. ২ নীতিভ্রষ্ট, প্রেমপুষ্ট লাঞ্ছিত রবীন্দ্রে নাই নাই কিছু নাই শুধু দুষ্ট-প্রেম, শুধু হাসি অভিসার চকোর চুম্বন, বাসিমালা-কোলে-করি রজনী যাপন | স্বর্ণথালে “নৈবেদ্যের” মন্দার মঞ্জীর, দেবদ্যুতি বিকারিয়া ঢালিছে পীযুষ, ঈর্ষা বিনিময়ে যদি হৃদয়-চষক, সে অমৃত নিত ভরি, শিরায় শিরায় প্রসন্ন সরল প্রেম বহিত মধুর |
. ৩ গান ছেড়ে, হাসি ছেড়ে জগতের কবি মহিমায় মহীয়ান, বঙ্গের গৌরব জ্যোতিষ্ক রবিরে চাও শিখাইতে রুচি !! পাষাণে গঠিয়া বপু সগর্ব্বে সে মুসি আপনারে দম্ভসহ করিছ প্রক্ষেপ চূর্ণ করিবারে ওই অদ্রির শিখর | রুচিশীলে ডাকিতেছ হইতে সহায় দুর্নীতি কন্টক-দলে আবিদ্ধ ভারতী, বেদনা উঠেছে বেজে হৃদয়ে তোমার, তাই আজি প্রিয়সখা বাঁধিয়া কোমর কবি-বীণা দূরে ফেলি, গদাধারী হ’য়ে, বিদ্ধ কন্টকের দলে নির্ম্মূল করিতে উঠিতেছে গরজিয়া, বলিহারি যাই !!
. ৪ ওগো কবি ! প্রেম ! প্রেম ! চুম্বন-চয়ন ! অধরে মদিরা ঢালি, কবিতা সৃজন, অসহ্য অশ্রাব্য, রুক্ষ্ম, কাব্যের ভাণ্ডারে হেন কাব্য অবশ্যই পাইবে না স্থান | চণ্ডালের হাত দিয়া এসো ‘মানসীরে’ পুড়াইয়া ছাই করি, মাখাই রবিরে | গানে প্রেম, ধ্যানে প্রেম, রূপে প্রেম-ঝরা রবিরে এসোহে করি চির নির্ব্বাসন | আমরা আষাঢ়ে নিয়ে হাসিয়া হাসিয়া করিব গুড়ুক ফুঁকে জীবন যাপন | হে কবি উজ্জ্বল, রস রসশিখরিণী পরশে কোকিল তার করে কুহরণ, সমীর মলয় রূপ করিয়া ধারণ, কলিকার বক্ষ মাঝে, সঞ্চারি যৌবন বিলাস হিল্লোলে তারে রাখে মাতাইয়া | হৃদয়ে বাসনা বাস, ফুলে পরিমল, অধরে ফুটিয়া উঠে, মণিয়ার হাসি, প্রেম-স্নাত মন সদা ধায় অভিসারে উল্লাস চঞ্চল পদে, দুনয়ন মেলি হেরিতে সে চারুতায়, ডুবিতে তাহার, অতল হৃদয় তলে তুলিতে রতন |
. ৫ আমরা সহায় তব, হেমেন্দ্র, রামেন্দ্র, বিজয়, সুরেশচন্দ্র---এসো মিত্রগণ ! প্রণয় বিকীর্ণ বঙ্গ, অরূচি প্রবাহে দেখ আজি পরিপ্লুতা | রবিচিত্ত হ’তে প্রবাহিত হইতেছে দুর্নীতি জীবন | ধর্ম্ম নীতি সমাজের হিতকল্পে ভাই, সমবেত বলরাজি করিয়া প্রয়োগ, রবি হতে রবি-দ্যুতি লইয়া ছিনায়ে মলিন করিয়া তারে এসো সবে রাখি | অতি দূরে দুর্গাদাস করিছে গর্জ্জন চিতোরের শৈলে শৈলে প্রতিধ্বনি তার চীত্কারিয়া উঠিতেছে, শুধু দীর্ণ করি আকাশ-ইথর-ভরা গভীর পরাণ | প্রেম আনে অবসাদ ; খুব সাবধান রবির প্রেমের আলো করিতে নির্ব্বাণ | ভাবে ভরা শুভ্র স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য-মালায় বিদ্বেষ তমিশ্রা রাশি করিতে মিশ্রিত এই বার ঈর্ষা তব তৃতীয় প্রকাশ | জানি আমি বিষমিশ্র সুধা কন্ঠে তব, অনেকে উঠিবে মাতি, অনেকে আবার, বিজনে বসিয়া দিবে দুই হাতে তালি, বাখানিয়া উচ্চ-কন্ঠে রবির লাঞ্ছনা | নগ্নতায় অশ্লীলতা যে বলে বলুক, নগ্নচিত্র সৌন্দর্য্যের প্রকৃত আশ্রয় সৌন্দর্য্য কিরণবাসে, সদা প্রকাশিত | সত্য, শিব, শ্রেয়ঃ, সবাই নগন অশিব অসত্য চায়—শিষ্ঠের বসন | কত লোকে সুরুচির মাহাত্ম্য ঘোষিতে ক্ষুদ্র গৌতমের কার্য্য করিল জাহির, হায় হায় কি বলিব কপালের দোষে Such and so various are the . tastes of men. হায় কবি রুচি তব ফণি ফণা ধরি গরজিছে শিত্কারিছে গরল গৌরবে, ঢুলাও আপন শির অদূরে রবির, কন্ঠ মুরলীর তান কি আলাপে শুন |
. ৬ ডন জোয়ানের কবি ওই দেখ শোভে উদ্ভাসিয়া সাহিত্যের নির্ম্মল আকাশ | গর্ব্বস্ফীত জেফেরির পেচক চীত্কার এখন গাজে না আর সৌন্দর্য্য বিপিনে জেফেরির বিদ্বেষের বিষনয়ী ভাষা সুপ্ত হ’য়ে এবে যেন কোথা আছে পড়ি |
. ৭ স্নিগ্ধ-রশ্মি-রেখা দিয়া শরতের শশী সাজাইবে প্রেম-মুগ্ধা কুমুদ বালায়, বিধূরা রথাঙ্গ-বধূ, সৈকতে বসিয়া চির নিশি মিলনের করিবে ধিয়ান ; মেঘ যে সে মেঘে চায় | শিখিনী শিখিনী, নাহি থাকে কন্ঠে তার কম কহু তান | রবিরে অরবি কেন করিবার তরে ঘূর্ণিত মস্তক তব, উদ্যম-পীড়িত ? দ্বিজেন দ্বিজেন রবে, রবি রবে রবি, কেন ঈর্ষা দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ হে হাসির কবি ! . *************************
গর্ব্বী কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত “নব্যভারত” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩১৬ ( জুলাই ১৯০৯ ) সংখ্যা থেকে নেওয়া |
. ‘The best of men That e’er wore Earth about him was sufferer ; A soft, meek, patient, humble, tranquil spirit, The first true gentleman that ever breathed.’
দম্ভ আজি মূর্ত্তি ধরি তোমারি ভিতর বাঁধিয়াছে নিজ নীড়, হে গর্ব্ব-সম্ভব ! অঙ্গ-ভঙ্গি প্রকাশিয়া, উদগারি বচন, কানকী জোনাকী দলে আপনার জ্যোতি, দুর্দ্ধর্ষ ক্ষমতারাজি করিছ জ্ঞাপন ; কুটবক্ষে বশীভূত ছুছুন্দরী রাজি উপরে সোণালী সাজ ভিতরে বালুকা, গোময়ে জোনাকী গোঁজা বুদ্ধির কিরণ | বংশ-মঞ্চস্থিত অহো, কুষ্মাণ্ড-সন্নত ! বৃথা ভাব আপনারে ভেনাস ( Venus ) অনুজ ; তুমি যাহা তাই যদি বুঝিতে বারেক, উপেক্ষার নিষ্ঠীবন করিয়া নিক্ষেপ বাইতে না প্রতিভার করিতে নির্ব্বাণ, কেড়ে নিতে চাহিতে না সুজন সম্মান | . *************************
নহে শ্যামা, বিগলিত কাঞ্চন বরণা নহে সেই সহচরী শিখরি-দশনা, নয়ন ঘোষে না তার হরিণী প্রেক্ষণ, কেশরী জিনিয়া নহে ক’টির গঠন, রূপের বৈচিত্যে যাহা হৃদয় তাহার ভিতরের শোভা করে বাহিরে বিস্তার, প্রেমদীপ্ত ব্যথাতুর যুগল নয়ন সমভাবে হাসি অশ্রু করে বরিষণ |
সেই মম প্রেমকুঞ্জ, যৌবন-বরষা, লাবণ্য শীকরে তারে করিছে সরসা “ইন্দুরেখা” “তরলিকা” দুটি চন্দ্র কলি, পুষ্পরূপা অলি কন্ঠে করিছে কাকলি, ( তাদের ) সুধামাখা আধ ভাষা ধৈবতে জাগায় ( তাদের ) সুবাসে চামেলি-চম্পা গৌরব হারায় কাছে তারা নাহি বলে হৃদয় গুহায় হর্ষ গুচ্ছ মগ্ন, আছে গভীর নিদ্রায় |
খান বাহাদুর মৌলভী মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ কবি বেনোয়ারীলাল গোস্বামী রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ (ডিসেম্বর ১৯৩৭ ) সংখ্যা থেকে নেওয়া |
মৃত্যু তুমি নহ ভয় নহ বিভীষিকা অরূপা শান্তির রূপে তুমি বিগঠিতা ধ্যানের মাঝারে তব সৌন্দর্য্যের শিখা আমার হৃদয়ে করে আনন্দ স্পন্দিত আমার জড়িত সখা মজিদ আমার শান্তিপুরে গেছে লয়ে মঞ্জুল মরণ, নাহি সেথা রোগ শোক নাহি অহঙ্কার নাহি সেথা ক্ষমতার উত্কট পীড়ন |
কীর্তি তার কালবক্ষে দ্যুতি ছড়াইয়া স্মৃতিরে উজ্জ্বল করে রাখিবে সতত উদাত্ত হৃদয় তার মৃদুল হাসিয়া ফিরায়ে আনিবে তাহা হয়েছে যা গত | হার্দ্দ্য কোমলতা তার বহিবে সুবাস দেখাবে প্রকৃতি তার মৃদু-মধু হাস |