কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামীর কবিতা
*
কেন?
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার কার্তিক ১৩১৬ ( অক্টোবর ১৯০৯ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া |


.                ১
ওগো কবি ছিয়ে ছিয়ে  হা ধিক্ হা ধিক্ !
আবার জাগিল ঈর্ষ্যা, ভৈরব হুঙ্কারে,
সুকোমল সাহিত্যের ললিত বিপিন,
বিকম্পিয়া, দম্ভভরে কেন দিলে সাড়া ?
‘বিজয়’ পশ্চাতে তব, সঙ্গে মতিমান্
বন্ধুবর্গ, প্রতিভার উজ্জ্বল অনলে
দম্ভের ইন্ধন রাশি করিয়া প্রক্ষেপ
তুলেছে করিয়া তোমা হেন আত্মহারা ?
দম্ভ অদ্রি শিরোপরি গৌরবে বসিয়া
দেখিতেছ সবে ক্ষুদ্র, সঙ্কীর্ণ, মলিন |
ভঙ্গিকর হাস্যকর দম্ভ বিকাশিয়া
Mathurin, Lucilius যাহা ইচ্ছা সাজি,
চিত্ত-উত্স হতে দেও ঢালি অকাতরে
অবাঞ্ছিত মধুরাশি, ভক্তি সহৃদয়—
যাদুদের মনোমাঝে, করিতে সৃজন
কাব্যের বিচিত্র লীলা, হাসি অকিঞ্চন
কল্পনার ব্যঙ্গভরা স্থূল রঙ্গরাশি |
শিখিপুচ্ছে প্রসারিত বায়সের দল
তোমার মল্লার রাগে নাচিয়া বেড়াক |

.                ২
নীতিভ্রষ্ট,  প্রেমপুষ্ট লাঞ্ছিত রবীন্দ্রে
নাই নাই কিছু নাই শুধু দুষ্ট-প্রেম,
শুধু হাসি অভিসার চকোর চুম্বন,
বাসিমালা-কোলে-করি রজনী যাপন |
স্বর্ণথালে “নৈবেদ্যের” মন্দার মঞ্জীর,
দেবদ্যুতি বিকারিয়া ঢালিছে পীযুষ,
ঈর্ষা বিনিময়ে যদি হৃদয়-চষক,
সে অমৃত নিত ভরি, শিরায় শিরায়
প্রসন্ন সরল প্রেম বহিত মধুর |

.                ৩
গান ছেড়ে, হাসি ছেড়ে জগতের কবি
মহিমায় মহীয়ান, বঙ্গের গৌরব
জ্যোতিষ্ক রবিরে চাও শিখাইতে রুচি !!
পাষাণে গঠিয়া বপু সগর্ব্বে সে মুসি
আপনারে দম্ভসহ করিছ প্রক্ষেপ
চূর্ণ করিবারে ওই অদ্রির শিখর |
রুচিশীলে ডাকিতেছ হইতে সহায়
দুর্নীতি কন্টক-দলে আবিদ্ধ ভারতী,
বেদনা উঠেছে বেজে হৃদয়ে তোমার,
তাই আজি প্রিয়সখা বাঁধিয়া কোমর
কবি-বীণা দূরে ফেলি, গদাধারী হ’য়ে,
বিদ্ধ কন্টকের দলে নির্ম্মূল করিতে
উঠিতেছে গরজিয়া, বলিহারি যাই !!

.                ৪
ওগো কবি ! প্রেম ! প্রেম ! চুম্বন-চয়ন !
অধরে মদিরা ঢালি, কবিতা সৃজন,
অসহ্য অশ্রাব্য, রুক্ষ্ম, কাব্যের ভাণ্ডারে
হেন কাব্য অবশ্যই পাইবে না স্থান |
চণ্ডালের হাত দিয়া এসো ‘মানসীরে’
পুড়াইয়া ছাই করি, মাখাই রবিরে |
গানে প্রেম, ধ্যানে প্রেম, রূপে প্রেম-ঝরা
রবিরে এসোহে করি চির নির্ব্বাসন |
আমরা আষাঢ়ে নিয়ে হাসিয়া হাসিয়া
করিব গুড়ুক ফুঁকে জীবন যাপন |
হে কবি উজ্জ্বল, রস রসশিখরিণী
পরশে কোকিল তার করে কুহরণ,
সমীর মলয় রূপ করিয়া ধারণ,
কলিকার বক্ষ মাঝে, সঞ্চারি যৌবন
বিলাস হিল্লোলে তারে রাখে মাতাইয়া |
হৃদয়ে বাসনা বাস, ফুলে পরিমল,
অধরে ফুটিয়া উঠে, মণিয়ার হাসি,
প্রেম-স্নাত মন সদা ধায় অভিসারে
উল্লাস চঞ্চল পদে, দুনয়ন মেলি
হেরিতে সে চারুতায়, ডুবিতে তাহার,
অতল হৃদয় তলে তুলিতে রতন |

.                 ৫
আমরা সহায় তব, হেমেন্দ্র, রামেন্দ্র,
বিজয়, সুরেশচন্দ্র---এসো মিত্রগণ !
প্রণয় বিকীর্ণ বঙ্গ, অরূচি প্রবাহে
দেখ আজি পরিপ্লুতা | রবিচিত্ত হ’তে
প্রবাহিত হইতেছে দুর্নীতি জীবন |
ধর্ম্ম নীতি সমাজের হিতকল্পে ভাই,
সমবেত বলরাজি করিয়া প্রয়োগ,
রবি হতে রবি-দ্যুতি লইয়া ছিনায়ে
মলিন করিয়া তারে এসো সবে রাখি |
অতি দূরে দুর্গাদাস করিছে গর্জ্জন
চিতোরের শৈলে শৈলে প্রতিধ্বনি তার
চীত্কারিয়া উঠিতেছে, শুধু দীর্ণ করি
আকাশ-ইথর-ভরা গভীর পরাণ |
প্রেম আনে অবসাদ ; খুব সাবধান
রবির প্রেমের আলো করিতে নির্ব্বাণ |
ভাবে ভরা শুভ্র স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য-মালায়
বিদ্বেষ তমিশ্রা রাশি করিতে মিশ্রিত
এই বার ঈর্ষা তব তৃতীয় প্রকাশ |
জানি আমি বিষমিশ্র সুধা কন্ঠে তব,
অনেকে উঠিবে মাতি, অনেকে আবার,
বিজনে বসিয়া দিবে দুই হাতে তালি,
বাখানিয়া উচ্চ-কন্ঠে রবির লাঞ্ছনা |
নগ্নতায় অশ্লীলতা যে বলে বলুক,
নগ্নচিত্র সৌন্দর্য্যের প্রকৃত আশ্রয়
সৌন্দর্য্য কিরণবাসে, সদা প্রকাশিত |
সত্য, শিব, শ্রেয়ঃ, সবাই নগন
অশিব অসত্য চায়—শিষ্ঠের বসন |
কত লোকে সুরুচির মাহাত্ম্য ঘোষিতে
ক্ষুদ্র গৌতমের কার্য্য করিল জাহির,
হায় হায় কি বলিব কপালের দোষে
Such and so various are the
.                                     tastes of men.

হায় কবি রুচি তব ফণি ফণা ধরি
গরজিছে শিত্কারিছে গরল গৌরবে,
ঢুলাও আপন শির অদূরে রবির,
কন্ঠ মুরলীর তান কি আলাপে শুন |

.                ৬
ডন জোয়ানের কবি ওই দেখ শোভে
উদ্ভাসিয়া সাহিত্যের নির্ম্মল আকাশ |
গর্ব্বস্ফীত জেফেরির পেচক চীত্কার
এখন গাজে না আর সৌন্দর্য্য বিপিনে
জেফেরির বিদ্বেষের বিষনয়ী ভাষা
সুপ্ত হ’য়ে এবে যেন কোথা আছে পড়ি |

.                ৭
স্নিগ্ধ-রশ্মি-রেখা দিয়া শরতের শশী
সাজাইবে প্রেম-মুগ্ধা কুমুদ বালায়,
বিধূরা রথাঙ্গ-বধূ, সৈকতে বসিয়া
চির নিশি মিলনের করিবে ধিয়ান ;
মেঘ যে সে মেঘে চায় |  শিখিনী শিখিনী,
নাহি থাকে কন্ঠে তার কম কহু তান |
রবিরে অরবি কেন করিবার তরে
ঘূর্ণিত মস্তক তব, উদ্যম-পীড়িত ?
দ্বিজেন দ্বিজেন রবে, রবি রবে রবি,
কেন ঈর্ষা দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ হে হাসির কবি !

.             *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
গর্ব্বী
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩১৬ ( জুলাই ১৯০৯ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া |


.                                                  ‘The best of men
That e’er wore Earth about him was sufferer ;
A soft, meek, patient, humble, tranquil spirit,
The first true gentleman that ever breathed.’


দম্ভ আজি মূর্ত্তি ধরি তোমারি ভিতর
বাঁধিয়াছে নিজ নীড়, হে গর্ব্ব-সম্ভব !
অঙ্গ-ভঙ্গি প্রকাশিয়া, উদগারি বচন,
কানকী জোনাকী দলে আপনার জ্যোতি,
দুর্দ্ধর্ষ ক্ষমতারাজি করিছ জ্ঞাপন ;
কুটবক্ষে বশীভূত ছুছুন্দরী রাজি
উপরে সোণালী সাজ ভিতরে বালুকা,
গোময়ে জোনাকী গোঁজা বুদ্ধির কিরণ |
বংশ-মঞ্চস্থিত অহো, কুষ্মাণ্ড-সন্নত !
বৃথা ভাব আপনারে ভেনাস
( Venus ) অনুজ ;
তুমি যাহা তাই যদি বুঝিতে বারেক,
উপেক্ষার নিষ্ঠীবন করিয়া নিক্ষেপ
বাইতে না প্রতিভার করিতে নির্ব্বাণ,
কেড়ে নিতে চাহিতে না সুজন সম্মান |

.             *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
জন্মভূমি
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬ (মে ১৯০৯ ) সংখ্যা
থেকে নেওয়া |

.                ১
এই মম জন্মভূমি !  শ্যামা, বরাঙ্গনা
স্নিগ্ধরশ্মি উন্মেষিণী, সতত শোভনা,
তরুরাগে বিশোভিত স্নিগ্ধ চলদল
তমাল পনস নীপ বঞ্জুল নির্ম্মল
পাতিয়াছে বক্ষে যার, শান্ত স্নিগ্ধছায়া,
প্রগাঢ় প্রশক্তি ভরে শীতলিতে কায়া |

.                ২
এই মম জন্মভূমি !  সুবর্ণ সিচয়া,
লক্ষ্মীরূপে পদ্মনেত্রে বিচ্ছুরিত দয়া ;
নিশ্বাসে প্রবাহে যার বসন্ত অনিল
বক্ষে বহে ক্ষীর ধারা----প্রসন্ন সলিল ;
মুখরিত পিক কন্ঠ ---কুহরণ ছন্দ,
রেণুভরা পদ্মলোধ্র, কুন্দ, মল্লিগন্ধ ;
স্নেহরস পরিপ্লুতা মমতা-রূপিনী
যার সান্দ্র বত্সলতা অতিভূ-গামিনী |

.                ৩
সবগুণ বহে যার ধমনী ব্যাপিয়া,
সেই দেবী জাগে ওই প্রীতি বিথারিয়া,
ববিষ্ঠা, বরেণ্যা, স্নিগ্ধা, বেদপরায়ণা
মাধ্বিক বর্ষিণী মাতা পদুম আননা !
ধ্যান যার, হিমালয় মূরতি ধরিয়া,
দৃঢ়ভাবে স্বর্গস্পর্শী আছে দাঁড়াইয়া |

.                     ৪
এ দেবতা জগতের কল্যাণদায়িণী
সপত্নী সন্তান তরে দীপ্তি-বিধায়িনী,
তামসী, রাজসী পূজা রক্ত উত্ক্ষেপণ,
দম্ভের উদ্ভ্রান্ত গাথা, বীরত্ব গর্জ্জন
মা আমার নাহি চান |  মা চান কেবল,
শান্তি, প্রীতি,দয়া, শ্রদ্ধা, নহে পশুবল ;
উচ্ছৃঙ্খল নীতিভ্রষ্ট, রিপু-পদানত
ক্লিষ্ট ক্ষিপ্ত সুপ্তচিত্তে করিতে জাগ্রত |

