কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কবিতা
*
পুরাণো চিঠির ফাইল
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা”  
কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | ১৯১৯ সালে প্রকাশিত “রজনীগন্ধা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


এটা বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠি মুছে গেছে আঁখরগুলা যত,
রঙটি রাঙা তেমনি আছে লেগে অতীত বিয়ের পাক্ চূণারি মত |


এ যে বড়ই গরম গোছের চিঠি চেয়েছে কার সাতাশ টাকা বাকি
কাট্ ঠোক্ রা কোথায় গেছে উড়ি নীরস শাখায় ঠোকর কটা রাখি |


এখান যে হায় আনন্দেরি লিপি পরীক্ষাতে প্রথম পাশের খবর
লাভের চেয়ে আনন্দটাই বেশী কাঁকুর চেয়ে বীজটা তাহার জবর |


এ কি এ যে আদালতের শমন মুড়কি সাথে বোলতা কেন হেরি
সাপ গিয়েছে খোলসখানা রাখি ফুলে এ ছুঁচ মিশলো কেমন করি |


এ চিঠিটা লিখেছে বাড়ীর ছেলে ইষ্টাসিনে পাঠিয়ে দিতে গাড়ী
ছেলের এখন বহুত ছেলেপুলে ঠাকুরদাদা চিনতে তাঁরে পারি |


এখানা এক ঔষধেরি লিপি আসতেছে এঁক ঔষধালয় হতে
কাল করেছে পাঁচটি টাকা ভি পি অনুরোধটা শীঘ্র সেটায় নিতে |


এখানা এক আত্মীয়েরি টিঠি চেয়েছে হায় ত্রিশটি টাকা ধার
দেখছি তাহার শীর্ণ হাতের পাতা পাওয়ার কোনো খবর নাহি আর |


কোনটি ছেঁড়া শোকের খবর এটি অতীত ভোলা সুদূর বুকের ব্যথা,
ছেলের গলায় সোণার হারের সাথে কেন রে এই বাঘের নখ গাঁথা |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
তৈজসের ইতিহাস
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা”  
কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | ১৯১৯ সালে প্রকাশিত “রজনীগন্ধা” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


এই থালাখান দাদুর বিয়ের দানের সময় পাওয়া,
ওর উপর কর্ত্তা-মায়ের বিশেষ ছিল দাওয়া,
পড়লে কারো হাত হ’তে ও, সইত নাকো তাঁর,
তোরঙ খুলে তুলতে যেতেন দিনে শতেকবার |


গয়াধামের গয়েশ্বরী,  বৃন্দাবনের বাটি
পয়মন্ত জিনিষ বড়, যায়নি আজও ফাটি ;
লক্ষ্মীছাড়া গামলাখানা, ডাল ঢালা হয় যাতে,
এসেছিল ভাগ্যহীনা খুড়ী-মায়ের সাথে’


বাঁটলোটিতে  দাদুর মায়ের সাধের পায়স রাঁধা,
দুষ্টু রাখাল লুকিয়ে নিয়ে পরকে দিলে বাঁধা,
হয় যে বাবার অন্নপ্রাসন ধুম ধামেরি সাথ,
এই বগিথাল এতেই বাবা প্রথম খেলেন ভাত |


বোগ্ নোটি ওই --- বেশ যে মনে পড়ছে আজি মোর---
চৌধুরীদের মধ্যমেরি বিয়ের বিলানোর |
তৈল ভরা বোগনো আহা মোণ্ডা – ভরা ঠোলা,
অনেকদিনের কথাই বটে, যায়না তবু ভোলা |


তুবড়ে-যাওয়া দাগ-ধরা ঐ গঙ্গাজলী ঘড়া
মায়ের হাতে পড়লো কুয়োয় টানতে গিয়ে দড়া |
তখন তিনি দশ বছরের ন-বসতের কনে,
কেঁদেছিলেন কুয়োর ধারে মহাপ্রমাদ গনে |


ছক্ কাটা ওই পানের বাটা ফুলশয্যার দান,
বাবার বাবার ঠাকুরমা সে সাজতো ওতেই পান |
খাগড়ায়ে ও পানের ডিবে, ময়লা ধূলা ঢাকা,
দেখলে চোখে জল যে আসে কাকার স্মৃতি মাখা |


প্রকাণ্ড ঐ পুষ্পপাত্র বার করিতে মানা
এই ভিটারই বাস্তুযাগের জন্যে প্রথম আনা |
মুখ-আঁটা যে কমণ্ডলু যত্নে দিলাম রেখে,
আনেন সেটি জেঠাইমা যে বদরী-নারাণ থেকে |


ঘরের প্রতি তৈজসেতে, রাঙ ঝালেরই ওর
লেগেই আছে কতই শত উত্সবের-ই জোড়,
কাঁসারী চায় বদলে নিতে আসছে প্রতি মাস
গৃহস্থালীর তাম্রলিপি, স্নিগ্ধ ইতিহাস ||

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
গ্রীষ্মের ভেট
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত “রজনীগন্ধা” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।

মর্ত্তমান রম্ভা এনো বঙ্কিমের উপন্যাস দেবে ভোগে দুই দিকে লাগে,
হিঙ্গুল কমলা এনো রবীন্দ্রের কাব্য সুধা অম্ল মিঠা যার যথা ভাগে |
এনো যেন পাণিফল গ্রীষ্মে বড় স্নিগ্ধকর অমৃতের নক্সা মনোহর,
আনিয়ো সরল ইক্ষু দ্বিজেন্দ্রের নাট্যগীতি মণ্ডী আর ডাণ্ডা একত্তর |
এনো ভাল খরমুজ গন্ধ তার বড় মিঠা শরতের উপন্যাস সম,
এনো কালো তরমুজ ভিতর গভীর লাল দেবেন্দ্রের কাব্য অনুপম |
এনো কচি কচি আম বাউল খেপার গীতি পেতে প্রাণ আনচান করে,
এনো নেয়াপাতি ডাব রামপ্রসাদের গান বুক দেয় সুধারসে ভরে |
বাণীর কলসী করে এনো সুরধনী নীর সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন,
পরাণ জুড়ানো আহা বৈষ্ণবের পদাবলী তুলসী দাসের রামায়ণ |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
নিষ্ক্রমণ
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা”  কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | ১৯১৯ সালে প্রকাশিত “রজনীগন্ধা” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


নীড় বলিছে ‘ওরে আমার পাখি
.        ওরে আমার গোপন বুকের ধন
আজকে ফিরিস সুনীল নভে ডাকি
.        বারেক এসে আমার কথা শোন |’
বিহগ বলে  ‘মাগো আমার মা
তোমার কোলে এখন যাব না |
তোমার গভীর স্নেহের মধুর দান
বিশ্ববাসী আজকে করুক পান
যতক্ষণ এ কন্ঠে আছে শিষ
মাগো আমার বিলাইতে দিস |’

          ২
ভূধর বলে  ‘নদী আমার নদী
.        আমার কোলে আয়রে ফিরে আয়,
শ্রান্ত যে তুই, ছুটিস নিরবধি,
.        ক্লান্ত দেহ বিশ্রামই ত চায় |’
কয় তটিনী  ‘পিতা আমার পিতা’
নিভিয়ে যাই চোখের জলে চিতা
আনন্দকে পরিবেশন করি
তৃষ্ণাতুরের শ্রান্তিটুকু হরি |
পাষাণ পিতার বুকের সুধারাশি
পান করাতে বড়ই ভালবাসি |’

            ৩
বলেন কবি ‘ওরে আমার গীত
.        ওরে আমার বিজন ঘরের সুখ
নিস্ নে খবর, দেখছি যে তোর জিৎ
.        ছড়াস্ সুধা নিংড়ে নিয়ে দুখ |’
গীত বলিছে ‘সাথী আমার সাথী
কষ্টে দুখে কাট্ তো দোঁহার রাতি |
সত্য হলো ভাবতে যাহা ভুল,
আমি তোমার নয়ন জলের ফুল |
নিত্য আমি তোমার খবর নিই,
তোমার ব্যথা সবার করে দিই |’

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
শুভা
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা”  কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | ১৯২০ সালে প্রকাশিত “নূপুর” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা।


সরল বালিকা শুভা নাম তার ভিখারিনী মার সনে,
কাশীর প্রান্তে পর্ণ কুটিরে যাপে দিন নিরজনে |
প্রতিদিন প্রাতে ভিক্ষায় যায় নয় বছরের মেয়ে
লোকে দান করে গঙ্গার ঘাটে, দেখে বালা চেয়ে চেয়ে |
মনে হয় তারও করিবারে দান কি করিবে দান খেপী
ভাবিয়া না পায় ভাবে কত দিন প্রহর রজনী ব্যাপী |
বহু দিন পর এক শুভ দিনে দ্বিগুণ চাউল পেয়ে,
মুখ ভরা হাসি জননীর কাছে কুটিরে আসিল ধেয়ে |
জননী তাহার আছিল পীড়িত দারুণ বেদন শিরে |
নিজে আজ শুভা করি রন্ধন খাওয়াইল জননীরে |
না করি আহার অবোধ বালিকা সরা ভরা ভাত লয়ে
মাতারে লুকায়ে বাহিরিল পথে পুলকে অধীর হয়ে |
আজি কাশীধামে মহা উত্সব বরদার মহারাণী,
দিয়াছেন আসি অন্নসত্র, ছুটিছে অযূত প্রাণী |
অতিথি ভিখারী কত সারি সারি রাজপথে চলে যায়
শুভার আহা সে সরা ভরা ভাত কেহ নাহি ল’তে চায় |
ভ্রমি পথে পথে ভাতগুলি তার কেহ লইল না দেখি
মনো দুখে বালা ভাবিতে লাগিল ম্লান অবনত মুখী |
ভিখারীনী বলে আমার নিকটে কেহ পাতিল না হাত,
দিতে এসে কিগো ফিরে নিয়ে যাব মোর এক সরা ভাত |
ফিরিল বালিকা বিষাদিত মনে আসি কুটিরের কাছে
দেখিল দুয়ারে ভিখারী জনেক ম্রিয়মান বসে আছে |
বলিল ভিখারী--- ‘আছি উপবাসী দাও দাও কৃপা ক’রে
মোর হাতে তুলি এই ভাতগুলি অন্নপূর্ণা মোরে |’
বালিকার আহা ধরে না পুলক হাসি হাসি কহে কথা
‘হ্যাঁগা এত লোক গিয়াছে যেখানে তুমি যাও নাই সেথা ?
শুনিলাম পথে কত সন্দেশ পরমান্ন যে কত,
খেতেছে নিয়ত অন্নসত্রে আজি লোক শত শত |’
বুড়া বলে ‘ওগো সব যেথা যায় আমি ভিড়ে নাহি যাই
সকলেই পায় তাহাদের কাছে আমি কিছু নাহি পাই |
হইয়াছি বুড়া না টানিলে কেহ যাইব কেমন করে,
পথ ভুলে এই পথে ব’সে আছি দাও ভাতগুলি মোরে |’
উল্লাসে বালা কম্পিত করে সরা আনি ধীরি ধীরি
নামাইয়া দিল বৃদ্ধের হাতে বুড়া বলে’ হরি হরি |
এমন অন্ন পাইনি কখনো ঘুরিয়া হয়েছি সারা
আমারে কে আর দিবে গো অন্ন অন্নপূর্ণা ছাড়া |
চ’লে গেল বুড়া বালিকা দেখিল হইয়াছে দেরী পথে
বকিবে জননী এই ভয়ে ধীরে ফিরে গেল কুটিরেতে |
আট কড় কড়ে ভাতগুলি খেয়ে যে সুখ লভিল আসি,
ইন্দিরা কভু লভেনি সে সুখ ভুঞ্জিয়া সুধা রাশি |
দেব মন্দিরে পর দিন প্রাতে দেবতার অতি কাছে
পরিচারকেরা ‘জুঠা’ সরা এক দেখিল পড়িয়া আছে |
প্রধান পাণ্ডা প্রভাত স্বপনে দেখিছেন পাতি হাত
বিশ্বেশ্বর বালিকার কাছে লইছেন মাগি ভাত |
স্নান করি প্রাতে মন্দিরে আসি শুনি এই বিবরণ,
দরদর ধারে অশ্রু গড়ায় বিস্মিত হয়ে র’ন |
ফোঁটা ফোঁটা জল মুকুতার মত পড়ে দুগণ্ড বাহি,
বলে বম্ বম্ বিশ্বেশ্বর আন্নপূর্ণা মায়ি |
এসেছেন শুভা প্রণমিতে দেবে তারে নিজ কোলে টানি,
বলেন পাণ্ডা স্বপনে দেখেছি এই সেই মুখখানি |
হে ভিখারী শিব ভকত বাঞ্ছা মন্দিরে রাখি সরা
এতদিন পরে হাতে হাতে প্রভু আজিকে পড়িলে ধরা |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
ব্রজদাস
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা”  
কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | ১৯২০ সালে প্রকাশিত “নূপুর” কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


কালাপাহাড়ের কাল অভিযানে আজি ব্রজপুর ধ্বস্ত,
দেবতা ফেলিয়া পাণ্ডার দল ছুটিয়া পলায় ত্রস্ত |
সারা ব্রজধামে দীন ব্রজদাস
মন্দিরে একা করিতেছে বাস,
দেবতা সমুখে বসিয়া রয়েছে কুসুমাঞ্জলি হস্ত |


দেব মন্দির সুরভিত আজি ভুরু ভুরু ধূপ গন্ধে |
প্রভাত আরতি করি ব্রজদাস প্রাণ ভরি পদ বন্দে |
ভক্ত আজিকে একিরে বিভল
টস্ টস্ করি পড়ে আঁখি জল,
তৃষিত ভ্রমর পান করে যেন শ্রীমুখের মকরন্দে |


সাজায়ে সাজায়ে খেদ নাহি মিটে আবার সাজায় ভক্ত
শিশুকাল হ’তে রাধারমণের সে যে চির অনুরক্ত
হাতের বাঁশিটি করি দেয় বাঁকা
হেলাইয়া দেয় ময়ূরের পাখা,
বাঞ্ছিত চির চরণে বুলায় করবীপরাগালক্ত |


অঙ্গনে ঐ ঢুকিল সৈন্য করেতে করাল দণ্ড
উপাড়ি ফেলিছে তুলসীর মূল করিছে লন্ড ভন্ড |
পূজায় মগন ধীর ব্রজদাস
বুঝিনে বহে না বহে নিশ্বাস,
প্রেম আঁখিনীরে ভাসিয়া যেতেছে পাণ্ডু যুগল গণ্ড |


মন্দির দ্বারে দাঁড়ায়ে পাহাড় হাঁকিয়া বলিলর তূর্ণ
বুকেতে তাহার ভীম বিদ্বেষ নয়ন রোষেতে পূর্ণ |
চাহিয়া বারেক ব্রজদাস পানে
বলিল মির্জ্জা রহ এইখানে
পূজাশেষে এই পাষাণ ছবিটা পদাঘাতে ক’রো চূর্ণ |


প্রহরের পর প্রহর কাটিল হয় না যে পূজা ভঙ্গ,
সাধক আজিকে লভিয়াছে বুঝি চির আরাধ্য সঙ্গ |
চাহিয়া চাহিয়া দেখি সেনাপতি
মনে মনে হায় করিল যে নতি,
পরাণে তাহার কি ব্যথা জাগিল পুলকিত হল অঙ্গ |


ফিরিয়া আসিল সে কালাপাহাড় সাথে সেই সেনাবর্গ,
রোষ কষায়িত নয়ন সাগর করেতে দুলিছে খড়গ।
দেখি পুজারিরে স্থির নিশ্চল
কঠোর নয়ন হল ছল ছল,
বুঝিল ভক্ত জীবন তাহার দেবেরে দিয়েছে অর্ঘ্য।


মির্জ্জার পানে চাহিয়া দেখিল সেও সে সংজ্ঞা শূন্য
কালাপাহাড়ের পাষাণ হৃদয় বারেক হইল ক্ষুন্ন।
বলে বিচিত্র চিত্র যে হেতা
চিনিতে নারিনু কোনটি দেবতা
বুঝিতে নারিনু দেবতা নরের কাহার অধিক পুণ্য।


আমি ত জানিনে দেবতা কোথাও রক্ষা ক’রেছে ভক্তে।
ভক্ত দেবেরে অমর ক’রেছে আপন বক্ষ রক্তে।
এসেছে দেবতা আজি মন্দিরে
যেতেছি ফিরিয়া পদ বন্দি রে
সাধু মির্জ্জারে চল লয়ে চল শোয়াইয়া হেম তক্তে।

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
পল্লী কবি
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | "বীথি" ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


অজয় পারে ওই যে ভাঙ্গা দেয়াল আছে পড়ি,
শিউলি এবং শ্যাম লতাতে করছে জড়াজড়ি |
.               বছর বিশেক আগে
.               মনের অনুরাগে
থাকতো হোতায় পল্লী কবি অনেক দিবস ধরি |

.                        ( ২ )
ভোর হলে সে ডাঙ্গার মাঠে আগেই যেত ছুটি
মুখটি তাহার দেখতো রবি সবার আগে উঠি |
.               কোকিল নিশি ভোরে
.               ডাকতো তাহার দোরে
না উঠতে সে, কুসুমগুলি উঠতো আগেই ফুটি |

.                        ( ৩ )
সাঁজের বেলা থাকতো পারের ঘাটটি পানে চেয়ে
ফিরতো বাড়ী কৃষক তা’রি তৈয়ারী গান গেয়ে  |
.              হাসতো শুনে কবি,
.              ডুবতো নভে রবি,
মাঝিরা সব যেত তা’দের বোঝাই নৌকা বেয়ে |

.                        ( ৪ )
গ্রামখানিকে ঘিরতো যখন রাঙা অজয় বানে
উঠতো যেন কি এক তুফান কবির কোমল প্রাণে |
.              শশক শিশু ধরি
.              রাখতো বুকে করি
বাঁচাতো সব পাখীর ছানায় স্নেহের ছায়াদানে |


.                        ( ৫ )
রাখাল রাজার ভক্ত ছিল রাখালগণের প্রিয়,
অতিথিদের সত্কারেতে পুণ্য তাহার গৃহ |
.                সর্ব্ব জীবে দয়া
.                অতুল স্নেহ মায়া
হরিনামে চোখের বারি পরম রমণীয় |

.                        ( ৬ )
গেছে কবি নামটি তাহার গাঁয়ের বুকে আঁকা
তরুলতার শ্যামল গায়ে মমতা তার মাখা
.                  আজও তাহার গানে
.                   তা’রেই ফিরে আনে,
আজও তাহার বিহনে গ্রাম ঠেকেছে ফাঁকা ফাঁকা |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বৈষ্ণব পদাবলী
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা”  কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া |  “বীথি” ( ১৯১৫ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


ভক্তির ভাণ্ডারে ওগো তোমরা সুন্দর
অক্ষয় উজ্জ্বল মণি, অমূল্য অতুল,
প্রেমের নন্দন বনে আছ নিরন্তর
চিরস্ফুট মধুময় পারিজাত ফুল |
প্রীতির পীযূষ সবে তোমরা নির্ম্মল,
চির নভ সুরভিত নীল ইন্দীবর
হরি পাদপদ্ম মাঝে চির অচঞ্চল
তোমরা সুতৃপ্ত মুগ্ধ প্রমত্ত ভ্রমর |
রাধার চরণ স্পর্শে উঠেছ কি ফুটি
ভক্তি বৃন্দাবনে শত অশোক মঞ্জরী
কিংবা মুকুতার মালা অভিমানে টুটি
ছড়ালো কবিতা কুঞ্জে ব্রজের সুন্দরী ?
না গো না বৈষ্ণব ভক্ত রেখে গেছে হেতা,
ছোঁয়ায়ে হরির পদে তুলসীর পাতা |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
নান্নুর
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা”  কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “বনমল্লিকা” ( ১৯১৮ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।


বঙ্গের বৈশালী তুমি, গুপ্ত তপোবন,
গীতের গঙ্গোত্রী তুমি বন্দি শ্রীচরণ |
প্রেমের পবিত্র নীরে করিবারে স্নান
আনিয়াছি বহি হেথা ভগ্ন দেহ প্রাণ |
কোথা সেই দুষ্টু ছেলে যে হেথায় বসি,
অনুদয়ে নেহারিল নদীয়ার শশী |
রাখালের সাথে মিশে যেই ভাগ্যবান,
রাখালরাজের আহা লভিল সন্ধান |
পেলে যার পুণ্য হৃদি প্রেমে ভরপুর
রামীর কাঁকণে, রাই মঞ্জীরের সুর |
ভোগবতী উচ্ছসিত ভোগপথে যার,
মালা হ’ল হরির হিয়ার হেমহার |
কোথা ওগো রজকিনী গরবিনী তুই
ফুটেছিলি জবা সাথে অর্দ্ধফোটা যুঁই |
বঁধুর মধুর প্রেমে হারাইলি নাম,
নয়ন অনলে করি ভস্মীভূত কাম |
চন্দ্র হ’ল তোর ক্ষুদ্র কপালের টিপ
স্বরগবর্ত্তিকা হল বাসর প্রদীপ |
তুই সোহাগিনী বড় আদরিণী ধনি
নীলাম্বরী খুঁটে বাঁধা নীলকান্ত মণি |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
মজিদ
কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক
শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ
কাব্যমঞ্জুষা”  কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “স্বর্ণসন্ধ্যা” ( ১৯৪৮ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

লেখাপড়া জান্ তো অতি কম, বিষয় আশয় ছিলই নাক মোটে,
নাইক’ কিছুই, কিন্তু মনোরম ; এমন কুসুম পথের ধারেই ফোটে |
মিথ্যা কথা কইত সে যে ঢের--- লেগেই ছিল অভাব অনটন,
সাধু সে নয় নিত্য পেতাম টের, তবু তার কি ছিল আকর্ষণ !
না এলে সে লাগত ফাঁকা ফাঁকা, পুকুর ধারে শঙ্খ চিলের মত,
না ডাকলেও ইচ্ছা হ’ত ডাকা---- গুণ দেখিনি--- দোষ দেখেছি কত !
যেমন চতুর তেমনি  সে সরল ভাল আমায় বাস্ ত নিষ্কপটে,
অজয়ের সে যেন বানের জল ময়লা ঘোলা তবু মধুর বটে |
ভৃত্য এবং বন্ধু ছিল দুই-ই, ব্যথার ব্যথী --- না বল্ লে হয় ভুল,
সত্য বটে নয় সে টগর যুঁই,  ‘কেয়া’ সে তার কাঁটাই যেন ফুল |
তার কত দর ? কতই যে দরকার ? বুঝত নাক হিসাবী সমাজ,
ধারতো না সে ফুল কি ফলের ধার আনন্দের সে পাতাবাহার গাছ |

.              *************************              
.                                                                                 
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর