কবি কিরণচাঁদ দরবেশ-এর কবিতা
*
নির্জ্জন-বাস
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


ছেড়ে দে  ছেড়ে দে মোরে, আমি ত তোদের নই,
নীরবে  আপন ভুলি মরমে মরিয়া রই |
আবিল কৈতব প্রেম, --- ক্ষুদ্র হৃদয়ের দান,
হেন তুচ্ছ প্রতিদানে তৃপ্ত নহে মম প্রাণ
যত্নে আবরিয়া বুক, মুখ-ভরা হাসি-রাশি,
আপন বঞ্চনা হেন আমি ত না ভালবাসি !

করুণ মল্লার-রাগে দীপ্ত দীপকের গান,
এ কেমন কপটতা, এ কেমন মিছে ভান্ !
অনাদর অবিশ্বাস উপেখা’ সংসারময়,
অকৈতব দিব্য প্রেম জগতে সুলভ নয় |
তবে কেন মোরে নিয়ে বৃথা কর টানাটানি ?
তোরা দিবি ভালবাসা ? --- আমি ত তোদের জানি !

নিরজন বনমাঝে তাই আসিয়াছি ছুটে,
হেথায় বাঁধিব ঘর বিমল তটিনী তটে |
আপনা পাশরি হেথা হেরিব কনক-ছবি,
জীবন-গগন-কোণে জাগিয়া উঠিবে রবি |
বসিয়া বকুল-শাখে পাখিরা গাহিবে গান,
মাতিবে পরাণ মোর সেই সাথে ধরি তান
সাধের বীণাটী লয়ে ঘুম—পাড়ানিয়া তানে,
বাজায়ে হৃদয়-তন্ত্রী গাহিব মরম গানে |
শুনে মোর ভাঙা বীণ্ যে আসিবে মন-সুখে,
আমি যে তাহার হব, লুঠিয়া লইব বুকে |
সোহাগে উথলি নদী বহে যাবে কুলু—কুল্,
উজলিয়া তট-ভূমি ফুটিবে কনক ফুল
ফটন্ত-অফুট’ কলি আরামে  হাসিয়া চা’বে,
আপনা-আপনি ফুটি নিজ মনে ঝরে’ যাবে |
আকাশের শিশুগুলি ধীরে ধীরে হেথা আসি’
অনাবিল ভালবাসা ছড়াইবে কাঁদি—হাসি  |
এ হেন দুর্লভ প্রেম পাইয়া পরাণ মোর,
ডুবিয়া রহিবে ভাবে, বহে’ যাবে আঁখি-লোর |
আপনা-বিভোল হয়ে কি যেন কি রূপ দেখি,
হৃদয়ের পাতে পাতে তনে রাখিব আঁকি’ |
সে রূপ পরাণে মাখি উতরিব সব বাধা ,
বীণার ধৈতব-সুরে সে রূপ রহিবে সাধা |
আপন যৌবন খানি, ---- দু’দিনের মহাধন,---
ঢেলে দিব পূত-পদে আমার এ প্রাণ-মন |
সেথায় যাইব আমি, অনন্ত যৌবন-তীরে,
যেথা মোর ধ্রুবতারা শান্তির সাগর-নীরে |

সেই আশে আশে আমি সদা নিরজনে রই,
ছেড়ে দে  ছেড়ে দে মোরে আমি ত তোদের নই |

.                              ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
নির্জ্জন-বাসে অশান্তি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


কেন গো পরাণ মম
.           আকুলি ব্যাকুলি করে ?
বিষাদ খেলিছে যেন
.           হৃদয়ের থরে থরে |
কেন এত আঁখি-জল,
.           কেন এত হা-হুতাশ ?
কেন এত উতরোল,
.           কেন তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ?

জানি না কি এত মোহে
.           ঘিরেছে অন্তর হেন,
লাঞ্ছিত জীবন দহে
.           দারুণ অনলে যেন !
ধমনি-শোণিত-স্রোত
.           বহিছে উন্মাদ বেগে,
একি ব্যাধি বুঝিনা-ত,
.           ঘিরিল গো একি রোগে ?

কি এক ভুজঙ্গ অহো !
.            দংশিয়াছে মোর বুকে
হলাহলে জ্বলে দেহ,
.            বচন সরে না মুখে |

কেন এ হৃদয়-কক্ষে
.            বাজিছে বিষম ব্যথা ?
সহিছে কোমল বক্ষে
.             অতি সকরুণ গাথা !
জীবনের কর্ম্মক্ষেত্রে
.             পারি না মিলিতে হায় !
চিত্রিত হৃদয়-পত্রে
.             বিষাদ-তুলিকা ভায় |

গাহিব বলিয়া মনে
.             ত্রিতারে ঝঙ্কার দিলে,
আপনা হইতে বীণে
.             বিষাদ গাহিয়া ফেলে |
শূন্য জীবনের খাতা,
.             ভরা শুধু ব্যর্থ গানে,
অবশিষ্ট কটা পাতা
.             পূর্ণ হোক্ সুধা-তানে |

কে আছ আপন-জন !
.         এস যদি থাক কেহ !
সঁপিব  হে এ জীবন,
.         ধর অর্ঘ লহ লহ |
স্নিগ্ধ করে দাও মুছে
.          পরাণে অনল-লেখা,
বাঞ্ছিত এস হে কাছে,
.           ব্যক্ত রূপে দেহ দেখা |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মনের মানুষ
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


এত অবজ্ঞার ভার,
অত বোঝা যাতনার,
বহিতে পারি না আর,
.           বল কোথা যাই |

নিরাশে ডুবিয়া মন
করে আঁখি বরিষণ,
খুজিয়া মনের মত
.             মানুষ না পাই |

উজল চাঁদ্ নী নিশি,
আলোকিত দশদিশি,
কী মোহন বিশ্ব-ছবি
.             তুলিকা-চিত্রিত ;

যেন কোনো সুরপুরে,
অতি সকরুণ সুরে,
মরম-সঙ্গীত মম
.            হইতেছে গীত |

কৌমুদী-বিধৌত রাকা,
মরম-পরাণে আঁকা,
তাড়িত-জড়িত জ্যোতি
.             প্রাণ ছুঁয়ে যায় ;

একটী কনক-লতা
যেন প্রাণে কয় কথা,
একটী আনন্দ-গাথা
.            গুমরিয়া গায় |


মিলাইয়া প্রাণে প্রাণে,
বিষাদের মৃদু তানে,
কি জানি কাহার সনে
.            গাহিবারে চায় ;

খেদ-বিজড়িত গানে,
ক্ষণিক বিভোল তানে,
মনের মানুষে ডাকে,
.            আয় আয় আয় |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কল্পিত রূপ
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


হৃদয়-কাননে তাঁর সরল সুন্দর,
বসন্ত-কুসুম ভরা ফুল্ল মনোহর |
নন্দনে মন্দার-বনে পাতিয়া আসন,
কমলের শতদলে বিরাজে কেমন !
আঁচলে মলয়া তাঁর কন্ঠে তারাহার,
জড়াইয়া শান্ত-জ্যোতি দীপ্ত-চারিধার |
দরশন মাত্র হয় হরষিত মন,
সে দেশে ভানুর তাপে দহেনা জীবন

কত দিন কত বেলা করেছি যতন,
পাইতে দুর্লভ সেই প্রিয় প্রাণধন |
নিষ্ফলে তপস্যা করি কাটানু জীবন,
বিফল আমার যত পূজা আয়োজন !

জীবনের সুখ-স্বপ্ন আঁধারের ছায়,
আমার লুকানো ব্যথা কে বুঝিবে হায় !

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কর্ম্মের আকাঙ্ক্ষা
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে ( রত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


ক্ষীণ অবসন্ন সুপ্ত ব্যথিত পরাণে,
.          তোমার নিখিল তন্ত্রে পারিনা মিলিতে
সুদীর্ঘ জীবন মম ভরা দুখ-গানে,
.          আনন্দের তান কেন পারিনা সহিতে ?

কে তুমি, নিবারো তৃষা, মিটাও হে ক্ষুধা,
.           বল প্রভু, কোন্ বলে হইব সবল ?
অনাহার শীর্ণ-প্রাণে সার হল কাঁদা,
.            হে অভীষ্ট, দেহ পুষ্টি, দেহ শান্তি জল !

নবীন উদ্যমে মোরে দাও মাতাইয়া,
.           ডেকে লও তব প্রিয় জগতের কাজে ;
চির পুণ্য কর্ম্মভূমি উঠুক্ ফুটিয়া,
.           সাজাইয়া দাও দিব্য সঞ্জীবনী-সাজে |

উদ্ধোধন-আরাধনা-ধেয়ান-প্রার্থনা,
সার্থক হউক্ আজি মম উপাসনা |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
নীতি
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-বাহিরে (জরত্ব-নীতি)
থেকে নেওয়া।


আর কতকাল হেন সং-সাজে সাজি,
থাকিতে হইবে বল এ সংসারে মজি’ ?
আর কতকাল মোহ কালিমা জড়ায়ে
তোমারে ভুলিয়া রব কর্ত্তব্য হারায়ে ?
আর কতকাল বল বৃথা কথা কয়ে
জীবন কাটাতে হবে দুখ-গান গেয়ে
আর কতকাল বল তোমার সন্তানে
প্রীতি-প্রেম ঠেলি’, চাব ঘৃণার নয়ানে ?

আশীর্ব্বাদ কর প্রভু, আমি দীন-হীন,
চরিত্র পবিত্র যেন রহে চিরদিন |
বাহু হোক্ বজ্র-সম অন্যায়-শোধনে,
প্রাণ হোক্ পুষ্প-সম দুখীর রোদনে |

চলেছি জীবন-পথে অতুল গৌরবে,
রক্ষা কর বীরবাহু, জীবন-আহবে |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আরতি-ঘন্টা
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।  মন্দির-পথে (বৃক্ষত্ব–সেবা)
থেকে নেওয়া।


তব মন্দির-দ্বারে আরতি-ঘন্টা
.               বাজে প্রভু, বাজে বাজে !
কর সজ্জিত মোরে রাগ-কজ্বলে,
.               উজ্বল নব সাজে

গ্রন্থি সকল মন্থন করি,
অন্তর মম দেহ রসে ভরি,
মন্দির-পথে লহ আগুসারি,
.               কন্টক-ঘন মাঝে,
ওই শুনা যায় মন্দির-দ্বারে
.               আরতি-ঘন্টা বাজে |

ঘন্টানাদের মধু আবাহন,
কন্ঠে আমার বাজাও সঘন,
সুপ্ত সুষমা কর গো চেতন
.               দীপ্ত দীপক ঝাঁঝে ;

বল কোথা পথ হে রাজার রাজা,
কোন্ দিকে বাজে আরতির বাজা ?
সার্থক কর ব্যর্থ এ খোঁজা,
.                 পাই পাই পাইনা যে ;
মন্দির-দ্বারে আরতি-ঘন্টা
.                  ঐ ঐ মধু বাজে |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
সেবা
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-পথে (বৃক্ষত্ব–সেবা)
থেকে নেওয়া।


চল সবে চল জগতের কাজে, সাধিতে হইবে সাধনা,
ভাই ভাই মিলি দাঁড়াইব মোরা, ভুলিয়া অতীত বেদনা |
আনন্দময় বিশ্ব-ভুবনে দুখ-গাথা আর গাবনা,
জীবন-আহবে বিজয় লভিব, পরাজিত কভু হবনা |

দুখে রোগে শোকে প্রতিবাসীজনে দিব আশ্বাস-মন্ত্রণা,
ব্যথিত দেখিলে, সুমধুর বোলে করিব তাহারে সান্ত্বনা |
পাপের যাতনা আর ত রবেনা, পাপ-পথে কেহ যাবনা,
নিরাশার কথা, আঁধারের গাথা, ভুলেও কখন’ গাবনা |

এস সবে মিলি হই আগুয়ান, পিছে ফিরি আর চাবনা,
যে রহিবে পড়ে’ তুলিব গো ধরে’ মরে’ যেতে কারে’ দিব না |
দেখরে চাহিয়া হাসিছে যামিনী, হাসিছে উছল চাঁদিমা,
আঁধারের মাঝে কেন পড়ে’ তবে, মুছে ফেল সব কালিমা |

চল রে বাজায়ে বিজয়-বাদ্য, লইয়া বিজয়-নিশানা,
সে প্রেম-কিরণ লুফিয়া পরাণে বিজয় কর রে ঘোষণা |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
দ্বারী রূপে শ্রীগুরু
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ
কবির “মন্দির”, ১৩২২ বঙ্গাব্দ ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মন্দির-তোরণে (জীবত্ব–সঙ্গ)
থেকে নেওয়া।


হে জ্যোতির্ম্ময় দিব্য-পুরুষ.
.            দীন-দরিদ্র সখা,
রাজাধিরাজের মন্দির-দ্বারে
.            কে তুমি দিয়েছ দেখা ?

উজ্জ্বল নব রূপের ধারায়
.           দিক্-দিগন্ত ভাসে ;
বেদ-বেদান্ত-পঙ্কজ, তব
.           ময়ূখ মাখিয়া হাসে |
সন্দেহমাখা অন্ধ আঁখির
.           জ্ঞান-অঞ্জন তুমি ;
নিত্য শান্ত ভ্রান্তি-বিহীন
.           ক্ষান্তি-রসাল-ভূমি |
আনন্দ-ঘন ব্রহ্ম-স্বরূপ,
.           পরম আরাম-দাতা ;
চেতনা-ছুপ্ত জ্ঞানের মূরতি,
.            দ্বন্দ্ব-অতীত ধাতা |
অনন্ত-ব্যাপী প্রশান্ত দ্যুতি,
.            সুমহান্ যোগানন্দী ;
অন্ধ-জীবনে গন্ধ-দীপালি,
.            নন্দন-পথ-সন্ধি |

পূর্ণ-রাগের স্বর্ণাভ জটা
.            সুশোভিত শিরসিতে ;
গণ্ড-বাহিত করুণার ধারা
.             আখণ্ড লোক-হিতে |

ললাট-দীপ্ত মোক্ষ-তিলক,
.             বক্ষে তত্ত্ব-মালা ;
হাতে করঙ্গ--- প্রেমের ভাণ্ড,
.             দণ্ড---- পারের ভেলা

বলায়াঙ্কিত দক্ষিণ ভুজে
.             মণ্ডিত বরাভয় ;
মধুর অধরে আধ-আধ বাণী
.             শ্রবণে ত্রিতাপ ক্ষয় !

জ্ঞান-কৌপিন-বহির্বসন
.             ভাব-তন্তুর গাঁথা ;
উজ্জ্বল-রস-বিভূতি লিপ্ত,
.              অঙ্গে শক্তি-কাঁথা |

সকল ধর্ম্ম বিধি-ব্যবস্থা
.               অতীত তোমার স্থান ;
সকল চেষ্টা, সকল কামনা,
.               তোমাতেই সমাধান |
       
সত্য তোমার সরস স্বরূপ,
.                সত্য-সাধনা মাখা ;
সত্যে স্থিতি, চির পরিণিতি,
.                সত্যের চির-সখা |

নমামি ভক্ত,  প্রেমানুরক্ত,
.                বিমল যুক্ত-যোগী ;
চির সংসারী, চির উদাসীন,
.                 চির ত্যাগী, চির ভোগী |

চির জনমের বান্ধব তুমি,
.                 চির মরণের সাথী ;
সঞ্চার’ চির বাঞ্ছিত বীজ
.                 মম জীবত্ব ভাতি |

.               ******************               


.                                                                           
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর