কবি হরিবল্লভ - কবির আসল নাম বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। তাঁর পদাবলীর অধিকাংশতেই “হরিবল্লভ”
ভণিতা পাওয়া যায়। কিছু সংখ্যক পদে “বল্লভ” ভণিতাও পাওয়া যায়। আনুমানিক ১৭০০ সালে তিনি
“শ্রীশ্রীক্ষণদা-গীতচিন্তামণি” নামে একটি বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন প্রকাশিত করেন। ১৯২৪ সালে এই গ্রন্থটিকে
সম্পাদনা ও মুদ্রণ করে প্রকাশিত করেন রাধানাথ কাবাসী।
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত, জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত “শ্রীগৌরপদ তরঙ্গিণী” গ্রন্থের “পদকর্ত্তৃগণের পরিচয়” তে
হরিবল্লভ সমন্ধে লেখা রয়েছে, ---
“হরিবল্লভ দাস। ইনি বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। নদীয়া জেলার অন্তর্গত দেবগ্রামে
রাঢ়ীশ্রেণীয় ব্রাহ্মণবংশে বিশ্বনাথ গ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই তাঁহার মনে বৈরাগ্যভাবের উদয় হয়। এই জন্য
সংসারে আবদ্ধ করিবার জন্য তাঁহার পিতা তাঁহার বিবাহ দিয়াছিলেন, এবং গৃহে পণ্ডিত রাখিয়া
শ্রীমদ্ভাগবতাদি পড়াইয়াছিলেন। এই সকল গ্রন্থ পাঠে তাঁহার বৈরাগ্য আরও বৃদ্ধি পাইল। শেষে তিনি পিতা
মাতা ও সুন্দরী ভার্য্যা পরিত্যাগ করিয়া শ্রীব-ন্দাবনে গমন করেন এবং পরে রাধাকুণ্ডতীরে কৃষ্ণদাস
কবিরাজের কুটীরে তাঁহার শিষ্য সুন্দরীদাসের সহিত বাস করেন। ইহার পূর্ব্বে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার
সৈয়দাবাদনিবাসী কৃষ্ণচরণ চক্রব্রত্তীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া, গুরুগৃহে সম্ভবতঃ কিছুকাল বাস করিয়াছিলেন
। কারণ, নিম্নলিখিত শ্লোকে তিনি আপনাকে সৈয়দাবাদবাসী বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন ; যথা---
“সৈয়দাবাদনিবাসিশিরীবিশ্বনাথশর্ম্মণা। চক্রবর্ত্তীতি নাম্নেয়ং কৃতা টীকা সুবোধিনী॥”
কিন্তু ক্ষণদাগীতচিন্তামণির সুবিজ্ঞ সম্পাদক কৃষ্ণপদদাস বাবাজী মহাশয়ের মতে রাধারমণ চক্রবর্ত্তী ইঁহার
গুরু ছিলেন। . . . . বিখ্যাত ঐতিহাসিক কবি ঘনশ্যাম ওরফে নরহরু চক্রবর্ত্তীর পিতা মুর্শিদাবাদ-জঙ্গীপুরের
সন্নিকটস্থ রেঞাপুরবাসী জগন্নাথ শর্ম্মা বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তীর বহু শিষ্যের মধ্যে অন্যতম। . . . . বিশ্বনাথ কবে যে
হরিবল্লভ নাম গ্রহণ করেন, তাহা ঠিক জানা যায় না। তবে তাঁহার বাঙ্গালা পদগুলি হরিবল্লভ, হরিবল্লভদাস,
কিংবা শুধু বল্লভ-ভণিতা দিয়া রচিত। ”
“শ্রীশ্রীক্ষণদা-গীতচিন্তামণি” গ্রন্থে “গন্থকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়” তে রাধানাথ কাবাসী লিখেছেন যে বিশ্বনাথ
চক্রবর্তী ষোড়ষ শকাব্দের মধ্যভাগে (খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতকে ) নদীয়া জেলার দেবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা
ছিলেন রাঢ়ীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর পিতা মাতার নাম জানা যায়নি। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন, রামভদ্র, রঘুনাথ
ও কনিষ্ঠ বিশ্বনাথ। কিছু প্রচলিত অলৌকিক ঘটনাবলী ও কিংবদন্তী সহ, রাধানাথ কাবাসী মহাশয় বিশ্বনাথ
চক্রবর্তীর জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে নানা তথ্যের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ---
“বাল্যকালে স্বদেশে থাকিয়াই চক্রবর্ত্তী মহাশয় ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কারাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
অলোকসাধারণ-প্রতিভা-বলে তিনি পঠদ্দশাতেই একজন দিগিবিজয়ী পণ্ডিতকে পরাস্ত করিতে সমর্থ
হইয়াছিলেন। ঐ সমস্ত পাঠ সমাপনান্তে শ্রীল বিশ্বনাথ মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত সৈয়দাবাদ
গ্রামে গমনপূর্ব্বক শ্রীমদ্ভাগবতাদি ভক্তিশাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করেন এবং তথায় অবস্থান কালে পরম ভাগবত
শ্রীমদ্ গঙ্গানারায়ণ চক্রব্রত্তী মহাশয়ের পুত্র শ্রীল কৃষ্ণচরণ চক্রবর্ত্তী মহোদয়ের গুণে বিমোহিত হইয়া তাঁহার
নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। এই গঙ্গানারায়ণ পরম পূজ্যপাদ শ্রীল ঠাকুর মহাশয়ের (শ্রী নরোত্তম ঠাকুর) শিষ্য
ও শাখা ছিলেন। "
[ গঙ্গানারায়ণের পুত্র ছিল না। তিনি তাঁহার গুরুভ্রাতা রামকৃষ্ণ আচার্য্যের কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণচরণকে দীক্ষা দিয়া
পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন।" জগবন্ধু ভদ্র, গৌরপদ-তরঙ্গিণী। ]
"জন্মজন্মার্জ্জিত সুকৃতি ও সাধনের বলে বিশ্বনাথ শৈশবকাল হইতেই অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। তাঁহার পিতা
তাঁহাকে সংসারে আবদ্ধ রাখিবার জন্য বাল্যকালেই এক পরমা সুন্দরী কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ দেন।
কিন্তু অতুল ঐশ্বর্য্য, পরম রূপবতী ভার্য্যা বা জনক জননীর অপার স্নেহ---কিছুতেই তাঁহাকে সংসারে আবদ্ধ
করিতে পারিল না। তিনি গুরুদেবের আজ্ঞা লইয়া বৃন্দাবনে গমন করিলেন। অন্তর সেই গুরুদেবের আদেশে
পুরনরায় একবার মাত্র স্বদেশে প্রত্যাগমন করিয়া অত্যল্পকাল অবস্থান পূর্ব্বক চির জীবনের জন্য শ্রীবৃন্দাবনে
গমন করেন এবং কিয়দ্দিবস শ্রীবৃন্দাবনের স্থানে স্থানে বাস করিয়া পরিশেষে শ্রীরাধাকুণ্ড-তীরে
পূজ্যপাদ শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী প্রভুর কুটীরে অবস্থান করেন। . . . . ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থকারের
পিতা জগন্নাথ যে তাঁহার ( বিশ্বনাথের ) মন্ত্রশিষ্য ছিলেন, তাহা ঐ গ্রন্থ পাঠে অবগত হওয়া যায়। . . .
গোবিন্দভাষ্যাদি প্রণেতা সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ মহাশয় চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের ছাত্র ছিলেন।”
রাধানাথ কাবাসী, “শ্রীশ্রীক্ষণদা-গীতচিন্তামণি” গ্রন্থে “গন্থকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়”।
দুর্গাদাস লাহিড়ী, ১৯০৫ সালে, তাঁর সম্পাদিত বৈষ্ণব পদ লহরী সংকলনে লিখেছেন,---
“বল্লভদাস, রাধাবল্লভ দাস এবং হরিবল্লভ দাস --- এই তিনজন বৈষ্ণবকবির পরিচয় পাওয়া যায়। ইঁহাদের
তিনজনেরই ভণিতা অনেকস্থলে বল্লভদাস প্রদত্ত হইয়াছে। তন্মধ্যে হরিবল্লভ দাস ১০৭০ সালে (১৬৬৩ খৃ)
নদীয়া জেলার অন্তর্গত দেবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণচরণ চক্রবর্ত্তী ইঁহার গুরু ছিলেন। অল্প বয়সেই ইঁহার
সংসার বৈরাগ্য জন্মায়। ইনি তখন সংসার ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনবাসী হন হন। এই বৃন্দাবনে
কৃষ্ণদাস কবিরাজের কুটিতে আসিয়া ইনি শ্রীমদ্ভাগবত ও গীতা প্রভৃতির টীকা এবং ‘গৌরাঙ্গ লীলামৃত’,
‘চমত্কার চন্দ্রিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। রাধাবল্লভ দাস --- কাঞ্চনগরিয়া নিবাসী সুধাকর মণ্ডলের পুত্র।
ইনি কয়েকখানি সংস্কৃত কাব্যের পদ্যানুবাদ করিয়া কবিপদবাচ হইয়াছেন। বল্লভদাস --- ইনি কবিরাজ
উপাধিধারী এবং বৈদ্যবংশ সম্ভুত। শ্রীনিবাসাচার্য্য ইঁহার দীক্ষাগুরু ছিলেন। ইনি বড়ই ভক্তিমান পুরুষ।
কুলীনগ্রামে ইঁহার নিবাস ছিল। শিবানন্দ সেন ইঁহার জ্ঞাতি হইতেন।”
কবি হরিবল্লভ ওরফে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সংকলিত এবং বিরোচিত বৈষ্ণব পদাবলী গ্রন্থের নাম
“শ্রীশ্রীক্ষণদাগীতচিন্তামণি”। এছাড়া তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে “সারার্থদর্শিনী” (শ্রীমদ্ভাগবতের টীকা),
“সারার্থবর্ষিণী” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার টীকা), “সুবোধিনী” (অলঙ্কারকৌস্তভের টীকা), “আনন্দচন্দ্রিকা”
(উজ্জলনীলমণির টীকা), “সুখবর্ত্তনী” (আনন্দবৃন্দাবনচম্পূর টীকা), “গোপালতাপনীর টীকা”,
“শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের সংস্কৃত টীকা”, “শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকার সংস্কৃত টীকা”, “বিদগ্ধমাধবের টীকা”,
“শ্রীকৃষ্ণভাবনামৃত”, “স্বপ্নবিলাসামৃত”, “স্তবামৃতলহরী”, “চমত্কারচন্দ্রিকা”, “প্রেমসম্পুট”, “গৌরগণোদ্দেশচন্দ্রিকা”,
“গোপীপ্রেমামৃত”, “ভক্তিসরামৃতসিন্ধু-বিন্দু”, “উজ্জ্বলনীলমণি-কিরণ”, “ভাগবতামৃক-কণিকা”, “রাগবর্ত্মচন্দ্রিকা”,
“মাধুর্য্যকাদম্বিনী”, “ঐশ্বর্য্যকাদম্বিনী”, “শ্রীগৌরাঙ্গলীলামৃত” প্রভৃতি।
পাঠকের, একত্রে এই কবির রচিত সব পদাবলী, পাঠ করার উদ্দেশ্যে, শ্রীশ্রীক্ষণদা-গীতচিন্তামণি গ্রন্থে পাওয়া
“বল্লভ” ভণিতার সব কটি পদই আমরা “হরিবল্লভের” এই পাতাতেও রাখছি কারণ এই গ্রন্থটি তাঁরই রচিত
এবং পদের সুর ও ছন্দের প্রয়োজনে হয়তো হরিবল্লভ থেকে সংক্ষেপ করে “বল্লভ” করে থাকতে পারেন।
আমরা প্রতিটি পদে, সেই পদেটির উত্স-গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি। একাধিক ক্ষেত্রে একাধিক রূপে পাওয়া
একই পদ একত্রে তুলে দিয়েছি তুলনার জন্য। সংস্কৃত ভাষার পদগুলির বাংলায় অনুবাদ বা ব্যাখ্যা হাতে
পেলেই তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আমরা মিলনসাগরে কবি হরিবল্লভের বৈষ্ণব পদাবলী আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই
প্রচেষ্টার সার্থকতা।
“বল্লভ”।
"বল্লভ দাস"।
“বীর বল্লভ দাস”।
“বল্লভ দাসিয়া”।
“দাস বল্লভী”।
“শ্রীবল্লভ”।
“রাধাবল্লভ”।
“কবিবল্লভ”।
“হরিবল্লভ”।
কবি হরিবল্লভের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতা প্রথম প্রকাশ - ২৩.৩.২০১৭
...