কবি কিরণচাঁদ দরবেশ - জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহর থেকে ১২কি.মি. দূরে
অবস্থিত খালিয়া-য়। পিতা কূলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মাতা রাসময়ী দেবী। পিতা ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন এবং
তাঁর গৃহের লক্ষ্মী নারায়ণ ও শিবের মন্দিরে নিষ্ঠাভরে পূজা-অর্চনা করতেন। পিতামহ শ্রী দুর্গাচরণ
চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কাশী, পুরী ও কলকাতার মত ধর্মীয়স্থানে
জমিজমা ক্রয় করেছিলেন।
কবির মাত্র কয়েক মাস বয়সে তাঁর মাতা রাসময়ী দেবী স্বপ্নে দেখতে পান যে তাঁর পুত্রকে একজন সাধুপুরুষ
এক ভীষণাশ্চর্যারূপী চতুর্ভূজা নারীর কাছ থেকে রক্ষা করছেন। কিরণচাঁদের তিন বছর বয়সে তাঁর পিতা-
মাতার সঙ্গে কাশীতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা মহাপুরুষ ও সাধক তৈলঙ্গস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে
গিয়েছিলেন। তিনি সেই সময় নিদ্রামগ্ন ছিলেন বলে তাঁর ফিরে আসার উপক্রম করতে, স্বামীজী জেগে উঠে
শিশু কিরণচাঁদকে দেখতে পান। তিনি সহসা সেই শিশুকে স্নেহপরবশত কোলে তুলে নেন এবং আশীর্বাদ
করে মাতার হাতে তুলে দেন। সবাই এই ঘটনায় আশ্চর্য হন কারণ তৈলঙ্গস্বামী এমন কাজ এর আগে আর
করেননি। তাই অনেকেরই মনে হয়েছিল যে এই শিশু বড় হয়ে সাধু-সন্ত হবেন।
শৈশবে তাঁর পিতা তাঁর জন্য গৃহশিক্ষক রেখে পড়াশুনার ব্যাবস্থা করেন। পরে গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন। সেই
সময় কবি মহাভারত সহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ শুনতে ভলবাসতেন। কবির মাত্র এগার বছর বয়সে
পিতৃবিয়োগ ঘটে। ১৮৯২ সালে ( পয়লা বৈশাখ ১২৯৯ ) কবির উপনয়ন হয়। এরপর তাঁর অগ্রজ শ্রীশচন্দ্র,
তাঁকে ঢাকার জুবিলি স্কুলে ভর্তি করে দেন ও হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তিনি ব্রাহ্মসমাজের
আদর্শের অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁদের সভায় উপস্থিত থাকতে শুরু করেন। ঢাকায় তাঁর বেশী দিন থাকা হয় নি।
বাড়ী ফিরে তিনি আর্য মিশন ইন্সটিটিউশন স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ভগবত গীতা পাঠ আবশ্যিক ছিল। তিনি
গীতা কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন এবং একই সাথে নৃত্য-গীত-বাদ্যাদিতে অংশ গ্রহণ করতে থাকেন।
১৮৯৪ সালে তিনি বরিশালের বৃজমোহন হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি Little brother of the poor নামের
একটি সমাজসেবা সংস্থার সদস্য হন এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত থাকেন। এই সময় তিনি ব্রজমোহন
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অশ্বিনিকুমার দত্ত, গোরাচাঁদ, চন্দ্রনাথ দাশ ( ইনিই সম্ভবত কবি কুসুমকুমারী দাশের পিতা
এবং কবি জীবনানন্দ দাশের মাতামহ ) প্রমুখদের সংস্পর্শে আসেন।
সেই সময়ে কবির ছাত্রাবস্থায়, শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (গোঁসাইজী), হিন্দু ধর্মানুসারী হয়ে কুমকুম তথা
ফুলের মালার আভূষণে নিজেকে ভূষিত করা শুরু করেছিলেন। একবার তিনি কোনো ধর্মানুষ্ঠানে,
ভোজনকালে সুরাপান করেছিলেন বলে ব্রাহ্মসমাজে বিদ্রোহ হয়। ব্রাহ্মসমাজের শিবনাথ শাস্ত্রী, গোঁসাইজীকে
তিরস্কার করেন এবং কিরণচাঁদ দরবেশ এই বিদ্রোহে বড় আকারে সামিল হয়ে পড়েন গোঁসাইজীর বিরুদ্ধে।
ভবিষ্যতে কিরণচাঁদ দরবেশ এই গোঁসাইজীরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন!
বন্ধু মাখনলালের অনুপ্রেরণায় কিরনচাঁদ শেষমেশ গোঁসাইজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বৃন্দাবনে গোঁসাইজীর
আশ্রমে, ১৭ই আষাঢ় ১৩০২ (১৮৯৫) তারিখে। দীক্ষা নেবার সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭। শুরু হয় তাঁর
আধ্যাত্মিক জীবন।
১৮৯৭ সালে তিনি বিবাহ করেন বন্ধু মাখনলালের ভগিনী সরোজবালা দেবীকে।
১৮৯৯ সালে তাঁর গুরুজীর তিরোধান হয়।
১৯০১ সালে তিনি তাঁর গুরুর সমাধী মন্দির পুরীতে তৈরীর কাজ শুরু করেন। ১৯০৩ সালে গুরুজীর
উপদেশে তিনি ফোটোগ্রাফি এবং জীবনবীমার ব্যবসায় শুরু করেন, বরিশালে। ভালো আয় হতে লাগলো
এবং তিনি দান-ধ্যানও করতে লাগলেন। গুরুর আজ্ঞামত ২৩শে কার্তিক ১৩১৯ তারিখে ( নভেম্বর ১৯১২ ),
১২ বছরের বিবাহিত জীবন শেষ করে, স্ত্রী সরোজবালা দেবীর জন্য বিষয়-সম্পত্তির ব্যবস্থাপত্র সাঙ্গ করে,
তিনি বারাণসীর সঙ্গমে শ্রী প্রবুদ্ধানন্দ সরস্বতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় কেশরানন্দ
সরস্বতী কিন্তু তিনি কিরণচাঁদ দরবেশ নামেই খ্যাত হন।
সন্ন্যাস গ্রহণ করার পরে তিনি কাশীধামে থেকে যান ভাড়া বাড়িতে। পরে তাঁর শিষ্যরা কাশীতে বিজয়কৃষ্ণ
মঠের পত্তন করেন। মেদিনীপুর ও শরিফাবাদেও শাখা আশ্রম খোলা হয়।
কিরণচাঁদ খুব সুন্দর কবিতা লিখতে পারতেন। সেইজন্য তাঁর গুরু গোঁসাইজী তাঁকে প্রবোধচাঁদের লেখা
"শ্রীবৃন্দাবন শতক" কাব্যগ্রন্থটি, বাংলায় লিখতে বললেন। গুরুজীর তিরোধানের বেদনাতেও তিনি কিছু
কবিতা লিখেছিলেন। ১৯২২ সালে, কলকাতার ৮০নং বিডন স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত করেন তাঁর “মন্দির”
কাব্যগ্রন্থ। বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই আমরা কিছু
কবিতা মিলনসাগরে তুলেছি।
আমরা মিলনসাগরে কবি কিরণচাঁদ দরবেশ-এর কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
এই প্রচেষ্টাকে সার্থক বলে মনে করবো।
উত্স - www.sadgurubijoykrishna.com
কবি কিরণচাঁদ দরবেশ-এর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৭.৭.২০১৬
...