কী আছে মোদের --- না আছে কী কবি জগদ্বন্ধু ভদ্র দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত “বাঙ্গালীর গান” ( ১৯০৫ ) সংকলন থেকে নেওয়া।
. গান
কী আছে মোদের --- না আছে কী। আছে আমাদের নঙ্গল-জোঁয়াল ; আছে আমাদের দাম্ রা আবাল ; কড়া-পড়া পা রোদে-পোড়া-ছাল, এ উভয়েই আছে --- বহিতে হাল। লজ্জা ঢাকিবার আছে নেঙ্গটি। কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ আছে আমাদের ভারতমণ্ডল --- ফলশষ্যপূর্ণা, খাটিবার বল --- আছে শরীরেতে ; কাস্তে লয়ে হাতে, তাড়াতাড়ি পারি কাটিতে ফসল। পাই তুষ, নাড়া, বিচালি সকল ; তণ্ডুল ঘরেতে নাই সে কেবল। খাইতে না পাই তাতে কি দুখী, কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ বাণিজ্য বিষয়ে ছোটো কি আমরা, ধরি সদা হাতে দাঁড়ি-বাটখাড়া। আমাদের কর্ম বেচা-কেনা করা। মোরা নইলে কার ব্যবসা ঘটে, তবে কি না লাভ পরেরই বটে। আমরাই সব --- লাভে করে কী, কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ মাস্টার, কেরানি, বাজার-সরকার, পদে একচেটে আছে অধিকার। খানসামা, প্যাদা, কে আছে আর, রেলওয়ে মোরা স্টেশন-মাস্টার ; আমাদের হাতে কত কাজের ভার। ম্যাজিস্ট্রেট, জজ প্রভৃতি চকুরি --- আমাদের নাই ; তাতে কী হে ভাই, বিদেশীয়েরা নেয় ? নেক তুচ্ছ করি। অমন ঝুঁকি তে মোরা কি পা দি ; কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ শিল্পে আমাদেরে কে পারে ছাড়াতে, সাক্ষী তার দেখো, ঢেঁকি, চরকা, তাঁতে। দুরবিন, কম্পাস, রেলের গাড়িতে, পারে কি তণ্ডুল, সুতা, বস্ত্র দিতে ; তবে বিদেশিরা বড়ো কি কলেতে, কীসে মোরা ছোটো, বলো না দেখি। কী আছে মোদের ? না আছে কী॥ মাটি, কাঠ, খড়, আছয়ে সকল, আছে নিপূণতা গৃহ নির্মিবার ; তবে যে মোদের কুটিরে বাস, হা, হা, সেটি শুদ্ধ নম্রতা-প্রকাশ। চালে খড় নাই, থেকে কী ফল, গায়েতে পড়িবে --- পড়ুক জল, কিছুতেই মোরা হই না বিকল। ক্ষুদ্র কাজে মন, দিবো কী কারণ। আমরা কি ছোটো, নচ্ছার পাজি। কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ সৈনিক-বিদ্যায় নহি মোরা কম ; পত্নীরে তাড়াতে কালান্তক যম। ছেলেরে ঠেঙাতে ভীমশূরোত্তম ; কাটি শত শত পেনের মাথা। কলম-কামান যখন চালাই, দিস্তা দিস্তা তোপে কাগজ উড়াই। কোন জাতি ধরে এ হেন ক্ষমতা, রক্তপাতে বটে বিরত থাকি ; সেটি ধর্মভয়ে --- ধরমসাখী। কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ নির্বোধ বেটারা বলে শুনতে পাই, ‘বাঙালি সমাজে একতা নাই’। কেন না থাকিবে, দেখো রাত্রি দিবে, ধর্মঘট কত করি ঠাঁই-ঠাঁই। কারো জাতি মারি, কারো বন্ধ করি --- কুল-পুরোহিত, জ্ঞাতি, ধোপা, নাই। আর দেখো, শ্রাদ্ধ-বিবাহ উত্সবে, হয়ে একতায় একত্রিত সবে, খাই লুচি, লাবড়া, সন্দেশ, বরফি ; সপাসপ মারি বুন্দে ক্ষীর, দধি। একতার বল, কী আর বাকি ? কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ বংশের মর্যাদা আমাদের যত, অপর জাতির আছে কি তত, মর্যাদা-কারণে কন্যা বিনাপণে, দেই না বিবাহ, দৃঢ় কুলব্রত। দুধের বালক কুলীন হইলে বুড়ো মেয়ে তার দেই গেঁথে গলে। কিম্বা, ঝোপ বুঝে, বুড়ো এঁড়ে বরে, পাঁচ সাত মেয়ে দেই এক কালে। ছেলে বিয়ে দিতে হইয়া কশাই, কনের পিতার তিন কুল খাই। ভদ্রাসনে তার ঘুঘু যে চরাই, বংশের মর্যাদা সামান্য একি! কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ ‘নাই আমাদের কার্য-তত্পরতা’ যে বলে, প্রকাশ তাহারই মূর্খতা। যে আজ্ঞা হুজুর --- বলিতে তত্পর, আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কে অপর ; অনুকরণেতে কত নিপুণতা। দানশীলদের বদান্যতাভোগী, দাতব্য-চিকিত্সা-আলয়ের রোগী, জন্মাতে মোদের কেমন পটুতা। ধামা-ধরা-কাজে, মানব সমাজে, কারে কি আমরা দখল দিই। কী আছে মোদের --- না আছে কী॥ ‘বাঙালি অবোধ’ বলে কেহ কেহ, যে বলে, সে বোকা --- কী তার সন্দেহ। পর-ভাষা রড়ি, পর-ভাব চুরি, করি, নিজ-ভাব বলিয়া চালাই ; তোতাগিরি কত সর্বত্র ফলাই। লিখি ইতিহাস, লিখি নবন্যাস, আর কত শত লিখি ছাইপাঁশ। সভা-সমিতিতে, কংগ্রেসে, বেদিতে, কেমন বক্তৃতা-ফোয়ারা ছুটাই। পেটেন্ট দাওয়াই করি আবিস্কার, রোগশোকহীন করি এ সংসার। আলু অর্ধখান বাঁধিয়া কারেতে রাঙেতে মুড়িয়া ঝুলাই গলেতে ; রোগীর বগলে চুঙ্গিটি বসাই, বুকে পিঠে তার লাগাই সানাই ; সাজিয়া ডাক্তার, কশে লই ফি। কী আছে মোদের --- না আছে কী॥