মৃত-রবি-কর-রেখা --- শুষ্ক ফুল সঙ্গে তার, জীবন ভরিয়া মোর ; কাঁদে অন্ধ হাহাকার | শুকায় শুকাক ফুল, থেমে যায় যাক হাসি, লক্ষ্যহীন অন্ধকারে হৃদয় যাইবে ভাসি | চাহি না শুনিতে আর, বসন্তের পুষ্পরাণী, ঢেল না শ্রবণে তব বীণা-বিনিন্দিত বাণী | জ্বেল না জীবনে আর তোমার সোনার বাতি আছে প্রাণে, থাক্ থাক্ আমার আঁধার রাতি ||
শতচ্ছিন্ন ছিদ্র-বস্ত্র পরিধানে আছে যা'র কনক আলোর রেখা, লজ্জার কারণ তার | ভাসিয়া গিয়াছে স্বপ্ন, ভুলিয়া যেতেছি গান, সাজে না জীবনে আর বসন্ত ব্যাকুল তান | সকলি হারায়ে গেছে, জীবন দিয়াছি ছেড়ে--- আঁধার হৃদয় মাঝে, আঁধার গিয়াছে বেড়ে | নিভিয়া এসেছে হাসি, শুকায়ে এসেছে ফুল, বিধাতার এ কি লীলা,--- মৃত্যুর এ কি রে ভুল |
আমার এ প্রেম মোর চিত্ত হ'তে এসে, তোমারি লাবণ্য মাঝে নিত্য খেলা করে, কৌতূহল দীপ্ত আঁখি, সুখশ্রান্তি শেষে, আবার তোমারি বক্ষে ঘুমাইয়া পড়ে ! আমার আকাঙ্ক্ষা সখি ! পতঙ্গের মত দিবসে নিশীথে শুধু দগ্ধ হতে চায়, ঢলিয়া পড়েছে তব সর্ব্বাঙ্গে সতত, অতৃপ্তের তৃপ্তি লাগি উন্মত্তের প্রায় ! আমার এ মন সখি ! মুগ্ধ কবি সম, সর্ব্বদা করিছে শত সঙ্গীত রচনা, গাঁথি গাঁথি সুখ দুঃখ পুষ্প অনুপম, আপনি চরণে তব ঢালিছে আপনা ! তুমি আমি কাছে তবু দূরে দূরে থাকি, দুজনার মাঝে এক দীপ জ্বেলে রাখি !
হে সুন্দরী ! সেই দিন বসন্ত প্রভাতে মন-প্রাণ-অন্ধ-করা সুবাসিত রাতে ঝলসিলে আঁখি মোর পরশিলে মন ! অবাক অন্তর তোমা করিল বরণ !--- ভালো ক'রে দেখে নাই, করেনি জিজ্ঞাসা প্রেমাতুর প্রাণ, দিয়া সর্ব্ব ভালোবাসা, সেই দিন, সর্ব্ব কাজে চিত্ত আনমনা, করেছে করেছে শুধু তোমারি অর্চ্চনা | আর সেই, সেই দিন বসন্ত বাতাস, আপন আবেগে পূর্ণ নিশীথ আকাশ, চন্দ্রালোকে আলোকিত সকল ভূবন, স্বপ্নালোকে আলোকিত আমার এ মন !--- অর্দ্ধ নিমিলিত নেত্রে মনে হ'ল মোর স্বর্গ হতে নেমে এলে! জগতের ঘোর ঢাকিলে স্বর্গের করে ! গরবী পরাণ করিল পূজার লাগি পুষ্প-অর্ঘ্য দান ! সব মনে নাই, শুধু মনে আছে মোর, উজ্জ্বল অধর তব অবাক বিভোর, চরণে পরশি যেন অজানিত দেশ !--- নূতন রাজ্যের মাঝে আশ্চর্য্য অশেষ ! রহস্য-মধুর হাসি ! কৌতুকে অপার পরিপূর্ণ দুই নেত্র ! প্রতি পত্রে তার বিস্তারিত স্বর্গ-ছায়া স্বরগের পথ নিতান্তই স্বরগের ভাবিনু সেই মুখ !
তারপর গেছে দিবা, গেছে নিশা কত | গিয়াছে স্বপন প্রায় আশা শত শত--- প্রভাতের মুক্ত বায়ু, শ্রান্ত রজনীর অলস অঞ্চল-গন্ধ সুরভী সমীর, এ মোর পরাণ 'পরে ! সুখে দুঃখে শোকে, পরিম্লান ধরণীর মলিন আলোকে, সম্পূর্ণ আঁধারে কভু, এ মোর জীবন কত দীর্ঘ দিবানিশি করেছে যাপন ! হে মোর প্রভাত পুষ্প, হে অপিরিচিতা ! হে আমার যৌবনের পূর্ণ-প্রস্ফূটিতা ! হে মোর মানস স্বর্গ, হে স্বপ্ন-চঞ্চলা, হে মোর চঞ্চল চিত্তে চির অচঞ্চলা ! হে আনন্দ নিখিলের ! হে শান্ত রঙ্গিণি ! হে আমার যৌবনের স্বপন-সঙ্গিনী | হে আমার আপনার ! হে আমার পর ! হে আমার বাহিরের ! হে মোর অন্তর--- হে আমার --- হে আমার চির-মর্মময় ! আজ পাইয়াছি তব সত্য পরিচয় ! আছিলে গোপনে মোর মন-অন্তঃপুরে আমারি বাসনা, মোর এ পঞ্জর জুড়ে ! যেমনি বাজানু বাঁশি, সলাজ চরণে --- বাহিরিলে --- দাঁড়াইলে --- অপূর্ব্ব ধরণে,--- চরণে প্রস্ফুট পুষ্প, মস্তকে গগন !--- আমি অন্ধ দেখেছিনু স্বর্গের স্বপন !