কবি গোপাল ভৌমিক-এর কবিতা
*
দুঃসাহসিক নাবিকের গান
কবি গোপাল ভৌমিক
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা”, শ্রাবণ ১৩৪৬ (জুলাই ১৯৪০)
কাব্যসংকলনে প্রকাশিত।


মনে ছিল মানচিত্র
ভূগোলেও ছিল নাকো ভুল :
দিকদর্শনের যন্ত্রে
দেখে নিয়ে কোন দিকে কূল
যাত্রা শুরু হয়েছিলো
অজানা এ সমুদ্রের বুকে ;
অনেক আশ্বাসে ভরা
রাত্রির সম্মুখে
ছিলো সূর্য-সম্ভাবনা,
আকাশে অজস্র তারা-ফুল
হাতছানি-দিয়ে-ডাকা ছায়া-পথে
মায়ার মুকুল।

যাত্রাকালে কিন্তু দিকশূল
ছাড়েনি আমার পিছু,
বুঝেছি তা অনেক দেরিতে
যখন অনেক কিছু
ক্ষয়-ক্ষতি দিয়ে
এ-জাহাজ পায়নিকো কুলের নিশানা,
অজানা চড়ায় ঠেকে
বন্দরের হারালো ঠিকানা।

দুঃসময় যে-ই দিলো হানা
দুরন্ত দস্যুর মতো,
আমি কিন্তু এতটুকু
হইনি বিব্রত
জানি আমি বিজ্ঞানীরও
গণনায় মাঝে-মাঝে ভুল
হ’তে পারে ; তাই ব’লে
সৃষ্টির মুকুল
চিরদিন ঝ’রে যাবে অন্ধকারে
কিংবা বন্ধ্য বালুচরে
তাও আমি মানিনা কিছুতে :
আমি যদি না-ও পারি, আর কেউ শক্ত হাতে ধ’রে
এ-জাহাজ নিয়ে যাবে সমুদ্রের পারে
অতি দূর আলোর বন্দরে।

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
লোকটা
কবি গোপাল ভৌমিক
কবিশেখর কালিদাস রায় সম্পাদিত “মাধুকরী” (১৯৬২) কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।


লোকটা বিস্ময় বটে, এই বৈশ্য যুগে
না করে বেসাতি, করে সে হৃদয় নিয়ে
মাতামাতি ; অনাহারে রোগে ভুগে ভুগে
পান্ডুর দু’চোখ তার, তবু তাই দিয়ে

সে চায় দেখতে ওই দূরের আকাশে
কি করে ঘনায় সন্ধ্যা রৌদ্রমাখা
চিলের ডানায়, কি করে মেঘেরা ভাসে
রাত্রির বুকে যেন ছায়াছবি আঁকা।

মাটি মা’কে ভাল বাসে, তাই ঘাসে শুয়ে
ভাবে সে অনেক কথা, আকাশ পৃথিবী,
ভাবে সে কি করে মিলে দুয়ে আর দুয়ে
চার হয় ; ওদিকে যে জমে উই ঢিবি

পরবাসী করে তাকে স্বদেশে স্বঘরে,
ভুলে সে থাকেই বসে হৃদয়-চত্বরে।

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রতিশোধ
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৮ (জুলাই ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।


জীবনে কোথায় যেন
গুপ্ত ছিল ধ্বংসকারী কীট :
কোথায় ফাটল ছিল---
ছিল বুঝি চির খাওয়া ইঁট।

মানুষের শ্যেন চোখে
পড়ে নাই সে প্রকাণ্ড ফাঁকি :
নগরে নগরে তাই

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ছায়া
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪৮ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪২)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


ধূসর সন্ধ্যার ছায়া প্রলম্বিত আকাশের গায়ে,
বিস্মৃতির মত শান্তি নেমে আসে কানন-প্রচ্ছায়ে ;

.                      ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমরা
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪৮ (এপ্রিল ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।


আমরা দেখিনি কভু
রঙে রঙে উজ্জ্বল প্রভাত :
পাতায় পাতায় ফুল---
বনে বনে অজস্র প্রপাত।

আমরা এসেছি যবে

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
অবরুদ্ধ নায়ক
কবি গোপাল ভৌমিক
বিষ্ণু দে সম্পাদিত “এ কালের কবিতা”, (১৯৬৩) কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।


সম্মুখে সমুদ্র নেই,
চিন্তার পাহাড়
উদ্যত ও প্রলম্বিত :
ঘাসে ঢাকা সমভূমি।
নুয়ে-পড়া মানসিকতার
পরিচয়বাহী ব’লে
চিন্তা গড়ে বিদ্রোহী প্রাকার।

যতই পাহাড় হই
যত করি আকাশ কামনা,
হৃদয় পায় না খুঁজে
শান্তি কিংবা মধুর সান্ত্বনা।
সে তার ধ্যানের শঙ্খে
বারবার দিয়ে যায় ডাক
সে চায় সমুদ্র, শান্তি,
পাহাড় মাথায় তোলা থাক।

পাহাড়ে সমুদ্রে তবু
কদাচিৎ হয় দেখাশোনা ;
এক হাতে তরবারি
আর হাতে শান্তির সান্ত্বনা
নিয়ে তবু
দূর হতে দূরে পথ চলি,
পথ জুড়ে থাকে আরাবলি॥

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুহূর্ত-বিলাস
কবি গোপাল ভৌমিক
প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত “প্রেম যুগে যুগে” (১৯৪৫) কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া।


আবেগের মাটির প্রলেপ
মন থেকে খসে যদি
খসে যাক---
করি না আক্ষেপ :
বুদ্ধির ইস্পাত যদি
ঝক্ মক্ করে সারাক্ষণ
ক্ষতি নাই---
যাক্ পুড়ে ঘুণ-ধরা বিবর্ণ এমন

অনুভবে আবেগে উচ্ছ্রিত সময়
মুঠো মুঠো হল অপচয়
অপাত্রে অকালে :
তবু কই জয়টিকা তোমার কপালে!
একান্তে ঘরের কোনে
তুমি ছিলে বসে---
আনমনে সন্মোহ-রভসে :
সহসা আমার মনে আবেগের ঢেউ
কানায় কানায় হল জড়ো,
মুগ্ধ সুখে জানালাম---
এ বিশ্বে তোমার চেয়ে বড়
আর নেই কেউ---
এই কথা সত্য জেনো তুমি’---
দুজনের স্পর্শসিক্ত আবেগের ভূমি।

একটি মুহূর্ত শুধু---
উদ্দাম আবেগে সুমধুর :
তারপর তুমি আমি
দুইজনে বহু বহু দূর।
মাঝখানে জনতার উচ্চ ব্যবধান
মাথা তোলে ধীরে অতি ধীরে :
বুদ্ধির প্রখর সূর্য দেখি তেজীয়ান্
আবেগ-ফেনায় কাঁপা সমুদ্রের শিরে।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
অচির স্থায়ী
কবি গোপাল ভৌমিক
রায় জলধর সেন বাহাদুর সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার মাঘ ১৩৪৩ (জানুয়ারী ১৯৩৭)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


চিরস্থায়ী নয় কিছু, এ রোদন, এই মধু হাসি :
.                প্রেম, ঘৃণা, বহ্নি কামনার
নিঃশেষে বিলোপ পায় মানবের অন্তর মাঝারে
.                ছেড়ে গেলে জগতের দ্বার!

দীর্ঘ তারা নয় কভু, গোলাপী মধুর দিনগুলি :
.                কুয়াসায় ঘেরা স্বপ্ন-দেশে
ক্ষণিক আলোকপাতে দেখা দিয়ে মানবের পথ---
.                মেশে পুনঃ স্বন-আবেশে!

.                 ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কোন্ পথ
কবি গোপাল ভৌমিক
সমরেন্দ্র ঘোষাল সম্পাদিত “শতাব্দীর শত কবিতা” (১৯৬২) কাব্য সংকলনে প্রকাশিত।


অনাদি কালের থেকে
মরণের খড়গটা মাথার উপর ঝুলিয়ে
প্রেম করি, ঘর বাঁধি,
সন্তান-সন্ততির জনকও হই
তবু তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত
দুশ্চিন্তায় বিদ্ধ হইনা,
আগামী কালের কথা ভেবে
থামে না প্রাণের সহজ প্রবাহ।
আজ পৃথিবীর পরিধি যত বেড়েছে
আমার গণ্ডী হয়েছে তত ছোট,
কত দূরে কার হাতে পারমাণবিক বোমা
তা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই ;
কোথায় লুকোব শহরে না গ্রামে?
একটা অস্বাভাবিক মরণের সমারোহে
আমার বর্তমান ভবিষ্যত বিপর্য্যস্ত।
বিপন্ন স্থায়িত্বকে তবু উজ্জ্বল করে তুলতে
উদয়াস্ত পরিশ্রম করি,
রাষ্ট্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে
পরিবার-পরিকল্পনা পর্য্যন্ত রূপায়িত করি।
অপ্রকৃত সব কিছু জেনে শুনে
পণ্ড-শ্রমে আনন্দের সমাধু ঘটাই।

.                 ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্বগতোক্তি
কবি গোপাল ভৌমিক
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত “মাসিক বসুমতী” পত্রিকার চৈত্র ১৩৫১ (মার্চ ১৯৪৫) সংখ্যায়
প্রকাশিত।


পৃথিবীতে বার বার আমাদের পরাজয় হল ;
মুছে নিয়ে ছল ছল
দু’টি চোখ, তবু ত আমরা চলি---
এক রাত্র শেষ হলে---
আর রাত্রে অ মরাই বলি।
দিন কাটে, রাতও কেটে যায়---
সময়ের পাখায় পাখায়
আমরাই তবু ছুটে চলি---
কোথায় ক্লাইভ্ স্ট্রীট---
কোথায় বা ইয়ালটার অন্ধ সোঁদা গলি।

প্রাত্যহিত কাগজের পাতায় পাতায়---
সংবাদের ছড়াছড়ি ;
প্রতি পৃষ্ঠা ভরে ওঠে
আমাদেরই জীবন-গাথায়।
পৃথিবীর কোন প্রান্তে
কয় নেতা বসে---
আমাদের ভাগ্য গোণে ছক কেটে কসে।

এ নতুন যাদুবিদ্যা---
পূর্ণাঙ্গ নতুন তবু নয় ;
অলক্ষ্যে পুরানো দিন হাসে---
সেই তার হারাবার ভয়।

এক মজার অঙ্ক, মন্দ নয়---
ভাগ্যের এ খেলা ;
এ দিনের এত মৃত্যু এ রক্ত-সঞ্চয়---
সব তবে বৃথা হল!
মানুষের সনাতন ভয়---
থেকে গেল আগের মতন---
পুরাতন পৃথিবীতে
এ নতুন শাসন-শোষণ
আগের মতই চলে ;
মৌলিক নীতিতে ভেদ কই?
গাছে যারা তুলে দিল---
তারাই ত কেড়ে নিল মই!
খণ্ডিত সময়ে তবু---

আশা নিয়ে বসে আছি ঠায়---
ক্লাইভ্ স্ট্রীট, বাস চলে যায়।

.                 ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর