কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
আমি যাযাবর
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
বিমল গুহ সম্পাদিত "হাজার কবির হাজার কবিতা", ২৫শে বৈশাখ ১৪১১ (মে ২০০৪)
কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।


.                গৃহহারা আমি বেদুইন।
পথেরে বেসেছি ভালো, পথে তাই কেটে যায় দিন।
মুক্তপথ চলে গেছে দিক হতে দিগন্তের পানে---
.                শেষ তার কোথায় কে জানে!
ঊর্ধ্বে নীল মহাকাশ, শুভ্র মেঘ ভেসে চলে যায়
.        ফাল্গুনের পাখি-ডাকা সকালবেলায়।
নীলকণ্ঠ উড়িতেছে---ডানা দুটি রঙিন সুন্দর!
.                বেণুবনে কপোতের স্বর।
ফিঙে নাচে বাবলার ডালে,

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমারই আনন্দ নিয়ে কাঁপে নিশিদিন
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার ভাদ্র ১৩৫১ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৪)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।


আজ কোন দাহ নাই, নাই কোন জ্বালা!
পথের কণ্টক যত হোলো ফুলমালা।
ঘর-ছাড়া মূঢ় ছেলে ফিরে এনু ঘরে---
জননীর বক্ষে মোর। ছায়ার ভিতরে
স্বর্গেরে খুঁজেছি আর হয়েছি নিরাশ।
কামনার জতুগৃহে ফেলেছি নিঃশ্বাস।

বাসনা-মরুর প্রান্তে পেলেম মুক্তিরে।
প্রভাত-আলোকে স্নিগ্ধ বনস্পতি শিরে।
ব্যাপ্ত হয়ে গেল মোর আনন্দ অধীর!
আমার আনন্দ আজি নিম-মঞ্জরীর
সৌগন্ধ্য মিশিয়া যায়! আমের বাগানে
উচ্ছ্বল আনন্দ মম কোকিলের গানে।

দখিনা বাতাসে আজি পল্লব নবীন
আমারি আনন্দ নিয়ে কাঁপে নিশিদিন।

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
এ জীবন নয় মায়া নয়
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫০ (মার্চ ১৯৪৪) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।


কালের দুরন্ত স্রোতে ভেসে চলে যায়
একে একে দিনগুলি। রক্তিম সন্ধ্যায়
প্রভাতের অবসান। সন্ধ্যায় হয় লীন
ঊষার ধূসর বুকে। আসে নব দিন
ল’য়ে তার সুখ-দুঃখ, হাসি-অশ্রুজল।
বসন্তের কচি কচি নব পত্রদল
আর এক বসন্তে ঝ’রে পড়িছে বাতাসে!
সান্ধ্যবায়ু কাঁদে ঝরা-পুষ্পের নিঃশ্বাসে!
জীবন মৃত্যুর খেলা চলে ঘুরে ঘুরে।
বিচিত্র সৃষ্টির নাট্য মেঘে ও রোদ্দুরে।
জানিনা হঠাৎ যাত্রা ফুরাবে কখন!
চলে যাবো বহুদূরে। আসিবে নূতন।

যুগ যুগ চলিতেছে একই অভিনয়।
তবু বলি, এ জীবন নয় মায়া নয়।

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পুত্রের প্রতি পিতা
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫০ (মার্চ ১৯৪৪) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।


শতজীবী হও তুমি হে মোর নন্দন!
তোমার আত্মায় মম আত্মার স্পন্দন।
তোমার প্রত্যেক রক্তবিন্দুতে আমার
ধমনীর রক্তধারা তুলিছে ঝঙ্কার।
তোমার চিত্তের জন্ম মম চিত্ত হোতে।
তোমার প্রবাহমান অস্তিত্বের স্রোতে
ভেসে চলিয়াছি আমি। হে মোর সন্তান,
আমার স্বপ্নেরে তুমি কর ফলবান
মবাবীর্য্য দিয়ে। মোর অস্তিত্ব ধারারে
লয়ে যাও ঊর্দ্ধপানে। তোমার মাঝারে
অসমাপ্ত ‘আমি’ তার পরিপূর্ণতারে
লভিয়া হউক ধন্য। হে মোর তনয়।
তোমার জীবনে মোর জীবনের জয়।

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
জয়তু আফ্রিকা
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবিশেখর কালিদাস রায় সম্পাদিত "মাধুকরী" (১৯৬২) কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।

মৌন মহারণ্যে জাগে নব জীবনের আলো ঝলমল প্রভাত!
.        জাগে গণতন্ত্রের গরিমাময়ী ঊষা!
.        আফ্রিকা, ভারতের কবি
.                একদা তোমাকে বলেছিল, “মান-হারা মনবী”।
সেই মান-হারা মানবীর উন্নত শিরে
.                আজ বিজয়িনীর মুকুটমণির জ্যোতিঃ।
আফ্রিকা, তোমার এই মহাজাগরণের ব্রাহ্ম মুহূর্তে
গ্রহণ কর নগন্য এক বাঙ্গালীকবির অশ্রুসিক্ত অর্ঘ্য।

নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদ অর্থলালসায় উন্মত্ত হ’য়ে
.                দলিত মথিত করেছে তোমার হৃদয়,

.                           ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভীরু আছে --- তাই গর্ব্বে দুলিছে
চারণের গান
ভীরু আছে --- তাই গর্ব্বে দুলিছে
চারণের গান / কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
প্রথমে আমরা গানটি "দেশ" পত্রিকার পৌষ ১৩৪৫ (জানুয়ারী ১৯৩৯) সংখ্যা থেকে গানটি
আমরা পেয়েছিলাম। এখানে গানটিতে কবির নামের জায়গায় “চারণের গান” লেখা হয়েছে।


ভীরু আছে --- তাই গর্ব্বে দুলিছে
.                অত্যাচারির জয়-নিশান।
ক্লৈব্য রয়েছে --- অন্যায় তাই
.                নিঃস্বের করে রক্ত পান॥

দুঃখের ভয়ে কাঁপে সদাই---
মানুষ আজিকে বন্দী তাই---
জীবনেরে বড়ো ভালবাসি ব’লে
.                শয়তান এত শক্তিমান॥

গগন-বিদারী বজ্রকণ্ঠে
.                গর্জ্জিয়া বলো --- ‘রে অন্যায়
মরে যাবো তবু মস্তক কভু
.                নত করিব না তোমার পায়॥

দেখিবে নূতন অরুণোদয়
রাঙিয়া তুলিবে দিগ্বলয়---
মৃত্যুর পাশ ছিন্ন করিয়া
.                জাগিয়া উঠিবে বিজয়ী প্রাণ॥

রে, সতীশচন্দ্র সামন্ত সংকলিত, বৈশাখ ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (এপ্রিল ১৯৪৩) প্রকাশিত, “মুক্তির
গান” সংকলনে গানটি “বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়”-এর  নামে প্রকাশিত পাই। তাই বোঝাই
যাচ্ছে যে গানটি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের রচনা।


ভীরু আছে, তাই গর্বে দুলিছে
.                অত্যাচারির জয়-নিশান।
ক্লৈব্য রয়েছে, অন্যায় তাই
.                নিঃস্বের করে রক্তপান॥

দুঃখের ভয়ে কাঁপি সদাই
.        
        শৃংখলে আজি বন্দী তাই।
জীবনেরে বড়ো ভালবাসি ব’লে
.                শয়তান এত শক্তিমান॥

আকাশ-বিদারী বজ্রকণ্ঠে
.                গর্জিয়া বলো রে অন্যায়।
মরে যাবো তবু মস্তক কভু
.                নত করিব না তোমার পায়॥

দেখিবে নূতন অরুণোদয়
.        
       রাঙিয়া তুলিবে দিগ্বলয়!
মৃত্যুর পাশ ছিন্ন করিয়া
.                জাগিয়া উঠিবে দৃপ্তপ্রাণ॥

আমরা তিন জন কবি পাই যাঁদের নামের সাথে চারণ কথাটি যুক্ত রয়েছে।  প্রথমত  
চারণকবি মুকুন্দদাস। দ্বিতীয়ত সেই সময়ে পানগর-বর্ধমানের কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায়-
কেও অনেকে চারণ কবি বলে সম্বোধন করতেন কারণ তাঁর  “চারণ” নামক একটি কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতির মতো পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত  
হোতো। তৃতীয়ত নদীয়ার
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, যিনিও চারণ কবি নামে খ্যাত  
হয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে দেশ পত্রিকার প্রকাশের পেছনে এই কবির সক্রীয় ভূমিকা ছিল।  
গানের কথা এবং ভাবগত বৈশিষ্ট্য থেকে গানটি
চারণকবি মুকুন্দদাস অথবা বিজয়লাল
চট্টোপাধ্যায়ের রচনা বলেই মনে হচ্ছে। তবুও আমরা তিনজন কবির পাতাতেই কবিতাটি  
রাখছি


.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পণ্ডিত
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত "দেশ" পত্রিকার নভেম্বর ১৯৩৮ সংখ্যা থেকে নেওয়া।


দৃষ্টি কেবল চাকরি পানে,
.                স্বার্থ-খুঁটি আঁকড়ে রয়,
কথার বেলায় চোস্ত ভারি,
.                কাজের বেলায় কিচ্ছু নয় ;

হাত-পাগুলো শীর্ণ অতি,
রাস্তা হাঁটে --- মন্দ গতি,
একটু যদি ঠাণ্ডা লাগে
অমনি কাশি সর্দ্দি হয়।

পুঁথির প্রাকার দিয়ে ঘেরা
.                একটুখানি জগৎ তার!
সেই জগতের বাইরে গেলেই
.                চক্ষে সবই অন্ধকার!

গরীব চাষীর স্কন্ধে ব’সে
সিগারে টান মারছে ক’সে,
অপদার্থ বললে রোষে
.                আদালতের দেখায় ভয়।

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
চাই স্বাধীনতা সাম্য চাই
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
সতীশচন্দ্র সামন্ত সংকলিত, বৈশাখ ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (এপ্রিল ১৯৪৩) প্রকাশিত, “মুক্তির গান”
সংকলনের গান।


চাই স্বাধীনতা, সাম্য চাই,
গাহ দিকে দিকে চারণ দল,
পীড়িত দলিত বন্দী নয়,
.                সবলে দুহাতে ভাঙো শিকল।

মুক্তির কভু নাই মরণ,
কোটি-হিয়া-তলে তার আসন,
সাম্যের জয় চিরন্তন,
.                এই বিশ্বাসে রহ অটল।

শুভ্র পতাকা ফেলিয়া দাও,
ঊর্দ্ধে উড়াও লাল নিশান,
শান্তির কথা ভুলিয়া যাও,
.                প্রলয়-নাচন নাচে ঈশান।

মরণ-পথের-পথিক বীর,
ভীরুরা থাকুর আঁকড়ি তীর,
তুমি বিদ্রোহী, তুমি অধীর,
.                দিকে দিকে জ্বাল কাল অনল।

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুক্তি মোদের পরাণ বঁধু
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
সতীশচন্দ্র সামন্ত সংকলিত, বৈশাখ ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (এপ্রিল ১৯৪৩) প্রকাশিত, “মুক্তির গান”
সংকলনের গান।

মুক্তি মোদের পরাণ বঁধু,                 বন্দীশালা---বাসর ঘর।
মরণ মোদের পিয়ার মধু,                কামান শোনায় বাঁশীর স্বর॥
ল্বাধীনতার প্রেমে পাগল,                 তাই ভেঙেছি ঘরের আগল।
আপন বুকের রক্তে রাঙা,               মোদের মাথায় লাল টোপর॥

অমূল্য ধন্ মুক্তি রতন,                  বাইরে কোথায় খুঁজিস্ তায়?
দুঃখের বুকে সৃষ্টি তাহার,               বন্দীশালার কারখানায়॥
ভালো তারে বাস্ লো যে জন,           ব্যথায় তাহার ভরলো জীবন,
দৈন্য হোলো সাথের সাথী,                সঙ্গী হোলো প্রলয় ঝড়॥

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর