কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ-এর গান ও কবিতা |
এসো, দেশের অভাব ঘুচাও দেশে কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ স্বদেশ-সংগীত দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান ( ১৯০৫ ) থেকে নেওয়া | ॥ প্রসাদি সুর॥ এসো, দেশের অভাব ঘুচাও দেশে | সবার, আহার বিহার বিলাস বেশে || দেখো দেখি, মিলে আঁখি, যত ভিন্নদেশী এসে | দেশের যা ছিল ধন, কচ্চে হরণ জাহাজভরে এক নিমেষে || গৃহ ধনধান্যে ভরা, আমরা মজি নিজের দোষে | আমরা, কিছুই না পাই, হেলাই হারাই, নয়নজলে বেড়াই ভেসে || সকল কাজে বিজ্ঞ সাজি অনভিজ্ঞ ধল্লে ঠেসে | আসে, ত্যাগ স্বীকারের নামেই বিকার, দংশে যেন আশীবিষে || বসন ভূষণ, যা প্রয়োজন, পান ভোজন নয় আত্মবশে | যেন, বাসা থাকতে বাবুই ভিজে, নিজের উপায় দেখে না সে || ধুতি চাদর মাঞ্চেস্টরের চেয়ে দেখো সব সর্বনেশে, ভরে জাহাজগুলো, তোদের তুলো তোরাই কিনিস সেই জিনিসে || যাদের তুলো তাদের দিয়ে লাভ নিয়ে যাস সব বিদেশে | আমরা, অলস হয়ে, আছি চেয়ে বিদেশবাসীর দয়ার আশে || লজ্জা বারণ, শীতের দমন, রেশম পশম পাট কাপাসে | বলো, কীসের কসুর, খাবার প্রচুর, কীনা ফলে খেতের চাষে || মাছ মাংস ফল, আছে সকল, সব পাওয়া যায় বিনা ক্লেশে | নদী, সরোবরে, স্নিগ্ধ করে, মিষ্ট জলে তৃষ্ণা নাশে || গুড় চিনি আর মধু ফেলি লোফসুগারের মজি রসে | আছে গোয়াল পোরা বকনা গাভি কৌটাতে দুধ তবু আসে || বিষ কোটি শ্রমজীবী হেথা, পশু পুষ্ট মাঠের ঘাসে | লোকে, অল্পে তুষ্ট, সহে কষ্ট, বাঁকায় না মুখ অসন্তোষে || তবু কেন ভিক্ষা করি বিদেশবাসীর দ্বারদেশে | কেবল স্বভাব দোষে অভাব ভাবি, নাহি দেখি কী হয় কীসে || কাঞ্চন বিলায়ে দিয়ে, কাচ খুঁজি হায় পরের বাসে | পর, নাহি দিলে, মুখে তুলে, দিন কেটে যায় উপবাসে || দিয়ে, সোনা হীরের খনি, আমদানি কাচ রাংতা সিসে | যত, বিদেশবাসী নে যায় শস্য, আমরা আছি সমান বসে || চারিদিকে, দৃষ্টি রেখে, কাজ করে যাও আবেগবশে | সবে, করিলে পণ, অধঃপতন, হবে দমন অনায়াসে || নিজের বলে হও না বলী, আসবে অরি কোন সাহসে | যখন, ঘরের পেলে কার্য চলে, কেন যাবে পরের পাশে || হয়ে যদি লুপ্ত শক্তি সুপ্ত থাক নিদ্রাবেশে | জেনো, সবার দুঃখে, অধোমুখে, শিয়াল কুকুর কাঁদবে শেষে || আশার আলো, সামনে জ্বালো, তুচ্ছ ভাবো, ভোগবিলাসে | আজি, কয় বিশারদ, যাবে বিপদ, হতাশবাণী উড়াও হেসে || . ****************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
( ভাই সব ) দেখো চেয়ে, বাজার ছেয়ে কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান ( ১৯০৫ ) থেকে নেওয়া | ॥ বাউলের সুর॥ ( ভাই সব ) দেখো চেয়ে, বাজার ছেয়ে, আসতেছে মাল বিদেশ হতে | আমাদের, বেচা-কেনা, পাওনা-দেনা, অভাব মোচন পরের হাতে || আমাদের, পিতল কাঁসা, ছিল খাসা, কাজ চালাতেম কলার পাতে | এখন এনামেল, মাথা খেলে কলাইকরার ব্যাবসাতে || এখানে, পরেশ পাথর, পায় না আদর, চটা উঠ্ ছে পেয়ালাতে | যত, ঠুনকো পলকা, দরে হালকা দ্বিগুণ মূল্য পালটে নিতে || ঘরে, নাইকো আহার বেশের বাহার, যাহার তাহার ঘাটে পথে | হায় রে, নিজের দেশে, যায় না অভাব, অশন বসন সব বিলাতে | ছেড়ে, পরের ঠাকুর, ঘরের কুকুর, ইচ্ছা করে মাথায় নিতে | বিশারদ, ছাড়তে নারে, কেঁদে মরে, কার্য সারে কোনো মতে || . ****************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
ওই যে জগৎ জাগে, স্বদেশ অনুরাগে কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ বাউলের সুর দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান ( ১৯০৫ ) থেকে নেওয়া | ওই যে জগৎ জাগে, স্বদেশ অনুরাগে | কে আর, ব্যবচ্ছিন্ন, বঙ্গভিন্ন, নিদ্রামগ্ন দিবাভাগে ভাঙবে না কি এ কাল নিদ্রা, রইবে এ ভাব যুগে যুগে | পেয়ে, পরের প্রসাদ, যায় কি বিষাদ, এ অবসাদ কোন বিরাগে || থাকতে অঙ্গ, পঙ্গু বঙ্গ, দাগা বুলায় পরের দাগে | করে, গৃহ শূন্য, পরের জন্য, লক্ষ্মীর পুত্র ভিক্ষা মাগে || স্নিগ্ধ কত্তে দগ্ধ উদর, গোলামি চায় সবার আগে সদা, গোরার দুপায়, তৈল জোগায়, তাও বাঙালির ভালো লাগে | আর কী কারণ, জীবন ধারণ, প্রাণ ধরে তো কুকুর ছাগে | যদি, দেশের দশা, এমনই থাকে, বিলম্ব কী অনুত্যাগে || দেশের শিল্পে জলাঞ্জলি, ভেকের ভোজ্য, জোগায় নাগে | বলে ব্যাবসা অবাধ, নাইকো বিবাদ, কতই দ্রব্য দেয় সোহাগে || পরের পদে, তোষামোদে, মর্মব্যথা কর্মভোগে | বলো কোন দেশের আর দশা এমন, জীবন ধারণ যোগাযোগে || এই বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে, আমরা অন্ধ নেত্ররোগে | ও তাই আশার পথে, যেতে নারি আর সকলে চলচে বেগে || সমুন্নত সর্বজাতি আমরা কেবল অধোভাগে | এবার, মন্ত্র সাধন, করেছি পণ, ছাড়ব না তা প্রাণ বিয়োগে || প্রাণে যখন আবেগ আসে, শত্রু ভাষে ‘হুজুগ চাগে’ | বিশারদ কয়, সেই তো সময়, কার্য সারো সেই সুযোগে || . ****************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
এই দ্বারদেশে, এসেছে ভিখারি কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান ( ১৯০৫ ) থেকে নেওয়া | ॥ ললিত, যৎ॥ এই দ্বারদেশে, এসেছে ভিখারি, কহো কৃপা করি, কী দিবে তায় | স্বদেশসেবক, এ সব যাচক, বঞ্চিত কোরো না করুণাকণায় || ভ্রমে ভিক্ষা করি, এসব পথিক, সামান্য কামনা--- চাহে না অধিক, ধনরত্ন আশে আসেনি সকাশে, তুষ্ট হবে তব সুমিষ্ট কথায় || শক্তি অনুসারে পুরাইও সাধ, নাহি ঘটে যেন হরিষেবিষাদ, বড়ো আশা করে, আসিয়াছে দ্বারে, করিলে হতাশ যাইবে কোথায় || তব দেশবাসী এ যাচকগণ, নগরে নগরে করিবে ভ্রমণ, পুরালে বাসনা বিফল হবে না, হইও সুজন সুপথে সহায় || চারু কারু কার্য তব পরিজ্ঞাত, স্বদেশসম্ভূত শিল্প-কৃষিজাত, সে সব সন্ধান করিলে প্রদান, করিব প্রচার তোমারই কৃপায় | প্রতিবেশী শিল্পী যদি কেহ থাকে, কহো কী উপায়ে পালিবে তাহাকে, কী ধন সেজন করে উপার্জন, কীসে পারিবে সে প্রতিযোগিতায় || এই ভিক্ষা চাই সদনে তোমার, স্বদেশের বস্তু করো ব্যবহার, বিদেশীয় কিছু কোরো না গ্রহণ, যদি তুল্য তার দেশে পাওয়া যায় || বলে বিশারদ এই ভিক্ষা দাও, কোরো না বিমুখ মুখ তুলে চাও, স্বদেশের ধন স্বদেশে রক্ষণ, না করিলে বলো কী হবে উপায় || . ****************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |