কবি ত্রিলোচন দাস-এর পুরো নাম
লোচন দাস বা লোচনানন্দ দাস বা সুলোচন।
জগবন্ধু ভদ্র লিখেছেন যে, চৈতন্যমঙ্গল  
রচনার পর লোকে তাঁকে ‘সুলোচন’ ও  
‘লোচনানন্দ’ বলতেন।

তাঁর সম্বন্ধে বেশিরভাগ তথ্য আমরা ১৮৯৩
সালে প্রকাশিত, রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন  
সম্পাদিত লোচনদাসের “চৈতন্য-মঙ্গল” গ্রন্থের
বিজ্ঞাপন (ভূমিকা) এবং বিভিন্ন লেখকের
লেখা থেকে সংগ্রহ করেছি যার উত্স-
আলেখ্যগুলিও কালানুক্রমিকভাবে নীচে
দেওয়া রয়েছে। পাশে দেওয়া সূচীতে ক্লিক
করলেও সেই লেখায় পৌঁছে যাবেন।
এই পাতার কবিতার ভণিতা -
ত্রিলোচন, লোচন, লোচনদাস, সুলোচন,
লোচনানন্দন
দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি -                                                     পাতার উপরে . . .  
দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ১৯৭৭ সালে সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদসঙ্কলন”-এ   
পরিশিষ্টের বর্ণানুক্রমিক কবিপরিচয় তে লোচনদাস সম্বন্ধে লিখেছেন . . .

বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মঙ্গলকোটের নিকট কোগ্রামে লোচন দাস বা ত্রিলোচন দাসের জন্ম। পিতার নাম  
কমলাকর দাস, মাতার নাম সদানন্দী।  লোচনের বৈদ্যবংশে জন্ম।  নরহরি সরকার ছিলেন লোচনের  
দীক্ষাগুরু। নরহরির গৌরাঙ্গনাগর-বাদের প্রচারক ছিলেন লোচন দাস। ১৫৩৭ খৃষ্টাব্দে লোচন দাসের  
চৈতন্যমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। ছড়ার ছন্দে ধামালি-জাতীয় পদরচনা লোচন দাসের পদাবলীর বিশিষ্টতা
।”

আমরা
মিলনসাগরে  কবি লোচন দাসের বৈষ্ণব পদাবলী আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই  
প্রচেষ্টার সার্থকতা।


কবি লোচন দাসের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।  
কবি সুলোচনের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।  
কবি ত্রিলোচন দাসের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
কবি লোচনানন্দ দাসের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন


আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৩০.১০.২০১৮
হারাধন দত্তর উদ্ধৃতি সহ এই পাতার ১ম পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১.১১.২০১৮
...
“লোচন” ও “লোচনদাস” ছাড়াও ৩টি “ত্রিলোচন”, ১টি “সুলোচন” এবং ১টি “লোচনানন্দ” ভণিতার পদ পাওয়া
গিয়েছে। ওই নামের অন্য কোনো পদকর্তার খোঁজ পাওয়া যায় নি। তাই সব ক’টি ভণিতাই লোচনদাসের
বলে মনে করা হয়। তাঁর রচিত চৈতন্যমঙ্গল কাব্য মুরারীগুপ্তের কড়চার অনুসরণে রচিত। চৈতন্যমঙ্গল
রচনার পরে লোচনদাসকে লোকে সুলোচন ও লোচনানন্দ বলতেন। তাঁর ধামালী পদের জন্য তাঁকে লোকে
ব্রজের “বড়াই বুড়ীর” অবতার বা “ব্রজের বড়াই” বলেও ডাকতেন। ব্রজ-লীলায় তার নাম “লোচনা-সখী” ছিল
বলে মানা হয়। শ্রীগৌর গণোদ্দেশ দীপিকামতে ইনি ব্রজের শ্রীচন্দ্রশেখরা সখী।

রামগোপাল দাস (গোপাল দাস) দ্বারা ১৬৪৩-১৬৭৬ খৃষ্টাব্দ সময়কালে, সংকলিত ও বিরোচিত, এযাবৎ প্রাপ্ত
প্রথম বৈষ্ণব পদাবলী  সংকলন "শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ-রসকল্পবল্লী” গ্রন্থের “শ্রীশ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর প্রভুর শাখা
নির্ণয়”-তে আছে . . .

আর এক শাখা বৈদ্য লোচনদাস নাম।
পূর্ব্বে লোচনা সখী যার অভিমান॥
শ্রীচৈতন্যলীলা যেহ করিলা বর্ণন।
গুরুর অর্থে বিকাইলা ফিরিঙ্গি সদন॥--- রামগোপাল দাস, "শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ-রসকল্পবল্লী”॥

শেষ দুটি পংক্তিতে জানা যায় যে লোচন দাস তাঁর গুরু নরহরি সরকারের জন্য নিজেকে ফিরিঙ্গি অর্থাৎ
পর্তুগীজ বণিকের কাছে জামিন রেখেছিলেন।

কবি লোচনদাস জন্মগ্রহণ করেন বর্দ্ধমান জেলার গুষ্করা স্টেশন থেকে ৫ ক্রোশ (১৮কিমি) দূরে, মঙ্গলকোটের
কাছে, কুনুর নদীর তীরে অবস্থিত “কুয়া” বা “কো” গ্রামে। তিনি জাতিতে বৈদ্য ছিলেন।

অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর নরহরি চক্রবর্তী ও রঘুনাথ দাসের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে
গিয়ে তাঁর সংসারে অনাসক্তি হয়। কিন্তু গুরু নরহরির আদেশে স্ত্রীর বয়সকালে তাঁদের আমোদপুর, কাকুটে
গ্রামে গিয়ে প্রথম দেখায় চিনতে না পেরে মাতৃসম্বোধন করার ফলে তাঁর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন না কাটাবার
কথা বলেন। স্ত্রী ক্ষুব্ধ হলে তিনি তাঁকে সঙ্গে নিয়েই সাধন-সঙ্গিণী হিসেবে জীবন কাটান এবং ব্রহ্মচর্য্য পালন
করেন। তাঁদের মধ্যে প্রেম ও প্রীতি পুরোমাত্রায় ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এত তথ্যের মধ্যেও আমরা
এই মহীয়সী নারীর নাম কোথাও উল্লিখিত পাই না। এই মর্ম্মসঙ্গিণী নারীর প্রভাবেই লোচনের “চৈতন্য-মঙ্গল”
রচনা এত সরস ও মর্ম্মস্পর্শী হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন লিখেছেন, “
ত্রিলোচন দাস শাস্ত্রজ্ঞ বটেন, তবে তাঁহার হস্তাক্ষর গুলি বড় মোটা মোটা
ছিল। বাঁশের কলমে তেড়েটের পাতায় লিখিতেন। এবং তাঁহার “ক, খ” তেড়েটপাতা যোড়া হইত। তাঁহার
হস্তলিপি অদ্যপিও বর্ত্তমান আছে।” ১৮৯৬ সালে, দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থে লিখেছেন
যে গুস্করা স্টেশনের কাছে অবস্থিত কো গ্রামের অদূরে কাঁকড়া গ্রামের বিখ্যাত চৈতন্যমঙ্গল গায়ক প্রাণকৃষ্ণ
চক্রবর্তীর বাড়ীতে লোচনদাসের নিজের হাতে লেখা চৈতন্যমঙ্গল আছে। প্রাণকৃষ্ণ বলতেন, “লোচনের আখর
উঠানযোড়া কএর মতো
।” লোচনদাস যে পাথরটির উপরে বসে চৈতন্যমঙ্গল লিখেছিলেন তা এখনো আছে।
লোচন দাসের আত্ম-পরিচয় -                                                          পাতার উপরে . . .   
তাঁর রচিত “শ্রীচৈতন্যমঙ্গল” ও “দুর্লভসার” গ্রন্থে তাঁর নিজের পরিচয়ে তিনি জানিয়েছেন যে তাঁর পিতা
কমলাকর দাস, মাতা সদানন্দী অথবা অরুন্ধতি। আমাদের প্রাপ্ত সব গ্রন্থেই সদানন্দী নামটি পেয়েছি। কিন্তু
বিমান বিহারী মজুমদার তাঁর “শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান” গ্রন্থের ৯ম অধ্যায় “লোচনের শ্রীচৈতন্যমঙ্গল”-এ
গ্রন্থকারের পরিচয়তে ২৪৯-পৃষ্ঠার পাদটীকায় লিখেছেন যে তিনি “অরুন্ধতী” নামটিও পেয়েছেন . . .

“মৃণালকান্তি ঘোষ-সম্পাদিত মুদ্রিত গ্রন্থে আছে---
“মাতা মোর পুণ্যবতী সদানন্দী নাম”।
১৩০৪ বঙ্গাব্দের চতুর্থ সংখ্যা, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় প্রকাশিত ১১০৬ সনের এক চৈতন্যমঙ্গলের পুঁথির
বিবরণ উদ্ধৃত হইয়াছে---
“মাতা সতী সুরপতি অরুন্ধতি নাম”।

এ ছাড়া লোচন দাস তাঁর পরিচয়ে জানিয়েছেন যে তিনি ছিলেন তাঁর মাতৃকুল ও পিতৃকুলের একমাত্র সন্তান।
তাঁর মাতামহী অভয়া দাসী এবং মাতামহ শ্রীপুরুষোত্তম গুপ্ত যিনি তাঁকে মেরে ধরে লেখাপড়া শেখান . . .

চারিখণ্ড কথা সায় করিল প্রকাশ।
বৈদ্যকুলে জন্ম মোর কু-গ্রাম নিবাস॥
মাতা মোর শ্রীশ্রীমতী সদানন্দী নাম।
যাঁহার উদরে জন্মি করি কৃষ্ণ কাম॥
কমলাকরদাস নাম পিতা জন্মদাতা।
যাঁহার প্রসাদে কহি গৌর-গুণগাথা॥
সংসারেতে জন্ম দিল সেই পিতা মাতা।
মাতামহ কুল তার শুন কিছু কথা॥
পিতৃকুল মাতৃকুল বৈসে এক গ্রামে।
ধন্য মাতামহীসে অভয়া দাসী নামে॥
মাতামহের নাম শ্রীপুরুষোত্তম  গুপ্ত।
নানাতীর্থ-পূত সেহ তপস্যায় তৃপ্ত॥
মাতৃকুলে পিতৃকুলে আমি মাত্র পুত্র।
সহোদর নাহি মাতামহের যে সূত্র ॥
যথা তথা যাই সে দুল্লিল করে মোরে।
দুল্লিল লাগিয়া কেহ পঢ়া’বারে নারে॥
মারিয়া ধরিয়া মোরে পঢ়াইল অক্ষর।
ধন্য সে পুরুষোত্তমগুপ্ত চরিত্র তাঁহার॥
তাঁহার চরণে মুঞি করো নমস্কার।
চৈতন্যচরিত্র লিখি প্রসাদে যাঁহার॥---“চৈতন্য-মঙ্গল”, শেষ খণ্ড॥

তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন নরহরি সরকার ঠাকুর, যাঁর আদেশে বা প্রসাদে তিনি চৈতন্যমঙ্গল কাব্য রচনা
করেছিলেন। চৈতন্যমঙ্গলে আছে . . .

“মাতৃকুলে পিতৃকুলে কহিল মো কথা।
নরহরিদাস মোর প্রেমভক্তি দাতা॥
তাঁহার প্রসাদে যেবা করিল প্রকাশ
পুস্তক করিল সায় এ লোচনদাস॥---“চৈতন্য-মঙ্গল”, শেষ খণ্ড॥”

১৯২৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত, তারাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য সংকলিত, “বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির
বিবরণ”, ৩য় খণ্ড, ৩য় সংখ্যা, ১৫২-পৃষ্ঠায় লোচন দাস রচিত “দুর্লভসার” পুথিতে, চৈতন্যমঙ্গলের ন্যায় তাঁর
পরিচয় এইরূপে দেওয়া রয়েছে।

বৈদ্যকুলে জন্ম মোর কোগ্রাম বাস॥
মাতা সতি সুদ্ধমতি সদানন্দী নাম।
যাহার উদরে জন্মি করি কৃষ্ণ কাম॥
কমলাকর দাস নাম পিতা জন্মদাতা।
যাহার প্রসাদে দেখি সুনি গৌরকথা॥
সংসারেতে জন্ম দিল এই মাতা পিতা।
মাতামহো কুলে মোর কহোঁ কিছু কথা॥
মাতৃকুল পিতৃকুল মোর বৈসে এক গ্রামে।
ধন্য মাতামহি সে অভয়া দাসী নামে॥
মাতামহো হএন মোর শ্রীপুরুষোত্তম গোপ্ত।
বলে তীর্থ পুত্র তেহ তপস্যায় তৃপ্ত॥
মাতৃকুলে পিতৃকুলে আমি এক মাত্র।
সহোদর নাহি নাহি মাতামহের পুত্র॥
যথা তথা যাই পাল . . . . . মোরে।
দুর্ন্নিত লাগিয়া কেহো পঢ়াইতে নারে॥
মারিয়া ধরিয়া মোরে সিখান আখর।
ধন্য পুরুষোত্তমগুপ্ত . . . . .  তাঁহার॥ “দুর্লভসার” পুথি॥
.
লোচন দাসের আত্ম-পরিচয়   
লোচন দাসের রচনাসম্ভার   
তাঁর সম্পাদিত চৈতন্যমঙ্গলে, রামনারায়ণ বিদ্যারত্নের উদ্ধৃতি   
নব্যভারত-এ হারাধন দত্তর চৈতন্যমঙ্গলের নাম-বিভ্রাট নিয়ে উদ্ধৃতি   
নব্যভারত-এ হারাধন দত্তর লোচনদাসের বিভিন্ন নাম নিয়ে উদ্ধৃতি   
লোচনদাসের কবিত্ব নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্ধৃতি   
দীনেশচন্দ্র সেনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে সতীশচন্দ্র রায়ের উদ্ধৃতি   
লোচনের নাম ও ধামালী পদ নিয়ে জগবন্ধু ভদ্রর উদ্ধৃতি   
লোচনের পদাবলী ও ধামালী নিয়ে সতীশচন্দ্র রায়ের উদ্ধৃতি   
লোচন দাস নিয়ে দুর্গাদাস লাহিড়ীর উদ্ধৃতি   
লোচনদাসের দাম্পত্য জীবন নিয়ে মৃণালকান্তি ঘোষের উদ্ধৃতি   
লোচনদাসের শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনা নিয়ে মৃণালকান্তি ঘোষের উদ্ধৃতি   
রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের উদ্ধৃতি   
প্রিয়নাথ জানার উদ্ধৃতি   
সুকুমার সেনের উদ্ধৃতি   
চৈতন্যমঙ্গলের ৩টি উদ্দেশ্য নিয়ে বিমান বিহারী মজুমদারের উদ্ধৃতি   
বিমান বিহারী মজুমদারের নাগরীভাবের ব্যাখ্যা   
চৈতন্যমঙ্গলের রচনাকাল নিয়ে সুখময় মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি   
লোচন সম্বন্ধে নীলরতন সেনের উদ্ধৃতি   
দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি      
বৈষ্ণব পদাবলী নিয়ে মিলনসাগরের ভূমিকা     
বৈষ্ণব পদাবলীর "রাগ"    
কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও উত্স গ্রন্থাবলী     
মিলনসাগরে কেন বৈষ্ণব পদাবলী ?        
লোচন দাসের রচনাসম্ভার -                                                            পাতার উপরে . . .   
লোচন দাসের রচনা সম্ভারে আছে “শ্রীচৈতন্যমঙ্গল”, রায় রামানন্দের সংস্কৃত ভাষায় রচিত “জগন্নাথবল্লভ”  
নাটকের বঙ্গানুবাদ (ভাবানুবাদ), “দুর্লভসার”, “চৈতন্য প্রেমবিলাস”, “বস্তুতত্ত্বসার”, “আনন্দ লতিকা” প্রভৃতি
গ্রন্থ। শ্রীচৈতন্যমঙ্গল ও দুর্লভসার, এই দুটি গ্রন্থে কবি তাঁর আত্ম-পরিচয় দিয়েছেন।
.
তাঁর সম্পাদিত চৈতন্যমঙ্গলে রামনারায়ণ বিদ্যারত্নের উদ্ধৃতি -                  পাতার উপরে . . .   
আনুমানিক ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে, ত্রিলোচন দাস বা লোচন দাস বিরচিত, ১৮৯৩ সালে রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন দ্বারা
সম্পাদিত ও প্রকাশিত "চৈতন্যমঙ্গল" কাব্যের বিজ্ঞাপনে তিনি লোচন দাসের জীবনী দিয়েছেন। সেখান থেকে
আমরা কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি . . .

এই গ্রন্থে শ্রীশ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাব হইতে অন্তর্ধান পর্য্যন্ত সমুদায় লীলা সুন্দর কবিতায় বর্ণিত হইয়াছে,
প্রসঙ্গাধীন তদীয় ভক্তগণের বিবরণও পরিত্যক্ত হয় নাই, তাহা গ্রন্থপাঠেই বিদিত হইতে পারিবেন। তবে  
এস্থলে গ্রন্থকর্ত্তা লোচনদাস মহাশয়ের জীবনচরিত সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করা গেল।

“বর্দ্ধমানের উত্তর দশ ক্রোশ, গুস্করা ষ্টেসন্ হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে কুনুর নদীর তীরে মঙ্গলকোটের নিকট,  
“কুয়া” বা “কো” গ্রামে বৈদ্যবংশীয় কমলাকর দাসের ঔরসে ও সদানন্দীর গর্ভে ত্রিলোচন জন্মগ্রহণ করেন।  
ইহাঁর নাম ত্রিলোচন দাস হইলেও বৈষ্ণবসমাজে “লোচনদাস” বলিয়াই বিখ্যাত, কারণ ইনি  নিজকৃত   
পদাবলীতে প্রায়ই “কহয়ে লোচনদাস” এই বলিয়াই ভণিতা দিয়াছেন। ত্রিলোচনের মাতামহের ও পিতামহের  
এক গ্রামেই বাস এবং দুই কুলের ইনিই একমাত্র কুলপ্রদীপ। তাঁহার মাতামহের একটিমাত্র কন্যা ত্রিলোচনের
গর্ভধারিণী সদানন্দী, কাজেই ত্রিলোচন দুই বংশের বড়ই আদরের ধন ছিলেন। তাঁহার নিজলিখিত চৈতন্য-
মঙ্গলে আত্মপরিচয় এইঃ---

