কবি কিরণচাঁদ দরবেশ-এর কবিতা
*
‘ইয়ে’ মাহাত্ম্য
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


বিশ্ব যে দিন হাস্যমুখে                              জাগল,
বাণী-বাণীর আগমণী                                মাগল ;
.               মৌন মূঢ় বুকের তলে
.               শোণিত রাঙা শতদলে
ভাষার মুখর ফুল-কুমারী                          ফুটল,
ভাব-মহলার সোহাগ-সুবাস                        ছুটল ;

কোমল হাতের লীলা-কমল                        হিল্লোলে,
বহে গেল নয়টি ধারা                               কল্লোলে,
.              বয়ান ভরা জাগল হাস্য
.              নয়ন-কোণে করুণ লাস্য
শান্ত রৌদ্র বীর বীভত্স                            সকলে
জাগল ভীষণ জাগল মোহন                       অতলে ;

তুমি ছিলে কোন সায়রে                           মগনা ?
ভাষা রসের কোন লহরে                          লগনা  ?
.                মন্দিরবেরি চূড়া নিয়ে
.                কোন বাসুকীর দড়া দিয়ে
উঠলে তুমি ওগো ইয়ে,                            মন্থনে ?
ভাষার অটুট মাল্যখানি                           গ্রন্থনে ?

রাজ্য যেথা মৌন নীরব                           কথাহীন
তুমি সেথা বাঁচাও তারে                           চিরদিন |
.               সকল রসের আলাপনে
.               তুমি আরো সঙ্গোপনে
সকল কথার সমাপনে                             আছ লীন ;
নিত্য তোমারে চিতে আসন                     হে প্রবীণ !


সভার মাঝে বক্তা সাজে                          দাঁড়ায়ে |
বাক্য তখন বচন ফেলে                          হারায়ে ;
.                তখন ইয়ে তুমি এসে
.                নীরব কন্ঠে দাঁড়াও হেসে
আকুল তটে কোমল বাহু                         বাড়ায়ে |
দাঁত-চিবানো ঘ্যাঙানি দাও                       দাঁড়ায়ে |

সকল রসের ভাস্য তুমি                           ইয়েটি
প্রাণ-পিঁজরার যত্নে পোষা                         টিয়েটি |
.                 তোমার মধু গুঞ্জরণে
.                 বাণী বাণীর কুঞ্জবনে
রঙীন রাগের শিন্ত্রী বাজে                        সোহাগে |
কি ভৈরবে কি মল্লারে                           বেহাগে |

ধন্য তুমি বিপথ-বারণ                           হে মহৎ
ওগো ইয়ে, তোমার পায়ে                       দণ্ডবৎ |
.                  যে বোঝে না তোমার তত্ত্ব
.                  জ্ঞান নাই তার ষত্ব-ণত্ব
তুমি ছাড়া ভাষা ব্যর্থ                           রচনে ;
তোমার দয়ায় বাক্য বাঁচে                     বচনে |

.                              ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমি কবি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

ভাই রে,     আমি একটি কবি !
কাব্যি লিখতে যা কিছু চাই,
.         আছে আমার সবই |

দোয়াত-পোরা আছে কালি,
কলম আছে এক হালি,
কাগজ আছে মোটা বালি,
.          দিস্তা খানেক জড় ;
প্রাণে বইছে তরুণ রস
( নেহাৎ বেশি নয়ত বয়স ),
দোষের মধ্যে গিন্নী নীরস,
.             কাব্যেতে নয় দড় |

জ্যোছনা-রাতে চাঁদের হাঁকে
রুদ্ধ বাতায়নের ফাঁকে
চোখ দুটি মোর চেয়ে থাকে
.         যদিও কাব্যিরসে,
ভয় হয়, চাঁদ দেখে দেখে
বুকটা কখন বসে বেঁকে,
ফুসফুসিটা ওঠে পেকে,
.              গিন্নীর নোয়া খসে |

বাড়ি আমার গলির মধ্যে
অতি নিবিড় অবরুদ্ধে,
ঘরে মশা-মাছির যুদ্ধে
.             ব্যস্ত সকাল-সাঁঝে ;
দুই বেলা না জোটে আহার,
গিন্নীর তাই মুখখানি ভার,
আমার কিন্তু বইছে জোয়ার
.           প্রাণের ভাঁজে ভাঁজে |

ছাতে বসে শুনছি ভারি,
বাহির পথের কি হুড়মাড়ি,
মটর বাইক সারি সারি
.                 চলছে কলরোলে ;
খাতায় লিখছি গাঁয়ের কথা,
নদীর ধারের নীরবতা,
কত ফুল ফল বৃক্ষ লতা
.                 মনের চোখে দোলে |

শীতে যখন কোর্তা গায়ে,
শুয়ে আছি লেপের ছায়ে ;
বালিস বুকে উপুড় হয়ে
.                   লিখছি ফাগুন মাস ;
বসন্তের কি মস্ত বাহার,
মলয় হাওয়ার গোপন বিহার,
ভোম্ রা-কুলের ফুলের তেহার
.                 মাঠের নানান্ চাষ |

ধান্যবৃক্ষ দাওয়ায় উঠি
কিরূপে হয় ঘরের খুঁটি,
মাঘে আম্র-মুকুল ফুটি
.               বাগানটি কি তোফা ;
আপন কক্ষে মনের মিশে
যাচ্ছি সে সব কলম পিষে ;
এমনি আমার সজাগ-দিশে,
.                পুঁথি-গত চোপা |

আষাঢ় মাসে নদীর বাঁকে
গাঁয়ের নারী কলসী কাঁখে
জলের লাগি দাঁড়িয়ে থাকে
.             আছে আমার জানা :
জানি তাদের শঙ্কা-শরম,
নিলাজ যুবার তোয়াজ-ধরম,
তাইতে বেরোয় গরম গরম
.              কাব্যি-রসের দানা |

যদিও আমি শহর ছেড়ে
যাইনি কভু কিছুর তরে,
তবু জানি কোথায় ওড়ে
.               রঙ-বেরঙের পাখী ;
কোথায় কোকিল ডাকে কুহু,
বিরহী কয় উহু উহু,
বিদ্যা আমার আছে বহু
.                হুবহু সব লিখি |

এত যোগাড় এত যন্ত্র,
এত আমার জাগত মন্ত্র,
আমার রসাল কাব্যিতন্ত্র
.               গভীর এবং পষ্ট ;
তবু যদি কবি ব’লে
না দাও মালা আমার গলে
জানবো তবে দেশের ভালে
.                আছে বহুৎ কষ্ট ||

.                              ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মন্দির
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


তব মন্দির --- তব মন্দির !
কোন্ সে সুদূরে,  স্বপনের পুরে,
.               গুপ্ত-মিলন-সন্ধির,
.                       তব মন্দির |

অমৃত আলোর অমল ছায়ায়,
আমি-হারা   নব দিব্য মায়ায়,
ঘন  নির্ঝর  উজল ধারায়
.              কোন্ রস-নিষ্যন্দীর,
.                       তব মন্দির |

কল্পনা-লোকে  কল্প-আবাসে,
মোহ-বিকল্প-জল্পন-ত্রাসে,
ভূতলে অতলে আকাশে বাতাসে
.                    গন্ধ-নব-সুগন্ধির,
.                          তব মন্দির

শাশ্বত-শিখা  অম্বর জোড়া,
হিন্দোল--রাগ--অঞ্জন--মোড়া,
আঙিনা-ধৌত  উন্মদ  ধার |
.                নিত্য লীলা—কালিন্দীর,
.                            তব  মন্দির |

দীপকে  দীপ্ত  পঞ্চমে  সাধা,
মল্লারে  মৃদু মধ্যমে বাঁধা,
আলোকের আলো আঁধারের আঁধা,
.                    বাঞ্ছিত চির দ্বন্দ্বীর,
.                             তব মন্দির !

চির জনমের চির মরণের,
চির  উজ্জ্বল বিধু বরণের,
চির  ব্যাকুলিত তৃষিত মনের,
.                বন্দিত  চির  বন্দীর,
.                             তব মন্দির

সত্য-বীণার সার্থক সাড়া,
কম-করুণায়  বন্ধন-হারা,
রস-মন্থনে  মন্দর-চূড়া,
.                    সঙ্গম—সুখ—সন্ধির,
.                                 তব  মন্দির

.                        ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
সংহার মূর্ত্তি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


রাজার মতন নাই অন্ধ আস্ফালন,
হে রাজাধিরাজ !  গুপ্ত তব সিংহাসন |
তোমার শাসন-দণ্ড আড়ম্বর-হীন,
তবু এ বিশ্বের সব তোমার অধীন |
যেখানে সেখানে তব অনিবার গতি,
সভয়ে সকল বিশ্ব পদে করে নতি ;
দুর্গম দুর্ভেদ দুর্গ তুমি কর জয়,
তোমার প্রতাপে সব চুমার হয় |
বিলাস-লালসা-হাসি যৌবনের গর্ব্ব,
নিমেষে তোমার শ্বাসে হয়ে যায় খর্ব্ব ;
যতই উদ্ধত হোক্,---- সবে অবহেলে
নীরবে টানিয়া আন তব পদতলে |

ধন্য ওহে মহাকাল !  অক্ষয় আখরে
অঙ্কিত তোমার দীপ্তি বিশ্ব-চরাচরে |

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
সৃজন মূর্ত্তি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


কাতরে মিনতি করি
শীতল চরণ ধরি,
.           দুঃখ হর করুণা-নিধান !
পূর্ণ  কর  মম আশা,
দাও শক্তি দাও ভাষা,
.            গাহিবারে তব স্তুতি-গান

তোমার  রাতুল পায়
সারা বিশ্ব মূরছায়,
.         পিক গায় তোমার সঙ্গীত ;
কাননে কুসুম ফুটে,
গগনে  চন্দ্রমা উঠে,
.         বায়ু ছুটে পাইয়া ইঙ্গিত |

অটল  অচল খাড়া,
গিরিরাজ আত্মহারা,
.           তেজে দীপ্ত তব পদ চুমি ;
বিমল তটিনী বহে---
তোমার বন্দনা কহে,
.            ছাপাইয়া চারু তট-ভূমি |

যা’ কিছু নয়নে হেরি,
সব তব কারিকরী,
.            শিল্পী তুমি মহান্ সুন্দর !
তোমার করুণা-নদী
প্রবাহিত নিরবধি,
.            ধৌত করি হৃদয়-অন্দর |

যখন যে দিকে চাই
তখনি দেখিতে পাই
.             বিশ্ব আছে সবিস্ময়ে চেয়ে ;
পীযূষ-পূরিত ধারা,
স্নান-পানে আত্মহারা
.             মত্ত সবে তব নাম গেয়ে |

তোমার মঙ্গল-নাম,
সকল শান্তির ধাম,
.            একবার যেবা করে’ গান,
সুবিমল সুখ স্রোত
তার প্রাণে প্রবাহিত,
.            ধুয়ে যায় যত মিথ্যা--ভান

দুঃখের  তরঙ্গাঘাতে
পারে না তাহার চিতে
.              বিন্দুমাত্র আবর্ত্ত আনিতে ;
কাম--ক্রোধ--লোভ--আদি
আছে প্রাণে যত বাদী,
.              বাধ্য হয় তোমারে মানিতে |

পার্থিব ভাবনা যত----
সব হয় তিরোহিত,
.              পাপ-ইচ্ছা নাহি পায় স্থান ;
ধন্য হে বিশ্বের পতি !
তব পদে করি নতি,
.              লহ স্তুতি করুণা-নিধান !

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পালন মূর্ত্তি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


সত্য  তোমার  সার্থক  নাম,
.                    করুণা  তোমার গন্ধ,
মঙ্গল  তব  রূপের বিভায়
.                     আঁখি পায় চির অন্ধ |
বীর্য্য  তোমার পরশ--মাধুরী
.                     ন্যায়ের সায়কে ছাঁদা,
চেতনা-বিদ্ধ  নিয়ম—বদ্ধ
.                    বিশ্ব পড়েছে বাঁধা |
চির আনন্দ তব রস--সুধা
.                    সিঞ্চিত ধরা-গাত্রে,
চরাচর-বাসী  সে রস-সুষমা
.                    পিয়িছে জীবন-পাত্রে |

তোমার নিয়মে সকল মন্ত্র
.              একই তন্ত্রে সাধা ;
সুন্দর তব নন্দন-বীণা
.               লয় ও ছন্দে বাঁধা |
তোমার রচিত বিধি-ব্যবস্থা
.               স্বস্তি-তুলিকাঘাতে—
শক্তি-জতুর  মসী-অঙ্কিত—
.               ভুবন-ভুর্জপাতে |

ধন্য তুমি হে পুণ্য-পুলক,
.                ধন্য তোমার বাঁশী ;
জন্ম ও ব্যাধি, জরা ও মৃত্যু,
.                 সকলি তোমার হাসি !
দিয়েছ করুণা পরাণের কোণে,
.                 রুচি দি’ছ তব নামে ;
দিয়েছ ভক্তি, যুঝুতে শক্তি
.                 জীবনের সংগ্রামে |
দিয়েছ ধৈর্য্য, দিয়েছ বীর্য্য,
.                 দিয়েছ বিচার-বুদ্ধি ;
দিছ পবিত্র প্রণয়-দীক্ষা,
.                 শিক্ষা সরম শুদ্ধি |

নমো নমো নম অচেনা-পুরুষ,
.                 অজানা তোমার দ্যুতি ;
বিশ্ব-ব্যাপিয়া বিস্মিত প্রাণী
.                 করিছে তোমারে নতি |

.                ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
সত্য, ন্যায় ও দয়া মূর্ত্তি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


.             ধন্য   সত্যময় !
সত্য-সন্ধ, সত্য ছন্দ সঙ্গীত সুর লয় |
.       সত্য রচনা বিশ্ব-ভুবন,
.       সত্য স্বভাব-শোভা-বিনোদন,
সত্যের সাথী, সত্যের রথী, সত্য এ অভিনয়;
.              ধন্য  সত্যময় !

.              ধন্য হে ন্যায়বান !
ন্যায়ের দণ্ড অতি প্রচণ্ড, নহে অণু ব্যবধান |
.         কর্ম্মফলের বিশ্বতা-ধাতা,
.         অতি বিচিত্র বন্টন প্রথা,
জ্ঞানী-অজ্ঞান ধনী-নির্ধনী সকলের সম মান ;
.              ধন্য হে ন্যায়বান !

.               ধন্য হে তব দয়া !
দয়ামাখা তব শাশ্বত দ্যুতি, তিলেক নাহিক’ মায়া |
.          দয়া-শিরোমণি দয়ালসিন্ধু,
.          স্নাত সংসার পেয়েছে বিন্দু,
মধুর করেছ বিধুর সুষমা, বসুর দিয়েছ ছায়া ;
.               ধন্য হে তব দয়া !

.                দিয়েছ হে পিতা মাতা !
তব প্রতিনিধি, সাক্ষাৎ তুমি, ভূতলের মম ধাতা |
.         মাতার চক্ষে দিছ স্নেহ-নীর,
.         বক্ষে দিয়েছ স্বাদু দ্রব ক্ষীর,
রক্ষা করিছ সম্পদে শোকে পিতা রূপে তুমি পাতা ;
.                 দিয়েছ হে পিতা মাতা !

.                 দিয়েছ প্রিয়ার হাসি !
আঁধার-মাখান অন্ধকারের মাণিক জরাণ শশী |
.           কহিতে শুনিতে উঠিতে বসিতে,
.           দোসর দিয়েছ ভাল যে বাসিতে,
তোমার প্রেমের এক ফোঁটা আলো ভূতলে পড়েছে খসি ;
.                   দিয়েছ প্রিয়ার হাসি !

.                  দিয়েছ আমারে সব !
ঘুচিল না তবু ভিখারীর মত সদা নাই নাই রব |
.             সুনিয়ন্ত্রিত মঙ্গল বীণ্
.              বাজাও আমারে প্রাণে চিরদিন,
তোমার বিধান মানিতে শক্তি দেহ মোরে অভিনব ;
.                    দিয়েছ আমারে সব |

.                        ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
জগতের বৈষম্য
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


ওগো   সত্য-শাসিত নিত্য-ভূমিতে মিথ্যার কেন বাস ?
ওরা    প্রবঞ্চনার মঞ্চ রচিয়া সুখে থাকে বারমাস |
ওরা    জীবনের পথে সুধীর-ললিতে কহে কত মিঠা কথা,
পুন      সুযোগ বুঝিয়া স্বার্থ সাধিয়া ত্বরিতে লুকায় কোথা !

তুমি     ন্যায়বান যদি, তবে কেন ধাতা, গর্ব্বের এত জয় ?
কেন     অত্যাচারের তপ্ত বালুকা ব্যাপ্ত ভুবনময় ?
কেন    সুখের ভবনে দুখের রাগিণী মথিত করে গো চিত্ত ?
কেন     তব বিচিত্র কর্ম্মক্ষেত্রে এত তাণ্ডব নৃত্য ?

কেন     কোন দয়াময়,   নির্দ্দয় তুমি চরাচরবাসী-জনে ?
কেন     শক্তি-দণ্ডে পিষিছ সকলে কঠোর নিষ্পেষনে ?
কেন     দান্ত সুশীল শান্ত জনেরা কর্ম্ম-কীলকে ধরা ?
কেন     যোগী আর রোগী ভোগী ত্যাগী সব জীয়ন্তে মরা ?

কেন    সূর্য্য ঢাকিয়া মেঘ উত্তরী, চাঁদে কলঙ্ক লেখা ?
কেন    সিক্ত শিশিরে রিক্ত শাখাটী, ময়ূর কন্ঠে কেকা ?
কেন    গোলাপ গুন্ঠে কন্টক-ঘন, রমণীর চোখে বিষ ?
কেন    সাম্য-বাসিত রম্য ভূমিতে কাম্য-কামনা-রিষ্ ?

এই      সুন্দর শোভা-সুষমার প্রাণ আছে কি হে কোন জন ?
শুনে    আর্ত্তজনের শোক-চীত্কার কাঁদে না তাঁহার মন ?
একি     অন্ধশক্তি, ঘূর্ণিত যেন  কুম্ভকারের পাকে ?
তাই     নির্জ্জীব-প্রায় সজীবের দুখে চক্ষু মুদিয়া থাকে ?

.                        ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


সুন্দর এ ধরা কি গো ঘোর অন্ধ-শক্তির বিকাশ ?
তন্তি-হীন তন্তু-রাশি,  গ্রন্থি-হীন গ্রন্থনের ফাঁস ?
প্রসূত ব্রহ্মাণ্ড-অণ্ডে এত দীপ্ত জীবনী-ফোয়ারা,
প্রসূতি কেবল শূন্য প্রাণহীন, নাহি কোন সাড়া ?

তাই যদি,---তবে কেন বিশ্বগ্রাসী অফুরন্ত আশা
ঘুমন্ত পরাণ কোণে শান্ত-ছায়ে বাঁধিয়াছে বাসা ?
কেন কেন সঙ্গোপনে অতি দূরে পরাণের পুরে
ঝঙ্কারে মধুর বীণা, নব ছন্দে ক্রন্দনের সুরে ?

আছে যদি, --- তবে কেন বিশ্বাসের নিশ্বাস বিবরে
হাস্যহীন অবিশ্বাস নিঃসঙ্কিত আশ্বাসে বিহরে ?
সত্য-ন্যায়-দয়া-ধর্ম্ম পরিপূর্ণ যদি রচয়িতা,
অসত্য-দুর্নীতি তবে পরতে পরতে কেন গাঁথা ?

কে আমি, কি আমি ওগো, কেন আমি বিশ্বের বাসরে ?
অবিশ্বাস প্রতারণা কেন পূর্ণ সত্যের সংসারে ?

.                        ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিরক্তাবস্থা
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


.        কে তোমরা চারিদিক ঘিরে ?
হাতে লয়ে বাসি মালা,  সাজায়ে বরণ-ডালা,
.        আদরে ভুলাতে চাও মেরে ?
মুখে মেখে ক্ষিপ্ত-হাসি, হেঁকে কও ‘ভালবাসি’
.         বাঁধিতে চাহ গো মায়া-ডোরে
বাজায়ে স্বার্থের ঢোল, তুলিয়াছ মহা-রোল,
.          গর্জ্জনে গগন গেছে ভরে’ ?
.          কে তোমরা চারিদিক ঘিরে ?

.          ও সকল আমি ত না চাই !
শৈশবের খেলা ধূলা,   আনন্দের দাগ গুলা,
.          পুড়ে আজ হয়ে যা’ক ছাই |
কি জানি কিসের তরে পরাণ আকুল করে,
.           জানিনা কোথায় ছুটে যাই ;
শুনিলে আনন্দ-গাথা প্রাণে কেন বাজে ব্যথা,
.           সুখ মাঝে দুখ জাগে ভাই !
সরস হরষ তান,   আহ্বানে  খেদের বান,
.           তৃপ্তি মাঝে অতৃপ্তি সদাই ;---
.           তাই গান শুনিতে না চাই |

অন্তর অম্বর-কোলে,    হাসিয়া তারার দোলে,
.            ভেসে যায় জ্যোছনার চাঁদ ;
এমন নিঝুম রাতে,   কি জানি  কোথায় যেতে
.             মনে মনে হয় বড় সাধ |

রজত কৌমুদী-মালা,     ধরা-বুকে করে খেলা,
.             হাসে চারু কাননে কুসুম ;
মৃদুল মলয় বায়,     কানে কি যে ক’রে যায়,
.             আলসে বিবসে আনে ঘুম |

ফুটন্ত হাসির মাঝে  মোর  কেন  ব্যথা বাজে,
.             দুঃখ আনে এ সুখের তানে ?
ছেড়ে  সংসারের আশা,  রিপু-করা  ভালবাসা,
.             কি  জানি কি ভাবে  প্রাণ টানে |

কি জানি কি ভাবে হায়,  জীবন বহিয়া যায়,
.             কার তরে ঘুরি দিবানিশি
সংসারের প্রেম দানে,    উল্লাসের দগ্ধ ভানে,
.             পার কি তা’ নিবারিতে আসি ?

তবে আর কেন এত করিতেছ ওতপ্রোত
.             হৃদয়ের নিদ্রিত বাসনা !
অপূর্ণ রহিবেযাহা,  কি কাজ শুনিয়া তাহা,
.             সে দুরাশা কভু মিটিবে না |

কে তোমরা ঘিরে মোরে,   দানব দানবী যত,--
.              তোমাদের প্রণয় না চাই ;
আমি  যেন মরি পুড়ে  অবোধ পতঙ্গ মত,---
.               লয়ে মোর দুখের বড়াই |

যা’ আছে আমার আছে,   যাবনা তোদের কাছে,
.               এক বিন্দু স্নেহ নাহি চাব ;
বেদনার আঁখি জল,       কিম্বা আঁখি ছল-ছল,
.               চাই না গো,-- আমি একা রব |

যা’ আছে আপন ঘরে,      তাই নিয়ে রব পড়ে’
.               ভিক্ষা মাগি দাঁড়াব না আর ;
সতর্কে  ওজন করা      চাই না স্নেহের ভরা,
.               চাই না এ ছিন্ন মণিহার |

নীরবে আপন প্রাণে       মগন রহিব গানে,
.               দয়া করে’ দূরে যাও সরে’ ;
.               কে তোমরা ঘিরিয়াছ মোরে ?

.                        ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর