কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা
কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা প্রয়োজন আজ;
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।
সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।
সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব’লে মনে হয়।
অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্ব হেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।

হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল—মেঘে মেঘে তনুভূত জল—
এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কী আশ্চর্য দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
কবিতার খসড়া / ২০
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

একটি পাকুড়গাছে সম্পূর্ণ নূতন পাতা, তার সঙ্গে বিবাহিত এই
বটগাছে লাল লাল ফল ফ’লে আছে।
চারিদিকে চিরকাল আকাশ থাকার কথা, আছে কিনা আমি দেখে নিই।
অনেক শালিক পাখি আসে রোজ এই গাছে, বট ফলগুলি
তারা খুঁটে খুঁটে খায় বসন্তের হাওয়া বয়, শালিকের ডাক
এবং পাতার শব্দ মিশে একাকার হয়ে চারিদিকে ভাসে।
এখন অনেক মেঘ সোনালি রূপালি কালো আকাশে আকাশে।
একটি মুকুট সেই পাকুড় গাছের নিচে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মদের ফেনার মতো সাদা সাদা দাঁত আমি অনেক দেখেছি।
জেনেছি আগুন যত দূরেই হোক না কেন তাকে দেখা যায়।
মুকুরের বুকে ঠাঁই পেতে হলে সরাসরি সম্মুখেই চ’লে যেতে হয়
পিছনে বা পাশে নয়; গ্রন্থ ছন্দোবদ্ধ হলে তবে আপনিই মনে থাকে
মৃত্যু অবধিই থাকে; মানুষ সমুদ্রকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে
তবে সবচেয়ে বেশি ভয়ও ক’রে যায়।
সকল মুকুট ঘিরে এইসব চিরসত্য চিরকাল উড়ে উড়ে যায়।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
বড়ো বৃদ্ধ হয়ে গেছি
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

বড়ো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, চোখের ক্ষমতা ক’মে গেছে
পরস্পর মিশে থাকা কাচপুঁতি এবং নীলার
পার্থক্য নির্ণয় করা এখন সম্ভব নয় আর।
এখন কি কাগজের নৌকা নির্মাণের পদ্ধতিও
ভুলে গেছি, কবিতার মিল খুঁজে মন্থর প্রহর
চ’লে যায়, সন্ধ্যাকালে শুনেছি শীতের পুরোভাগে
মৃত্তিকাসংলগ্ন মেঘ এখনো কুয়াশারাশি ব’লে
অভিহিত হয়—এই কুৎসাভীত বহু ভালোবাসা।
অভিজ্ঞতা ফুরিয়েছে; অন্ধকারে আহার্যবিহীন
ক্ষুধায় অতিবাহিত করা ভিন্ন বৃক্ষদের কোনো
গত্যন্তর নেই, হায়, এই ক্লেশে ম্রিয়মাণ আমি।
হেঁটেছি সুদীর্ঘ পথ; শুধু কাঁটা, রক্তাক্ত দু-পায়
তোমার দুয়ারে এসে অনিশ্চিত, নির্বাক, চিন্তিত।
তুমি কি আমাকে বক্ষে স্থান দিতে সক্ষম মুকুর?

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
সুরায় উন্মত্ত হয়ে
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

সুরায় উন্মত্ত হয়ে পদাঘাতে পুষ্পাধারটিকে
বিচূর্ণ করেছি; কোনো পরিতাপ রাখিনি হৃদয়ে।
এখন টেবিল রবে অন্তর্গত কাগজে আবৃত।
দিনগুলি চ’লে যাবে রহস্যের সমাধানে, যাবে
উপচীয়মান কিছু বৎসর; বয়স বাড়ুক।
মাটি খুঁড়ে যেতে হবে; মাটির গভীরে ইতস্তত
সভ্যতার অবশেষ খুঁজে পাই, পেয়েছি অনেক
পোড়া ইট, পুতুলের অবয়ব, ভগ্নপ্রায় বুক।
মানুষেরা আজ যেন নিরুপম সম্রাটশিকারে
ব্যস্ত আছে; নানারূপ ছলা-কলা মিথ্যার আশ্রয়ে
কোনোভাবে কিছু কাল বিনষ্ট করায় আস্থাবান।
জান্তব আগ্রহে দ্যাখে অশ্বের ভয়ার্ত গতিবেগ—
কখন সে শ্রান্ত হবে, ধরা দেবে এই প্রতীক্ষায়।
সম্রাট বলে না কথা, রহস্যের সমাধানে থাকে।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
আকাশআশ্রয়ী জল
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

আকাশআশ্রয়ী জল বিস্তৃত মুক্তির স্বাদ পায়, পেয়েছিলো।
এখন তা মৃত্তিকায়, ঘাসের জীবনে, আহা, কেমন নীরব।
মহৎ উল্লাস, উগ্র উত্তেজনা এইভাবে শেষ হতে পারে?
ঈপ্সিত গৃহের দ্বারে পৌঁছোনোর আগেই যে ডিম ভেঙে যায়—
এই সিক্ত বেদনায় দূরে চ’লে গেলে তুমি, পলাতকা হাত,
বেদানার দানা-দানা নিয়ে একা-একা খেলা করো, সুকুমার খেলা।
ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে
তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়;
এত দীর্ঘ যাতে তার উচ্চ শীর্ষে উপবিষ্ট নিরাপদ কোনো
বিকল পাখির চিন্তা, অনুচ্চ গানের সুর মাটিতে আসে না।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
বেশ কিছুকাল হ’লো
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

বেশ কিছুকাল হ’লো চ’লে গেছো, প্লাবনের মতো
একবার এস ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি
জীবনযাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরনো
দেয়ালে তাকালে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
মানুষীর আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কূজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো; তুমি পুনরায় চলে গেছো।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
ধূসর জীবনানন্দ
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিলো, ‘এই জন্মদিন’।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
সংশয়ে-সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতোন
ঝ’রে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেলো।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনো রয়েছে, চিরকাল
রয়ে যাবে; সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা—
তোমার কবিতা, কাব্য, সংশয়ে-সন্দেহে দুলে-দুলে
তুমি নিজে ঝ’রে গেছো, হরিতকী ফলের মতোন।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
তিন পা পিছনে হেঁটে
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

তিন পা পিছনে হেঁটে পদাহত হয়ে ফিরে আসি।
আবার তোমার কথা মনে আসে; ধূমকেতুর মতো
দীর্ঘকাল মনে রবে তোমাকে; পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা, প্রতিঘাত বালকের মতন সাগ্রহে
ভালোবাসি; হৃদয়ের গুরুভার জলে নিমজ্জিত
অবস্থায় লঘু ক’রে নেবার পিচ্ছিল সাধ ক’রে
পদাহত হ’য়ে ফিরি; অজ্ঞাত পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা, প্রতিঘাত বালকের মতো ভালোবাসি।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
প্রিয়তমা ত্রিশূলীপাহাড়
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

সাধারণভাবে তাকে ত্রিশূলের মতো মনে হয়;
ত্রিশূলী পাহাড়, প্রিয়া, প্রিয়তমা ত্রিশূলী পাহাড়।
এখন বর্ষার দিন, সিক্ত বনভূমি কাকে চায়
গুপ্ত কৃতাঞ্জলিপুটে, চায় তার দৃঢ় অতিথিকে।
সিক্ত আজ বনপথ, সিক্ত গিরিগুহা গিরিখাত—
দ্যাখো, কার নিষ্ঠিবনে সিক্ত, অভ্যর্থনাময় সব।
প্রবল আঘাতে শেষে পাহাড় নাচাই ক্ষিপ্র স্বামী;
ছন্দে ছন্দে নেচে যায় প্রাত্যহিক সন্ধির মতোন।
এই আমাদের এই চিরন্তন পিছল প্রণয়।
ত্রিশূলী পাহাড়, প্রিয়া, প্রিয়তম ত্রিশূলী পাহাড়।
অবশেষে বহির্গত কণাকণা তীর্থযাত্রী যায়
তৃপ্ত গিরিখাতপথে অন্তরের দিকে দলে দলে;
এত ঘন প্রেমপাত আর কোন্‌ কারুকার্যে চলে?

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
আমরা দুজনে মিলে
কবি বিনয় মজুমদার
মিলনসাগরে প্রকাশ - ২৩.৮.২০২০

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাটা [ছাঁটা],
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।

আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

.             ********************

.                                                                           
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর