কবি গোপাল ভৌমিক-এর কবিতা
*
মৃত্যুঞ্জয়
কবি গোপাল ভৌমিক
যামিনীমোহন কর সম্পাদিত “মাসিক বসুমতী” পত্রিকার পৌষ ১৩৫২ (ডিসেম্বর ১৯৪৫)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


তোমরা বীরের দল---
আত্মার ঐশ্বর্যে মহীয়ান্
করে গেছ র্কত-রাঙা পথের ধূলিকে :
অতর্কিতো উত্সারিত পুলিশের উদ্যত গুলিকে
বুক পেতে দুর্জয় সাহসে
করে দিল স্তব্ধ ম্রিয়মাণ
নগ্নোদ্ধত রাজশক্তি রাজপথে হল অবসান!

সে এক বিচিত্র দৃশ্য :
রাজপথে সহস্র তরুণ
নিরস্ত্র অহিংস নিরুপায়---
শুধু চায়
নিজেদের স্বাভাবিক পৌর অধিকার---
পথে পথে মিছিল করার।
বলদর্পী শাসকেরা
পরিবর্ত্তে কি দিল তাদের?
চতুর্দিকে পুলিশের বেড়---
তার পর লাঠি আর অগ্নিবর্ষী বুলেটের ঝাঁক---
এনে দিল দুরন্ত বিপাক।

রাজপথাশ্রয়ী তবু তরুণের দল
রক্তদিয়ে ভীত নয়
নয় তারা আদৌ দুর্বল :
তারা মৃত্যুঞ্জয়
অহিংসার নীরব সাধক---
বীর শিশু দেশ-মাতৃকার---
রক্ত দিয়ে ভেঙে দিল
উদ্ধত অস্ত্রের অহংকার,
তাজা রক্ত-মাখা স্বৈরাচার।

হে দুর্জয় সাহসী তরুণ,
তোমাদের জানাই প্রণাম :
অনন্ত রাত্রির শেষে হাসে নবারুণ---
তোমরা এনেছ তার গোপন সন্ধান।
বিপক্ষের হাতে লাঠি বন্দুক কামান
যতই উঁচানো থাক---
ভীত নয় সত্যাগ্রহী
অহিংসার অস্ত্রে বলবান্।
হে করুণ তোমাদেরই জয়,
বক্ষ-রক্ত ঢেলে নিয়ে
ভেঙে দিলে জড়তার ভয়---
হলে মৃত্যুঞ্জয়!

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্বপ্ন-শেষ
কবি গোপাল ভৌমিক
লীলা রায় সম্পাদিত “জয়শ্রী” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪৬ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪০) সংখ্যায় প্রকাশিত।


শেষ হল পৃথিবীর বসন্ত-বিলাস :
কর্মহীন জীবনের স্লান্তিহীন অবসরে
নেমে এল ধূলিপূর্ণ রুক্ষ অবিচার।
বালুকীর্ণ মরুপথে যাত্রা হ’ল শুরু :
মাথার পরে প্রখর সূর্য
নীচে উত্তপ্ত বালুকণা---
আর সংশয়ের প্রবল ঝটিকা।
ক্লান্ত চোখে নৈরাশ্য ঘনায় :
তবু দেখি---
সুদূর অতীতের অনাস্বাদিত স্বপ্ন
যার সম্ভাবনার বীজ
অংকুরেই গেছে বিনষ্ট হ’য়ে :
আজএ মনে পড়ে তার মদির দোলা---
আকাশ আর সমুদ্র
স্বপ্ন আর বাস্তব।
বালুকীর্ণ মরুপথে---
ধরণীর শ্যামল মাটির গন্ধ
আজও আমি অনুভব করি :
তৃপ্ত হ’য়ে ভাবি---
সে-দিন কি আবার আসবে?
আসবে কি উড়ে-যাওয়া স্বপ্ন-হাঁসের দল---
রৌদ্র-দগ্ধ আকাশের বক পাড়ি দিয়ে?

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ডার্ক
কবি গোপাল ভৌমিক
লীলা রায় সম্পাদিত “জয়শ্রী” পত্রিকার ভাদ্র ১৩৪৮ (অগাস্ট ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।


কমরেড্, সাইরেন শোন :
দুর্দিনের ভয় ছিল---
সে দুর্দিন আজ সমাগত---
আকাশে বাতাসে তাই সূচনা-সংকেত।
সভ্যতা-সৌধের ভিত্তি ন’ড়ে ওঠে আজ---
ধ্বংসের দেবতা তাই বাজায় বিষাণ :
এতদিন তন্দ্রা ছিল মানুষের চোখে
নিশ্চিন্ত আরামে ছিল
দৃঢ়বদ্ধ গাঁথুনির নীচে,
মুখে ছিল অহিংসার মধুময় বাণী।
আজ দেখি আসলেই ছিল বড় ফাঁকি :
আস্তরণ ভেদ ক’রে
বের হয় প্রকাণ্ড ফাটল---
ধূলিসাৎ হ’তে চায় কৃত্রিম প্রাসাদ।
ধ্বংস-স্তুপ দেখে ভয় পেয়ো না কমরেড্ :
এরই মাঝে উপ্ত আছে ভবিষ্যের বীজ---
সভ্যতার চক্র-পথ বন্ধন-বিহীন।
পুরাণো ধ্বংসের বুকে---
নতুনের কর উদ্বোধন :
নিরন্ধ্র গাঁথুনি দিয়ে
গ’ড়ে তোল সভ্যতার ভিৎ।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিপর্যয়
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮ (মে ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।


ধূসর প্রান্তর দেখে ঝলসে নয়ন
কোথা সে বিচিত্র কীর্তি
দেখি না ত সৌন্দর্যের নিখুত নয়ন।
স্বপ্নালস চোখ দুটি খুলি
সৌন্দর্য-রভস চায় আত্মার ভিখারী
প্রত্যাশায় আঁখিপদ্ম তুলি।
প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টি আঁখির কিনারে ;
যুগান্তের পথ চেয়ে তাই
প্রত্যাহত ফিরে আসে আমার দুয়ারে।

প্রপীড়িত স্থূল দৃষ্টি দেখে ধ্বংস-স্তূপ
দেখে না ত ভবিষ্যতে তার
আবৃত বীজের নীচে সুন্দরের রূপ।
দীপ্ত বুদ্ধি দিয়া বুঝি বৃথা এই খেদ
অসম্ভব ভুলে যাওয়া
অবিস্মরণীয় তবু আত্মার নির্বেদ।
প্রচ্ছন্ন অতীত চৈত্যে আমার বিহার ;
নিপীড়িত বুদ্ধিজীবী মন---
অনাগত ভবিষ্যৎ হাসে নির্বিকার।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
লাল সূর্য
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার মাঘ ১৩৪৭ (জানুয়ারী ১৯৪১) সংখ্যায় প্রকাশিত।


অতর্কে উদ্যত দিন
হানা দিল দুয়ারে আমার---
বাহিরে বিপুল বিশ্ব
এখনও আঁধারে একাকার!

একাকী আমিই জাগি---
আর সব সুষুপ্তি-বিলীন
অসীম বৈষম্য সব
এন্ধকারে হয়ে গেছে ক্ষীণ!

জীর্ণ কুটির মাঝে---
দরিদ্রের ক্ষুধার যন্ত্রণা,
তারই পাশে হর্ম্য মাঝে
আনে ঘুম সুরের মূর্ছনা!

হঠাৎ দিনের আলো
এসে পড়ে গৃহাঙ্গন তলে
আমার মনের মাঝে
শত সূর্য লাল হয়ে জ্বলে।

প্রদীপ্ত দিনের ডাকে
সাড়া দেই আনন্দিত মনে---
দেখি লাল সূর্য জ্বলে
প্রতি পর্ণ কুটিরের কোণে!

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
উজ্জীবন
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪৭ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪১) সংখ্যায়
প্রকাশিত।


আমার পৃথিবী কেন সীমাবদ্ধ
বল হে ঈশ্বর?
মুক্তি-স্বাদ পাব নাকি, পাব, নাকি
ঐশ্বরেযের বর?

অন্ধকারে রাত দিন কক্ষপথে
করি চক্রমণ :
কচ্ছপ দেহের মাঝে বন্দী আমি
অত্মমুখী মন।

পৃথিবীর চাকা ঘোরে শঙ্কা ভীরু
হতাশ্বাসময় :
সাগর-গর্জন-ধ্বনি শুনি না ত---
কোথা সূর্যোদয়?

চারিদিকে শুনি শুধু কাতরোক্তি
বুভুক্ষু রোদন :
পঙ্কিল রক্তের ঋণ চায় বুঝি
অঙ্গের শোধন!

তবু জানি মরি নাই, হে ঈশ্বর---
জীবন্ত আমরা :
ধূসরে সোনার রঙ দিবে জানি
অবশ্যই ধরা।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
দিন
কবি গোপাল ভৌমিক
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৯ ( জুন ১৯৪২) সংখ্যায় প্রকাশিত।


প্রেতায়িত অন্ধকারে
এইসব ভাঙাচোরো অন্ধ খোঁড়া দিন
রাত্রি শেষে ঝ’রে পড়া
এরা যেন শিউলীর ফুল :
বাতাসের মৃদু ঘায়ে
এরা জেন নিতান্ত চঞ্চল---
একান্ত দোদুল।
এমন নরম দিন কাম্য নয় মোটে :
আমি ত চেয়েছি দিন জমাট পাথর
যার ঘায়ে আকাশ সাগর
হবে কম্পমান---
আমার দিনেরা হবে নিরেট পাষাণ।

বরফ-জমাট দিন
অন্ধকারে কেঁদে কেঁদে ফেরে :
আমি তার পেয়েছি খবর
মায়া-পাহাড়ের পারে তাহাদের ঘর।
এ কঠিন অভিযান তাই নিরন্তর।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবি কুমুদরঞ্জনের প্রতি
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার ভাদ্র ১৩৫৩ (অগাস্ট ১৯৪৬)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


তোমার আমার মাঝে রয়েছে অমিল :
ব্যবধান বয়স ও যুগের
যেন মহাসমুদ্রের মত---
তোমাকে আমাকে করে বিচ্ছিন্ন বিব্রত।

তোমার চোখের দেখা শ্য়ামল মাটিতে
সবুজের ছিল সমারোহ :
ধান্য-শীর্ষে আন্দোলিত প্রান্তরে প্রান্তরে
সৌন্দর্যের ছিল যে-প্রবাহ---
তারই ছোঁয়া দিয়ে জানি---
তোমার মানস-সৃষ্টি কাব্য-বিবর্তন---
মুগ্ধ করে মানুষের মন,
হৃদয়ে হৃদয়ে জাগে সুতীব্র রণন।

তোমার অনেক পরে আমরা এসেছি :
দেখেছি কখন যেন সবুজ প্রান্তর---
হয়ে গেছে ধূসর গম্ভীর,
আকাশের বুক চিরে ফ্যাক্টরীর শির---
মানুষে মানুষে গড়ে তীব্র ব্যবধান,
মানুষের লোভে হল
সুন্দরের ব্যর্থ অবসান।
আমাদের কাব্য তাই---
রুক্ষ তীব্র সৌন্দর্য-বিহীন
এ মাটিতে পেতে চায় সোনাঝরা দিন।

তোমার আমার পথ ভিন্ন জানি---
লক্ষ্য ভিন্ন নয়,
আমাকে পাথেয় দিল তোমারই সঞ্চয়।

নতশিরে হে অগ্রজ,
করি আমি সে ঋণ স্বীকার---
যে ঋণের সেতু বাঁধে সমুদ্রের এপার ওপার
তারই অঙ্গীকারে রাখি ক্ষুদ্র নমস্কার।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
অবিনশ্বর
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার মাঘ ১৩৪৬ (জানুয়ারী ১৯৪০)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


রাতের পাথার ভর দিয়ে গেছে চ’লে’
আমার মনের সোনালী বনের পাখী,---
আসিবে কি ফিরে’, তারে স্মরি’ যদি কাঁদে
বাসা বেঁধেছিল যার বুকে, সেই শাখী?
বহুদিন হ’ল লুকোচুরি খেলা শেষ---
মন-ঠকানোর পালা হ’ল অবসান
একদিন ছিল, সে কথা ত ভাল জানি ;
তাইত রচিলা করুণ বিষাদ গান!
স্মৃতির পরিখা একদা ভরাট ছিল---
একদা সেখানে ছিল বহু বীরবর,
এখন সেখানে নাই অসি-ঝন্ ঝন্---
মাটির পরিখা, শুধুই বালুর চর।
ধূ-ধূ করা সেই বালুচরে তবু শুনি---
দূরাগত কোন নিশীথের কলরব,---
আমার জীবনে সে মহা লগন ভাবি---
যখন সেখানে চলেছিল উত্সব!
সে-দিন এখন বাতাসে মিলায়ে গেছে
কালের কোঠায় জমা আছে তার ফল,
তাই আমি কভু গাহি না বিষাদ-গীতি-
তাইত ফেলিনা করুণ আঁখির জল!

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রেম
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮ (মে ১৯৪১) সংখ্যায়
প্রকাশিত।


তোমার আমার মাঝে চম্বক-প্রবাহ---
নিশিদিন চলমান, হে বান্ধবী তাই---
বাহির জগতে নাই হোক্ বা ইদ্বাহ---
অন্তর-জগতে তুমি রয়েছ সদাই।

নির্মম এ পৃথিবীর ডাকে, দূর হ’তে
দূরান্তরে অবিরাম স’রে স’রে যাও ;
ভাব অচঞ্চল প্রেম নহে কোনমতে,
মানসিক বিবর্তনে বুঝি ভয় পাও।

একনিষ্ঠ এ প্রেম আমার, মিছে ভয়---
মিছে দ্বিধা ক’র না ক’র না অনুক্ষণ ;
আমাদের এই প্রেম মিথ্যা কভু নয়---
ব্যর্থ নয় আণবিক এই আকর্ষণ!

তাই ত নির্ভয়ে তোমা যেতে দেই দূরে---
চুম্বক-আবেশে জানি আসিবেই ঘুরে।

.              ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর