কবি জগদ্বন্ধু ভদ্র - "ছুছুন্দরীবধ" কাব্য এবং ৮০ জন পদকর্ত্তার প্রায় ১৫০০ গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদের
সংকলন "শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী"-র রচয়িতা জন্মগ্রহণ করেন ঢাকা জেলার পাণকুণ্ডা গ্রামে। পিতা রামকৃষ্ণ ভদ্র
দুর্ভাগ্যবশতঃ পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে অতি কষ্টে সংসার চালাতেন। এর জন্য কবি জগদ্বন্ধু ভদ্র
নিয়মমত পড়াশুনা করতে পারেন নি।
বৈষ্ণব পদাবলী সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুরেশচন্দ্র
সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার পৌষ, ১৩২৫ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯১৮), তাঁর “সঙ্গীত শাস্ত্রের
একখানি প্রাচীন গ্রন্থ” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“. . . বৈষ্ণব পদাবলীর মত সুন্দর জিনিস বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। কাণের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া প্রাণ
আকুল করিয়া তুলিতে পারে, এমন সুধাস্রাবী ঝঙ্কার বৈষ্ণব পদাবলী ভিন্ন বাঙ্গালায় আর কিছুতে নাই।”
জগদ্বন্ধু ভদ্রর একমাত্র পুত্রের নাম ছিল রামগোবিন্দ সেন (?)। তাঁর দুই কন্যা (?)। তাঁর পৌত্রের নাম
প্রসাদকুমার ভদ্র।
আমরা মিলনসাগরে কবি জগদ্বন্ধু ভদ্রর বৈষ্ণব পদাবলী আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই
প্রচেষ্টার সার্থকতা।
কবি জগদ্বন্ধু ভদ্রর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ১৮.২.২০১৭
দীনেশচন্দ্র সেনে রায়বাহাদুর এর উদ্ধৃতি সংযোজন - ১৭.৮.২০১৯
...
কবি জগদ্বন্ধু ভদ্রর শিক্ষা ও কর্মজীবন - পাতার উপরে . . .
কবি ১৮৬২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ( Entrance Exam ) উত্তীর্ণ হয়ে দস টাকা বৃত্তি পান। ১৮৬৪ সালে তিনি
এল.এ. পরীক্ষায় পাশ করলেও কোনো বৃত্তি পান নি বলে পড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এই সময়ে স্কুল
ইনস্পেক্টর বেলেট সাহের অনুগ্রহে কুমিল্লা স্কুলে তৃতীয় শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর তিনি
সেখান থেকে যশোহর জেলা স্কুলে বদলি হয়ে যান। ১৮৭৫ সালে তিনি এই স্কুলেই প্রথম শিক্ষকের পদে উণ্ণীত
হন। ১৮৯২ সালের ২৯শে মার্চ তারিখে তিনি পাবনা জেলা স্কুলের ভার গ্রহণ করেন প্রধান শিক্ষক হয়ে।
১৮৯৬ সালের শেষভাগে ফরিদপুর জেলাস্কুলের প্রথম শিক্ষকের পদে বদলি হন। এখান থেকেই তিনি অবসর
গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরেও তিনি কিছুকাল স্থানীয় ঈশান স্কুলের হেড মাস্টারের কার্যভার সামলান
এবং সেখানে একটি ছোট বাড়ী করে বসবাস শুরু করেন।
পাঠ্যাবস্থা থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ঢাকার মিত্রপ্রকাশ ও বান্ধব,
মুর্শিদাবাদের ভারতরঞ্জন, অমৃতবাজার পত্রিকা, শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, শ্রী গৌরবিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা,
আনন্দবাজার পত্রিকা ( যশোহরের মাগুরা গ্রাম থেকে প্রকাশিত ) প্রভৃতি সাময়িক ও মাসিক পত্রিকায় তাঁর
লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।
জগদ্বন্ধু ভদ্র সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর, তাঁর আত্মজীবনী “ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্যে”-এর পড়াশুনা অধ্যায়ের,
৬৩-পৃষ্ঠায়, তাঁর স্কুলের হেডমাস্টার জগদ্বন্ধু ভদ্র মহাশয় সম্বন্ধে লিথেছেন . . .
“আমি ১৮৭৯ সনে মাইনর পাশ করিয়া কুমিল্লায় পড়িতে গিয়াছিলাম। সেখানে যাইয়া গভর্নমেন্ট স্কুলে চতুর্থ
শ্রেণীতে ভর্তি হইলাম। তখন হেডমাষ্টার ছিলেন জগদ্বন্ধু ভদ্র---ইনি সাহিত্যসমাজে সুপরিচিত। মেঘনাদবধ-
কাব্যকে ঠাট্টা করিয়া ছুছুন্দরী বধ নামক যে অপূর্ব বিদ্রূপকাব্য রচিত হইয়াছিল, তাহার লেখক ছিলেন এই
জগদ্বন্ধু ভদ্র মহাশয়। এই কাব্যটি পুরাপুরি রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বঙ্গসাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থে উদ্ধৃত
হইয়াছিল। পূর্ববঙ্গে তখন ইংরাজী ভাষায় ব্যুত্পন্ন ব্যক্তিদিগের শীর্ষস্থানে ছিলেন ঢাকা জেলার
মত্তগ্রামনিবাসী উমাচরণ দাশ মহাশয়। তিনি যেমনই পণ্ডিত ছিলেন তেমনই সঙ্গীতশাস্ত্রে বিশারদ ছিলেন।
জগদ্বন্ধু ভদ্র মহাশয় উমাচরণ বাবুর সাহায্য লইয়া বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদ প্রকাশ করেন। ইঁহাদের
পূর্বে কোন আধুনিক তন্ত্রের লোক এইসকল পদের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন নাই। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়
‘বংশীধরে’র প্রসঙ্গে সর্বদা ঠাট্টাবিদ্রূপ প্রকাশিত হওয়ায় বৈষ্ণব-পদাবলীর প্রতি শিক্ষিত সমাজের বরং
একটা তীব্র ঘৃণার ভাবই ছিল। জগদ্বন্ধু ভদ্র মহাশয় বহুসংখ্যক বাবাজীর আখড়াতে ঘুরিয়া কি কষ্টে যে এই
সকল পদ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার পদাবলীর ভূমিকায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ইনিই এইক্ষেত্রে
প্রথম হলধর, ইট-পাথর ভাঙিয়া ইনিই এই ক্ষেত্র সর্বপ্রথম হলচালনার উপযোগী করিয়াছিলেন। ইঁহার পরে
সারদা মিত্র মহোদয়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, রমণী মল্লিক, অক্ষয়চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার,
নীলরতন, নগেন্দ্র গুপ্ত, সতীশ রায়, অমৃতবাজার পত্রিকার অধ্যক্ষেরা এবং অপর অপর শিক্ষিত লোক এই
ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, কিন্তু এই পথের সর্বপ্রথম পথিক এবং নব্যতন্ত্রীদের মধ্যে এই বিষয়ের প্রথম
দীক্ষিত ছিলেন ভদ্র মহাশয় ও উমাচরণ বাবু।
জগদ্বন্ধু ভদ্র মহাশয়ের তৃতীয় কীর্তি, তাঁহার অসাধারণ সংগ্রহ-নৈপুণ্য ও বিরাট অধ্যবসায়ের জীবন্ত দৃষ্টান্ত
গৌরপদতরঙ্গিণী---সাহিত্য-পরিষৎ হইতে টাকির খ্যাতনামা জমিদার রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, এম.এ. বি.এল.
মহাশয়ের ব্যায়ে প্রকাশিত হইয়াছিল। প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। এখন ভদ্র মহাশয় স্বর্গত ;
অপর কোন যোগ্য ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত হইয়া এই দুর্লভ পুস্তকের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময়
আসিয়াছে।
জগদ্বন্ধু মহাশয় ছিলেন হেডমাস্টার। আমি চতুর্থ শ্রেণীর পড়ুয়া, আমি তাঁহার কাছে পড়ি নাই। কিন্তু তিনি
যে মাথার উপর চাপিয়া ছিলেন, এ বিষয়ে তো সন্দেহ নাই। তাঁহার চেহারাটা ছিল ছোটখাটো, কোগা ও
শ্যামবর্ণ, তিনি অতি নিরীহ ব্যক্তি ছিলেন। যে যুগের শিক্ষকদের হস্তে বেত্র, চক্ষে রক্তিমা ও ভাষায়
ভীতিপ্রদর্শন সর্বদাই যেন ছাত্রদের রক্ত শুষিয়া খাইত, অধ্যাপনার সেই নিদারুণ যুগেও জগদ্বন্ধুবাবুর
হাঁকডাক আমরা কখনও শুনি নাই। তিনি বৈষ্ণব সাহিত্য চর্চা করিয়া প্রকৃতই বৈষ্ণব হইয়া গিয়াছিলেন।
তিনি প্রাচীন কবিগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া সময় সময় ব্রজবুলিতে পদ রচনা করিতেন, তাহা বিষ্ণুপ্রিয়া
প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হইত।ভদ্র মহাশয় বড়ই পানের ভক্ত ছিলেন, তাম্বুলরসসিক্ত অধরপ্রান্ত তিনি
রুমাল দিয়া মুছিতেন আর কথা কহিতেন। . . .
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে নিদারুণ শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হইয়া আমি এক বত্সর ফরিদপুরে ছিলাম, তখন জগদ্বন্ধুবাবু
অবসর লইয়া তথায় বাস করিতেছিলেন। আমি শয্যাশায়ী, সুতরাং যাইতে পারিতাম না। তিনি প্রায়ই
আমাকে দেখিতে আসিতেন। তাঁহার মত অমায়িক ও সাহিত্যপ্রাণ, ভক্তিপরায়ণ লোক একালে খুব অল্পই
দেখা যায়।”
এই পাতার কবিতার ভণিতা - জগবন্ধু, হীন জগবন্ধু
|
“মেঘনাদ বধ” কাব্যের প্যারডী “ছুছুন্দরী-বধ কাব্য” - পাতার উপরে . . .
মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অমৃতাক্ষর ছন্দে রচনা করেন “মেঘনাদ বধ” কাব্য। সেই সময়ে এই নতুন ছন্দের
রচনা নিয়ে বাংলা সাহিত্য জগতে আলোড়ণের সৃষ্টি হয়। কবি জগবন্ধু ভদ্র, যশোহরে থাকাকালীন মাইকেল
মধুসূদন দত্তর “মেঘনাদ বধ” কাব্যের প্যারডী বা অনুকরণে, “ছুছুন্দরী-বধ কাব্য”-এর প্রথম সর্গ রচনা করেন।
১২৭৫ বঙ্গাব্দের ১২ই আশ্বিনের অমৃতবাজার পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। ব্যারিষ্টার মনমোহন ঘোষ তা
পাঠ করে মোহিত হন এবং তিনি মাইকেলকে তা পড়তে দেন। জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত, মৃণালকান্তি ঘোষ
সম্পাদিত “শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী” (১৯৩৪), সংকলনের তৃতীয় পরিশিষ্টে রয়েছে যে, মাইকেল মধুসূদন তা পড়ে
বিশেষ সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, “আমার মেঘনাদবধ একদিন হয় ত বাঙ্গালা সাহিত্য হইতেও বিলুপ্ত হইতে
পারে, কিন্তু ছুছুন্দরীবধ কাব্য চিরদিন অমর হইয়া থাকিবে।”
জগদ্বন্ধু ভদ্রর রচনা সম্ভার - পাতার উপরে . . .
মাসিক পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর “বিলাপতরঙ্গিণী” (মিত্রাক্ষর কাব্য), “বঙ্গেশ রহস্য” (উপন্যাস),
“দুর্ভাগিনী বামা” (গল্প), “বিজয়সিংহ” (নাটক) প্রভৃতি।
কবি মাত্র ১২ বছর বয়সে ব্রজলীলা বিষয়ে একটি সুবৃহৎ পাঁচালী লেখেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দে (১৮৭৩) “মহাজন-
পদাবলী সংগ্রহ” নাম দিয়ে বিদ্যাপতির পদাবলী সংকলন করেন। বৈষ্ণব কবিদের জীবনী অনুসন্ধানে তিনিই
প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৩১০ বঙ্গাব্দে (১৯০৩), ৮০ জন বৈষ্ণব পদকর্তার ১৫১৭টি পদ সংগ্রহ করে
“শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী” নামে সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে “তপতী-উদ্বাহ”
(কাব্য), “ভারতের হীনাবস্থা” (কাব্য), “বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদাবলী”, "দেবলদেবী" (নাটক) প্রভৃতি।
এখানে তাঁর কয়েকটি “বৈষ্ণব পদাবলী”, “ছুচ্ছুন্দরীবধ কাব্য (প্রথম সর্গ)” এবং “কী আছে মোদের - না আছে
কী” কথার ব্যাঙ্গাত্মক গান তুলে দিচ্ছি আগামি প্রজন্মের জন্য।