দৈবকীনন্দনের রচনা সম্ভার - পাতার উপরে . . . দৈবকীনন্দনের প্রধান কীর্তি “বৈষ্ণব-বন্দনা”। এই বন্দনাতে তিনি ২০২ জন বৈষ্ণব মহাত্মার বন্দনা করেছেন। সংস্কৃতে রচনা করেছেন “শ্রীবৈষ্ণবাভিধানম্”। এর অতিরিক্ত, রাধামোহন ঠাকুর রচিত "পদামৃত সমুদ্রে" ১টি সংস্কৃত পদ, বাংলা ভাষায় নরহরি চক্রবর্তী বিরচিত "ভক্তিরত্নাকর" গ্রন্থে ২টি, বৈষ্ণবদাস সংকলিত "শ্রীশ্রীপদকল্পতরু"-তে তাঁর ৫টি পদ এবং জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত গৌরপদতরঙ্গিণী সংকলনে ১টি পদ সহ মোট ৭টি পদ আমরা খুঁজে পেয়ে এখানে তুলে দিয়েছি।
আমরা মিলনসাগরে কবি দৈবকীনন্দন-এর বৈষ্ণব পদাবলী আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
কবির একটি ছবি ও তাঁর জীবন সম্বন্ধে আরও তথ্য যদি কেউ আমাদের পাঠান তাহলে আমরা, আমাদের কৃতজ্ঞতাস্পরূপ প্রেরকের নাম এই পাতায় উল্লেখ করবো। আমাদের ঠিকানা - srimilansengupta@yahoo.co.in
কবি দৈবকীনন্দন - এর পূর্বের নাম ছিল “চাপাল গোপাল”। তিনি ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক। তাঁর প্রধান কীর্তি “বৈষ্ণব-বন্দনা” নামক পদাবলী যেখানে তিনি ২০২জন বৈষ্ণব মহাত্মার বন্দনা করেছেন। সাহিত্যরসের দিক দিয়ে অতি উল্লেখনীয় রচনা না হলেও, ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই পদাবলীর গুরুত্ব অসীম। এই বন্দনায় যে সব বৈষ্ণবদের নাম করা হয়েছে তাঁদের কয়েকজন চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্ব্বেকার হলেও বেশিরভাগই তাঁর সমকালীন বা অব্যবহিত পরবর্তীকালের মানুষ। বৈষ্ণব ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই পদাবলীটি তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত শ্রীগৌরপদতরঙ্গিণীর ২য় সংস্করণের সম্পাদক মৃণালকান্তি ঘোষ, “পদকর্ত্তৃগণের পরিচয়”-তে দেবকীনন্দন এর জীবন সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লিখেছেন যে দৈবকীনন্দনের নিবাস ছিল নদীয়া জেলার কুমারহট্ট বা হালিসহরে। তাঁর গুরুর নাম ছিল পুরুষোত্তম, যিনি তাঁরই গাঁয়ে বসবাস করতেন।
চাপাল গোপাল ও দেবকীনন্দন একই ব্যক্তি - পাতার উপরে . . . কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলা, সপ্তদশ পরিচ্ছেদে “চাপাল গোপাল” নামের এক ব্রাহ্মণের বৃত্তান্ত রয়েছে। চৈতন্যচরিতামৃতের সেই অংশের উদ্ধৃতি পড়তে এখানে ক্লিক করুন। ঘটনাটি এই রকম . . .
গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস নেবার কিছুদিন আগে, তিনি তাঁর পরিকরগণের সঙ্গে, নবদ্বীপে, শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে এক বত্সর কাল ধরে নৃত্য সহকারে হরিনাম সংকীর্ত্তন করেছিলেন। এই কাজের সময়ে রাতে গৃহের দরজা বন্ধ রাখা হোতো যাতে ভক্ত ছাড়া আর কেউ ভিতরে না ঢুকতে পারে। সংকীর্ত্তন শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে, ভিতরে না ঢুকতে পেরে, চাপাল গোপাল শ্রীবাসকে দুঃখ দেবার অভিপ্রায়ে, তাঁর দরজার বাইরে ভবানী পূজার সামগ্রী রেখে গিয়েছিলেন। সেই অপরাধের ফলে তিন দিন পর দেখা গেল যে তার সারা দেহে কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে গঙ্গার ঘাটে গাছতলায় তিনি দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন সে পথ দিয়ে যাবার সময় গৌরাঙ্গ স্নানে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে তাঁকে এই রোগদশা থেকে উদ্ধার করার অনুরোধ জানাতে, গৌরাঙ্গ প্রচণ্ড ক্রোধিত হয়ে বললেন যে তিনি যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তাঁর রৌরব নরকে পতন হবে। তার কিছুদিন পরেই গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণ করে নীলাচল (পুরী) চলে যান। পাঁচ বছর পর বৃন্দাবনে যাবার পথে, নদীয়ায় এলে, তখন চাপাল গোপাল আবার সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যের কাছে উদ্ধারের প্রার্থনা করেন। এবার শ্রীচৈতন্যের দয়া হয় এবং তিনি তাঁকে বলেন যে, অপরাধ তিনি করেছেন শ্রীবাস পণ্ডিতের কাছে। একমাত্র তিনিই তাঁকে ক্ষমা করে শাপমুক্ত করতে পারেন। সেই আদেশ অনুযায়ি চাপাল গোপাল শ্রীবাস পণ্ডিতের কাছে গেলে, শ্রীবাস তাঁকে ক্ষমা করেন। এর পর চাপাল গোপাল কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি পান।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতের চাপাল গোপাল বৃত্তান্তকে কেন্দ্র করে বাংলায় দীর্ঘকাল ধরে “চাপাল গোপাল উদ্ধার” নামের পালা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন রচয়িতার দ্বারা রচিত সেই পালাগান যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। এই আধুনিক কালেও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে নি। এখনও এই পালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এমন কি ইনটারনেটেও এই পালার বহু ভিডিও এবং অডিও পাওয়া যায়। ইউটিউবে তেমন একটি ভিডিওর লিঙ্ক আমরা এখানে দিলাম। দুর্ভাগ্যবশত এই পালাটির রচয়িতা, উপস্থাপক, কলা- কুশলী, কারও নাম সেখানে দেওয়া নেই, তাই আমরা এখানে তা দিতে পারলাম না। ইউটিউবে, সেই “চাপাল গোপাল উদ্ধার” পালায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .।
মৃণালকান্তি ঘোষের আবিষ্কৃত দৈবকীনন্দনের বৈষ্ণব-বন্দনার “ভুমিকা” থেকে জানা যায় যে দৈবকীনন্দনও বৈষ্ণবদের নিন্দা করার দোষে ব্যাধিগ্রস্থ হয়েছিলেন। তারপরের ঘটনাবলি অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে তাঁর ক্রোধিত হয়ে পড়া এবং সন্ন্যাস গ্রহণের পরে নদীয়া এলে শ্রীচৈতন্যের তাঁকে শ্রীবাসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলা, ইত্যাদি ঘটনাবলী হুবহু চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। এখানে আরও জানা যায় যে শ্রীবাস, দৈবকীনন্দনকে দুটি শর্তে ক্ষমা করেন। প্রথম শর্ত, তাঁর নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে সেখানে পুরুষোত্তমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করা এবং দ্বিতীয় শর্ত বৈষ্ণবদের নিন্দার বদলে বৈষ্ণবদের বন্দনা করা। এর পরেই দৈবকীনন্দন ব্যাধিমুক্ত হন এবং নানা তীর্থ ভ্রমণ করে বৈষ্ণব-বন্দনা গ্রন্থটি রচনা করেন।
চৈতন্যচরিতামৃতের চাপাল গোপালের বৃত্তান্ত এবং মৃণালকান্তি ঘোষের আবিষ্কৃত দৈবকীনন্দনের বৈষ্ণব বন্দনার ভূমিকার বৃত্তান্তে এত মিল দেখে, মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁর সম্পাদিত গৌরপদতরঙ্গিণীর ২য় সংস্করণের “পদকর্ত্তৃগণের পরিচয়”-তে লিখেছেন, “এই গোপাল চাপাল বিপ্র ও দেবকীনন্দন একই ব্যক্তি বলিয়া মনে হয়।” দৈবকীনন্দনের বৈষ্ণব-বন্দনার ভূমিকার বৃত্তান্ত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
অন্য দিকে সতীশচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত বৈষ্ণবদাস বিরচিত শ্রীশ্রীপদকল্পতরুর ৫ম খণ্ডের ভূমিকার ১২৪- পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এই গোপাল ঠাকুরই ঈদৃশ বৈষ্ণবাপরাধী, তাঁহারই কুষ্ঠব্যাধি হয় এবং তিনিই শ্রীবাস পণ্ডিতের ক্ষমাগুণে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়েন। সুতরাং অন্য লোকেরা নীরব থাকিলেও আমরা যদি অনুমান করি যে, দৈবকীনন্দনের পূর্ব্বনামই “চাপাল গোপাল” ছিল, তবে বোধ হয় অসঙ্গত না হইতে পারে।”
আমরাও মনে করি যে “দৈবকীনন্দন” ও “চাপাল গোপাল” নিঃসন্দেহে একই ব্যক্তি ছিলেন।
চাপাল গোপাল উদ্ধার বৃত্তান্ত, জগাই-মাধাই উদ্ধারের মতো, শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের পাতকী-পাষণ্ডী-উদ্ধারণ কীর্তির অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়।
মৃণালকান্তি ঘোষের আবিষ্কৃত দৈবকীনন্দনের বৈষ্ণব বন্দনার ভুমিকা - পাতার উপরে . . . মৃণালকান্তি ঘোষ, দৈবকীনন্দনের বৈষ্ণব বন্দনার একটি হস্তলিখিত পুখিতে, একটি ভূমিকা আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি তখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত ছিল। তিনি সেই ভুমিকাটি প্রথমে ১৩০৫বঙ্গাব্দের (১৮৯৮) “শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া” পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় এবং পরে “শ্রীগৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া” পত্রিকার ১৩০৯বঙ্গাব্দের (১৯০২) পৌষ সংখ্যায় “শ্রীদেবকীনন্দন ও বৈষ্ণব-বন্দনা” শিরোনামের প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত করেন। দুঃখের বিষয় এই যে, আমরা সেই প্রবন্ধটি হাতে পাইনি, কিন্তু মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁর সম্পাদিত শ্রীগৌরপদতরঙ্গিণীর ২য় সংস্করণের “পদকর্ত্তৃগণের পরিচয়”-তে দেবকীনন্দন এর সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে, সেই “ভূমিকা”-টি থেকে কিছু কলি বা পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন। আমরা গৌরপদতরঙ্গিণীর ২য় সংস্করণের “পদকর্ত্তার পরিচয়”-এর ১৮৪- পৃষ্ঠা থেকে সেই অংশের উদ্ধৃতি এখানে তুলে দিচ্ছি। সেখানে মৃণালকান্তি ঘোষ লিখেছেন . . .
“একখানি প্রাচীন হস্তলিখিত বৈষ্ণব-বন্দনা পুথি আমাদের হস্তগত হইয়াছে। ইহার ভূমিকায় দেবকীনন্দন তাঁহার বৈষ্ণব-বন্দনা লিখিবার উদ্দেশ্য এইরূপে বর্ণনা করিয়াছেন---
“শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দ না জানিয়া। নিন্দিলুঁ বৈষ্ণবগণ মানুষ বলিয়া॥ সেই অপরাধে মুঞি ব্যাধিগ্রস্ত হৈলুঁ। মনে বিচারিয়া এই নিরূপণ কৈলুঁ॥ নিমাই পণ্ডিত কত পাতকী উদ্ধার। পরিণামে কেন মোরে না কৈলা নিস্তার॥”
তত্পরে দেবকীনন্দন বলিতেছেন---
“নাটশালা হৈতে যবে আইলেন ফিরিয়া। শান্তিপুরে যান যবে ভক্ত-গোষ্ঠী লৈয়া॥ সেই কালে দন্তে তৃণ ধরি দূর হৈতে। নিবেদিলুঁ গৌরাঙ্গের চরণ-পদ্মেতে॥”
মহাপ্রভু নীলাচল হইতে নবদ্বীপের পথে বৃন্দাবনে যাইবার সংকল্প করেন। কিন্তু শান্তিপুর হইয়া কানাঞি- নাটশালা পর্য্যন্ত যাইয়া শান্তিপুরে ফিরিয়া আসেন। দেবকীনন্দন বলিতেছেন--- ‘মহাপ্রভু ভক্তগোষ্ঠী সহ শান্তিপুর অদ্বৈতগৃহে ফিরিয়া আসিলে, আমি দন্তে তৃণ ধরিয়া দূর হইতে শ্রীগৌরাঙ্গের পাদপদ্মে শরণ লইয়া নিবেদন করিলাম---’
“পতিত-পাবন-অবতার নাম যে তোমার। জগাই মাধাই আদি করিলে উদ্ধার॥ তাহা হৈতে কোটিগুণে অপরাধী আমি। অপরাধ ক্ষম প্রভু জগতের স্বামী॥”
ইহাতে দীন-দয়ার্দ্র-নাথের কমল-নয়নদ্বয় জলভারে ভরিয়া গেল। কিন্তু তিনি ভক্ত-বত্সল, চিরদিনই ভক্তের গৌরব রক্ষা করিয়া থাকেন। এখানেও তাহাই করিলেন ; দেবকীনন্দন শ্রীবাসের নিকট অপরাধ করিয়াছিলেন ; তাই তাঁহাকে শ্রীবাসের চরণে শরণ লইতে বলিলেন। যথা---
তখন দেবকীনন্দন কি করিলেন, তাহা তিনি এইভাবে বর্ণনা করিতেছেন---
“প্রভুপাদপদ্ম আমি মস্তকে ধরিয়া। বাঢ়িল আরতি চিত্তে উলসিত হিয়া॥ বৈষ্ণব-গোসাঞির নাম উদ্দেশ কারণ। নানা ক্ষেত্র তীর্থ মুঞি করিল গমন॥ যথা যথা যাঁর নাম শুনিলুঁ শ্রবণে। যাঁর যাঁর পাদপদ্ম দেখিলুঁ নয়নে॥ শাস্ত্রে বা যাঁহার নাম দেখিলুঁ শুনিলুঁ। সর্ব্ব প্রভুর নাম-মালা গ্রহণ করিলুঁ॥”
দেবকীনন্দন যখন যে বৈষ্ণব-গোসাঞির নাম জানিতে পাইয়াছেন বা শুনিতে পাইয়াছেন, তখনই তাহা গ্রহণ করিয়াছেন। এই ভাবে, বড় ছোট বিচার না করিয়া, নাম-মালা গ্রন্থিত করায়, পাছে তাঁহার অপরাধ হয়, এই জন্য বলিতেছেন---
“ইথে অগ্রপশ্চাৎ মোর দোষ না লইবে। ঠাকুর-বৈষ্ণব মোর সকল ক্ষমিবে॥”
তার পর বলিতেছেন, কেনই বা তাঁহারা ইঁহাতে আমাকে অপরাধী করিবেন? কারণ---
“এক ব্রহ্মাণ্ডে হয় চৌদ্দ ভুবন। যাহাতে বৈষ্ণবগণ করিয়া যতন॥ জাতির বিচার নাই বৈষ্ণব-বর্ণনে। দেবতা অসুর ঋষি সকলি সমানে॥ দেবতা গন্ধর্ব্ব আর মানুষ আদি করি। ইহাতে বৈষ্ণব যেই তাঁয় নমস্করি॥ পদ্মপুরাণ আর শ্রীভাগবত-মত। বন্দিব বৈষ্ণব প্রভুর সম্প্রদায়ী যত॥”
দৈবকীনন্দনের গুরু কোন পুরুষোত্তম? - পাতার উপরে . . . মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁর সম্পাদিত গৌরপদতরঙ্গিণীর ২য় সংস্করণের “পদকর্তার পরিচয়’-তে, উপরে দেওয়া অনুচ্ছেদের পরেই, ১৮৫-পৃষ্ঠায় লিখছেন . . .
"এখন দেখা যাউক, উল্লিখিত “পুরুষোত্তম” কে এবং “পুরুষোত্তমপদাশ্রয় কর গিয়া ঘরে” একথার তাত্পর্য্য কি? দেবকীনন্দনের বৈষ্ণব-বন্দনায় চারি জন পুরুষোত্তমের নাম আছে। যথা--- ১। “বন্দিব পুরুষোত্তম নাম ব্রহ্মচারী।” ২। “পুরুষোত্তম পণ্ডিত বন্দোঁ বিলাসি-সুজন।” ৩। “রত্নাকর-সুত বন্দোঁ শ্রীপুরুষোত্তম। নদীয়া বসতি যাঁর দিব্য তেজোধাম॥” ৪। “ইষ্টদেব বন্দোঁ শ্রীপুরুষোত্তম নাম। কে কহিতে পারে তাঁর গুণ অনুপাম॥ . সর্ব্বগুণহীন যে, তাহারে দয়া করে। আপনার সহজ করুণাশক্তিবলে॥ . সপ্তম বত্সরে যাঁর কৃষ্ণ-উনমাদ। ভুবনমোহন নৃত্য শকতি অগাধ॥”
আবার শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শাখা বর্ণনায়ও চারি জন পুরুষোত্তমের নাম পাওয়া যায়। তন্মধ্যে অদ্বৈত শাখাভুক্ত দুই জন--- (১) “পুরুষোত্তম ব্রহ্মচারী” ও (২) “পুরুষোত্তম পণ্ডিত।” আর নিত্যানন্দের শাখাভুক্ত দুই জন। যথা---
১। “নবদ্বীপে পুরুষোত্তম পণ্ডিত মহাশয়। নিত্যানন্দ নামে যাঁর মহোন্মাদ হয়॥“ ২। “শ্রীসদাশিব কবিরাজ বড় মহাশয়। শ্রীপুরুষোত্তমদাস তাঁহার তনয়॥ . আজন্ম নিমগ্ন নিত্যানন্দের চরণে। নিরন্তর বাল্যলীলা করে কষ্ণ সনে॥”
বৈষ্ণব-বন্দনা ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতোক্ত পুরুষোত্তম-চতুষ্টয়ের নাম মিলাইয়া বেশ বুঝিতে পারা গেল যে, দেবকীনন্দনের ইষ্টদেবই সদাশিব কবিরাজের পুত্র। এই সম্বন্ধে আরও একটি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। অনুরাগবল্লী নামক একখানি বাষ্ণবগ্রন্থ আছে। শ্রীনিবাস আচার্য্যের শিষ্যানুশিষ্য মনোহর দাস ১৬১৮ শকে এই গ্রন্থ রচনা করেন। ইহাতে আছে, “শ্রীনিত্যানন্দপ্রিয় শ্রীপুরুষোত্তম মহাশয়। শ্রীদেবকীনন্দন ঠাকুর তাঁর শিষ্য হয়॥ তিঁহো যে করিল বড় বৈষ্ণব-বন্দন।”
সদাশিব কবিরাজের বাড়ি কুমারহট্ট বা হালিসহরে ছিল। শ্রীবাস এই সদাশিবের পুত্র পুরুষোত্তমের নিকট দেবকীনন্দনকে দীক্ষা গ্রহণ করিতে বলিয়াছিলেন। যথা---পুরুষোত্তমের পদাশ্রয় কর গিয়া ঘরে। ঘরে অর্থাৎ নিজ গ্রামে যাইয়া পুরুষোত্তমের নিকট দীক্ষিত হও। ইহাতে জানা যাইতেছে যে, দেবকীনন্দনের বাড়িো কুমারহট্টে ছিল। আরও বুঝা যাইতেছে যে, দেবকীনন্দন ছিলেন মহাপ্রভুর সমসাময়িক। আবার বৈষ্ণব- বন্দনায় যাঁহাদিগের নাম আছে, তাহা দেখিলে কোন্ সময়ে এই গ্রন্থ রচিত হয়, তাহা অনেকটা স্থির করা যাইতে পারে।"