চারি খণ্ড পুঁখি এই করিল প্রকাশ। বৈদ্যকুলে জন্ম মোর কো গ্রামে নিবাস॥ মাতা শুদ্ধমতী সদানন্দী তাঁর
নাম। যাঁহার উদরে জন্মি করি কৃষ্ণকাম॥ কমলাকর দাস মোর পিতা জন্মদাতা। যাঁহার প্রসাদে গাই গৌরগুণ
গাথা॥ মাতৃকুল পিতৃকুল বৈসে এক গ্রামে। ধন্য মাতামহী সে অভয়া দাসী নামে॥ মাতামহের নাম   
শ্রীপুরুষোত্তম গুপ্ত। সর্ব্বতীর্থপূত সেই তপস্যায় তৃপ্ত॥ মাতৃকুলে পিতৃকুলে আমি এক মাত্র। সহোদর নাই  
মোর মাতামহের পুত্র॥ যথা তথা যাই সে দুল্লিল করে মোরে। দুল্লিল (আদুরে) দেখিয়া কেহ পড়াইতে নারে॥
মারিয়া ধরিয়া মোরে পড়াইল অক্ষর। ধন্য সে পুরুষোত্তম গুপ্ত চরিত তাঁহার॥ তাঁহার চরণে মুঞি করি   
নমস্কার। চৈতন্যচরিত্র লিখি প্রসাদে যাঁহার॥ মাতৃকুলে পিতৃকুলে কহিল মো-কথা। নরহরিদাস মোর  
প্রেমভক্তি দাতা॥ তাহার প্রসাদে যেবা করিল প্রকাশ। পুস্তক করিল সায় এ লোচনদাস॥ (চৈতন্য-মঙ্গল শেষ)।

ত্রিলোচন দাস নিজে দৈন্য পূর্ব্বক যাহাই বলুন, তিনি মূর্খ ছিলেন না। রামানন্দ রায়ের অপূর্ব্ব সংস্কৃত নাটক
জগন্নাথবল্লভ স্থিত গীত ভাঙ্গিয়া যিনি বাঙ্গালা পদ করেন এবং চৈতন্য-মঙ্গল নামক গৌকগুণময় এক বৃহৎ  
বাঙ্গালা পদ্যাত্মক কাব্য লিখেন ও তাহাতে নরহরি সরকার অনুমতি দেন, সুতরাং ইনি যে এক জন পণ্ডিত,
তাহাতে সন্দেহ নাই।

গৌরাঙ্গের গুণ বাঙ্গালাপদ্যে লিখিতে ইহাঁর বড়ই সাধ হয় এই জন্যই চৈতন্য-মঙ্গল লিখেন। ইহাঁর রচিত  
“দুর্ল্লভসার” নামক একখানি সূক্ষ্মতত্ত্বে পরিপূর্ণ গ্রন্থ আছে। ত্রিলোচন দাস শাস্ত্রজ্ঞ বটেন, তবে তাঁহার হস্তাক্ষর
গুলি বড় মোটা মোটা ছিল। বাঁশের কলমে তেড়েটের পাতায় @ লিখিতেন। এবং তাঁহার “ক,  খ”  
তেড়েটপাতা যোড়া হইত। তাঁহার হস্তলিপি অদ্যপিও বর্ত্তমান আছে। এই তেড়েটপাতা লইয়া তাঁহার বাটীর
কুলগাছ তলায় একখানি প্রস্তরের উপর বসিয়া চৈতন্য-মঙ্গল লিখিয়াছিলেন। সে প্রস্তর এখনও বর্ত্তমান, সাধুগণ
দর্শন ও প্রণাম করিতে যাইয়া থাকেন।

ত্রিলোচন আদরের ছেলে, সকলে তাঁহার অল্প বয়সেই বিবাহ দিলেন। তাঁহার শ্বশুরবাটী আমোদপুর, কাকুটে
গ্রামে। তাঁহার বিবাহে মহাসমারোহ হয়, মাতামহ পিতামহ এক গ্রামের বলিয়া স্ত্রীগণের আনন্দ উত্সব  
যথেষ্টও হইয়াছিল। বিবাহের পর ত্রিলোচন শ্রীখণ্ডে শ্রীনরহরি ও শ্রীরঘুনন্দন সরকার ঠাকুর  মহাশয়ের  
নিকটে বিদ্যাভ্যাস করিতে যান। বিদ্যালাভের সঙ্গে সঙ্গে মহাত্মাগণের সহবাস নিবন্ধন সংসারে অনাসক্তিও  
অভ্যস্ত হইল। ত্রিলোচন অনিচ্ছাসত্ত্বেও গুরুজনের অনুরোধে শ্রীখণ্ড ত্যাগ করিয়া গৃহে আসিলেন এবং শ্বশুর
বাটী পদব্রজে গমন করিলেন। বিবাহের পর এই প্রথম শ্বশুরবাটী গমন, কাজেই স্ত্রীও তত পরিচিতা নহেন।
শ্বশুরবাটীর নিকটে যাইয়া একটী স্ত্রীলোককে বলিলেন, “মা! অমুকের বাটী কোন পথে যাইব?” তিনিই  
ত্রিলোচনের পত্নী। অনতিবিলম্বেই তাঁহাকে পত্নী জানিয়া বড়ই লজ্জা ও পাপভয়ে কাতর হইলেন। মনে  
ভাবিলেন, শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর মহাশয় আকুমার ব্রহ্মচারী, আমারও স্ত্রী-ত্যাগের এই এক সুবিধা হইল।
স্ত্রীও বড় ক্ষুব্ধা হইলেন। শেষে চিরজীবন একত্ত্র যাপন করিলেন বটে, কিন্তু ভগ্নবিষদন্ত সর্পের ন্যায় দাম্পত্য
ব্যবহার কিছুই ঘটিল না। ত্রিলোচন যে শক্তিমান্ ও জিজিতেন্দ্রিয়, তাহা এই ঘটনাতেই বোধ হয়।  স্ত্রীর
সহিত প্রগাঢ় প্রীতিও ছিল, তাহাও নিজে ব্যক্ত করিয়াছেন।

“প্রাণের ভার্য্যে! নিবেদি নিবেদি নিজ কথা, আশীর্ব্বাদ মাগি আগে, যত যত মহাভাগে, তবে গা’ব গোরাগুণ
গাথা”।

উভয়ের কি মধুর ভাব, এই গীতে জানা যায়। ত্রিলোচনের গীত প্রায়ই কৌতুকরসে পরিপূর্ণ। শ্রীরাধিকা  
একদিন কৃষ্ণসম্ভোগ-চিহ্ন গোপন করিতে গিয়া শাশুড়ীর নিকট ছল করিয়াছিলেন, ত্রিলোচন তাহা গীতে বর্ণন
করিতেছেন।

শ্রীরাধিকা---“সাঁজ দিলাম শলিতা দিলাম গোহালে দিলাম বাতি। তোমার ঘরের চোরা বাছুর বুকে মারিল   
লাথি॥ বুক বকু ব’লে আমি পলেম ক্ষিতিতলে। এমন কেহ ব্যথিত নাই যে, হাতে ধ’রে তোলে॥ লোচন বলে
ওলো দিদি! আমি তখন কোথা?। শাশুড়ী ভুলাইতে তুমি এত জান কথা”॥

এই সমস্ত রহস্যময়ী কবিতা শ্রবণেই বোধ হয় বৈষ্ণবগণ লোচনদাসকে ব্রজের “বড়াই বুড়ীর” অবতার বলিয়া
বর্ণনা করেন। কারণ বড়াই কৃষ্ণ-লীলায় অতীব সুরসিকা একটী বদ্ধা ছিলেন। . . .

. . . লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল, জগন্নাথবল্লভের অনুবাদ ও দুর্ল্লভসার এই তিনখানি গ্রন্থ ব্যতীত কোন গ্রন্থ
দেখা যায় না, তবে অনেক গানের পুস্তকে তাঁহার পদাবলী আছে বটে। ইনি মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান সম্বন্ধে লেখেন
যে, মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করিয়া প্রার্থনা করেন যে, “আমি আর ইহ জগতে থাকিব না,
আমায় স্থান প্রদান করুন”, এই বলিলে দ্বারের কপাট রুদ্ধ হইয়া গেল। তত্পরে গুণ্ডিচামন্দিরের
একটী ব্রহামণ আসিয়া গুণ্ডিচামন্দিরে মহাপ্রভুর অদর্শনের (এখানে ছাপা আছে - সাক্ষাত্কারের) কথা বলিয়া
জগন্নাথের দ্বার উদ্ঘাটন করেন। তত্পরে আর কেহ মহাপ্রভুর দর্শন পাইলেন না। (শেষখণ্ড, শেষপরিচ্ছেদ,
শেষ)
।"

[ @ - তেড়েট - তেরেট - লেখালেখির কাযে ব্যবহৃত তালপত্রসদৃশ গাছের পাতা বিশেষ যা তালপত্রের চেয়ে
বেশী দীর্ঘস্থায়ী। ]
.
নব্যভারত-এ হারাধন দত্তর চৈতন্যমঙ্গলের নাম-বিভ্রাট নিয়ে উদ্ধৃতি -           পাতার উপরে . . .   
নব্যভারত পত্রিকার ১৩০০ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় (১৮৯৩ সাল), হারাধন দত্তর লেখা ধারাবাহিক প্রবন্ধ
“বঙ্গের বৈষ্ণব কবি”-তে “শ্রীশ্রীঠাকুর ত্রিলোচন দাস” এবং তাঁর শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থের নামকরণ সম্বন্ধে তিনি
লিখেছেন . . .

ঠাকুর ত্রিলোচন দাসের জীবনচরিত অন্য কোন গ্রন্থে নাই। যা আছে তা তাঁহারই কৃত শ্রীচৈতন্যমঙ্গলে ও
দুর্ল্লভসার গ্রন্থে। শ্রীগৌর গণোদ্দেশ দীপিকামতে ইনি ব্রজের শ্রীচন্দ্রশেখরা সখী। . . .

. . . মঙ্গকোটের নিকট কো গ্রামে বৈদ্যকুল সমুদ্ভব কমলাকর দাসের ঔরসে এবং সদানন্দী দেবীর গর্ভে
লোচনের জন্ম হয়। শ্রীসরকার ঠাকুর (নরহরি সরকার) বাল্যকাল হইতেই শ্রীলোচনকে ভাল বাসিতেন এবং
শ্রদ্ধা করিয়া সকল বিষয় শিক্ষা দিতেন। সরকার ঠাকুরের আদেশেই শ্রীলোচন কর্ত্তৃক শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ
লিখিত হয়। যে সময়ে শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আদেশে শ্রীশ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর, শ্রীশ্রীচৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ
লিখিয়াছিলেন, সেই সময়ের কিছু দিন পরেই শ্রীলোচন শ্রীগ্রন্থ লেখেন।

একদা উভয় গ্রন্থ লইয়া শ্রীবৃন্দাবন এবং শ্রীলোচনে যে তর্ক হয়, শ্রীবৃন্দাবনের গর্ভধারিণী শ্রীশ্রীনারায়ণী মধ্যস্থ
হইয়া পরস্পর বিবাদ মিটাইয়া দেন। এবং শ্রীলোচনের মতে মত স্থাপন করিয়া বৃন্দাবন কৃত
শ্রীশ্রীচাতন্যমঙ্গলের মঙ্গল শব্দ রহিত করিয়া “ভাগবত” শব্দ বসাইয়া দেন।

. . . লোচন অল্পবয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু একটী গুরুতর কারণ বশতঃ একদিনও
দাম্পত্যসুখাভিলাষ করেন নাই। ধন্য! তাঁহার প্রতিজ্ঞা এবং তাঁহার বৈরাগ্য
।”
.
দীনেশচন্দ্র সেনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে সতীশচন্দ্র রায়ের উদ্ধৃতি -                  পাতার উপরে . . .   
সতীশচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত ১৯৩১ সালে প্রকাশিত শ্রীশ্রীপদকল্পতরুর ৫ম খণ্ডের ভূমিকার ২০৭-পৃষ্ঠায়,
দীনেশচন্দ্র সেনের উপরোক্ত বক্তব্যের বিরোধিতা করে লিখেছেন . . .

সেন মহাশয়ের এইরূপ মন্তব্যের মূলে একটা মস্ত ভ্রম রহিয়াছে। বৃন্দাবনদাস, কৃষ্দাস কবিরাজ, কিংবা
লোচনদাস, কেহই ইতিহাস লিখিতে যান নাই। প্রতীচ্যের বর্ত্তমান উন্নত ধারণা (Conception) অনুসারে উত্কৃষ্ট
ইতিহাস রচনা করিতে গেলেও শুধু নীরস ঘটনাবলী ও উহাদের কালের বিবরণ লিপি-বদ্ধ করিলে চলে না।
ইতিহাসের নায়কদিগের তরিত্রের সহৃদয়তা-পূর্ণ বিশ্লেষণ ও চিত্রণ ব্যতীত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী অর্থশূন্য
হইয়া পড়ে। চৈতন্যভাগবত প্রভৃতি জীবনচরিত সম্বন্ধে এ কথা যে আরও অনেক অধিক প্রযোজ্য, তাহা বলা
অনাবশ্যক। যদি উক্ত গ্রন্থকারগণ চৈতন্যদেবের প্রতি অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধার দ্বারা প্রণোদিত না হইয়া, কেবল
তাঁহার জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাবলীর নীরস বিবরণ দ্বারাই তাঁহাদিগের গ্রন্থ পূর্ণ করিয়া যাইতেন, তাহা হইলে
আমরা চৈতন্যদেবের জীবনের এক একটা ‘রোজ্নামচা’ না হউক, এক একটা ‘মাস-কাবারী’ বা ‘সাল-তামামী’
পাইতে পারিতাম ; কিন্তু চৈতন্যদেবের যে জীবনচরিত পড়িয়া লক্ষ লক্ষ লোক তাঁহার ভক্ত ও শরণাগত
হইতেছেন, উহা পাওয়া যাইত না। ভাল হউক, মন্দ হউক, সে সময়ে রামকৃষ্ণ-চরিতামৃত গ্রন্থের ন্যায়
রোজ্নামচার ধরণে গ্রন্থ লেখা রীতি ছিল না। জীবনের দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ-সংগ্রহ জীবনচরিতকারগণ
অনাবশ্যক ও অযোগ্য মনে করিয়া, চরিত-নায়কের চরিত্রের আধ্যাত্মিক-ভাবসমূহের প্রদর্শনই প্রধান কর্ত্তব্য
বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন। বৃন্দাবনদাসের আদি-লীলার বর্ণনা সুবিস্তৃত এ উত্কৃষ্ট হইলেও, যে জন্যই হউক,
তিনি চৈতন্যদেবের কিশোরী পত্নী শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সহিত তাঁহার প্রেম-সম্পর্কের কোন ধারণা করিতে
পারেন নাই ; সুতরাং সে প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, এ জন্য তাঁহার উত্কৃষ্ট
গ্রন্থখানার একটা বিশেষ ত্রুটি রহিয়া গিয়াছে। লোচনদাস তাঁহার সহৃদয়তা-জনিত চরিত্রানুমানশক্তির বলে
চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থে সেই গুরুতর ত্রুটির পূরণ করিতে সমর্থ হইয়াছেন। . . .

. . . চৈতন্যভাগবতের আর একটি ত্রুটি ছিল যে, উহাতে শ্রীমহাপ্রভুর আদিলীলার বর্ণনাবসরে শ্রীমতী
বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সম্পর্কে সখী-স্থানীয়া নদিয়া-যুবতীদিগের প্রসঙ্গে-মাত্র বর্জ্জিত হইয়াছে। বলা বাহুল্য যে, যে
শ্রীগৌরাঙ্গে ভূবন-মোহন রূপ-গুণ ও নৃত্য-কীর্ত্তনের প্রভাবে নদিয়ার পাষাণ-হৃদয় পুরুষদিগের চিত্তও বিগলিত
না হইয়া পারে নাই, কোমল-হৃদয়া প্রেমবতী যুবতিদিগের চিত্ত যে উহার দ্বারা একান্ত মোহিত ও প্রেমাধীন
হইয়া পড়িবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। সত্য বটে, শ্রীগৌরাঙ্গ তাঁহার কোনও আচরণ দ্বারা নদীয়া-
নাগরীদিগের সেই প্রেমের প্রতিদান করেন নাই ; কিন্তু তা বলিয়া তাঁহাদিগের সেই স্বার্থ-গন্ধ-হীন
অপূর্ব্ব প্রেমের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। লোচনদাসের গ্রন্থে শ্রীগৌরাঙ্গের বিবাহ-বাসরে সখী-স্থানীয়া
নদিয়া-নাগরীদিগের হাব-ভাব-পূর্ণ প্রেম-ভাব প্রকটনের সরস বর্ণন ও নদিয়া-নাগরীর উক্তি,---

আর শুন্যাছ আলো সই
গোরা-ভাবের কথা।
কোণের ভিতর কুল-বধূ
কান্দ্যা আকুল তথা॥
হলদি বাঁটিতে গোরী
বসিল যতনে।
হলদি-বরণ গোরাচাঁদ
পড়্যা গেল মনে॥
কিসের রান্ধন কিসের বাড়ন
কিসের হলদি বাঁটা।
আঁখির জলে বুক ভিজিল
ভাস্যা গেল পাটা॥---(২১৭৪ সংখ্যক পদ)

ইত্যাদি ধামালী পদের সরস বর্ণন দ্বারা লোচনদাস বৈষ্ণবদাসের (বৃন্দাবনদাস হবে) নদিয়া-লীলা-বর্ণনার সেই
ত্রুটির সুন্দর পূরণ করিয়াছেন। উহা না করিলে, ঐ লীলার একটা মধুর ও করুণ দিক্ সম্পূর্ণ গুপ্ত থাকিয়া
যাইত। এ জন্য সহৃদয় কবি লোচনদাস আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতার পাত্র। সে মহাশয় যে, লোচনদাসের
লেখনীর গতি---“সত্যের পথে ধাবিত হইয়া করুণ ও আদিরসের কুণ্ডে পড়িয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে” বলিয়া
অযথা দোষারোপ করিয়াছেন, সত্য-প্রিয় কোনও সহৃদয় সমালোচকই বোধ হয়, উহার অনুমোদন করিবেন
না
। @

এইখানে স্টার চিহ্ন দিয়ে সতীশচন্দ্র ঐ পাতার পাদটীকায় লিখেছেন . . .

“ @
মহাপ্রভুর সন্ন্যাস-গ্রহণের পূর্ব্ব-রাত্রে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সহিত তাঁহার সপ্রেম আচরণের বর্ণনা বৃন্দাবনের
গ্রন্থে নাই। প্রবাদ আছে যে, ঐ বর্ণনা লোচনদাসের কল্পনাসম্ভুত বলিয়া বৃন্দাবন লোচনের প্রতি দোষারোপ
করিলে, উভয়ের মধ্যে ইহা লইয়া বাগবিতণ্ডা হয়। তখন বৃন্দাবনের মাতা নারায়ণী---যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর
সখী ছিলেন---মধ্যস্থ হইয়া বলেন যে, লোচনের বর্ণনা সম্পূর্ণ সত্য, তাতে কল্পনার লেশমাত্র নাই।---সম্পাদক

(সতীশচন্দ্র রায়, পদকল্পতরু)।
.
লোচনের পদাবলী ও ধামালী নিয়ে সতীশচন্দ্র রায়ের উদ্ধৃতি -                    পাতার উপরে . . .   
সতীশচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত ১৯৩১ সালে প্রকাশিত শ্রীশ্রীপদকল্পতরুর ৫ম খণ্ডের ভূমিকার ২০৯-পৃষ্ঠায়
লিখেছেন . . .

লোচন সুশিক্ষিত ছিলেন না ; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি উচ্চ শ্রেণীর সহৃদয়তা ও কবি-কল্পনার অধিকারী
হইয়াছিলেন। তাঁহার অধিকাংশ পদেই উচ্চ শ্রেণীর কবির উপযুক্ত সরলতা, স্বাভাবিকতা ও  ভাবের   
প্রগাঢ়তা দেখা যায়। তাঁহার “ধামালী”র পদগুলি সমগ্র পদাবলী-সাহিত্যে একটা অপূর্ব্ব বস্তু। কেন না, উহাতে
আমরা সাধু ভাষার পরিবর্ত্তে সরল ও স্বাভাবিক কথ্য ভাষার ব্যবহার দেখিতে পাই। ‘আনন্দে মাতামাতি’
অর্থে ‘ধামালী’ বা ‘ঢামালী’ শব্দ প্রযুক্ত হয়। বোধ হয়, এই ‘ধামাল’ শব্দের সহিত ধ্রুপদ গানের  হোরীর  
ব্যবহৃত ‘ধামাল’ বা ‘ধামার’ তালের যোগ আছে। যাহা হউক, লোচনদাসই যে, প্রথমে ধামালী পদের প্রচলন
করেন, এরূপ মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। পদকল্পতরু ও গৌরপদতরঙ্গিণী গ্রন্থে শুধু লোচনদাসের  
গৌরাঙ্গ-বিষয়ক ‘ধামালী’ পদই সংগৃহীত হইয়াছে ; উহাতে ব্রজলীলার “ধামালী” নাই
।”

সতীশচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত, ১৯২৬ সালে প্রকাশিত, “অপ্রকাশিত পদরত্নাবলী” গ্রন্থে লোচনদাসের  
ব্রজলীলার “ধামালী” পদ সংগ্রহ করে প্রকাশিত করেছেন।
.
লোচনের নাম ও ধামালী পদ নিয়ে জগবন্ধু ভদ্রর উদ্ধৃতি -                        পাতার উপরে . . .   
সতীশচন্দ্র রায় সম্পাদিত ১৯৩১ সালে প্রকাশিত শ্রীশ্রীপদকল্পতরুর ৫ম খণ্ডের ভূমিকার ২০৭-পৃষ্ঠায়
গৌরপদতরঙ্গিণীর সংকলক জগবন্ধু ভদ্রর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আমরা তা এখানে তুলে দিচ্ছি . . .

জগবন্ধু ভদ্র লিখিয়াছেন,--- চৈতন্যমঙ্গল রচনার পর ইঁহাকে লোকে ‘সুলোচন’ ও ‘লোচনানন্দ’ বলিতেন।
লোচনকৃত ‘ধামালী’ পদ সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ, এই জন্য কেহ কেহ লোচনকে ‘ব্রজের বড়াই’ বলিয়া ডাকিতেন।
লোচনদাস মুরারি গুপ্তের করচা অবলম্বনে চৈতন্যমঙ্গলের আদী-লীলা বর্ণন করেন। চৈতন্যমঙ্গলের আদি-
লীলাকে উক্ত করচার অনুবাদ বলিলে নিতান্ত অসঙ্গত হয় না। শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন বলেন,
তিনি ‘আহ্লাদে’ ছেলে বলিয়া সম্ভবতঃ বিশেষ প্রহার সহ্য করিয়া বাল্যাতিক্রান্তে অক্ষর চিনিয়াছিলেন, তিনি
চতুর্দশ বর্ষ বয়ঃক্রমে চৈতন্য মঙ্গলের ন্যায় এত বড় ও সুন্দর গ্রন্থখানি রচনা করেন, বৈষ্ণবগণ-কথিত এই
বিবরণে সম্পূর্ণ আস্থা হয় না। বৈষ্ণবসমাজে এ পুস্তকখানি বিশেষ আদৃত, কিন্তু চৈতন্যভাগবত ও
চৈতন্যচরিতামৃতের ন্যায় প্রামাণিক বলিয়া গণ্য নহে
।”
.
লোচনদাস নিয়ে দুর্গাদাস লাহিড়ীর উদ্ধৃতি -                                          পাতার উপরে . . .   
দুর্গাদাস লাহিড়ী ১৯০৫ সালে প্রকাশিত, তাঁর সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন  “বৈষ্ণব-পদলহরী”  
সংকলনের ৫৪৯-পৃষ্ঠায় লোচনদাস সম্বন্ধে লিখেছেন . . .

“লোচনদাস একজন প্রসিদ্ধ পদকর্ত্তা। “চৈতন্য মঙ্গল” প্রণয়ন করিয়া ইনি বৈষ্ণব সাহিত্যে অক্ষর স্মৃতি রাখিয়া
গিয়াছেন। “চৈতন্য প্রেম বিলাস” ও “দুর্লভ সার” প্রভৃতি ইহার আরও কয়েকখানি গ্রন্থ আছে। ৯৩০ সালে  
ইহার জন্ম হয়। ১০১৫ সালে তাঁহার তিরোভাব হয়। বৈদ্য বংশে ইহাঁর জন্ম। পিতার নাম  কমলাকর,  
মাতার নাম সদানন্দী। বর্দ্ধমান জেলার কো গ্রামে ইহাঁর জন্ম হয়।”
.
লোচনদাসের দাম্পত্য জীবন নিয়ে মৃণালকান্তি ঘোষের উদ্ধৃতি -                  পাতার উপরে . . .   
এই বিষয়ে মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁর সম্পাদিত ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত, জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত “শ্রীগৌরপদ-
তরঙ্গিণী” পদ-সংকলনে লোচন দাসের পরিচয়ে, ২৪২-পৃষ্ঠায় লিখেছেন . . .

আমোদপুর কাকুটে গ্রামে অতি অল্প বয়সে লোচনের বিবাহ হয়। ইহার পরে তিনি খণ্জবাসী শ্রীনরহরি  
সরকার-ঠাকুরের শ্রীচরণ আশ্রয় করেন। নরহরি ঠাকুর শ্রীগৌরাঙ্গের পার্ষদ ও অন্তরঙ্গ ভক্ত ছিলেন। তিনি
নাগরীভাবে গৌরভজন করিতেন। লোচনকেও তিনি সেই ভাবেই উপদেশ প্রদান করেন। কাজেই লোচনও
গৌররসে মাতোয়ারা হইয়া সংসার ধর্ম্ম একেবারে বিস্মৃত হয়েন। বিবাহের পরে তিনি আর শ্বশুরালয়ে যান
নাই। এদিকে তাঁহার স্ত্রী বয়ঃস্থা হইলে, তাঁহার শ্বশুরবাটীর লোকেরা আসিয়া নরহরি সরকারকে সমস্ত কথা
জানাইলেন। ইহা শুনিয়া নরহরি লোচনকে শ্বশুরবাড়ী যাইতে আদেশ করিলেন। তখন লোচন  অশ্রুপূর্ণ   
লোচনে গুরুদেবের নিকট প্রার্থনা করিলেন, “ঠাকুর, আমার মনোবাঞ্ছা যেন পূর্ণ হয়।” নরহরি লোচনকে   
আলিঙ্গনপূর্ব্বক একটু হাসিয়া বলিলেন, “লোচন তুমি নির্ভয়ে গমন কর, প্রভু তোমার মনোবাঞ্ছা নিশ্চয় পূর্ণ
করিবেন।”

লোচন বহুকাল পরে এই প্রথম শ্বশুরালয়ে গেলেন। গ্রামের কোন্ স্থানে তাঁহার শ্বশুরালয়, তাহা তখন ভুলিয়া
গিয়াছিলেন। গ্রামে প্রবেশ করিয়া তিনি একটি নবীনা যুবতীকে দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে মাতৃসম্বোধন করিয়া
শ্বশুরবাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। এই যুবতী লোচনের স্ত্রী। শ্বশুরালয়ে যাইয়া স্ত্রীর সাথা সাক্ষাত হইলে  
লোচন সমস্ত বুঝিতে পারিলেন। তখন স্ত্রীকে বলিলেন যে, তাঁহার সংসার-ধর্ম্ম করিতে ইচ্ছা নাই। স্ত্রী কাতর
হইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। লোচন তখন নরহরির শক্তিতে শক্তিমান্ হইয়াছেন। তিনি স্বীয় পত্নী প্রতি
সেই শক্তি সঞ্চার করিলেন। ইহাতে তাঁহার যুবতী স্ত্রীর মনও নির্ম্মল হইয়া গেল। তখন লোচন তাঁহার  
ভার্য্যাকে বলিলেন, “তোমাকে আমি কখনও বিস্মৃত হইব না ; তুমি নিয়ত আমার হৃদয়কন্দরে বাস করিবে,
এবং ইচ্ছা করিলে আমার সঙ্গলাভও করিতে পারিবে। তখন আমরা দুই জনে একত্রে শ্রীগৌরাঙ্গের গুণগান
করিয়া অপ্রাকৃত সুখ লাভ করিব।” লোচন শ্বশুরালয় হইতে শ্রীখণ্ডে আসিয়া শ্রীনরহরি ঠাকুরকে সমস্ত কথা
জানাইলেন। তিনি ইহাতে আনন্দিত হইয়া লোচনকে আলিঙ্গন করিলেন
।”
.
লোচনদাসের শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনা নিয়ে মৃণালকান্তি ঘোষের উদ্ধৃতি -          পাতার উপরে . . .   
মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁর সম্পাদিত ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত, জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত “শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিণী” পদ-
সংকলনে, উপরোক্ত উদ্ধৃতির পরেই লিখেছেন . . .

এই সময়ে বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইহা পাঠ করিয়া নরহরির আশা মিটে নাই।
যেহেতু তাহাতে নাগরীভাবে গৌরাঙ্গ-ভজনের কথা বর্ণিত হয় নাই। নরহরির পরিচর্য্যায় লোচন তখন  
বড়ডাঙ্গায় নিযুক্ত। সেই সময়ে বটপত্রে ঝাঁটার কাটি দিয়া লোচন পদ লিখিতেন। এই সকল পদ পাঠ করিয়া
নরহরি সন্তুষ্ট হইলেন ; তিনি বুঝুলেন, এতদিনে লোচনের দ্বারা তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। তাই তিনি  
লোচনকে গৌর-লীলা লিখিবার জন্য আদেশ করিলেন।

ঠাকুর নরহরি, লোচনকে স্বীয় বাসস্থান কো-গ্রামে গিয়া শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনা করিতে আদেশ দিলেন। নিজের
কাছে না কখিয়া কো-গ্রামে যাইয়া গ্রন্থ রচনা করিতে কেন বলিলেন, তত্সম্বন্ধে ইহাই মনে হয় যে, অন্তরঙ্গ
প্রিয়জনের সঙ্গ ব্যতীত মধুর-রসের পুষ্টিসাধন হয় না। নরহরি বুঝিয়াছিলেন, লোচনের সহধর্ম্মিণী প্রকৃতই  
তদ্গতপ্রাণা হইয়াছেন, এবং লোচনেরও এরূপ স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ অতি স্বাভাবিক। কাজেই এরুপ  মর্ম্ম-
সঙ্গিনীর প্রভাবে লোচনের রচনা সরস ও মর্ম্মস্পর্শী হইবে বলিয়া তিনি বিশ্বাস করিয়াছিলেন।

শুনা যায়, লোচন তাঁহার বাড়ীর নিকট একটি ফুলগাছতলায় একখানি পাথরের উপর বসিয়া  তেড়েটের  
পাতায় শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন। শ্রীচৈতন্যমঙ্গলের মঙ্গলাচরণ ও বন্দনা শেষ  করিয়া  
লোচন গ্রন্থারম্ভ করিবার সময় আপন সহধর্ম্মিণীকে সম্মবোধন করিয়া বলিলেন, “আমার প্রাণভার্য্যা! নিবেদোঁ
নিবেদোঁ নিজ কথা। আশীর্ব্বাদ মাগোঁ, যত যত মহাভাগ, তবে গাব গোরাগুণ-গাথা॥” তাঁহাদের উভয়ের মধ্যে
কিরূপ গাঢ় প্রীতি ছিল, তাহা এই ঘটনা হইতে জানা যায়। লোচন প্রাণের ভার্য্যাকে সঙ্গিণীরূপে পাইয়াছিলেন
বলিয়াই তাঁহার চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ এরূপ প্রাণস্পর্শী ভাবে ও ভাষায় রচনা করিতে পারিয়াছিলেন
।”
.
রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের উদ্ধৃতি -                                               পাতার উপরে . . .   
রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর ১৯৫৩ সালে সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “শ্রীপদামৃতমাধুরী” ৪র্থ খণ্ডের
ভূমিকায় মহাজনদের পরিচয়ের অন্তর্গত লোচন দাসের পরিচয়তে লিখেছেন . . .

লোচন দাস বর্দ্ধমান জেলার গুষ্করা স্টেশনের নিকট কোগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। লোচন অল্পবয়সেই শ্রীখণ্ডের
নরহরি সরকার ঠাকুরের কৃপালাভ করেন:

প্রাণের ঠাকুর মোর নরহরি দাস।
তার পদ প্রসাদে এ পথের প্রতি আশ। চৈতন্যমঙ্গল (শেষ খণ্ড)।

সরকার ঠাকুরের আদেশেই তিনি চৈতন্যমঙ্গল রচনা করেন। লোচনের গ্রন্থ চৈতন্যভাগবত বা  
চৈতন্যচরিতামৃতের ন্যায় ঐতিহাসিকতাসমৃদ্ধ না হইতে পারে, কিন্তু মধুর কবিত্বসম্পদে চরিতদ্রন্থের  মধ্যে
ইহা সর্বাপেক্ষা উত্কৃষ্ট বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। লোচন দাসের ধামালী পদগুলি বৈষ্ণব সাহিত্যে এক নূতন
ধারা প্রবর্ত্তন করে। নদীয়া নাগরীভাবে শ্রীগৌরাঙ্গের আস্বাদন এই পদগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রায় সাড়ে  
চারিশত বত্সর পূর্ব্বে বাঙ্গালীর চলিত ভাষা কিরূপ শক্তিশালী ছিল, তাহা লোচন দাসের ধামালী হইতে  
বুঝিতে পারা যায়।

ঠার ঠম্ কা কাঁকাল বাঁকা মধুর মন্দ হাসি।
রূপ দেখিয়া জাতি কুল হারাই হারাই বাসি॥

লোচনের গুরু নরহরি সরকার ঠাকুর ও বাসুদেব ঘোষ হইতে এই নাগরীভাবের কবিতার আবির্ভাব এইরূপ
মনে হয়। ইঁহারা আপনাদিগকে নদীয়ানাগরী কল্পনা করিয়া শ্রীচৈতন্যের রূপগুণ ও চরিত্র মাধুর্য আস্বাদন  
করিয়াছেন
।”
.
প্রিয়নাথ জানার উদ্ধৃতি -                                                                 পাতার উপরে . . .   
প্রিয়নাথ জানা তাঁর সম্পাদিত, ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত, বঙ্গীয় জীবনীকোষ, ১ম খণ্ড-এ লোচনের জীবনীতে
লিখেছেন . . .

লোচন (ত্রিলোচন, সুলোচন বা লোচনানন্দ) দাস --- লোচন দাস ১৪৪৫ শকে বা ১৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার
কোগ্রামে বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কমলাকর দাস, মাতা সদানন্দী। মাতামহ পুরুষোত্তম
গুপ্তের নিকট শিক্ষালাভ করেন। বিবাহিত হলেও পত্নীকে কেবলমাত্র সাধন সঙ্গিণী হিসাবে দেখেছেন।  
শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার ছিলেন লোচনের দীক্ষাগুরু। রামগোপালদাস রসিকদাসের শাখানির্ণয়ে আছে যে  
গুরুর জন্য লোচন দাস নিজেকে ফিরিঙ্গি (অর্থাৎ পর্তুগীজ) বণিকের কাছে জামিন রেখেছিলেন। লোচনদাসের
রচিত গ্রন্থের নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল ’---শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের জীবনচরিত। ইহা মুরারি গুপ্তের কড়চার অনুসরণে  
রচিত।কথিত আছে, তিনি ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর গুরু নরহরি সরকারের আদেশে এই গ্রন্থ রচনা করেন।  
কোগ্রামের নিকটবর্তী বিখ্যাত চৈতন্যমঙ্গল গায়ক প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীর বাড়ীতে লোচনের স্বহস্ত-লিখিত   
চৈতন্যমঙ্গল আছে। লোচন যে প্রস্তরখণ্ডের উপর বসে চৈতন্যমঙ্গল লিখেছিলেন, তা এখনো আছে।  লোচন  
দাস আনুমানিক ১৫৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তিরোহিত হন। ইনি কতকগুলি বৈষ্ণবতত্ত্ববিষয়ক পুস্তিকা রচনা  
করেছিলেন। যেমন, ‘দুর্লভসার’, ‘চৈতন্যবিলাস’, ‘বস্তুতত্ত্বসার’, ‘আনন্দলতিকা’ ইত্যাদি। ষোড়শ
শতকের  শ্রেষ্ঠ পদকর্তাদের মধ্যে লোচন দাস অন্যতম
।”
.
সুকুমার সেনের উদ্ধৃতি -                                                                 পাতার উপরে . . .   
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত,  সুকুমার সেন সংকলিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”-র  পরিচায়িকা-
তে, ৮৯-পৃষ্ঠায় লোচনদাস সম্বন্ধে লিখেছেন . . .

"
লোচনদাসের পূর্ণনাম ত্রিলোচন দাস। ইনি শ্রীখণ্ডের নরহরি দাস সরকার ঠাকুরের শিষ্য ছিলেন। এঁর রচিত
‘চৈতন্যমঙ্গল’ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত গীত হত। লোচন অনেক পদাবলী রচনা করেছিলেন। তার
মধ্যে কতগুলি মেয়েলি ছাঁদে কথ্য ভাষায়  ও ছড়ার ছন্দে লেখা। এই হিসেবে সমসাময়িক কবিদের তুলনায়
লোচন অনেক অগ্রসর ছিলেন। লোচনের লেখা ‘রাগাত্মিত’ অর্থাৎ মিষ্টিক পদাবলীও আছে। লোচনের অনেক
গানের মতো ১৯ সংখ্যক গানটিও @ চণ্ডীদাসের নামে চলিত ছিল
।"

@ - উক্ত গ্রন্থের উল্লিখিত ১৯ সংখ্যক গানটি হলো “সজনি ও ধনি কে কহ বটে”। এই পদটি “চণ্ডীদাসের
ভণিতায়”, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত, দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব  
পদসঙ্কলন”-এ রয়েছে, যা আমরা এখানে লোচনদাসের ভণিতাযুক্ত পদের সঙ্গে তুলে দিয়েছি।
.
শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনার ৩টি উদ্দেশ্য নিয়ে বিমানবিহারী মজুমদারের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .   
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান” গ্রন্থে, বিমান বিহারী মজুমদার লোচন দাসের  
“শ্রীচৈতন্যমঙ্গল” গ্রন্থের নানা দিক নিয়ে বিষদ আলোচনা করেছেন। প্রথমত তাঁর মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল
১৫৬০ থেকে ১৫৬৬ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। কি উদ্দেশ্য নিয়ে লোচন দাস চৈতন্যমঙ্গল রচনা করেছিলেন সেই বিষয়ে
তাঁর লেখা থেকে আমরা কয়েকটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি . . .

তিনি ২৫৭-পৃষ্ঠায় লিখেছেন . . .
লোচনদাস বলিয়াছেন যে মুরারি গুপ্তের সংস্কৃতে লিখিত শ্রীচৈতন্যচরিত পাঠ করিয়া পাঁচালী-প্রবন্ধে চৈতন্য-
লীলা লিখিবার লোভ তাঁহার মনে জাগিয়াছিল। তাই তিনি চৈতন্যমঙ্গল লিখিলেন। কিন্তু একমাত্র সংস্কৃত
গ্রন্থের স্বাধীন অনুবাদ করিয়া জনসাধারণকে শ্রীচৈতন্যলীলা শুনানই তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। লোচন
স্পষ্ট করিয়া না বলিলেও, তাঁহার গ্রন্থ-পাঠে মনে হয় যে, শ্রীচৈতন্যমঙ্গল লেখায় তাঁহার আরও তিনটি উদ্দেশ্য
ছিল।

প্রথমতঃ, তাঁহার গুরু নরহরি সরকারের সহিত বিশ্বম্ভরের ঘনিষ্ঠতার পরিচয় দেওয়া। দ্বিতীয়তঃ,
নরহরিকে পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে স্থান দেওয়া। তৃতীয়তঃ, নাগরীভাবের উপাসনাকে জনপ্রিয় করা।

পূর্ব্বে দেখাইয়াছি যে নবদ্বীপ-লীলা-প্রসঙ্গে লোচন ব্যতীত অন্য কোন চরিতকার নরহরির  নাম করেন নাই।
তাঁহাদের এই ত্রুটি সংশোধন করা লোচনের অভিপ্রায় ছিল। তিনি নবদ্বীপলীলা-বর্ণনা উপলক্ষে বহুস্থানে
নরহরির উপস্থিতি ও তাঁহার প্রতি বিশ্বম্ভরের প্রীতির কথা লিখিয়াছেন
।” . . .

২৫৮-পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন . . .
লোচন নবদ্বীপ-লীলা বর্ণনা করিতে যাইয়া নরহরি-সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলিয়াছেন, তাহা অন্য কোন লীলা-
গ্রন্থে পাওয়া যায় না।” . . .

২৬০-পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন . . .
“শ্রীচৈতন্যমঙ্গল লিখিবার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হইতেছে নরহরিকে পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে স্থান দেওয়া। স্বরূপ-দামোদর
তত্ত্বনিরূপণে বলিয়াছেন যে গৌরচন্দ্র, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, শ্রিনিবাস ও গদাধর পণ্ডিত এই পাঁচ জনকে লইয়া
পঞ্চতত্ত্ব। কবিকর্ণপুর গৌরগণোদ্দেশ-দীপিকায় স্বরূপ-দামোদরের নাম উল্লেখ করিয়া তাঁহার মতানুসারে
পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ইহার মধ্যে নরহরির স্থান নাই। লোচন স্পষ্টতঃ স্বরূপ-দামোদরের মতের
বিরুদ্ধে যাইতে সাহসী না হইলেও প্রকারান্তরে অন্যভাবে পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তিনি
মঙ্গলাচরনাংশে ও অন্যান্য স্থানে লিখিয়াছেন---
জয় জয় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নিত্যানন্দ।
জয়াদ্বৈত চন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ॥
জয় নরহরি গদাধর প্রাণনাথ।
কৃপা করি কর প্রভু শুভদৃষ্টিপাত॥ ---সূত্রখণ্ড  

পুনশ্চ আদিখণ্ডের প্রথমেই---
জয় জয় গদাধর গৌরাঙ্গ নরহরি।
জয় জয় নিত্যানন্দ সর্ব্বশক্তিধারী॥
জয় জয় অদ্বৈত আচার্য্য মহেশ্বর।
জয় জয় গৌরাঙ্গের ভক্ত মহাবর॥

এই বন্দনায় শ্রীনিবাস বা শ্রীবাস প্রধান স্থান হইতে চ্যুত হইয়াছেন, এবং সেই স্থান নরহরি অধিকার  
করিয়াছেন।” . . .

২৬১-পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন . . .
শ্রীচৈতন্যমঙ্গল-রচনার তৃতীয় উদ্দেশ্য ছিল নাগরীভাবের উপাসনা-পদ্ধতি প্রচলন করা। বৃন্দাবনদাস  
লিখিয়াছেন---
অতএব মহামহিম সকলে।
গৌরাঙ্গ নাগর হেন স্তব নাহি বলে॥

কিন্তু লোচন দাস লীলাবর্ণনা-উপলক্ষে সুযোগমত গৌরাঙ্গের নাগরভাব করিয়াছেন। গৌরাঙ্গের  রূপগুণ  
দেখিয়া নদীয়া-নাগরীরা তাঁহাকে দেহমন সমর্পণ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন ; গৌরাঙ্গ ক্কচিৎ কদাচিৎ
তাঁহাদের ভাবের প্রতিদান দিতেছেন, ইহাই হইতেছে লোচনের অঙ্কিত নাগরীভাবের উপাসনার মূল সূত্র।  
লোচনের মতে নিমাইয়ের জন্ম-সময় হইতেই নাগরীভাবের আরম্ভ হইয়াছে।

গৌর নাগরিয়া গন্ধে ভরিল ব্রহ্মাণ্ড।
প্রতি অঙ্গে রসরাশি অমৃত অখণ্ড॥---আদিখণ্ড

নবজাত শিশুর বর্ণনায় লোচন লিখিয়াছেন---
বিশাল নিতম্ব উরু কদলীর যেন।---ঐ

এই শিশু দেখিয়া নদীয়া-নাগরীদের অলসল অঙ্গ সভার শ্লথ নীবিবন্ধ। এরূপ বর্ণনা করিতে যাইয়া লোচন
সাধারণ ও ঐতিহাসিক বুদ্ধির সীমা উল্লঙ্ঘন করিয়াছেন। বিশ্বম্ভরের প্রথম বিবাহে জল সাধার সময়ের
বর্ণনা---

গৌরাঙ্গের নয়ন-সন্ধান শরঘাতে।
মানিনীর মান-মৃগ পলায় বিপথে॥
অথির নাগরীগণ শিথিল বসন।
মাতল ভূজঙ্গকুল খগেন্দ্র যেমন॥

অঙ্গ-উদ্বর্ত্তনের সময়ে পুরনারীদের---

হেরইতে পহুমুখ কি ভাব উঠিল।
মরমে মদনজ্বরে ঢলিয়া পড়িল॥
কেহ কেহ বাহু ধরি অথির হইয়া।
কেহো রহে উদ্বর্ত্তন শ্রীঅঙ্গে লেপিয়া॥
কেহে বুকে পদযুগ ধরিয়া আনন্দে।
ভুজলতা দিয়া সে বান্ধিল পরবন্ধে॥---আদি

বাসরঘরে কুলবধূদের---

বসন বচন সব স্খলিত হইল।
নয়ান অলসযুত কাহারো হইল॥
কেহ অঙ্গ পরশে অনঙ্গ-রঙ্গভরে।
ঢুলিয়া পড়িলা রসে বিশ্বম্ভর-কোলে॥---ঐ

বিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহের সময়ে---

পরম সুন্দরী যত        সভে হৈল উনমত
.        বেকত মনের নাহি কথা।
রসে রসে আবেশে        লোলিপরে গোরা পাশে
.        গর গর কামে উনমতা॥---ঐ

নদীয়া-নাগরী ভাব লইয়া পচিত ১৮০টি পদ গৌরপদতরঙ্গিণীতে প্রকাশিত হইয়াছে। তাহার মধ্যে সকলগুলি
যে প্রাচীন পদকর্ত্তাদের রচিত তাহা নহে। তবে অনেকগুলি পদ বাসুঘোষ, নরহরি সরকার, শেখর প্রভৃতি
মহাজনের রচিত সন্দেহ নাই। নাগরী-ভাবের উপাসনা নরহরি প্রবর্ত্তন করিয়াছেন ; লোচনদাস তাহা প্রচার
করিবার উদ্দেশ্যে শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনা করেন
।”
.
বিমানবিহারী মজুমদারের নাগরীভাবের ব্যাখ্যা -                                   পাতার উপরে . . .   
বিমানবিহারী মজুমদার তাঁর “শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান” গ্রন্থের ২৬২-পৃষ্ঠায় আরও লিখেছেন . . .

গৌরপদতরঙ্গিণীর ভূমিকায় জগবন্ধু ভদ্র মহাশয় “গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকার” ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত  
রাজীবলোচন দাসের এক প্রবন্ধ উদ্ধার করিয়া নাগরীভাবের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। দাস মহাশয় লিখিয়াছিলেন
“গৌরাঙ্গ না দেখিলে নাগরীদের প্রাণ ছটফট করে, আনচান করে; এমন কি তাঁহারা সোয়াস্তি পান না।   
গৌরহরি কিন্তু নারীদের পানে অপাঙ্গদৃষ্টিও করেন না। নাগরীসমূহ গৌরাঙ্গকে দেখিয়াই সুখী।  গৌর   
নাগরীদের পানে চান, আদপে তাঁহাদের মনে ভ্রমেও এ বাসনার ছায়াপাত হয় নাই। ইহাই নাগরীভাবের গূঢ়  
রহস্য” ( গৌরপদতরঙ্গিণী, ১ সং, উপক্রমণিকা, পৃ. ১৫৭ )। এই ব্যাখ্যা ব্যাখ্যা লোচনের নাগরীভাব-সম্বন্ধে  
সত্য নহে ; কেন-না লোচনের মতে গৌরাঙ্গ “নয়ন সন্ধান শরাঘাত” করেন ; যুবতীরা তাঁহার পদযুগে নিজেদের
বুক দিলে এবং তাঁহাকে ভূজলতা দিয়া বান্ধিলে বা তাঁহার কোলে ঢলিয়া পড়িলে তিনি বাধা দেন না
।”
.
চৈতন্যমঙ্গলের রচনাকাল সুখময় মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি -                         পাতার উপরে . . .   
১৯৫৮ সালে প্রকাশিত, সুখময় মুখোপাধ্যায় রচিত "প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের কালক্রম"-এর ১৮৩-পৃষ্ঠায়
লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলের রচনাকাল সম্বন্ধে লিখেছেন . . .

লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলকে মৌলিক গ্রন্থ বলা যায় কি না সন্দেহ। কারণ প্রায় বারো আনা অংশই মুরারি
গুপ্তের গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ। লোচনদাসের সংযোজিত অংশগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সন্দেহের অতীত
নয়।

“লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলের আনুমানিক রচনাকাল সিথির করা খুব কঠিন নয়। তাঁর গুরু ছিলেন   
চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ নরহরি সরকার। এই নরহরি চৈতন্যদেবের জন্মের আগেই ব্রজরস গান   
করেছিলেন বলে রায়শেখরের নামাঙ্কিত পদে পাওয়া যায়। যাহোক্, ১৫৫০ খৃষ্টাব্দের পরে নরহরি সকরার  
জীবিত ছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর শিষ্য লোচনদাসের জন্ম ১৫৩০ খৃষ্টাব্দের পরে নিশ্চয়ই হয়নি।  
সুতরাং তাঁর গ্রন্থরচনাকাল ১৬০০খৃঃর পরবর্তী নয়। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল রচনার সময় বৃন্দাবনদাসের
চৈতন্যবাগবত অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, কেননা চৈতন্যমঙ্গে আছে,

বৃন্দাবনদাস বন্দিব একচিতে। জগৎ মোহিত যার ভাহবত গীতে॥

সুতরাং বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত রচনার পরে অন্ততঃ এক পুরুষ অতিক্রান্ত হবার পরে লোচনদাসের  
চৈতন্যমঙ্গল রচিত হয়েছিল বলে মনে হয়। বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত ১৫৩৮ থেকে ১৫৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে
রচিত হয়েছিল বলে আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি। সুতরাং লোচনদাসের গ্রন্থের রচনাকালের ঊর্ধ্বতম সীমা
হয় ১৫৬০ খৃঃ
।”
.
লোচন সম্বন্ধে নীলরতন সেনের উদ্ধৃতি -                                               পাতার উপরে . . .   
নীলরতন সেন তাঁর ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয় গ্রন্থের ২৭২-পৃষ্ঠায় লোচন দাস সম্বন্ধে
লিখেছেন . . .

চৈতন্যমঙ্গল নামক চৈতন্য-জীবনী কাব্যের লেখকই সম্ভবতঃ ধামালী ছন্দে (লৌকিক দলবৃত্ত)  রচিত   
সুপরিচিত পদাবলী গানের রচয়িতা। বিষয়গত আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যে দেখা যায়, চৈতন্য-জীবনীকার লোচনদাস
চৈতন্যের নাগরী ভাব-লীলার যে ছবি অঙ্কিত করেছেন পদগুলিতে অনুরূপ লীলাচিত্রণ আরও স্পষ্ট ভাবে  
রয়েছে। চৈতন্যমঙ্গল থেকে লোচনের আত্মপরিচয়ে জানা যায় তিনি কোগ্রাম নিবাসী বৈদ্যবংশজ কমলাকর
দাস ও সদানন্দীর পুত্র, শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারের শিষ্য। সম্ভবতঃ ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় পাদে
লোচনদাস বৈষ্ণব সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

লোচন তাঁর চৈতন্যমঙ্গল লিখেছিলেন পাঁচালী গানের উদ্দেশ্যে আর দলবৃত্ত রীতির জনপ্রিয়  পদগুলি   
করেছিলেন ধামালীগানের উদ্দেশ্যে। শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বৈষ্ণব পদাবলী সংকলনে তাঁর ৫৮টি  গান   
সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এই পদগুলির মধ্যে গৌরাঙ্গের বিভিন্ন লীলা, বিষ্ণুপ্রিয়ার দ্বাদশবিরহ (ছোট ছোট  
পয়ার বন্ধের ষট্ পংক্তিক বারোটি পদ), নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত বন্দনা, রাধা কৃষ্ণের পূর্বরাগ, অভিসার, মান,  
আক্ষেপানুরাগ ও রসোদ্গারের পদ রয়েছে। ধামালী গানে দলবৃত্ত ছন্দ, বাকী পদগুলি অক্ষরবৃত্ত পয়ার  
ত্রিপদীতে রচিত।

লোচন গ্রাম্য শব্দব্যবহারে এবং কথ্য বাকরীতিতে অন্য পদকারদের তুলনায় সংস্কৃতানুগ বর্ণনাভঙ্গি  
বহুলাংশে কাটিয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পদ পড়তে গেলে অনেক স্বাভাবিক সজীব গ্রাম-বাংলার মানুষের  
কণ্ঠস্বর যেন শুনতে পাওয়া যায়। সেটা কিছুটা হয়তো অমার্জিত, কিন্তু প্রাণের স্পর্শ মাখানো

.
.
লোচনদাসের কবিত্ব নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্ধৃতি -                              পাতার উপরে . . .   
দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থের ১ম সংস্করণে “লোচনদাসের
চৈতন্যমঙ্গল” প্রসঙ্গে ২০০-পৃষ্ঠায় লিখেছেন . . .

লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলের ঐতিহাসিক মূল্য সামান্য হইলেও উহা একেবারে নির্গুণ নহে ; ৩০০ বত্সরকাল
যাহা লুপ্ত হয় নাই, সে সামগ্রীর অবশ্যই আয়ুবল আছে। চৈতন্যমঙ্গলের রচনা বড় সুন্দর। লোচনদাসের
লেখনী ইতিহাস লিখিতে অগ্রসর হইয়াছিল কিন্তু তাহার গতি কবিত্বের ফুলপল্লবে রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, তাহা
সত্যের পথে ধাবিত হইয়া করুণ ও আদিরসের কুণ্ডে পড়িয়া লক্ষ ভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে ; বৃন্দাবনদাসের
সাদাসিদা রচনায় কিম্বা কৃষ্ণদাস কবিরাজের নানাভাষামিশ্রিত জটীল লেখায় কবিত্বের ঘ্রাণ নাই ; এই দুই
পুস্তক ইতিহাসের নিবিড় বন, প্রত্নতত্ত্ববিৎ ও বৈষ্ণব ভিন্ন অপর কেহ ধৈর্য্যসহ এই ঘোর অরণ্য পর্য্যটনশ্রম
স্বীকার করিবেন না ; কিন্তু লোচনের চৈতন্যমঙ্গলের অনেক স্থলে কবিত্বের সৌন্দর্য্য আছে ; ইতিহাসের
রেখাঙ্কিত প্রস্তরখণ্ডের নিস্ফল খোঁজে পাঠক বিরক্ত হইলে পথে পথে মাধবী ও কুন্দকুসুম কথঞ্চিৎ পরিমাণে
তাঁহার শ্রম অপনোদনে সাহায্য করিবে
।”

সতীশচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত শ্রীশ্রীপদকল্পতরুর ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেনের উপরোক্ত মন্তব্যের বিরোধিতা
করেছেন। সেই উদ্ধৃতি পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . .
.
নব্যভারত-এ হারাধন দত্তর লোচনদাসের বিভিন্ন নাম নিয়ে উদ্ধৃতি -         পাতার উপরে . . .   
নব্যভারত পত্রিকার ১৩০০ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় (১৮৯৩ সাল), হারাধন দত্তর লেখা ধারাবাহিক প্রবন্ধ
“বঙ্গের বৈষ্ণব কবি”-তে লোচন দাসের বিভিন্ন নাম সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন . . .

শ্রীলোচনের পিতা মাতা কর্ত্তৃক রক্ষিত নাম শ্রীত্রিলোচন, পরন্তু লোচনের অজ্ঞকালে পাড়াপড়সী সকলে (ত্রি)
শব্দ লোপ করিয়া ফেলা নামে লোচন বলিয়া ডাকিত। ক্রমে সেই নাম প্রকাশ হইয়া পড়ে। পশ্চাৎ লোচন
যখন শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ লিখিয়া প্রকাশ করিলেন, সেই সময়ে তাঁহাকে প্রাজ্ঞ জানিয়া সকলে আহ্লাদের সহিত
কেহ সুলোচ, কেহ বা লোচনানন্দ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ইহাই লোচনের নাম পরিবর্তন হইবার কারণ
।”
.
*

এই পাতার উপরে . . .
*

এই পাতার উপরে . . .
*

এই পাতার উপরে . . .
*

এই পাতার উপরে . . .