মৃত্যুঞ্জয় কবি গোপাল ভৌমিক যামিনীমোহন কর সম্পাদিত “মাসিক বসুমতী” পত্রিকার পৌষ ১৩৫২ (ডিসেম্বর ১৯৪৫) সংখ্যায় প্রকাশিত।
তোমরা বীরের দল--- আত্মার ঐশ্বর্যে মহীয়ান্ করে গেছ র্কত-রাঙা পথের ধূলিকে : অতর্কিতো উত্সারিত পুলিশের উদ্যত গুলিকে বুক পেতে দুর্জয় সাহসে করে দিল স্তব্ধ ম্রিয়মাণ নগ্নোদ্ধত রাজশক্তি রাজপথে হল অবসান!
সে এক বিচিত্র দৃশ্য : রাজপথে সহস্র তরুণ নিরস্ত্র অহিংস নিরুপায়--- শুধু চায় নিজেদের স্বাভাবিক পৌর অধিকার--- পথে পথে মিছিল করার। বলদর্পী শাসকেরা পরিবর্ত্তে কি দিল তাদের? চতুর্দিকে পুলিশের বেড়--- তার পর লাঠি আর অগ্নিবর্ষী বুলেটের ঝাঁক--- এনে দিল দুরন্ত বিপাক।
রাজপথাশ্রয়ী তবু তরুণের দল রক্তদিয়ে ভীত নয় নয় তারা আদৌ দুর্বল : তারা মৃত্যুঞ্জয় অহিংসার নীরব সাধক--- বীর শিশু দেশ-মাতৃকার--- রক্ত দিয়ে ভেঙে দিল উদ্ধত অস্ত্রের অহংকার, তাজা রক্ত-মাখা স্বৈরাচার।
স্বপ্ন-শেষ কবি গোপাল ভৌমিক লীলা রায় সম্পাদিত “জয়শ্রী” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪৬ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪০) সংখ্যায় প্রকাশিত।
শেষ হল পৃথিবীর বসন্ত-বিলাস : কর্মহীন জীবনের স্লান্তিহীন অবসরে নেমে এল ধূলিপূর্ণ রুক্ষ অবিচার। বালুকীর্ণ মরুপথে যাত্রা হ’ল শুরু : মাথার পরে প্রখর সূর্য নীচে উত্তপ্ত বালুকণা--- আর সংশয়ের প্রবল ঝটিকা। ক্লান্ত চোখে নৈরাশ্য ঘনায় : তবু দেখি--- সুদূর অতীতের অনাস্বাদিত স্বপ্ন যার সম্ভাবনার বীজ অংকুরেই গেছে বিনষ্ট হ’য়ে : আজএ মনে পড়ে তার মদির দোলা--- আকাশ আর সমুদ্র স্বপ্ন আর বাস্তব। বালুকীর্ণ মরুপথে--- ধরণীর শ্যামল মাটির গন্ধ আজও আমি অনুভব করি : তৃপ্ত হ’য়ে ভাবি--- সে-দিন কি আবার আসবে? আসবে কি উড়ে-যাওয়া স্বপ্ন-হাঁসের দল--- রৌদ্র-দগ্ধ আকাশের বক পাড়ি দিয়ে?
বিপর্যয় কবি গোপাল ভৌমিক বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮ (মে ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।
ধূসর প্রান্তর দেখে ঝলসে নয়ন কোথা সে বিচিত্র কীর্তি দেখি না ত সৌন্দর্যের নিখুত নয়ন। স্বপ্নালস চোখ দুটি খুলি সৌন্দর্য-রভস চায় আত্মার ভিখারী প্রত্যাশায় আঁখিপদ্ম তুলি। প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টি আঁখির কিনারে ; যুগান্তের পথ চেয়ে তাই প্রত্যাহত ফিরে আসে আমার দুয়ারে।
প্রপীড়িত স্থূল দৃষ্টি দেখে ধ্বংস-স্তূপ দেখে না ত ভবিষ্যতে তার আবৃত বীজের নীচে সুন্দরের রূপ। দীপ্ত বুদ্ধি দিয়া বুঝি বৃথা এই খেদ অসম্ভব ভুলে যাওয়া অবিস্মরণীয় তবু আত্মার নির্বেদ। প্রচ্ছন্ন অতীত চৈত্যে আমার বিহার ; নিপীড়িত বুদ্ধিজীবী মন--- অনাগত ভবিষ্যৎ হাসে নির্বিকার।
দিন কবি গোপাল ভৌমিক বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৯ ( জুন ১৯৪২) সংখ্যায় প্রকাশিত।
প্রেতায়িত অন্ধকারে এইসব ভাঙাচোরো অন্ধ খোঁড়া দিন রাত্রি শেষে ঝ’রে পড়া এরা যেন শিউলীর ফুল : বাতাসের মৃদু ঘায়ে এরা জেন নিতান্ত চঞ্চল--- একান্ত দোদুল। এমন নরম দিন কাম্য নয় মোটে : আমি ত চেয়েছি দিন জমাট পাথর যার ঘায়ে আকাশ সাগর হবে কম্পমান--- আমার দিনেরা হবে নিরেট পাষাণ।
বরফ-জমাট দিন অন্ধকারে কেঁদে কেঁদে ফেরে : আমি তার পেয়েছি খবর মায়া-পাহাড়ের পারে তাহাদের ঘর। এ কঠিন অভিযান তাই নিরন্তর।
অবিনশ্বর কবি গোপাল ভৌমিক ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার মাঘ ১৩৪৬ (জানুয়ারী ১৯৪০) সংখ্যায় প্রকাশিত।
রাতের পাথার ভর দিয়ে গেছে চ’লে’ আমার মনের সোনালী বনের পাখী,--- আসিবে কি ফিরে’, তারে স্মরি’ যদি কাঁদে বাসা বেঁধেছিল যার বুকে, সেই শাখী? বহুদিন হ’ল লুকোচুরি খেলা শেষ--- মন-ঠকানোর পালা হ’ল অবসান একদিন ছিল, সে কথা ত ভাল জানি ; তাইত রচিলা করুণ বিষাদ গান! স্মৃতির পরিখা একদা ভরাট ছিল--- একদা সেখানে ছিল বহু বীরবর, এখন সেখানে নাই অসি-ঝন্ ঝন্--- মাটির পরিখা, শুধুই বালুর চর। ধূ-ধূ করা সেই বালুচরে তবু শুনি--- দূরাগত কোন নিশীথের কলরব,--- আমার জীবনে সে মহা লগন ভাবি--- যখন সেখানে চলেছিল উত্সব! সে-দিন এখন বাতাসে মিলায়ে গেছে কালের কোঠায় জমা আছে তার ফল, তাই আমি কভু গাহি না বিষাদ-গীতি- তাইত ফেলিনা করুণ আঁখির জল!