কবি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার-এর কবিতা
*
কন্যকা কুন্তী
কবি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ভারতী পত্রিকার আশ্বিন ১৩১৬ (সেপ্টেম্বর ১৯০৯) সংখ্যায়
প্রকাশিত।


.        রাজা শূরসেন তখন যদুবংশের অধীশ্বর। ভারত তখন আপন মহিমায় প্রদীপ্ত।
ঊর্দ্ধে সাম-গানের উথলিত স্বর, নিম্নে স্বচ্ছন্দ স্বাধীনতার মুক্ত কলরব মধ্যভাগে জ্ঞান, বিদ্যা,
বিজ্ঞান এবং বিক্রমের মহাসম্মিলন।
.        সেই সময় রাজা শূরসেন যদুবংশের মুকুটরত্ন। রাজার প্রতিজ্ঞা অটল, প্রতাপ
অসীম। সেই পণবীর্য্যমহীয়ান্ নৃপতি হইতে যাদব প্রকৃতিমণ্ডলের অতি নগণ্য
শিশুটিও যেন পুণ্য এবং তেজের শিখামূর্ত্তিবৎ বিরাজ করিত। যেন সেখানে সমুন্নত
ঘনশ্যাম শালতরু হইতে হরিৎ-কচি তৃণাঙ্কুরটি, মেঘবিদারী পর্ব্বত হইতে পথ-ধূলির
কঙ্করটি,  সমস্তই, নির্ম্মল আকাশের নীলিমার তলে আর্য্যাবর্ত্তের বক্ষ-মণিপুঞ্জের ন্যায়
চেতনার পুলক প্রভায় বিকসিত হইয়া থাকিত।
.        একদিন যদুপুরীর প্রাসাদচূড়া সমুহে পতাকার সারি চঞ্চল হইয়া
উঠিল, যাদবরাজ্যে মঙ্গলবাদ্য বাজিয়া উঠিল। যদুবংশের ঘরে ঘরে আনন্দকোলাহলের
মধ্যে, যখন, নির্ম্মল ঊষার প্রথম আলোকের রক্তাম্বর সরাইয়া, পুষ্প কিরণের অর্ঘ্য-ডালায়,
প্রাতঃস্নাত নবীন সূর্য্য উজ্জ্বল হস্তে ধরণীর জননীর পূজা সাজাইতেছিলেন, সেই
সময়ে, রাজা শূরসেনের গৃহে রাজকন্যা পৃথা জন্মগ্রহণ করিলেন।
.        সে দিনের ঊষা শীঘ্র প্রভাত হইল না। যেন, স্বর্গের যে অমৃত ছবি নৃপতিগৃহে
সঞ্জীবনী দিয়াছে, আপনি ঊষাদেবী বিভোর হইয়া তাহার সৌন্দর্য্যসুধা পান করিতেছিলেন।
লোকের সমস্ত দিনের স্নানাহার সেই কন্যার মন্দির-দুয়ারে ভুল হইয়া গেল ; সমস্ত
রাজ্য এই অলোকসামান্য রূপময়ী কন্যার কল্যাণগীতে ভরিয়া উঠিল।
.        কিন্তু রাজা শূরসেন এক কঠিন প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ ছিলেন। আপন পিতৃবসৃপুত্র পরম
বন্ধু রাজা কুন্তীভোজের নিকট তাঁহার এই প্রতিশ্রুতি ছিল, যে, প্রথম তাঁহার যে সন্তান
হইবে, তাহা তিনি বন্ধুকে প্রদান করিবেন।
.        আজ তাঁহার শিশু পৃথার চন্দ্রকিরণের ন্যায় অমৃতমূর্ত্তি --- গানের প্রথম সুরের মত,
পল্লবতলচারী বাতাসের আনন্দ ক্রন্দনের মত --- যেন বেদনায়, আরাধনায়-চিন্তায় এক
অপূর্ব্ব তরঙ্গ তাঁহার প্রাণময় খেলিয়া যাইতেছিল।
.        পৃথার জন্মসংবাদ পাইয়া হাস্য করিয়া ভাজরাজ বন্ধুর পার্শ্বে আসিয়া বলিলেন, ---
“বন্ধু, তোমার পণ?”
.        নির্ব্বাত শিখার মত রাজা শূরসেন বন্ধুর দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।
নিমেষে, হৃদয়ের অমৃত-উত্স খুলিয়া দিয়া রাজা বন্ধুকে আলিঙ্গন দিলেন, বলিলেন, ---“বন্ধু,
তাহাই আমার মনে ছিল। এস, দেখ কি সুন্দর প্রভাতের কলিকা! সত্যই তুমি সুখী হইবে,
--- বন্ধু। এস, তোমার কন্যা তুমি নিয়া যাও।”
.        বেদবিহিত যাগ-যজ্ঞ সমাহিত হইল ; নানা সমারোহ করিয়া রাজা স্বীয় নয়ন-প্রাণের
আনন্দনির্ঝর, স্বীয় প্রাসাদের স্নিগ্ধ আক, রাজ্য-কুলের প্রথম রত্ন হৃদয়বন্ধু কুন্তিভোজের
কোলে তুলিয়া দিলেন।


.                       
                         ( ১ )

আনন্দের গলদশ্রু বিধৌত সুন্দর সেই নিশা করিয়া যাপন
ফিরিলা অমৃসিক্র পথ বাহি নৃপ ভোজ নগরে আপন।
তথা, যেন কোন্ পূত অমিয়-কোমল দেবশিশু-স্পর্শলালসায়
সমগ্র প্রাসাদ পুরী সুপ্রভাত-উজল-শ্রী --- ছিল অপেক্ষায়।
অমনি বাজিল বাদ্য, প্রসূনে চন্দনে সারা সমীরণে ভরিল সুবাস,
আন্দোলিত পতাকার সুচঞ্চল আদর আহ্বানে বিচিত্র আকাশ।

খেলে গেল ভোজপুরে সুধাস্বরে যেন কোন্ মহাকলরব,---
মধুহাস্যে বিকশিত প্রভাতের শিশিরার্দ্র ফুলের উত্সব!
.        কোন স্বর্গ হ’তে আনি’ চাঁদের কলিকা,
স্নেহসরোবর জলে                         প্রেমানন্দ কুতূহলে
.        রাখিলা নৃপতি ভোজ আলোকিতে নিজ অট্টালিকা।

.                                                ( ২ )

কি সুষমা! কি সুষমা! প্রাসাদের অভ্যন্তরে --- খরধারে যেন লুটে’ যায়
অমৃত-আনন্দ স্রোত প্রতি স্পন্দে, প্রতি হাস্যে, প্রতি ভঙ্গিমায়!

.                              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাদল ধারা
কবি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজ পত্র পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৬ সংখ্যা (ডিসেম্বর ১৯১৯)
থেকে নেওয়া।

.                                                                আষাঢ়
ভোর বরষার জলে ভাসা আজ এ আমার পল্লীপারে
বাজ্ল উতল একি রে সুর বাজ্ল আলোর বিভোর তারে,
বাজংল মোর এ বিভল হাওয়ায়, বাজ্ল জলের কলস্বরে,
বাজ্ল সবুজ রেখায় রেখায়, বাজ্ল মেঘের থরে থরে,
বাজ্ল সারা গগনেরি অযুত সাঁঝের কাজল পরা
আঁখিকোণের অবাক্ ধারায় কোন্ নিবেদন---বাঁধন হরা!

পাল টেনে ঐ বাতাসে কি ছুটল রে আজ ছুটল তরী
পরিয়ে দিয়ে গানের মালা ভোর সাগরের লহর ভরি,

.                              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর