দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কবিতা
*
অন্তিমে
কবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ


নিভিয়া গিয়াছে হাসি, শুকায়ে এসেছে ফুল,
নিষ্প্রভ জীবন আজি, মৃত্যুর এ কি রে ভুল !
যৌবন চলিয়া গেছে, স্বপন গিয়াছে তার,
চরাচরে ছেয়ে গেছে, পরাণের অন্ধকার !
বঁধু নাই --- বাঁশী নাই ---বৃন্দাবন ? তা'ও নাই,
অন্তরের সাধগুলি পুড়িয়া হয়েছে ছাই !
আজ শুধু মধু-স্মৃতি শ্মশানে কুসুমসম,
পুরাতন জীর্ণ গৃহে মলিন প্রদীপ মম ||

মৃত-রবি-কর-রেখা --- শুষ্ক ফুল সঙ্গে তার,
জীবন ভরিয়া মোর ; কাঁদে অন্ধ হাহাকার |
শুকায় শুকাক ফুল, থেমে যায় যাক হাসি,
লক্ষ্যহীন অন্ধকারে হৃদয় যাইবে ভাসি |
চাহি না শুনিতে আর, বসন্তের পুষ্পরাণী,
ঢেল না শ্রবণে তব বীণা-বিনিন্দিত বাণী |
জ্বেল না জীবনে আর তোমার সোনার বাতি
আছে প্রাণে, থাক্ থাক্ আমার আঁধার রাতি ||

শতচ্ছিন্ন ছিদ্র-বস্ত্র পরিধানে আছে যা'র
কনক আলোর রেখা, লজ্জার কারণ তার |
ভাসিয়া গিয়াছে স্বপ্ন, ভুলিয়া যেতেছি গান,
সাজে না জীবনে আর বসন্ত ব্যাকুল তান |
সকলি হারায়ে গেছে, জীবন দিয়াছি ছেড়ে---
আঁধার হৃদয় মাঝে, আঁধার গিয়াছে বেড়ে |
নিভিয়া এসেছে হাসি, শুকায়ে এসেছে ফুল,
বিধাতার এ কি লীলা,--- মৃত্যুর এ কি রে ভুল |

.                *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      


মিলনসাগর       
*
তুমি ও আমি
কবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ


আমার এ প্রেম মোর চিত্ত হ'তে এসে,
তোমারি লাবণ্য মাঝে নিত্য খেলা করে,
কৌতূহল দীপ্ত আঁখি, সুখশ্রান্তি শেষে,
আবার তোমারি বক্ষে ঘুমাইয়া পড়ে !
আমার আকাঙ্ক্ষা সখি ! পতঙ্গের মত
দিবসে নিশীথে শুধু দগ্ধ হতে চায়,
ঢলিয়া পড়েছে তব সর্ব্বাঙ্গে সতত,
অতৃপ্তের তৃপ্তি লাগি উন্মত্তের প্রায় !
আমার এ মন সখি ! মুগ্ধ কবি সম,
সর্ব্বদা করিছে শত সঙ্গীত রচনা,
গাঁথি গাঁথি সুখ দুঃখ পুষ্প অনুপম,
আপনি চরণে তব ঢালিছে আপনা !
তুমি আমি কাছে তবু দূরে দূরে থাকি,
দুজনার মাঝে এক দীপ জ্বেলে রাখি !

.                *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      


মিলনসাগর       
*
স্বর্গের-স্বপন
কবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ


হে সুন্দরী ! সেই দিন বসন্ত প্রভাতে
মন-প্রাণ-অন্ধ-করা সুবাসিত রাতে
ঝলসিলে আঁখি মোর পরশিলে মন !
অবাক অন্তর তোমা করিল বরণ !---
ভালো ক'রে দেখে নাই, করেনি জিজ্ঞাসা
প্রেমাতুর প্রাণ, দিয়া সর্ব্ব ভালোবাসা,
সেই দিন, সর্ব্ব কাজে চিত্ত আনমনা,
করেছে করেছে শুধু তোমারি অর্চ্চনা |
আর সেই, সেই দিন বসন্ত বাতাস,
আপন আবেগে পূর্ণ নিশীথ আকাশ,
চন্দ্রালোকে আলোকিত সকল ভূবন,
স্বপ্নালোকে আলোকিত আমার এ মন !---
অর্দ্ধ নিমিলিত নেত্রে মনে হ'ল মোর
স্বর্গ হতে নেমে এলে! জগতের ঘোর
ঢাকিলে স্বর্গের করে ! গরবী পরাণ
করিল পূজার লাগি পুষ্প-অর্ঘ্য দান !
সব মনে নাই, শুধু মনে আছে মোর,
উজ্জ্বল অধর তব অবাক বিভোর,
চরণে পরশি যেন অজানিত দেশ !---
নূতন রাজ্যের মাঝে আশ্চর্য্য অশেষ !
রহস্য-মধুর হাসি ! কৌতুকে অপার
পরিপূর্ণ দুই নেত্র !  প্রতি পত্রে তার
বিস্তারিত স্বর্গ-ছায়া স্বরগের পথ
নিতান্তই স্বরগের ভাবিনু সেই মুখ !

তারপর গেছে দিবা, গেছে নিশা কত |
গিয়াছে স্বপন প্রায় আশা শত শত---
প্রভাতের মুক্ত বায়ু, শ্রান্ত রজনীর
অলস অঞ্চল-গন্ধ সুরভী সমীর,
এ মোর পরাণ 'পরে ! সুখে দুঃখে শোকে,
পরিম্লান ধরণীর মলিন আলোকে,
সম্পূর্ণ আঁধারে কভু, এ মোর জীবন
কত দীর্ঘ দিবানিশি করেছে যাপন !
হে মোর প্রভাত পুষ্প, হে অপিরিচিতা !
হে আমার যৌবনের পূর্ণ-প্রস্ফূটিতা !
হে মোর মানস স্বর্গ, হে স্বপ্ন-চঞ্চলা,
হে মোর চঞ্চল চিত্তে চির অচঞ্চলা !
হে আনন্দ নিখিলের ! হে শান্ত রঙ্গিণি !
হে আমার যৌবনের স্বপন-সঙ্গিনী |
হে আমার আপনার ! হে আমার পর !
হে আমার বাহিরের ! হে মোর অন্তর---
হে আমার --- হে আমার চির-মর্মময় !
আজ পাইয়াছি তব সত্য পরিচয় !
আছিলে গোপনে মোর মন-অন্তঃপুরে
আমারি বাসনা, মোর এ পঞ্জর জুড়ে !
যেমনি বাজানু বাঁশি, সলাজ চরণে ---
বাহিরিলে --- দাঁড়াইলে --- অপূর্ব্ব ধরণে,---
চরণে প্রস্ফুট পুষ্প, মস্তকে গগন !---
আমি অন্ধ দেখেছিনু স্বর্গের স্বপন !

.                *************************      

.                                                                             
সূচীতে . . .      


মিলনসাগর