.                ৫
মা আমার করুণার দেবী মূর্ত্তিমতী
আর্ত্তে দৈন্যে আধিগ্রস্তে কল্পরূপাসতী
শস্যপূর্ণ, নেত্ররম্য বিশাল প্রান্তর
স্বর্ণবীথি বক্ষে ধরি হাসে নিরন্তর ;
প্রীতিগর্ভা শৈবলিনী সৌম্য শৈলমালা
শষ্পস্তীর্ণ তরুতল যেন শান্তি ঢালা
শ্যামল কান্তার-কান্তি, আস্বাদললিত
কল বনকলিতে ভরা, পবন বেষ্টিত
সুনীল উল্লোচে জবাকুসুম শঙ্কাশ,
মহাদ্যুতি অরুণের অপূর্ব্ব বিকাশ ;
অমঞ্জীর-পদা-কম্র ঊষা রূপসীর
অতি মৃদু চলনের ক্ষরিত মদির
পান করি, পদ্মরাণী বিদ্যুৎ কম্পনে
হাসিয়া ডাকিয়া লয় নব জাগরণে |

.                ৬
দ্বিরেক গুঞ্জন কল কাকলির তান,
কাণের ভিতরে যেন সুধা করে দান |
শুধাংশুর অতি মৃদু অতি মৃদু কর
শ্রান্ত প্রাণে সুধাসিঞ্চি করে মনোহর |
অনিদ্র প্রবণা তারা আকাশে বসিয়া
কান্তিময়ী দেবতায় দেখে নিরখিয়া,
এমন চারুতা তরা জননী আমার,
মমতা কম্পিত বক্ষে প্রীতির পাখার
স্ফুটপ্রভা সাত্বিকতা চির সঞ্জীবনী
ছড়াইছে শক্তি-স্রোত দিবস রজনী |

.                ৭
স্থাপিয়া হৃদয় মাঝে বিতথ্য মালার
কে উহারা, বিদ্যুজ্জিহ্ব পূজা তরে ধায়,
কে উহারা অসংযমী নির্ম্মল হৃদয়
তামসী পূজার ক্রিয়া করে অভিনয় ?
প্রচ্ছন্ন পিণ্ডন যারা দেবী পূজা তরে
হোতৃ বেশে কেন ব’সে বেদীর উপরে ?
মায়েরে পূজিতে চাও, মুগ্ধ ভক্ত হয়ে
পরিহরি দ্বেষ, হিংসা, অর্ঘ্য হাতে ল’য়ে,
কাঙ্গালের বেশ ধরি, হও অগ্রসর,
ধর্ম্ম সূত্রে ভা’য়ে ভা’য়ে বাঁধ পরস্পর |

.                 ৮
মা আমার স্বার্থ পশু রুধির ঈপ্সিতা
ওই ভোগ্যে ওই কাম্যে হন পুলকিতা,
বিচারের তীক্ষ্ণ অসি নিজ হস্তে ধরি,
একাঘাতে স্বার্থপশু দুই খণ্ড করি,
মহোল্লাসে প্রিয়তম উঠ গরজিয়া
শুচি হোমানল চিত্তে উঠিবে জ্বলিয়া |

.             *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
১লা পৌষ, স্বর্গীয়া ** দেবীর চিত্র দর্শনে উচ্ছ্বাস  
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার চৈত্র ১৩০৮ (মার্চ ১৯০২ ) সংখ্যা
থেকে নেওয়া |


ছবিখানি নেহারি তাহার
বুক যেন ভরে এলো আঁধারে,
পুরাতনে নূতন করিয়ে
কতদিন পরে পুন কাঁদাবে !

ভালবাসা-মাখান বয়ানে
প্রাণ যেন, আছে এবে নিহিত,
হাঁসির চিকণ শশী লেখা
এখনো প্রেমেরে করে মোহিত |

ছল ছল করিয়া নয়ন,
আসিতেছে ভিজে আজি যেন রে,
কৃণুর অঙ্কিত ছবি নেহারি,
তার তরে একা কাঁদি কেন রে ?

বিশ্বাসতো নাহি মনে জাগে,
তারে আমি ফেলিয়াছি হারায়ে,
লতিকা বিতানে বুঝি সেগো,
আমা তরে আছে এবে দাঁড়ায়ে !

হয়তো তুলিছে কত ফুল,
দোহে ব’সে মালা গাছি গাঁথিবে,
আঁচল ভরিয়ে “রাজু” মোর
আমা কাছে এখনিতো আসিবে |

জাগরণে অলস স্বপন
স্মৃতিরে পিয়ায় দারু যতনে,
এমর জীবনে কভু আর
পাইব কি সেই প্রিয়া রতনে ?

বসন্ত যা দূরে গেছে চলি
কাছে জাগে শরতের জোছনা,
কেঁদে কেঁদে শুধু মাঙা হাসি
হাসি দিয়া জীবনের রচনা |

হাসে তরু হাসে ইন্দু বসি
হাসে শেফা মাতৃহারা তনয়া,
শরতের অক্ষ মাঝে শোভে
নবজাত শিশুবর্ণ কপয়া !!

আসে অশ্রু টুটি হাসি বুক,
হাসি আসে অশ্রু বুক চিরিয়ে,
চলে যে গিয়াছে তারে ছেড়ে
নূতনেরে আনি স্নেহে ঘিরিয়ে |

নিরদয় হয়ে সেই দিন,
পুঁছেছি নয়ন জল বসনে,
পুরাতনে চাপাইয়া ভুল,
বসায়েছি চিতবনে নূতনে |

নিরাশাও দূরে যায় চলি,
সুবর্ণ মঞ্জীর দিয়া চরণে
শত উর্ব্বশীর রূপ লয়ে
আসে আশা ভগ্ন কুঞ্জ কাননে |

পিক পুন আলাপে পঞ্চম,
বাসনা উছলি উঠে মরমে,
অনুরাগে সাজাতে হৃদয়
আপনি চমকি উঠি সরমে |

স্পর্শ করে স্বজন বিরাগ
পিতা মাতা ঘৃণা দেন ঢালিয়া,
আসক্তি বৈরাগ্য রূপ ধরি
একাকিনী উঠে প্রাণে কাঁদিয়া |

.             *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
কীর্ত্তিমান
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার কার্তিক ১৩০৮ (অক্টোবর ১৯০১ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া |


আদরে তার                     ছেয়ে গেছে,
.              দশটা দিক         
কাব্য-বনে                 তেঁই বটে আজ,
.              দ্বিতীয় পিক |
প্রতিভা তার                      সোজা নহে
.              সর্ব্বতোমুখী,
সে বক বকমে                       কর্ত্তে পারে
.               সজ্জনে সুখী |
বোঝেনা যে                    সেও বলে সে
.               লেখক ভারী,
ভাগ্য ভাল,                      প্রয়াগ তীর্থে
.                বসত তারি |
তাইতে বিজয় !                         ভাগ্যধর
.                রাজার রাজ !!
আমরা কজন                     কেবল আছি
.                  স্তাবক সেজে,
নিন্দা তাহার                          কল্লে কেহ
.                উঠ্ ব বেজে !
যুক্তি বলে                          তর্ক করে,
.                হারিয়ে দিয়ে,
ক্ষুধার আগুন                      জ্বালিয়ে দিব,
.                  আবাস গিয়ে |
Real beauty                      আমরা ছাড়া,
.                বুঝবে কেবা ?
কচ্ছি আমরা                         যত্ন ক’রে
.                  বাণীর সেবা |
পাঠক বর্গে                        যা শিখাচ্ছি,
.                শিখছে তাই,
আমরা জানি,                      আমরা ছাড়া
.                আদ্ মি নাই |

.         
       *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
প্রেয়সী
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার কার্তিক ১৩০৮ ( অক্টোবর ১৯০১ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া |


তার         চম্পকরূপে            যৌবন আসি
.                    করেছে মাধুরী বিথার,
তার         কম্র হৃদয়ে              উদ্দাম প্রেম
.                       সতত করিছে বিহার ;
তার         নয়ন যুগলে            হরষে তরষে
.                    বরষে আশার কাহিনী,
তার         নির্ম্মল প্রাণে,        পিরীতি বসিয়া,
.                    আলাপে মধুর রাগিণী |
.         প্রেমরাগ তার            রূপের লহরী
.                 রোধিয়া রেখেছে শরীরে
.         বিশ্ব নতুবা              যাইত ভাসিয়া
.                  উজ্জ্বল রূপ মদিরে ;
.        গতিটী তাহার,               স্বভাব মৃদুল
.                   মুখর নুপূর চরণে,
.        যৌবন গাথা             ঘোষে অবিরল
.                  মধুর ললিত রণনে |
.        ভাষা দিয়া তার,     মণিক ঝরিয়া
.                 বরষে বীণার কাকলি
.        বিশ্ব মাঝারে            দেবী স্বরূপিনী
.                 আমার প্রেয়সী কেবলি !
সেযে    বন্দী করিয়ে,            রেখেছে আমার
.                তাহার গুণের কারায়,
আমি     চাহি না স্বরগ,     চাহি না গোলক,
.                ভাল যে বেসেছি ধরায়
.          সাঁজের বেলায়,       বকুল তলায়,
.                 দুজনে গাথিয়ে মালিকা,
.          দুই জনে বসি,       এক মনে শুনি
.                 গাহিছে মুখর শারিকা ;
.          আমরা দুজনে,       শান্তি সলিলে
.                 সতত থাকি যে রসিয়া,
.          প্রভাত প্রদোষ,        সন্ধ্যা নিশীথে
.                 প্রকৃতি দাঁড়ায় হাসিয়া |
.          দুইটী প্রাণের          এমন মিলনে
.                  বিরহের ভয় নাহিরে |
.          তাইতে আমরা     দোঁহাদুঁহু ছাড়া
.                  আর কিছু নাহি চাহিরে |
.          চাঁদেতে যেমন     দেখি শোভারাশি
.                  তেমতি শোভন আঁধারে,
.          সব আছে বলি,       সুখের রোদনে
.                  কেঁদে ভাসি প্রেম পাথারে |
এবে      রোদনে নাহিক           একটু বেদন
.                   বেদনে নাহিক যাতনা,
.          যত দুখ ছিল,           সুখে পরিণত
.                    গভীর হরষে বেদনা |
.          অপার প্রেম               অমেয় ভক্তি
.                     বসেছে হৃদয় জুড়িয়া,
.           তৃপ্তি হীনতা,            বাসনা পিয়াসা
.                      গিয়াছে অনলে পুড়িয়া |
.           “সুন্দর যিনি”                    সুন্দর তর
.                      করেছে দোঁহারে রচনা
তাই,       তৃপ্তি হীনতা             বাসনা পিয়াসা
.                      গভীর নিরয়ে মগনা |
ওরে       আমার প্রেয়সী,         গুণেতে শ্রেয়সী
.                     আদর সুধার খনিয়া,
আর       নিখিল হৃদয়            করিতে শীতল
.                      খিদির স্নিগ্ধ মণিয়া |

.                *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
শ্রাবণে – শূন্য মন্দির
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার আষাঢ় ১৩০৮ ( জুন ১৯০১ )সংখ্যা
থেকে নেওয়া |


দেখিতে যাদেরি সাধ নাহি দেয় দেখা
আমি বড় একা আজ আমি বড় একা !!

শঙন গগনে ঘেরা নীরদ-কাজল,
শিখীদেব করিয়াছে বড়ই চঞ্চল,
পড়েছে মেঘের ছায়া তমালে বকুলে,
বসে আছি আনমনে মেঘদুত খুলে,
কেতকী কদমে ঢালে পবনে সুবাস,
মরম ঢালিয়া দেয় নিবিড় নিশ্বাস |

নবতৃণে শ্যাম শোভা উঠেছে জাগিয়া,
‘বউ কোথা’ ? পাখী কাঁদে থাকিয়া থাকিয়া
অশরীরী পাখী ওটি, অশরীরী পাখী,
নীরবে মরম মাঝে, ডাকে থাকি থাকি,
শব্দ নাই রাব নাই, নাহিক কূজন
অতীন্দ্রীয় জ্ঞানে জাগে মৃদুল কম্পন,
গরজি বিরহ সিন্ধু উঠে আস্ফালিয়া,
অশ্রুসিক্ত চক্ষু আসে সুধীরে মুদিয়া |

নহে শ্যামা, বিগলিত কাঞ্চন বরণা
নহে সেই সহচরী শিখরি-দশনা,
নয়ন ঘোষে না তার হরিণী প্রেক্ষণ,
কেশরী জিনিয়া নহে ক’টির গঠন,
রূপের বৈচিত্যে যাহা হৃদয় তাহার
ভিতরের শোভা করে বাহিরে  বিস্তার,
প্রেমদীপ্ত ব্যথাতুর যুগল নয়ন
সমভাবে হাসি অশ্রু করে বরিষণ |

সেই মম প্রেমকুঞ্জ, যৌবন-বরষা,
লাবণ্য শীকরে তারে করিছে সরসা
“ইন্দুরেখা” “তরলিকা”  দুটি চন্দ্র কলি,
পুষ্পরূপা অলি কন্ঠে করিছে কাকলি,
( তাদের ) সুধামাখা আধ ভাষা ধৈবতে জাগায়
( তাদের ) সুবাসে চামেলি-চম্পা গৌরব হারায়
কাছে তারা নাহি বলে হৃদয় গুহায়
হর্ষ গুচ্ছ মগ্ন, আছে গভীর নিদ্রায় |

চারি ধারে বিরহেরা করিতেছে খেলা,
বাহিরে বিষাদ ঘেরা নীরদের মেলা,
মন্দ্র ধ্বনি, মন্দাক্রান্তা, করি আলাপন,
প্রতিধ্বনি প্রাণ মাঝে করিছে সৃজন,
নিভৃতে মানসী বসি আপনার মনে,
তুলিছে নূতন করি শত পুরাতনে |

বাদলের রিমি রিমি ঝিমি ঝিমি তান,
বাহিরে ভিতরে করে বিষাদের গান,
নিসর্গে বিজলি ছোটে, নয়ন সকাশে,
নয়নের অভিরাম বিজলি না হাসে ;
দিনের বেড়েছে কায়, দীর্ঘতর তনু—
বিতত বিস্তৃত ম্লান বিভাবরী জনু—
আপনি আপন কাছে ছেড়ে চলে যাই,
উদ্দেশ্য বিহীন পদে হেথা হোথা ধাই |

এই আছি আপনার নিভৃত কুটীরে,
নিমিষে গিয়াছি চলে শিপ্রা নদী তীরে,
অবন্তী শিংশপা বনে ‘উদয়’ন কথা,
কার মুখে শুনে যেন উপজিছে ব্যথা,
প্রাণ মাঝে ভেসে আসে পরের বেদনা,
নিজে কেঁদে, পরে বলি কেঁদনা কেঁদনা |
মেঘ কন্ঠে দুন্দুভির হতেছে নিনাদ,
বিরহ বর্ষিছে ধীরে নীরব বিষাদ |

.                *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
খান বাহাদুর মৌলভী মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ (ডিসেম্বর ১৯৩৭ )
সংখ্যা থেকে নেওয়া |


মৃত্যু তুমি নহ ভয় নহ বিভীষিকা
অরূপা শান্তির রূপে তুমি বিগঠিতা
ধ্যানের মাঝারে তব সৌন্দর্য্যের শিখা
আমার হৃদয়ে করে আনন্দ স্পন্দিত
আমার জড়িত সখা মজিদ আমার
শান্তিপুরে গেছে লয়ে মঞ্জুল মরণ,
নাহি সেথা রোগ শোক নাহি অহঙ্কার
নাহি সেথা ক্ষমতার উত্কট পীড়ন |

কীর্তি তার কালবক্ষে দ্যুতি ছড়াইয়া
স্মৃতিরে উজ্জ্বল করে রাখিবে সতত
উদাত্ত হৃদয় তার মৃদুল হাসিয়া
ফিরায়ে আনিবে তাহা হয়েছে যা গত |
হার্দ্দ্য কোমলতা তার বহিবে সুবাস
দেখাবে প্রকৃতি তার মৃদু-মধু হাস |

আজ তুমি গেছ সখা দেখার বাহিরে
সৃষ্টি ক’রে চিত্তমাঝে মহা শূন্যতায়
ব্যথা মাখা ভালবাসা ছুটিয়া তিমিরে,
বলিতেছে ফুকারিয়া “কোথায় কোথায়” ?
বিষাদে গিয়াছে ভরি প্রকৃতি বদন,
সংসার হ’য়েছে যেন কেমন মলিন ;
জনপ্রিয় তার দুঃখ ঝরিয়া রণন
শোকের সাগর মাঝে হ’তেছে বিলীন |

কে করিবে সযতনে অতিথি সত্কার
বুভুক্ষার তীব্রতায় কে ঢালিবে জল ?
কে করিবে প্রাণপণে শিক্ষার প্রচার !
নাহি তুমি তাই আজি হৃদয় চঞ্চল
তুমি ছিলে কি-যেন-কি অপূর্ব্ব রতন
এমন হবেনা আর, হবেনা এমন |

.            *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
জেগে কাঁদা
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
শৈলেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত “বঙ্গদর্শণ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩১৯ (জুন ১৯১২ )সংখ্যা
থেকে নেওয়া |


তারি নব অনুরাগ প্রভাতে মিশিয়া,
উষায় তুলিয়াছিল, মধুর করিয়া,
দিয়াছিল পক্ষীকন্ঠে, সঙ্গীত নবীন
হৃদয়ে ফুটায়েছিল কণক নলিন,
কেবল সংসারে ছিল, প্রেম-আলোচনা
যৌবন উঠিয়াছিল, উল্লাসে ফুলিয়া
নব ছন্দে, নব গীত, আলাপ করিয়া |

স্বপ্ন-রাজ্য হ’তে রত্ন, আনিতে আহরি
ভাসাইয়া দিয়াছিনু প্রণয়ের তরী ;
চলেছিনু গান গেয়ে বাজাইয়া বাঁশী,
বহুবিধ রতনের হইয়া প্রয়াসী ;
তুলেছিনু পদ্মকলি, পদ্মের মৃণাল
গিয়েছিনু পদ্মমধু, সকাল, বিকাল ;
বাঁশরী ধৈবতরাগ, উগারি উগারি
তুলিত হৃদয়মাঝে, কুহক লহরী,
নিদ্রা, জাগরণে যেন করিব বেষ্টন
নয়নে সৃজিত তার মধুর স্বপন ;
জাগরণে ছিল নিদ্রা নিদ্রায় মদির,
সুখের প্রাচুর্য্যে দোঁহে হ’তাম অধীর,
তর তর, থর থর, বেতসী কম্পনে,
কাঁপিয়া উঠিত হিয়া, সতত সঘনে,
স্পর্শে স্পর্শে বিনিময়. ঈক্ষণে ঈক্ষণ
হর্ষে হর্ষে, বিকিকিনি, মধুর কেমন!
দিবসে আনন্দভরা, নিশায় মাধুরী
বসন্তের পিকের তান, বর্ষায় দাদুরী
অধর আনিত বহি অধরের হাসি
সুখের বিলাসে সুখ হইত উদাসী |
নয়নে আছিল ভরা শীতল বিজরী,
মধুর মাধুরী ছিল সর্ব্ব-অঙ্গ ভরি,
দখিন পবন ভরে নাচিয়া নাচিয়া
যেতেছিল তরীখানি সুধীরে ভাসিয়া
পুলকের আলোকের, মাঝারে সহসা
ঘনাইয়া মান-মেঘ ঢাকিল ভরসা,
বাত্যা এলো অন্ধকারে ছাইল আকাশ
দোঁহাচিত্তে ‘আমিত্বের’ হইল বিকাশ
কোথা হ’তে ব্যবধান বিতস্তি প্রমাণ,
আনিল মালিন্যরাশি অমার সমান,
প্রেমেরে দলিত ক’রে দাঁড়াল গৌরব,
সৃজিল সম্মুখে এক ভীষণ রৌরব,
উঠিল গর্ব্বের ঝড় ডুবাইল তরী,
স্বপন গিয়াছে ঘুচি, জেগে কেঁদে মরি |

.            *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর       
*
হেম-কলস
কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী
দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার আষাঢ় ১৩০৮ (জুন ১৯০১ )সংখ্যা
থেকে নেওয়া |


‘কিনি’ ‘কিনি’ কিঙ্কিনি বোলত মধুর,
রূপ গাথা ‘কঙ্কণ’ ঘোষয়ে প্রভুর,
কানাড়া ছাদনে গুম্ফিত কবরী,
মালতী মালিকা তাহার উপরি,
তনুরুচি, পঙ্কজ—মৃদুল বিকাশ,
প্রেমভরা অন্তরে, চামেলী সুবাস ;
নবীন যৌবনে প্রফুল্ল গুরুয়া,
সুনীল নিচোলে আবরি তনুয়া,
বনি বনি রঙ্গিনী, কুঞ্জর গমনে,
একু একু ভ্রমিছে নিকুঞ্জ ভবনে |
পুষ্পিত কাননে মলয় সমীর,
হরষে কম্পিত, বিকল অধীর,
শাখী শাখে, কোকিল পঞ্চম তানে,
ঢালি দেয় মরন্দ, জনু সব প্রাণে ;
উগারে মাধুরী শ্যামল লতিকা
ঢালিছে সুরভি, নবীন যূথিকা,
বিচকিত ‘সম্বর’ নয়ন প্রসারি
রসবতী অম্বর যতনে নেহারি
প্রেম মাখা অপঘন, অপঘন প্রেম
রাধা নহে সুধুরাধা, সুধা ভরা হেম |

.            *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর