তুমি ছিলে কোন সায়রে মগনা ? ভাষা রসের কোন লহরে লগনা ? . মন্দিরবেরি চূড়া নিয়ে . কোন বাসুকীর দড়া দিয়ে উঠলে তুমি ওগো ইয়ে, মন্থনে ? ভাষার অটুট মাল্যখানি গ্রন্থনে ?
রাজ্য যেথা মৌন নীরব কথাহীন তুমি সেথা বাঁচাও তারে চিরদিন | . সকল রসের আলাপনে . তুমি আরো সঙ্গোপনে সকল কথার সমাপনে আছ লীন ; নিত্য তোমারে চিতে আসন হে প্রবীণ !
সভার মাঝে বক্তা সাজে দাঁড়ায়ে | বাক্য তখন বচন ফেলে হারায়ে ; . তখন ইয়ে তুমি এসে . নীরব কন্ঠে দাঁড়াও হেসে আকুল তটে কোমল বাহু বাড়ায়ে | দাঁত-চিবানো ঘ্যাঙানি দাও দাঁড়ায়ে |
সকল রসের ভাস্য তুমি ইয়েটি প্রাণ-পিঁজরার যত্নে পোষা টিয়েটি | . তোমার মধু গুঞ্জরণে . বাণী বাণীর কুঞ্জবনে রঙীন রাগের শিন্ত্রী বাজে সোহাগে | কি ভৈরবে কি মল্লারে বেহাগে |
ধন্য তুমি বিপথ-বারণ হে মহৎ ওগো ইয়ে, তোমার পায়ে দণ্ডবৎ | . যে বোঝে না তোমার তত্ত্ব . জ্ঞান নাই তার ষত্ব-ণত্ব তুমি ছাড়া ভাষা ব্যর্থ রচনে ; তোমার দয়ায় বাক্য বাঁচে বচনে |
আমি কবি কবি কিরণচাঁদ দরবেশ কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
ভাই রে, আমি একটি কবি ! কাব্যি লিখতে যা কিছু চাই, . আছে আমার সবই |
দোয়াত-পোরা আছে কালি, কলম আছে এক হালি, কাগজ আছে মোটা বালি, . দিস্তা খানেক জড় ; প্রাণে বইছে তরুণ রস ( নেহাৎ বেশি নয়ত বয়স ), দোষের মধ্যে গিন্নী নীরস, . কাব্যেতে নয় দড় |
জ্যোছনা-রাতে চাঁদের হাঁকে রুদ্ধ বাতায়নের ফাঁকে চোখ দুটি মোর চেয়ে থাকে . যদিও কাব্যিরসে, ভয় হয়, চাঁদ দেখে দেখে বুকটা কখন বসে বেঁকে, ফুসফুসিটা ওঠে পেকে, . গিন্নীর নোয়া খসে |
বাড়ি আমার গলির মধ্যে অতি নিবিড় অবরুদ্ধে, ঘরে মশা-মাছির যুদ্ধে . ব্যস্ত সকাল-সাঁঝে ; দুই বেলা না জোটে আহার, গিন্নীর তাই মুখখানি ভার, আমার কিন্তু বইছে জোয়ার . প্রাণের ভাঁজে ভাঁজে |
ধান্যবৃক্ষ দাওয়ায় উঠি কিরূপে হয় ঘরের খুঁটি, মাঘে আম্র-মুকুল ফুটি . বাগানটি কি তোফা ; আপন কক্ষে মনের মিশে যাচ্ছি সে সব কলম পিষে ; এমনি আমার সজাগ-দিশে, . পুঁথি-গত চোপা |
আষাঢ় মাসে নদীর বাঁকে গাঁয়ের নারী কলসী কাঁখে জলের লাগি দাঁড়িয়ে থাকে . আছে আমার জানা : জানি তাদের শঙ্কা-শরম, নিলাজ যুবার তোয়াজ-ধরম, তাইতে বেরোয় গরম গরম . কাব্যি-রসের দানা |
যদিও আমি শহর ছেড়ে যাইনি কভু কিছুর তরে, তবু জানি কোথায় ওড়ে . রঙ-বেরঙের পাখী ; কোথায় কোকিল ডাকে কুহু, বিরহী কয় উহু উহু, বিদ্যা আমার আছে বহু . হুবহু সব লিখি |
এত যোগাড় এত যন্ত্র, এত আমার জাগত মন্ত্র, আমার রসাল কাব্যিতন্ত্র . গভীর এবং পষ্ট ; তবু যদি কবি ব’লে না দাও মালা আমার গলে জানবো তবে দেশের ভালে . আছে বহুৎ কষ্ট ||
এই সুন্দর শোভা-সুষমার প্রাণ আছে কি হে কোন জন ? শুনে আর্ত্তজনের শোক-চীত্কার কাঁদে না তাঁহার মন ? একি অন্ধশক্তি, ঘূর্ণিত যেন কুম্ভকারের পাকে ? তাই নির্জ্জীব-প্রায় সজীবের দুখে চক্ষু মুদিয়া থাকে ?