ডাকে শুনি
থালায় থালায় ক্লান্ত ভাত
মাংসের কাবাব নড়ে ওঠে
প্রাণে প্রাণে ঢেউ আরব্যরজনীর

পাশাপাশি বসেছি তোমার
আজ ঘ্রাণ ভাসিয়ে দিক
দিকশূন্য বাসরের দিকে।
হাতে রাখি হাত, চলো প্রেম
ব্যঞ্জনায় ফিরে যাই
বিশেষণে কাটাব না রাত।

খোলা রাস্তায় আলতা পরা পা
রঙিন আঙুলগুলি স্পর্শ চায়
নতুন জ্যোৎস্নার......

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিনীত আশ্রয়
কবি তৈমুর খান

হাতি ডেকে উঠছে
ব্যাঘ্র ডেকে উঠছে
মাৎসর্যের গোলাপবাগানে
নতুন পাখির আনাগোনা
ভয় ও ক্লোডিয়াস ঘুম
আর্ত স্বপ্নের বারান্দায়
জেগে আছি ।
নিত্য হরিণীর দৌড়
লক্ষ্যভ্রষ্ট তির
হিমানীর প্রাচীর ভেদ করা চাঁদের ছায়া
আর জ্বরের কপাল ছোঁয়া হাওয়া
প্রত্যহ বিষাদ আঁকা খুর
অরণ্যের পর অরণ্যে চলে যাওয়া

হারাতে হারাতে শিরোজ মুখ
দ্রাবিড় আলোয় খুঁজে আনা
দু একটি অন্তর্হিত সুখ
এইসব রাতের প্রহরে
বিনীত আশ্রয়.....

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মহাসঙ্গম যাত্রা
কবি তৈমুর খান

স্রোতকে খরস্রোতে পরিণত করতে
আমরা দুজনেই ঢেউ তুলছি  ।
আমাদের নৌকা এগিয়ে যাক
অনুকূলে
.            মহাসঙ্গমে

অস্থির প্রচেত কত দৃশ্য রচনা করছে
মহাকালের বাল্মীকি উচ্চারণ করছে
কত স্তব স্তুতি
শুনতে শুনতে আমাদের সংসারেও
প্লাবন আসছে
ছোট্ট সংসার অনন্তের ইচ্ছার বাঁশিতে
বেজে উঠছে

হাঃ হাঃ
আমাদের হাসির পাশে কোনো বিস্ময়চিহ্ন নেই
ঝকঝকে জলের ঊরুর মসৃণ আভা
সৃষ্টিতত্ত্বের সংকেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে

আমরা স্পন্দিত হচ্ছি মহাসঙ্গমের পূর্বমুহূর্তের একান্ত আলাপে

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নারীদের কথা
কবি তৈমুর খান

সব নারীরাই কাছে ডাকছে
আমি যেতে পারি না
আমার সব ইচ্ছা জল হয়ে যায়

শস্যচাষ চলতে থাকে
এইমাঠে আমিই কৃষক
আমাকে চেনে না কেউ
জল গড়ায় , জল গড়ায়
জল অবিশ্বাস

অবিশ্বাস সাপ হয়ে আসে
কিছু কিছু ছোবল রক্ত ঝরায়
বিষও থাকে
বিষও একদিন জল হয়ে চোখে নামে

সব নারীরাই তরুলতা
ফুল ফোটায়
হাসে
ইশারায় কথা বলতে থাকে

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
রূপক মানুষ
কবি তৈমুর খান

গায়ে গা লাগিয়ে চলে যাচ্ছে দিন
দিনকে বলি না কিছু
.                   সব মৃত ঘোড়াগুলি রাতেই স্বাধীন

সব প্রাণ ফিরে এলে
.                  আরও এক অসামাজিক রাষ্ট্র তৈরি হয়
ইতিহাস জানে না সেকথা
.                   রাষ্ট্র বিজ্ঞানে শুধু দ্বিধা
.                                  অনুমান কথা কয়ে যায়

সন্তান সম্ভাবা সব আদিম প্রহেলিকা
দূর অন্ধকারে জ্বালে আগুনের শিখা
.                   মেঘ ডাকে দ্রৌপদীর ঘরে
.                                পঞ্চতিরে কাঁপে পাঞ্চালিকা

সন্ধ্যার আড়ষ্ট গান বর্ষার ঠোঁটে
ময়ূর ময়ূরী খায় নিঃশব্দে চেটে
বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে মেখে ৠতুমতী গাছ
সঙ্গম সেরে নিচ্ছে কুরুক্ষেত্র মাঠে

নীল ঊরুর দিন এই ফাঁকে ফ্রক খুলে হাসে
বিষন্নকাল কান্না মোছে মনমাটির ঘাসে
তবু এক গ্রাম্য ঢেঁকি ভেনে চলে অলৌকিক ধান
কৌশল্যা একাকী শোনে বিরহী ঘুঘুর গান

আমরা দুপুর চিনি , আর চিনি দুপুরের লোক
নির্বোধ পাড়ায় হাঁটে সুবোধ শোলোক
দ্বার বন্ধ হাহাকার           ঘামগন্ধ আসে তার
.                                 পাড়ায় পাড়ায় ছোটে নষ্ট খবর

তখন বিকেল যায়, আকাঙ্ক্ষার গায়ে জ্বর
আত্মবিশ্বাস মৃত্যুগন্ধে ভরে দেয় সংসার
হাঁটু অবধি গামছা পরা, হলুদ পা, রক্তহীন
গুলিবিদ্ধ শরীর দেখায়, মৃত সব ঘোড়সওয়ার

রাষ্ট্র আইন কোথায় কারা, দিশেহারা সভ্যতায়
অস্থিহীন বস্তিতে নিদেন ঝুপড়ি অগ্নিলীলায়
শহর ঘুরে একই সুরে হর্ন বাজায় ভ্রমের গাড়ি
গাড়ি চড়ে আসে রাত, কী সুন্দর শুভ্র শাড়ি

তাঁর দাঁতে দাঁত, লুকোনো দংশক
মধুর কথা  স্বপ্ন মেদুর উড়ছে বহুদূর
সব ভস্মেই ওড়ে ছল - চতুর
সব সুখে লেখা অসুখের গুঞ্জন

তবু মৌচাক খুলে খুলে মধু দেয়
মৃত্যু ঠেলে নৌকার হাসি চাঁদ একা তুলে নেয়
জোর কদম , কিন্তু পা কই?
হাতের আঙুলে কুষ্ঠ , কল্পনার সিঁড়ি
.                         বাতাসের মই
.                             এখনও বয়ে ফিরি

দাঁড়াও  কালের সড়ক,
.             শব্দ দিয়ে তৈরি করা আমার সরণি
.                             তোমরা দ্যাখোনি
.                                   পথের দুপাশে শুধুই মড়ক

লেজ দুলিয়ে কে যায় বচন?
শুনব না আর মনভুলানো পাড়াজুড়ানো
.                            খাজনা দেওয়ার বাণী
.                    ছড়াগুলি কুলোর বাতাস শিশুর সিম্ফনি

দুয়ার যারা খুলছে দুয়ারবিহীন ঘরে
হৃদয় তারাই দেখাচ্ছে হৃদয়হীন শরীরে
তাদের কাছেই ঘোড়াগুলি বাঁধা
আমরা সব পদলেখা জীব চণ্ডীদাসের রাধা

একটু ধীরে বাঁশি বাজাই , জোরে বাজানো মানা
রাজার দেশে ভোটনহবৎ , সন্ত্রাসের হানা
আমরা সবাই চোখের জলে সাঁতার কাটা মাছ
যখন ইচ্ছে বধ্ করে খায় রাজনৈতিক সমাজ

দেখতে দেখতে সুবর্ণ দিন পেরিয়ে চলে যায়
দিনের শেষে একমুঠো চাল যদিও ভাত হয়
ভাতের গল্প থাক না হয়
ঘর নেই কো , দুয়ার নেই কো, ঘোড়া তবু
.                                       চেয়ে থাকে জানালায়

মেঘ ওঠে খুব , লাল ঈশানে , ঝড় ওঠে তো উঠুক
অপ্রাকৃত বোধের সাথে খড়কুটো সব উড়ুক
উড়তে উড়তে এসংগ্রামে লিখুক পরাজয়
জয়-পরাজয় মিথ্যে সবই , মনে মনে যদিও সব বাসর সাজাই

টক ফলের স্বর্গরাজ্যে ব্যাঘ্র করে বাস
নেহাৎ নিরীহ আমরা তাই খেতে থাকি ঘাস
ঘাস ফুরোলে পাড়া জুড়োলে উপোস দেওয়া রীতি
রীতির ভেতর বাল্যকাল ঘুমিয়ে থাকে স্মৃতি

ইতিহাস চেঁচিয়ে ডাকে , জন্ম তবু জন্মান্তরে যায়
হয়তো সে এক কাঠুরে, বনে সোনার কুড়ুল পায়
রূপকথায় আর সততায় ধর্ম এসে নামে
কে যে কাকে চিঠি পাঠায়  সাদা মেঘের খামে!

কমলবরণ শোভায় ফোটে রাতের তারাগুলি
তারার ভেতর লুকিয়ে রাখি হারানো ডাংগুলি
কখন যে আবার খেলা হবে ভাবে আগুনশিশু
বুকের ভেতর গোপন থাকে রক্তঝরা যিশু

ঘোড়ার মুখে ফুটে ওঠে মনুষ্যচরিত
আয়নাওয়ালা আয়না দেখায় একান্ত নিভৃত
লাল আলো ,  নীল আলো অজস্র সংকেতে
হুইসল আর কলিংবেলে বাজতে থাকে রাতে

চেনা যায় না কে কোন্ দ্বীপ,  কে কোন্ স্বরলিপি
নির্বাসিত হতে হতে ইশকাপনের বিবি
গোলাম রাজা সবাই থাকে, থাকতে থাকতে চোর
সুযোগ পেলেই দাঁও মারে সব এমন হারামখোর

ঝড় সামলে নতুন জামায় মুগ্ধ বিচক্ষণ
গতানুগতিক পথেই হাওয়া খাচ্ছি সারাক্ষণ
সবাই বোঝে , আমরাও তাই জবাই হওয়া জীব
মিথ্যা ভণ্ড দরবারে আজ খুঁজছি সত্যশিব

সব উদ্ভাবনের ভেতর থেকে জলীয় ঘুম ভাঙে
দ্বিধাদ্বন্দ্ব কুয়াশাতে আকাশও শিং নাড়ে
ঘোড়াগুলো মহিষ হয়ে খোলস ছাড়ার ঢঙে
অন্ধকারে অন্ধ হয়ে চতুর্দিকে বাড়ে

নেহাৎ একটা জ্বর লিখে রোজ শান্ত স্বভাব ছায়া
দুর্বোধ্যরা ধরে নিচ্ছে এই মনুষ্যকায়া
একে সবাই লোকভাষাতে কহে দিনের লোক
লোকারণ্যে এদেরই দ্বারোদ্ঘাটন হোক।

.             ****************                                
.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর