মহাশূন্য কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
কর্তা ওঠেন, এই তো এসেছি – এসে গেছি সব জেলেরা ডাক দেয় তারা, ভোররাত্রির জল কাঁপে যেন নীরবে | পুকুরের মন স্থির হয়ে থাকে, বেতবন যেন ছায়া-মা চুপ করে থাকে, চুপ করে থাকে, সব মাছই তার চেনা যে !
অথচ সে জাল পুকুরে নামে না, কেন যেন ভাসে শূন্যে | সবাই তাকায় গাঢ় বিস্ময়ে, একী হল একী হল গো ; সাতটি রমণী আলতাছোপানো পায়ে ধরে রাখে জাল যে | ঘুঙুর-ঘাঘর-তোড়া-অঙ্গোট-চুকটি-গুজরিপঞ্চম রাতের আঁধার নীরব স্বর্ণ সূ আভরণ দু-পায়ে |
এইভাবে এই শূন্যে ভাসছে গাঢ় গাঢ় জাল চিরদিন জলের গভীরে মাছ আছে ব্যথা জল তবু আছে শান্ত পাড়ে ঘরবাড়ি, মানুষ রয়েছে, কর্মসূচীও কম নয় এরই নীচে দিয়ে বইছে বাতাস আভরণ আর আভরণ |
রানীকাহিনী কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
রানীর তখন রাজ্য গেছে, অন্ন গেছে, যৌবন গেছে নিজেরই রাজ্যে রানী ভিক্ষা করে | প্রজারা কেউ তাকে চিনতে পারে, কেউ পারে না | কেউবা, মুখ নারা দিয়ে ফিরিয়ে দেয় |
গ্রামের প্রান্তে ঘুঘুর নীড়ে রানী রাত কাটায় | ঘুঘুর ডিম কোলে নিয়ে ঘুমায় | নিচে, বৃক্ষকোটরে এক পরমাসুন্দরী সাপের গর্ত | সাপটি রাতে বেরিয়ে এসে ফণার খেলায় মাতে, নাচে, নাচ শেষ হলে পুত্রশোকে কাঁদে |
পুরনো কথা কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
নয়ন নামে এক দাসী ছিল রাজার | দাসী হলেও নয়নের রূপের সীমা ছিল না | যেমন তার মুখের গড়ন তেমনি দেহসৌষ্ঠব, যেন সূর্য কিরণে বিকশিত পত্রলেখা | এক হেমন্তের সন্ধ্যায় রাজা যখন দরবারের কাজকর্ম সেরে রাজপুরীতে ঢুকছেন, এমন সময় দেখলেন নয়নকে | সবে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে ; পাতলা সন্ধ্যা গাঢ় হতে চলেছে ; নীড়ে, পাখিদের পালকে এসেছে নিবিড়তা ; প্রেমের উপন্যাস এবং মৃত কবিরা আকাশে জেগে উঠেছে রাজা মুগ্ধ হলেন | ঝিম ঝিম করে উঠল জোনাকি এবং রাণীদের তখন কেশচর্চা শেষ হয়ে অলংকার পর্ব
শ্বশুরমশায় কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
আজকে আমার শ্বশুরমশাই আসবেন, আজ আসবেন আমরা সবাই খুশি তিনি আসছেন, ভাবা যায়—তিনি আসছেন ! নিত্যদিনের কাজকর্মের মধ্যে চওড়া জায়গা তাঁর জন্যেই রচনা করেছি তাঁরই দেওয়া এই জীবনে | কন্যাটি তাঁর, বয়েস হয়েছে, দিঘির মতোন জননী থই থই স্নেহ, সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা সাদা দ্যুতিময় যতখানি স্ত্রী তার চেয়ে তার মাতৃস্বভাব সীমাহীন আমিও একটু ভাগ পাই তার, কী যে সুখ, যাই ডুবিয়া | তাকে ডেকে বলি, তোমার পিতার আগমন আজ ঘটছে ; বল, কিছু বল, জোগাড় করব, কী কী আজ আনা দরকার | কার্তিকমাস ; ফুলকপি আর কইমাছ মেলে বাজারে পাকা-ভেটকি ও গলদাচিংড়ি সবই পাওয়া যায় ভূবনে | সে হাসে সে হাসে, মধুর মতন হেসে বলে, উ-হু , খুব যে ! শ্বশুর-জামাই জামাই-শ্বশুর চাঁদ মেঘ মেঘ চাঁদ গো ! মনে হয় আজ জ্যোত্স্না ঝরবে শ্বশুর জামাই মিলনে ভরে যাবে আজ সব জলাশয় টইটুম্বুর ছন্দে | আমাদের এক ছোট মেয়ে আছে, সকলের ছোটকন্যা দাদুর জন্যে সে সেজেছে যেন প্রজাপতি মন উড়ছে দাদু এসে তাকে বলবেন : ওগো দ্বিতীয়পক্ষ আদুরী, কাছে এস, এস, খুব কাছে এস, ভুলে যাই যত দুঃখ | লজ্জা লজ্জা কী যে লজ্জায় পুড়ে যাবে চোখ কাজলে দু-বেণী দুলবে, রাঙা ঠোঁটে তার চন্দ্রকুসুম ফুটবে | ছেলেরা আমার বড়মেয়ে সহ দাদুকে নিতেই মাতবে ঘরের মধ্যে আনন্দদীপ স্বর্ণশিখায় জ্বলবে | আমরা এসব আশা পুষে রাখি, আশা ভর করে আয়োজন কিন্তু শ্বশুরমশায় আসে না, আসে না নানান কারণে এসব কারণ আমরা বুঝি না কারণের বুক ফাটিয়ে, এ টুকুই জানি--- পরিকল্পনা, খেয়ার মতন খেয়া গো শুধু পার করে, পার করে দেয়, কে যাবে কোথায় জানে না কে আসে কোথায়, কেন বা সে আসে, কেন এইসব আয়োজন ! শ্বশুরমশায় আসুন কিংবা না-আসুন তাতে দুঃখ অথবা সুখের ছায়া পড়ে, যেন জলের জগতে জলই সে |
হলুদ পাখি কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
হলুদ একটা পাখি এল | এখনও নির্বংশ হয়নি যে দুয়েকটি এ পাখি তাদেরই একজন | বললাম, পান খাও | খাটের নিচে দেখো, বাটা আছে, জাঁতি দিয়ে গুয়া কেটে নাও | শামুকচুন ভালোবাসো, নিয়ো |
মিথ কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
কবিতা হল আসলে বেড়া বাঁধা | এখানে অন্তরভূমিতে যে কৃষিকাজ করেছি জল দিই, ধ্যান দিই, দুঃখের সার দিই ছাগলের রূপ ধরে অবজ্ঞা তা খেয়ে ফেলে | বেড়া বাঁধি | ছোট্ট বাগানের নম্র কৃষিকাজ | দুটো একটা ফল যা হয়ে ওঠে নিজেরই দু-বেলা অন্নে লেগে যায়, বিক্রি করি না | কিন্তু বেড়া বাঁধতে গিয়ে দেখি আকাশ থেকে কিশোরী এক নক্ষত্র নেমে এসেছে, বলছে : আমি দড়ি ধরি আত্মার ওপাশে দাঁড়িয়ে |
বউ-দেখা কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
এত জন্মের পর যে আবার এসেছি,--- বউ দেখতেই আসা | এসেছি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে | সঙ্গে এনেছি উপহার,--- এই প্রাণ | খুব একটা দামী কিছু আনতে পারিনি ; তবে যা যা দেব, তা আমাদের ছাড়িয়ে | দিতে পারি, নিতে পারি বলেই তো নিমন্ত্রণ |
এবারও যে এসেছি ; আমাদের সকল দুঃখ মঙ্গলালোকে | আমরা বউ দেখব, যার রূপের সীমা নাই ; তবে সানাইয়ে সুর বাজছে : আমি রূপে তোমায় ভোলাব না---
বউ দেখতে এসে আমাদের বহু বহু কথা মনে পড়ছে | তারা সত্যিই মনোহর | দিনের সঙ্গে রাতের পরিণয় এবং মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে কুমারের আবির্ভাব ! জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর পরিণয়ের মধ্য দিয়ে মহাকাব্য-অশ্রুলাভ, এমন কত কি ! এখন পৃথিবীর এই আত্মিক সংকটকালে দাঁড়িয়ে আমরা ভেবে কিনারা করতে পারছি না, কোনটি আগে বউ দেখা না খাওয়া | গৃহকর্তা বলছেন, আগে খেয়ে নিন, আসন খালি যাচ্ছে ; গৃহকর্তী আক্ষেপ করছেন, মা বেঁচে থাকলে আজ— এদিকে বউ দেখতে গিয়ে এ-বাড়ির বড়জামাই পা হড়কেছে | তাকে নিয়ে উদ্বেগ | বউ দেখা কি এতই সোজা ? বউ কেমন করে দেখতে হয় জানতেন ওয়ার্ডসওয়াথ ইয়েটস রবীন্দ্রনাথ | কীটসের কথা আর কী | তবে বউ দেখে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি – . বিচিত্র ছলনাজালে--- এর পর আমরা ! আমরা বউ দেখতে এসেছি |
পণ্যসাহিত্যের ভবিষ্যত কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কাজল চক্রবর্তী সম্পাদিত “সাংস্কৃতিক খবর” পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০১১ সংখ্যা থেকে নেওয়া।
এক বণিক গেল বিদেশে বাণিজ্য করতে | সঙ্গে গেল তার ঊনিশটি পুত্রের মধ্যে সকলের চেয়ে যে ছোট, সে | কনিষ্ঠপুত্রের এই প্রথম বাণিজ্যযাত্রা | এই পুত্রটির যেমন রূপ তেমনি মেধা | সে ছন্দ জানে, গণিতও জানে, জোয়ার-ভাঁটা, নক্ষত্র, মেঘতত্ত্ব সবই | জানে না মনের মানুষ |
এক দেশে বাণিজ্য করতে গিয়ে বণিকের সব গেল মযূরপঙ্খি গেল, লোকলস্কর গেল, বণিকের পুত্রটিকেও সেই দেশের সাংস্কৃতিক মাফিয়া ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গেল ডাইনির বেশে | অসহ্য শোকে দুঃখ নিতান্ত দরিদ্রের মতো দেশে ফিরল বণিক | দেশে ফিরে সে খবর পেল তার শ্বেতপাথরের বাড়ি পুড়ে গেছে | জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে সকল পরিজন | বাকি শুধু এক-পা কাটা বৃদ্ধ ঘোড়াটি |