কবি শিল্পী দেবাশিস রায় - জন্মগ্রহণ করেন হাওড়া জেলার বালীতে। পিতা কমলকৃষ্ণ রায়ের
আদিবাড়ী ছিল অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ১৯৪২ সালে তিনি চলে আসেন কলকাতায় এবং ১৯৪৭
সাল থেকে বালীতে বসবাস শুরু করেন। তিনি ফরিদপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন কৃষ্ণযাত্রা আর
কবিগানের দল নিয়ে। মাতা আরতি দেবী, একদিকে ছিলেন প্রখ্যাত ছায়াছবির নায়ক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত
শিল্পী পঙ্কজ মল্লিকের শিষ্যা, অন্যদিকে তাঁর নজরুলগীতির তালিম নেওয়া হয়েছিল প্রখ্যাত নজরুলগীতির
শিল্পী সুপ্রভা সরকারের কাছে।
দেবাশিষ রায়ের, ( ডাকনাম তাপস ) ধ্রুপদ ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের গুরু ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত-নির্দেশক ডঃ
সন্তোষ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীতজ্ঞ অজয় দাসের সংস্পর্শে আসারও সৌভাগ্য হয়েছিল দেবাশিসের।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেবাশিস, সঙ্গীত রচনা করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী বোথা সরকারের আমলে
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কবি বেঞ্জামিন মোলায়েস কে উত্সর্গ করা গানে।
এরপর তিনি ভয়েস ট্রেনিং লাভ করেন গীতিকার সুরকার অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
১৯৮৪-৮৫ সালে তিনি বালীর সেবাসদন সমিতির গানের দলের নেতৃত্ব দিয়ে, কলকাতা, বর্ধমান, ব্যাণ্ডেল,
সোধপুর সহ বিভিন্ন স্থানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৯৮৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত, বেলুড়ের লালবাবা কলেজ থেকে কমার্স বিভাগে
স্নাতক হন। কর্মজীবন শুরু করেন এইচ.সি.এল. কোম্পানিতে ১৯৮৯ সালে। এরপর আরও কয়েকটি ২০০৭
সালে তিনি ভারতীয় জীবন বীমা কোম্পানির সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত হন।
স্কুল ও কলেজ জীবন থেকেই তিনি বামপন্থায় প্রভাবিত হন। ১৯৯০ সালে তিনি মানবাধিকার সংঘটন A.P.D.
R. এ যোগদান করেন। ২০০০ সালের জমিভরাট বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন।
২০০২-৩ সালে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত বাংলা সঙ্গীত মেলায় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে নান্দীকার
সংস্থা থেকে গ্রামের দুস্থ ছেলে মেয়েদের শিক্ষাদানের কর্মসূচীতে তিনি সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে কাজ
করেছেন।
এরপর ২০০৬ সালে পশ্চিবঙ্গ সরকার দ্বারা, টাটা মোটরস এর জন্য, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ পর্ব শুরু হলে,
তিনিও তার বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। সেই সময়ে তাঁর পরিচয় হয় সাহিত্যিক মানিক মণ্ডল
এবং কবি মিলন সেনগুপ্তর সঙ্গে যিনি দুষ্টকবির ভণিতায় রচনা করতেন।
দুষ্টকবির কথায়, সুর দিয়ে দেবাশিস রায় আটটি গান রচনা করেন যা মানিক মণ্ডলের পরিচালনায়, সরকার
বিরোধী একটি ভিডিও সিডি হয়ে প্রকাশ পায় “বাংলা জ্বলছে” নামে। এই অ্যালবামের গানগুলিতে কণ্ঠ
দিয়েছিলেন প্রবীর বল, অমিত রায়, সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস রায় স্বয়ং এবং অনুরূপ।
সঙ্গীতায়োজনে ছিলেন অমিত রায়। সিডিটিতে প্রখ্যাত আবৃত্তিকার শিলা চক্রবর্তি এবং দুষ্টকবির একটি
করে কবিতা পাঠও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অচীরেই “বাংলা জ্বলছে” সারা পশ্চিমবঙ্গে, প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ
করে যা দেবাশিস রায়কে অন্যতম গণসঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীনই প্রকাশিত হয় দেবাশিস রায়ের নিজের কণ্ঠে, দুষ্টকবির কথায়,
“ভাঙো বাস্তিল” নামে আরেকটি গণসঙ্গীতের অডিও সিডি। বিখ্যাত কানোরিয়া আন্দোলনের জন্য দুষ্টকবির
কথায় সুরারোপিত করে ধর্মতলার সিধু-কানু-দহরের অনুষ্ঠানেও তিনি গণসঙ্গীত পরিবেশন করে আসেন
২০০৮ সালে।
২০১১ সালে আসে “পরিবর্তন”। ৩৫ বছরের বামফ্রন্টের শাসনকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম
আন্দোলনের নেত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেই হয়তো, সেই আন্দোলন থেকেই
উঠে আসা গান, গাওয়া ও বাজানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোড়ে মোড়ে বাজাতে শুরু করা হয় কেবল
রবীন্দ্রসঙ্গীত! সিঙ্গুর আন্দোলনের জয়ন্তী অনুষ্ঠানে, এমন কি তাপসী মালিকের স্মরণে আয়োজিত
অনুষ্ঠানেও সেই সব গান আর শুনতে পাওয়া যায় না। সেখানে প্রাধান্য পায় পাগলু-ড্যান্স এর মত উদ্দাম নাচ
আর গান!
আমাদের মনে হয় গণসঙ্গীতের প্রয়োজন কখনোই ফুরায় না। যুগে যুগে আবার শুরু হয় মানুষের উপর
উপীড়ন-নিপীড়ন। আর তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। সৃষ্টি হয় নতুন সংঘাতের। নতুন
সংঘাতই সৃষ্টি করে নতুন গণসঙ্গীতের, যার মধ্যে নিপীড়িত মানুষ খুঁজে পায়ে তাঁর মনের কথা। আসে
পরিবর্তন।
২০১২ সালে তাঁর সুরে প্রকাশিত হয় বাংলা আধুনিক গানের একটি অডিও সিডি “সমুদ্র দেয় দোলাদোল”।
সেই সিডিটিতে গান গেয়েছিলেন কুমার শানু, রূপঙ্কর, স্বয়ং দেবাশিস রায় এবং জেনিভা রায়। সিডিটি
প্রকাশনা করেন সাগরিকা মিউজিক প্রাইভেট লিমিটেড।
২০১৪ সালে সরকারের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন "হোক কলরব" সংগঠিত হয়। সেই
আন্দোলনের জন্যও দেবাশিস রায় প্রতিবাদী গানে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন। সেই গান মিলনসাগরের "হোক
কলরব"-এর দেয়ালিকাতে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে আরও বহু কবিতা ও গানের সঙ্গে।
আমরা মিলনসাগরে কবি দেবাশিস রায়ের কবিতা বা গণসঙ্গীত তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে
পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স - কবির সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া সাক্ষাত্কার।
কবি দেবাশিস রায়ের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২২.৮.২০১৬
...