কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
প্রবীণ হ’য়েও তুমি অন্তরে নবীন
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের বিপ্লবী জীবন ও সাহিত্যমন্ত্রের দীক্ষাগুরু, কৃষ্ণনগর
কলেজের অধ্যাপক নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্সর্গ করা কবিতা। কবির
"সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।

পরম শ্রদ্ধাস্পদ
অধ্যাপক শ্রীযুক্ত নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীচরণকমলেষু

প্রবীণ হ’য়েও তুমি অন্তরে নবীন,
গৃহস্থ হ’য়েও তুমি বন্ধন-বিহীন,
রসিক হ’য়েও তুমি পরম গম্ভীর,
ধীমান হ’য়েও তুমি মহাকর্ম্মবীর,
ক্ষাত্র তেজে দীপ্ত তুমি নির্ম্মল ব্রাহ্মণ
ক’রেছ ভোগের সাথে ত্যাগের মিলন।
জীবনে করেছ তুমি সবেরে স্বীকার,
উন্মুক্ত করিয়া তুমি রেখেছ দুয়ার
সকলের তরে ; শুধু মিথ্যার স্পর্দ্ধারে
দাও নাই স্থান কভু। তাই নির্ব্বিচারে
কাঞ্চন ছাড়িয়া নিলে সৈনিকের অসি,
স্বেচ্ছায় তাই ত তুমি কারাগারে পশি’
আকণ্ঠ করিলে পান ব্যথার গরল ;---
পরিলে নূপুর করি কারার শিকল ;
দারিদ্র্যে করিলে তুমি অঙ্গের ভূষণ,
দুঃখেরে মুকুট শিরে করিয়া ধারণ
দুখেরে দিলে গো লজ্জা ; মুক্তির বাঁশরী
বাজালে বন্ধন মাঝে ; দু’টি আঁখি ভরি
হেরিলে রুদ্রের শোভা ভীষণ মধুর ;
সাধিছ জীবনে তারই উন্মাদিনী সুর।

আমার এ গানে সেই রুদ্রের অর্চ্চনা,---
প্রচণ্ড সুন্দর যিনি তাঁরই আরাধনা
ক’রেছি সঙ্গীতে মোর। পদধ্বনি তাঁর
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শুনি অনিবার ;
শুনি লক্ষ তরুণের রক্তের কল্লোলে,---
শুনিতেছি মর্ম্মে মোর ; দোলে, ওরে, দোলে
রক্তিম-কেতন তার বিদ্যুত-শিখায়,
কোদণ্ড-টঙ্কার তাঁর ঐ শোনা যায়
সপ্ত-সিন্ধু-কলরোলে ঝঞ্ঝার গর্জ্জনে।
আসে আসে, ভয়ঙ্কর আসে প্রতিক্ষণে
রথ-চক্রে বিচূর্ণিয়া উদ্ধত প্রাসাদ,
অর্থগৃধ্নু ধনিকের অন্যায়ের বাঁধ।
তাঁরই জয়ভেরী শুনি চাষীর হুঙ্কারে,
শ্রমিকের ধর্ম্মঘটে। আজি কারাগারে
বন্দীরা জাগিছে রাতি তাঁরই প্রতীক্ষায় ;
কারারুদ্ধ সন্তানের মুক্তি কামনায়
তাঁরেই ডাকিছে মাতা বিনিদ্র নয়নে।
সে আসে, সে আসে ওগো তাণ্ডব নর্ত্তনে
ভাঙিয়া চূরিয়া সব করিয়া শ্মশান ;
আমার এ গানে তাঁরই আগমনী গান।

.                                
শ্রদ্ধানত
.                                ---বিজয়

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
সবহারাদের গান
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।

.                                        গাহি জীবনের গান।
রাতের আঁধারে জাগিতেছে ধীরে মহামানবের প্রাণ।
ব্যথার শোণিতে রক্তিম হ’য়ে সহস্র-দল ফোটে ;
তাহারই বার্তা নিশার বক্ষে গগনে গগনে ছোটে।
পাঁপড়ির পর খুলিছে পাঁপড়ি রাতের অন্ধকারে---
রক্তকমল ফোটে মানবের বেদনার পারাবারে।
পরম শোভায় ফোটে কুবলয়---আমি করি তার গান
গাহিতেছি আজি দুখের তিমিরে---আসিতেছে ভগবান।

.                                        আসিতেছে ভগবান।
মহামানবের হৃদয়-পদ্মে --- গাহ কবি তার গান।
মানুষের ব্যথা সঞ্চিত হ’য়ে ছুঁয়েছে আকাশ-তল, ---
যত দূরে চাই---তত দূরে হেরি সৃষ্টির চোখের জল,
জঠরে জঠরে জ্বলিছে বহ্নি, অন্ন নাহিক ঘরে---
কুকুরের সাথে লড়িছে মানুষ একটু রুটির তরে ;
কাকের মুখের আহার কাড়িয়া খেতেছে অন্ন খুঁটি---
কাঁদে নরনারী---চাহিনাকো কিছু---রুটি চাই, শুধু রুটি।

.                                        “দাও, ওগো দাও রুটি” ---
ধনিকের দল ফিরেও চাহে না, ---কাঞ্চন মুঠি মুঠি
ছড়াইছে তারা বিলাস-ব্যসনে --- ‘বিলিয়ার্ড’ খেলে সুখে,
নাচে ‘বলনাচ’, খায় ‘শ্যাম্পেন’, ‘সিগার’ ফুঁকিছে মুখে,
বাজায় পিয়ানো, করে প্রেমালাপ, মোটরে চলেছে ছুটি---
হাসিয়া হাসিয়া হোটেলে বসিয়া কুকুরেরে দেয় রুটি ;
বাহিরে মানব ধুঁকিছে ক্ষুধার দুঃসহ বেদনায়---
কুকুরের সাথে ভাগ্য বুঝি সে বদল করিতে চায়!

.                                        ভয় নাই, ভয় নাই ;
তোমার লাগিয়া জানে ভগবান। শোন রে মানুষ ভাই,
এই জগতের আড়ালে রয়েছে, অদৃশ্য এক জন---
ভয়ে যাঁর তাপ দিতেছে অগ্নি, বহিতেছে সমীরণ,
চন্দ্র সূর্য্য ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঢালিছে আলোর ধারা, ---
এই বিশ্বের আড়ালে সে জন জাগিছে তন্দ্রাহারা।
তোমাদের লাগি কত মহাপ্রাণ স’হেছে নির্ব্বাসন,
কারার কক্ষে শৃঙ্খলভার বহিয়াছে আজীবন,---
তোমাদের লাগি নয়নে তাদের ঝ’রেছে অস্রুধারা---
সে সব বেদনা, সে সব সাধনা---ব্যর্থ হবে না তারা।

.                                        নিশার আকাশ-তলে
মহামানবের মর্ম্ম-কোরক ফোটে অগণ্য দলে।
যত তারে হানে তত ছুটে বাস---প্রাণে প্রাণে জাগে ঢেউ,---
রবে না মানুষ মানুষের দাস---ক্ষুধিত রবে না কেউ।
দেহের রক্ত জল ক’রে যারা যুগ-যুগান্ত ধরি
লাঙলের মুখে মরু-ধরণীরে তুলেছে শ্যামল করি,---
পাহাড় কাটিয়া রচিয়াছে পথ, গ’ড়েছে প্রাসাদ-মালা,
খনির গর্ভে পশিয়া রত্নে ভরিছে ধরার ডালা,---
আজ পৃথিবীতে জীবন তাহারা যাপিতেছে উপবাসে---
নিকটে লক্ষ প্রাসাদ থাকিতে ঘুমায় পথের পাশে!
শোভে চারিদিকে পণ্যবীথিকা---বসনের স্তূপে ভরা---
তারই মাঝে শীতে কাঁপে নরনারী ছিন্নবস্ত্র-পরা।

.                                        শোন ধনিকের দল,
ফাঁকির উপরে দাঁড়ায়ে রয়েছে তোমাদের ধনবল।
তোমাদের যত বিপুল প্রাসাদ, ফাঁকির উপরে গড়া---
এই ফাঁকি আর কতকাল ধ’রে বহিবে বসুন্ধরা?
উপবাসী যত গোলামের দল খেটে যাবে চিরকাল---
তোমরা ঘুমাবে পালঙ্কে---আর চরাবে মানুষপাল! ---
মিথ্যা, এ সব মিথ্যা স্বপ্ন---তোমাদের জোর যত
ভাঙিয়া যেতেছে বাতাসের মুখে তাসের ঘরের মত!

.                                        ভাঙনের গান গাই।
ফাঁকিতে ফাঁকিতে ভরিয়া উঠেছে সমাজ ; আজিকে তাই
চক্র ধরিয়া আসে ভগবান চড়ি বিপ্লব-রথে,
দিগন্তে তার ডঙ্কা বাজিছে, নরনারী পথে পথে
“রুটি দাও” বলি’ করে গর্জ্জন, হাঁকে উচ্চৈঃস্বরে---
“আমরা খাটিব কলে-প্রান্তরে, অন্ন লুটিবে পরে!
বহু শতাব্দী ধরিয়া নীরবে সহেছি এ অবিচার,---
আজ থেকে ভাই সহিব না আর ‘পরগাছা’দের মার।”

সাম্যের যুগ এল ধরণীতে, এই যুগের নরনারী
রহিবে না কেহ উপবাসী ঘরে, প্রাসাদ-তোরণে দ্বারী
দিবে না তাড়ায়ে কাঙালের দলে, মূর্খ রবে না কেহ,
নর বেচিবে না বাহুর শকতি, নারী বেচিবে না দেহ---
সব-হারা যারা দুনিয়ায় তারা সবের মালিক হবে---
যুগের শঙ্খে এই মহাগান বাজে ভৈরব রবে।
সময় হ’য়েছে নিকট বন্ধু, দুঃখ বেদনা ভোলো---
ভগবান আসে,---আকাশে আকাশে আনন্দ-গান তোলো
ব্যথার সাগরে নিশার আঁধারে রক্তিম শতদল
করিছে রচনা তাহারই আসন,---মোছ মোছ আঁখিজল!

.                       ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
রক্ত-জবা
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।

আমার এ মালা নহে যুথী-বেল-বকুলের মালা---
গাঁথে যারা প্রণয়িনী তরুতলে বসিয়া নিরালা
প্রেমিকে সাজাতে তার ; এরে আমি গেঁথেছি নিশীথে
আমার চোখের জলে ; মরু পথে চলিতে চলিতে
আহত-হিয়ার তারে ব্যথা যত তুলেছে ঝঙ্কার---
তাই দিয়ে গাঁথিয়াছি আমার এ রক্তজবা-হার।
শোণিত চন্দনে লিপ্ত আমার এ মাল্যখানি দিয়ে
পূজিব চরণ তব।

.                                        এক দিন গ্রন্থরাশি নিয়ে
অধ্যয়নে ছিনু মগ্ন সুখসুপ্ত নিরালা কুটিরে ;

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
রক্ত-ঊষার যাত্রীদল
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


ওরে আমার বাঁধন-হারা রক্ত-ঊষার যাত্রীদল,
চল্ ফুটিয়ে মরুর বুকে নব আশার লাল কমল ;
অন্ধকারের দুর্দ-শিরে রাঙা-রবির জয়-নিশান
উড়িয়ে দিয়ে, কণ্ঠ নিয়ে পাগলা-ঝোরার বিজয় গান
চল্ এগিয়ে নতুন দিনে তরুণ যত বন্ধুগণ,
অরুণ-রাঙা মেঘের রথে এল পথের নিমন্ত্রণ।

চোখে তোদের দূর আকাশের স্বপ্নমাখা নীল কাজল,
বুকের তলে গর্জ্জি’ ফিরে সাত-সাগরের ক্রুদ্ধ জল ;
বজ্রে তোদের ত্যূর্য্য বাজে, ঝঞ্ঝা তোদের তুরঙ্গম,
রাজার মুকুট খেলনা তোদের, গলার মালা ভূজঙ্গম ;
করে তোদের বিজয়-ধেনু --- টঙ্কারে তার ভয়ঙ্কর
শঙ্কা লাগে, অশ্রুজলে অভয় মাগে নীল সাগর।

জীর্ণ বরষ ঐ মরে’ যায়, শিউরে উঠে অন্ধকার,
ঐ খুলে যায় দিগ্বলয়ের রক্ত-রাঙা তোরণ দ্বার,
সপ্ত ঘোড়ার রথ হাঁকিয়ে চক্রবালে লাল তপন
বেরিয়ে আসে রক্ত-বাসে, --- যাত্রা কর যাত্রিগণ।
জানি মধুর বঁধুর দিঠি, মধু প্রিয়ার আলিঙ্গন,
জানি মধুর মলয় বায়ে মুঞ্জরিত কুঞ্জবন,
জানি মধুর গন্ধে বিভোর কোকিল-ডাকা বকুলতল,
জানি মধুর পদ্ম-ফোটা মরাল-ডাকা দীঘির জল,
জানি মধুর সখার হাসি, মধুর কচি শিশুর বোল,
সবার চেয়ে জানি মধুর শীতল-করা মায়ের কোল।

তবু যে হায় সকল ছেড়ে চল্ তে হবে নাই সময় ;
ঘরের যত কান্না হাসি রথের বুকে হোক তা লয়।
নয়ন-কোণে জল জমেছে? বিদায় নিতে চায় না মন?
ক্ষণিক যাহা তারেই চেয়ে ভুলবি যাহা চিরন্তন?
সাঁঝের দীপই সত্য হবে? বিফল হবে চাঁদের কর?
নীল আকাশের চেয়েও তোদের আপন হবে বাসর ঘর?

যাত্রী তোরা, পথিক তোরা, সঙ্গী তোদের সূর্য্য চাঁদ---
প্রাণের বেগে ভাসিয়ে চলিস্ যুগন্তরেই জীর্ণ বাঁধ ;
পথ-বিহীন সিন্ধু-বুকের যাত্রী তোরা কলম্বাস---
পাহাড় মরু লঙ্ঘি চলিস্---নাইকো বাধা নাইকো ত্রাস
তরু-বিহীন মরুর বুকে ছুটছে যেথা বালুর ঝড়,---
ক্ষুব্ধ সাগর পাষাণ-তটে ভাঙছে যেথা নিরন্তর,
অভ্র-ভেদী গিরির শিরে বইছে যথায় তুষার স্রোত,
তিমির রাতে গগন-পথে চল্ ছে যেথা বিমান-পোত,
জন-বিহীন মেরুর দেশে নাই যেখানে সূর্য্যালোক---
সেই ভীষণের বুকে তোদের এবার তবে যাত্রা হোক্।

কাগজ কলম আয় না ফেলে, পুঁথি যেথায় সেথায় থাক্ ; ---
বঁধুর গাঁথা বরণ-মালা বঁধুর হাতেই শুকিয়ে যাক্।
আছে যাদের অট্টালিকা, রেশমী কাপড় মোটর কার
সোণার খাটে দেখুক তারা সোণার স্বপন চমত্কার।
শামলা-পরা উকিলগুলো মামলা নিয়ে থাক বিভোর,
রাত্র জেগে ছাত্রগুলো কেতাব ল’য়ে পড়ুক জোর,
কবি তাহার সেতার ল’য়ে চাঁদনী রাতে করুক গান,
পুরুত মশাই ঘন্টা নাড়ুন, পাঁজি পুঁথির দিন বিধান,
নাকের ডগায় চশমা রেখে হিসাব লিখুক ব্যবসাদার,
খোশ্ মেজাজে গল্প করুক সিগার হাতে ব্যারিষ্টার।

তোদের ত’ ভাই নাই ত’ কিছু, তোদের আছে নির্ব্বাসন,
তোদের আছে ক্ষুধার জ্বালা, তোদের আছে কাঁটার বন,
তোদের আছে ফাঁসির রসি, তোদের আছে শিকল-হার,
তোদের আছে আন্দামানের বন্দীশালার অন্ধকার,
তোদের আছে শূন্য ঝুলি মান্দালয়ের তপ্ত দিন,
তোদের আছে ‘রেগুলেশন’ লাঠির খোঁচা, অন্তরীন্।
পিছে তোদের শত্রুদলের বিদ্রুপেরই অট্টহাস---
সামনে আসে ঘূর্ণীবায়ু ধূলায় ঢেকে নীল আকাশ।

চলবি তোরা ভবের পথে আনন্দেরই ফুটিয়ে ফুল---
মুখের পানে চেয়ে তোদের অবিশ্বাসীর ভাঙবে ভুল।

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুক্তি-অভিযান
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


বাহিরিয়া এসো বন্ধু, আসিতেছে মুক্তির আহ্বান ;
সাগরের কীলে কূলে দুলে দুলে তরুণ নিশান
ডাকিছে তোমারে সখে ; দেশে দেশে সাজে বীরদল,
দিকে দিকে ধ্বনিতেছে তরুণের রণ-কোলাহল।
প্রশান্ত সাগরতটে নাচে আজি দুরন্ত ঈশান ;
শতাব্দীর অত্যাচারে ক্ষিপ্ত-প্রায় চীনের পরাণ
বল-দৃপ্ত ধনিকের দম্ভ আজি চূর্ণিবারে চায়।
ভূমধ্য সাগর তীরে মিসর-মরোক্কো-সিরীয়ায়
শোন গান-দেবতা পাঞ্চজন্য গর্জ্জে ঘন ঘন ;
নিখিলের দস্যু-দল, সাবধান, নিকট শমন।
ধন-দৃপ্ত, বলদৃপ্ত অত্যাচারী সভয়ে পলায় ;
অবিচার জয়ী হবে? নিভে গেছে রবি-তারা-চাঁদ?
প্রেম সত্য মিথ্যা সব? বিশ্ব কি রে শয়তানের ফাঁদ?

হো তরুণ, তোল শির ; মুক্তিরে তাড়াবে সাধ্য কার?
বিশ্ব-প্রাণ-শতদলে দেবী ব’সে আছে নির্ব্বিকার।
দুনিয়ার ধনদৃপ্ত বলশালী রাজেন্দ্র মণ্ডলী
লক্ষ্য করি তাঁরে সবে ছুঁড়িয়াছে নির্ম্মম দম্ভোলী
যুগে যুগে, দেশে দেশে ; আজও তারা হানে তরবার
মুক্তিশির লক্ষ্য করি, দেবী হাসে হাসি অবজ্ঞার।

লজ্জা কেন হে তরুণ? যত দিন রবে দুনিয়ায়
একটি বীরের স্মৃতি, যত দিন রহিবে ধরায়

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আপনার পানে ফিরে তাকাও
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


তোমার পিঠে যে হানে চাবুক
.                                          তার তরে কেন ধর লাঙল?
যার লাথি তব ভাঙিছে বুক
.                                          তারই তরে কেন রক্ত জল?

বসনে ভূষণে সাজি যে জন
.                                          মাথায় তোমার ভাঙে কাঁঠাল
তার তরে কেন বোন বসন?
.                                          তার তরে কেন ধর কোদাল?

খাটে না যেজন---খায় কেবল,

.                       ***********************

* শেলির “Songs to the men of England” হইতে।


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
*
বিজিতের গান
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


কে তোমারে বলে পরাজিত হে নির্ভীক! নির্জ্জিত কেশরী?
আমি জানি যুগে যুগে নব নব কবির বাঁশরী
তোমার গৌরব-গাঁথা ঝঙ্কারিবে নিত্য কাল ধরি ;
আমি জানি অনাগত নরনারী লবে চিত্ত ভরি’
শক্তির অমৃত-ধারা তব দীপ্ত প্রাণ-সিন্ধু হ’তে ;
যে আলো জ্বালালে তুমি নিজে দহি, সে দীপ্ত আলোতে
অগণিত যাত্রীদল মুক্তি-পথ লইবে চিনিয়া ;
জয়-গর্ব্বে স্ফীত হয়ে নাচে যারা তোমারে হানিয়া
মূঢ় তারা, নাহি জানে --- পদতলে আগ্নেয়-পর্ব্বত
ধূমাইছে প্রতি ক্ষণে ; তাহাদের বিনাশের পথ
তলে তলে পলে পলে গড়ে কাল আপনার করে ;
হাসিও না অবিশ্বাসী! এ বিশ্বের রঙ্গমঞ্চোপর
যুগে যুহে হ’য়ে গেছে ক্ষমতার বহু অভিনয় ;---
উন্মুক্ত কৃপাণ করে কত রথী, সম্রাট নির্দ্দয়
আসিয়াছে, খেলিয়াছে মানুষের মুণ্ড নিয়ে খেলা ;---
তারপর একে একে এল যবে অপরাহ্ন-বেলা
চলে গেছে নাম-হীন বিস্মৃতির দূর-সিন্ধু-পারে ;---
তাদের স্মৃতির বোঝা পচে আজি পুঁথির মাঝারে।

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বুড়ী বালামের তীরে
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


.                                        ‘বুড়ীবালামের’ তীরে
বুকের শোণিতে যেদিন তোমরা রাঙালে ধরিত্রীরে,
সম্মুখের-রণে যুঝি প্রাণপণে ঘুমালে বীরের দল---
মৃত্যু সেদিন জ্বালালো শ্মশানে মুক্তির হোমানল।
নিজেরে সেদিন নিঃশেষ ক’রে বিলায়ে গেলে যে আলো
সেই আলোকের রক্তশিখায় মিলায় রাতের কালো---
সেদিনের সেই মৃত্যুর দান সকল দৈন্য হরি’
নব জীবনের গরিমায় মরু তুলিছে শ্যামল করি।

.                                        আজি তোমাদের স্মরি
নবীন-আশার কণক-কিরণে উঠিছে চিত্ত ভরি।
সারা তনু মন ঝঙ্কার দিয়া গাহিতেছে অনুখণ---
‘বাঘা যতীন্দ্র’ --- ছিল সে বাঙালী, ---ছিল ‘মনোরঞ্জন’,
‘চিত্ত’, ‘নীরেন’ --- বাঙালীর ছেলে! এই আকেশের তলে
প্রাণ তাহাদের উঠিল বিকশি হাসি ও অশ্রুজলে।

কে বলে মানুষ এ দেশে মানুষ কেবল কল্প-কুঞ্জ-বাসী?
‘মোহন-লালের’ অসির সঙ্গে ‘চণ্ডীদাসের’ বাঁশী
মিশেছে এ দেশে,---খোলের সঙ্গে বাজে শাক্তের ঢাক,---
কোকিল ডাকের সঙ্গে হেথায় গর্জ্জে বাঘের ডাক,---
‘কপোতাক্ষী’র সঙ্গে ছুটেছে ভীষণ ‘পদ্মা’ নাচি---
ভোমরার সাথে বাঁধিয়াছে বাসা পাহাড়িয়া মৌমাছি,
বেণু রাগিণীর সঙ্গে নাগিনী ফণা নাচাইয়া খেলে,---
শ্যামলা ধরার বুক চিরে’ নীল পাহাড় উঠেছে ঠেলে,---
কোমলে কঠিন মেশানো এ মাটি, ---তরুণেরা এই দেশে
বটের ছায়ায় বাঁশরী বাজায়,---ফাঁসি কাঠে মরে হেঁসে।

.                                        বিজয়ী বীরের দল
মরিয়া তোমরা শিখাইয়া গেলে বাঁচিবার কৌশল।

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিপ্লবীর প্রতি
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


গলায় জড়ায়ে ফাঁসীর রশিটি, অধরে করুণ-হাসি,
তরুণ পথিক! ব’লে যাও মোরে কারে এত ভালবাসি’
এমন করিয়া বিবাগী হইয়া ফাঁসীরে বরিয়া নিলে,
যৌবন-তরী মরণ-সাগরে হেলায় ভাসায়ে দিলে।
তরুণ বয়স, রূপ-রস-ভরা এই ধরণীর গেহ,
ধন জন মান, পরিচিত কত আপন-জনার স্নেহ,
তোমারে বাঁধিতে পারিল না কেহ, বীর সন্ন্যাসী, তুমি
গাহিতে গাহিতে চ’লে গেলে “মোর জননী জন্মভূমি।
স্বরগের চেয়ে গরীয়সী তুমি, পরাণ-শীতল-করা,
সকল সুখের বড় সুখ মাগো! তোমার লাগিয়া মরা।”
ফাঁসীর মঞ্চে আজিকে তোমারে হেরি অপরূপ বেশে ;
বীর-বিদ্রোহী-সৈনিকরূপে বারে বারে তুমি হেসে
অত্যাচারীর খড়গের তলে পাতিয়া দিয়াছ শির ;
আপন বুকের রুধিরে মুছালে কলঙ্ক জননীর।
.        *                *                *
কেহ বা তোমারে কহিছে রক্ত-পিপাসু, কঠিন-প্রাণ,
কোহ কহে তোমা উন্মাদ নাহি কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান ;

.                       ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্রোহী বীর
কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়
কবির "সবহারাদের গান" (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমাদের হাতে এসেছে ১৯৩০ এর
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ।


.                                                        ওরে অভিমানী ছেলে!
একবার,---শুধু একবার আজি চেয়ে দেখ আঁখি মেলে!
বন্দীর বেশে একদা যে পথে চলে গিয়েছিলে একা---
অচেনা অজানা যুবক---সেদিন দেয় নাই কেহ দেখা!
শুধু গিয়েছিলে একা একা চ’লে, সাথে ছিল নাকে কেউ!
হৃদয়ে হৃদয়ে ওঠেনি সেদিন আজিকার মত ঢেউ।
কেহ গাহে নাই বন্দনা গান, ---কেহ দেয় নাই মালা,---
নীরবে সেদিন গিয়েছিলে চ’লে নিয়ে বন্ধন জ্বালা!
আজ রাজা হ’য়ে ফিরিছ সে পথে ; লাখো-নরনারী এসে
চরণের তলে ঠেকাইছে মাথা, নয়নের জলে ভেসে।

.                              ***********************
.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর