কবি গোপাল ভৌমিক-এর কবিতা
*
ব্যবধান
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার কার্তিক ১৩৪৯ (অক্টোবর ১৯৪২)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


সেদিন হৃদয় ছিল কামনা-রঙীন---
দিগ্বলয়ে ছিল বুঝি রক্ত-ঝরা দিন :
স্বপ্রকাশ আনন্দের ছিল না ত যতি---
যে মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়ালে তপতী।

অনিচ্ছায় দূরে আজ স’রে গেছি জানি---
তবু মিথ্যা নয় কভু সেদিনের বাণী :
সেই চোখে চোখ মেলা চকিত বিদ্যুৎ---
মনে হয় রূপ-কথা, অপূর্ব অদভুত।

সমাহিত আমি আজ, বিস্তৃত জীবন---
এ জগতে নও তুমি একামাত্র জন :
পৃথিবীর বক্ষে আজ যে বিপুল ঝড়---
চারিদিকে শুনি তার ভীত কণ্ঠস্বর।

আমি তাই ভুলে গেছি বিচ্ছেদের দাহ---
আমার হৃদয়ে আছে সিরক্কো প্রবাহ :
তুমি শুধু বদ্ধ-কূল এতটুকু নদী---
আমার সমুদ্রে ঝড় বহে নিরবধি।

প্রজাপতি-রাঙা পাখা মেলে’ কামনারা---
দিগন্তে ঝড়ের চাপে ভয় হ’ল হারা :
তোমার নদীতে আজও চড়ে স্বপ্ন-হাঁস---
তোমারে উন্মনা করে আসঙ্গ-বিলাস।

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রশ্ন
কবি গোপাল ভৌমিক
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার ভাদ্র ১৩৫০ (অগাস্ট ১৯৪৩)
সংখ্যায় প্রকাশিত।


জীবনের সুপ্রভাত কল্পনা-মদিরা
রহস্য-কুয়াশা দিয়ে রেখেছিল ঘিরে ;
প্রথম সাক্ষাতে তাই বলেছি, রুচিরা---
হও যদি সুদুর্লভ স্মরণের তীরে
তোমাকে রাখ্ ব ধরে। চিরঅচঞ্চল
হবে তুমি, হে আমার একমাত্র প্রিয়া---
জীবন প্রান্তরে শুধু স্মৃতির ফসল---
আহরণ করে যাব, ওগো অদ্বিতীয়া।
প্রতিশ্রুতি ভগ্ন আজ। তোমাকে হারায়ে
একে একে বহুদিন হয়ে গেছে গত :
বাস্তবের অভিঘাতে রয়েছি দাঁড়ায়ে---
কোথা গেল সেদিনের স্মরণের ক্ষত?
জৈবধর্মে, হে মানবী, তুমি কি গো তবে---
বিস্মৃতি বিলীন হলে হৃদয়ের মতে?

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বসন্ত-বাহার
কবি গোপাল ভৌমিক
প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কাব্যবিতান” (১৯৬৬)
কাব্যসংকলনে প্রকাশিত।


রমলা কমলা মায়া বা মায়াবী---
যে নামে তোমায় ডাকি,
জানি সবগুলি সত্যি
আবার সবগুলি তার ফাঁকি---
যাকে খুঁজি তার এখনও আসার
অনেক যে দিন বাকি।

অনেক তো ভুল করেছ জীবনে,
পায়ে পায়ে রশি এঁটে
বদ্ধ ঘরের চারটে দেয়ালে
এক ছবি সেঁটে সেঁটে
বহুমুখী মনে আনতে চেয়েছ
একমুখী অভিরুচি :
দোষ কি তোমার? তুমি যে মানবী,
খাঁটি হিরা ফেলে চেয়েছ কাচের কুচি।

কিন্তু এ মন দুরন্ত
এবং পৃথিবীও বহুরূপী,
ক্ষণে ক্ষণে তার বদলায় রূপ
অজান্তে চুপি চুপি।

ধর না এই আজকে সকাল
ফাল্গুনী রসে মত্ত মাতাল
হাতছানি দিয়ে বারবার ডাকে
কোথায় কি ছাই জানি!

কচি রোদ-শাড়ি পরেছে নগরী,
তার যে আঁচলখানি
দেখে মনে হয়, ছুটে চলে যাই,
বলি, আমি আছি, আছি---
কি করে বোঝাই উদ্বেল কেন
আজ মন মৌমাছি॥

.                ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
অকাল
কবি গোপাল ভৌমিক
“দেশ” পত্রিকার আষাঢ় ১৩৫৯ (জুন ১৯৫২) সংখ্যায় প্রকাশিত।


সৃষ্টির সময় যায়
বৃষ্টির অভাবে :
ফুটি-ফাটা মাঠ দেখে
কৃষকরা ভাবে
এবার সম্মুখে বুঝি
মহামন্বন্তর---
আমার হৃদয় জুড়ে
ঝড় শুধু ঝড়।

এই বন্ধ্যা দুঃসময়
হৃদয় নিষ্প্রেম---
দু-চোখে আগুন জ্বেলে
যারে চাইলেম
সেই গেল ফাঁকি দিয়ে।
গলিত সোনার মত
যত ভালবাসা
তুহিন শিতের রাজ্যে
জমে সর্বনাশা
কূপ নিয়ে দাঁড়ালো সম্মুখে---
এদিকে সময় চলে
রোজ ধুঁকে-ধুঁকে।

চাষীর অজন্মা যাবে---
বৃষ্টি হবে আগামী বত্সর :
সহস্র লাঙলে কেটে
এই মাটি রুক্ষ ও ধূসর
সবুজ সতেজ শস্য
তুলে নেবে ঘরে---
কিন্তু আমি সৃষ্টিহীন
বৃষ্টির প্রত্যাশী হয়ে
চোখ মেলে আকাশ-প্রান্তরে
সেদিনও তাকিয়ে রব দূরে
সৃষ্টির সময় যদি
বেজে ওঠে বৃষ্টির নূপুরে।

.             ******************               


.                                                                               
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর