কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কবিতা |
অগ্রদানীর ছেলে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “নূপুর” ( ১৯২০ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। চুন-বালি-খসা কঙ্কালসার জঞ্জাল ভরা বাড়ী, ঘন জঙ্গলে ঘেরা চারিধার, দেখিলে চিনিতে পারি | সর্বদা তার রুদ্ধ দুয়ার, কেহ নাই মনে হয়— দেয় ধূম আর ক্ষীণ আলোটুকু বসতির পরিচয়, বালক পুত্র লয়ে হোতা থাকে কৃপণ অগ্রদানী পত্নী তাহার দু’বছর আগে ধরা ত্যজিয়াছে জানি | এমনি পাষাণ যখন তখন চলে যায় কাজ পেলে, বিজন কুটীরে দশ বছরের ছেলেকে একাকী ফেলে | স্নিগ্ধকান্তি ছেলেটি তাহার স্নেহ-মমতায় মাখা— যেন লৌহের স্তম্ভের গায় কনক-কুসুম আঁকা | পুত্র এমনি পিতার বাধ্য যাবে না বাহিরে আর --- রহে জীবন্ত মণি-মরকত রুধি’ ভাণ্ডার-দ্বার | ২ পিতা চলে গেলে একাকী বালক দেখে আনমনে বসি’, গাছে থলো থলো আমগুলি যেন পড়িবারে চায় খসি’ | দেখে গাছ ভরে ফলিয়া রয়েছে শ্যাম নারিকেল-কাঁদি, স্নেহের সলিল তৃষিতের লাগি’ রাখিয়াছে যেন বাঁধি, অশ্বথ্ব গাছে নব কিশলয়--- অরুনাভ কচিপাতা, কবে ছায়া দান করিতে পারিবে তারি লাগি’ ব্যকুলতা | দেখিয়া দেখিয়া ভরে উঠে আহা ছোট বালকের বুক, ভাবে মনে মনে অজ্ঞাতে যেন—দানের কতই সুখ | সন্ধ্যায় পিতা ডাকে নাম ধরি, যেমন দুয়ারে আসি’— ত্বরিতে বালক খুলি দেয় দ্বার মুখেতে ধরে না হাসি | পরদিন গৃহে রাখি তনয়ের পিতা চলে যায় প্রাতে, বত্সর যেন সুখস্মৃতি রাখে পুরানো পাঁজির পাতে | ৩ বালক বিকালে চেয়ে চেয়ে দেখে সুনীল আকাশখান, দেখে সে কেমন মূমূর্ষু রবি করে হিরণ্য দান | সন্ধ্যায় দেখে ধনী সুধাকর রজতে ডুবায় ধরা, দেখে নীরদের দানসাগরেতে কতই বিনয় ভরা | দেখিয়া দেখিয়া কী এক ব্যথায়, ভরে উঠে তার বুক, ভাবে মনে মনে লওয়া চেয়ে হায় দেওয়ায় বৃহৎ সুখ | বহুদিন পর কৃপণ জনক মরণ আগত স্মরি,-- শিয়রে কাছে ডাকিয়া তনয়ে বলিল সোহাগ করি, সত্যই বাছা দানে বহুসুখ--- তব করে আজি তাই— যুগ সঞ্চিত বিপুল অর্থ আজ আমি দিয়ে যাই | এত কৃপণতা এত হে কষ্ট সকলি সফল লাগে— তব চাঁদ মুখ হয় নাকো ম্লান যেন দারিদ্র-দাগে | ৪ পিতার বিয়োগে অমিত অর্থ আসিল যুবার করে, নিরজনে তারে প্রকৃতি গড়েছে ঘন অনুরাগ ভরে | সে বছর হল অন্ন-অভাব --- এ সারা বাংলা জুড়ি’--- আহার অভাবে পলে পলে মরে ছেলে মেয়ে বুড়া বুড়ী | অনশন-ক্ষীণ তনয়ের মুখ চাহিয়া মরিল মাতা, বড় বড় হায় জমিদার-ঘরে দু’বেলা পড়ে না পাতা | তখন দয়ালু, স্বভাব দুলাল – অগ্রদানীর ছেলে— দুহাতে তাহার ভাণ্ডার দিল গরিবের তরে ঢেলে | খুলি’ দিল শত অন্নসত্র --- প্রচুর পান্থশালা, আপনি খাইল গরিবের সনে একসাথে পাতি থালা ; কষ্টার্জিত অর্থ পিতার দীন হীনে দিল বাঁটি’— চতুর যাহারা বলিল, এ বেটা একেবারে হল মাটি | ৫ শুনি’ সংবাদ নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়.— চাহিলেন ডাকি’ উপাধি-ভূষণে ভূষিত করিতে তায় | নিষেধ করিল বিনয়ে যুবক জুড়িয়া যুগল পাণি— পরের দানেতে আমরা পালিত পতিত অগ্রদানী | আমরা নিলাম সমাজের দান, জানি তা সবার আগে সার্থক হবে—আজি যদি তাহা ভুখারীর কাজে লাগে | আসন হইতে নামিয়া তখন কোলাকুলি করি’ রাজা, বলেন, জীবন ধন্য আমার ----সার্থক তুমি প্রজা | চৌদ্দ পুরুষ আগে দান লয়ে পতিত যদিই হ’লে ব্রাহ্মণ চেয়ে ব্রাহ্মণ তুমি আজি এ দানের ফলে | আজ হতে তুমি দানীর অগ্র, নহ হে অগ্রদানী— কপিলের শাপ ঘুচাইলে তুমি প্রেমের বন্যা আনি’ | . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
বকুলতরু কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “অজয়” ( ১৯২৭ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এই বকুলতরুটি শ্রীপাট কোগ্রামে লোচনদাসের আখড়ার নিকট অজয় নদের তীরে প্রায় পাঁচ শত বত্সর অবস্থিতি করিতেছিল | কোন ভাগ্যবতী তাঁহাকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন | অজয়ের সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন, তরুটিকে গ্রাস করিয়াছে | বকুল-তলাটি সমস্ত গ্রামবাসীর মিলন আনন্দ ও বিশ্রামের স্থান ছিল | শাস্ত্র কথা সংকীর্তন প্রভৃতির জন্য ব্যাবিহৃত হইত | পাঁচশো বছর হেতায় ছিলে প্রাচীন বকুলগাছ, অজয় নদের ভাঙনেতে পড়লে ভেঙে আজ | কালো ছিলে নিবিড় শ্যামল লোহার মত দৃঢ় ফুলের রাজা প্রফুল্ল মুখ লাখো পাখীর গৃহ | কাল ও ছিল সত্র তোমার জমাট মনোহর, সারা দিবস অতিথ ভ্রমর গুঞ্জন মুখর | কাল ও ছিল তোমার তলে ছেলে মেয়ের ভিড়, আজকে নত নদীর জলে অভ্রভেদী শির | সিদ্ধ তুমি না হও মোদের বৃদ্ধ বকুল গাছ, বক্ষ উঠে টন্ টনিয়ে চললে তুমি আজ | তুমি মোদের অক্ষয় বট তুমি বোধিদ্রুম , মাতামহের পিতামহ তোমায় নমো মনঃ | শৈশবেরি গোকুল তুমি স্নেহের ব্রজধাম, বার্দ্ধক্যেরি প্রভাস তুমি পুণ্য তব নাম | অক্ষরণের কুরুক্ষেত্র দেখলে হত ভ্রম রামায়ণের তুমিই মোদের বাল্মীকি আশ্রম | পুরাণের নৈমিষারণ্য তুমিই ব্যাসাসন – সংকীর্তনে তুমিই মোদের শ্রীবাস অঙ্গন | তুমিই মোদের সুহৃদ সখা তুমি গুরুর গুরু | হোলো তোমার চরণ তলেই ভক্তি জীবন সুরু | ২ লোচন দাসও তোমার তলে করেছিলেন খেলা বাদল দিনে নালার জলে ভাসিয়েছিলেন ভেলা | তোমার ফুলে মালা গেঁথে ছেলে খেলার ছলে অলক্ষ্যেতে পরিয়েছেন বনমালীর গলে | তোমার তলে পড়িয়াছে তাঁহার চোখের জল তুমিই প্রথম শুনিয়াছ চৈতন্য মঙ্গল | কাছেই তোমার শিবের দেউল তুমি মোদের কাশী ঘরের কাছেই স্বর্গ মোদের তোমায় ভালবাসি | ৩ শুনিয়াছ যুগের যুগের ছেলেমেয়ের কথা, উত্সবেরি আনন্দ ও ভাঙ্গা বুকের ব্যথা | প্রাচীনতম বাসিন্দা যে তুমি গ্রামের বুড়া একটি তোমার চুল পাকেনি চির শ্যামল চূড়া | সুদূর থেকে তোমায় দেখে উঠতো ভরি বুক, তুমিই সবার গৃহস্বামী আদর মাখা মুখ | আজকে তোমার স্বর্গারাহণ ওগো বনস্পতি | আজকে গোটা গ্রামের অশৌচ গোটা গ্রামের ক্ষতি মনে পড়ে তোমার স্নেহ তোমার শীতল ছায়া মনে পড়ে ফুলের সুবাস, স্নিগ্ধ মধুর হাওয়া | জমছে মনে হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখের ভিড় প্রিয় জনের বিচ্ছেদেরি যন্ত্রণা নিবিড় | ৪ তুমি গোটা গ্রামের দায়াদ অযুত নাতি, পুতি, চোখের জলে স্বর্গগামী করি তোমার স্তুতি | নন্দনেতে ঠাঁই হবে হে কল্পতরুর কাছে, গ্রামের তরুণ বৃদ্ধ বালক স্বর্গ তোমায় যাচে | স্বর্গ থেকে বকুলতরু মর্তপানে চেয়ে, আশীর্ব্বাদী তোমার ফুলে বুকটি দিয়ো ছেয়ে | মিত্র ও দৌহিত্র তোমার ভুলতে তোমায় নারি, আমায় করো তোমার প্রেমের উত্তরাধিকারী | . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
পল্লী-শ্রী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “অজয়” ( ১৯২৭ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। মূর্খ গরিব নামহীন মোর মা হয়েই তুই থাকলি মা | সব দিকে আমি ছোট বলে তুই আগ্ লিয়ে কোলে রাখলি মা | পাঠাবি কোথায় নাহি সৌরভ তুলিবি কোথায় নাহি গৌরব পরে নিলে নাতো ঘরে রেখে দিলি তাইত আমারে পাগ্ লী মা | ২ তোরি আঁচলের খুঁট ধরে যাই, ভরা অজয়ের ঘাট পানে ; তোরি পাদমূলে দাঁড়াইয়া চাই রামধনু আঁকা মাঠ পানে | মন্দিরে তোর সাথে সাথে যাই, পীযুষ প্রসাদ হাত ভরে পাই, ভগবতী যার সুমুখে তাহার বৃথা ভাগবত পাঠ কেনে ? ৩ দিওনা আমারে দরবারে যেতে দুরু দুরু কাঁপে বক্ষ মা, আছে শুধু দীন দুর্ব্বল দুখী অক্ষম সাথে সখ্য মা | জ্ঞানাঞ্জনের শলাকার ভার জলভরা চোখ সবে না আমার, কাজল-লতার কাজলে তোমার জুড়াও নয়ন, রক্ষ মা | ৪ তুই গড়ে দিস্ পাতার টোপর সোণার কিরীট সেই মা মোর, তোর আঁচলের মধুর বাতাস আয়াস করে কি পায় চামর ! পারিনে পুঁথির ওলটাতে পাত, দিই শিষ, শ্যামা পাপিয়ার সাথ, গুণ না থাকুক, গুণ গুণ করি বেড়িয়া ও পদ ওই ভ্রমর | ৫ যেন মা তোমার স্নেহের দীঘিতে কমলের সাথে নাইতে পাই | যেন মা তোমার বিপিন ভবনেপাপিয়ার সাথে গাইতে পাই | চন্দন সাথে যেন রোজ রোজ পরশি মা তোর চরণ সরোজ, যেন মা তোমার চাতকের মত হরির করুণা চাইতে পাই | . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
দাবী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক শ্রীজ্যোত্স্নানাথ মল্লিক, শ্রীকৌশাম্বীনাথ মল্লিক ও শ্রীসুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত “কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা” কাব্যসংকলন থেকে নেওয়া | “অজয়” ( ১৯২৭ ) কাব্যগ্রন্থের কবিতা। টার্কী কি টাসখাণ্ড টোকিয়ো কি মস্কো কেনেডা কি কেন্ টাকী যেথা হ’ক বাস গো | হ’ক বেশ হ’ক দেশ আহারাদি ভিন্ন, একেবারে মুছে যা’ক স্বজাতির চিহ্ন, যে ভাষায় কথা কয়, সেখানেই রয় সে হিন্দু সে হিন্দু আর কিছু নয় সে | ২ অমৃতের অধিকার জন্মের সঙ্গে সূর্য্যের রশ্মি সে বিম্বিত রঙ্গে, চরণে কি শিরে র’ক হক সে বিবর্ণ সনাতন ছাপ মারা সে যে সেই স্বর্ণ | জন্মের অধিকার জোরে পুনঃ লয় সে হিন্দু সে হিন্দু আর কিছু নয় সে | ৩ প্রলোভনে ভয়ে যদি ত্যজে নিজ ধর্ম অনুতাপে পরে যদি বিঁধে তার মর্ম | অনাচার করি যদি পরে হয় ক্ষুণ্ণ, পুনঃ ফিরে আসা যদি ভাবে মনে পুণ্য করি হরি নাম করে সভ পাপ ক্ষয় সে হিন্দু সে হিন্দু আর কিছু নয় সে ৪ যে ডোবায় ডুব দিক সে যে রাজহংস শুভ্রতা কোন মতে হবে নাক ধ্বংস | যেই দিকে ছুটে যায় বর্ষার জল গো গঙ্গার বুকে এলে পূত নির্মল গো | অভয়ের বাণী স্মরি সব ব্যথা সয় সে হিন্দু সে হিন্দু আর কিছু নয় সে | ৫ যে বনেই থাক আর যে নামেই ডাকবে, চন্দন চিরদিন চন্দন থাকবে | কুর্ত্তা কামিজ কোটে খেদ নাহি বিন্দু যে বাসেই ঢাকা থাক বুক তার হিন্দু | ডাক নামে ডাকিলেই শুনি তন্ময় সে হিন্দু সে হিন্দু আর কিছু নয় সে | ৬ শ্মশানেতে শ্যামা তার গৃহে তার লক্ষ্মী আপদে বিপদে তার নারায়ণ রক্ষী | বাণী তার জিহ্বার বুকে তার স্বর্গ প্রাণ কাঁদে ইহাদিকে করিতে যে পর গো | শিরে সে হিন্দু আর কিছু নয় সে | . ************************* . সূচীতে . . . মিলনসাগর |