কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুরের কবিতা
তোরা দেখবি যদি আয়!
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত, “রামধনু” পত্রিকার আষাঢ় ১৩৩৮ (জুন ১৯৩১) সংখ্যার
২৯৬-পৃষ্ঠায় প্রকাশিত। আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে
করছি। আশ্বিন ১৩৩৮ এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থেও কবিতাটি
রয়েছে।

(তোরা)         দেখবি যদি আয়,
(ওই)            মত্ত মাদল
.                বাজিয়ে পাগল
.                সাঁওতাল-দল যায়,
(তোরা)         দেখবি যদি আয়!
(ওই)            বনদেবীর স্নিগ্ধ বুকে ফুটল কত ফুল,
(ওই)            ফুল গুঁজে সব কাণের পাশে নাচেতে মশগুল!
(ওই)            মুখে হাসি
.                 বাজিয়ে বাঁশী
.                 বন্য বালক যায়,
(তোরা)         দেখবি যদি আয়!
(ওই)            ঝুমুর নাচে মত্ত সবাই সাঁওতালিনী বালা,
(ওই)            সরল কালো মুখে তাদের স্নিগ্ধ হাসি ঢালা!
(ওই)            নাচে দোলা
.                 ছন্দে ভোলা
.                 নূপুর বেজে যায়,
(তোরা)         দেখবি যদি আয়!


পাদটীকা -
এই কবিতার লেখক চাঁদমল বাঙ্গালী নহেন, কিন্তু বাংলা ভাষার উপর তাঁর খুব টান্।
নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখিয়া ইনি আজকাল কবিতা লিখিতেছেন।

.                             ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রতিশোধ
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। সেই গ্রন্থের টাইটেল
পেজে কবির জায়গায় শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।

একদা রাত্রে য়ুসুফের দ্বারে আসিয়া আগন্তুক
কহিল দুঃখে বিষণ্ণ মুখে নত করি নিজ মুখ!

“রাজার পেয়াদা হুমকি হানিছেযেথায় পালিয়ে যাই
দীন-দুনিয়ায় নাহিক যে মোর মাথা পাতিবার ঠাঁই।

সমাজ তাড়িত সমাজে পতিত অভাগা মানব আমি
আশ্রয় আশে আসিয়াছি হেথা ওহে শেখেদের স্বামী।”

হহিল য়ুসুফ্ “স্বাগত বন্ধু! এ গৃহ তো মোর নয়
এ-গৃহ খোদার, আমি দাস তাঁর সেবিতে তাঁর তনয়।

মম সম তব আছে অধিকার এ গৃহের সব ধনে
কর ব্যবহার সকলি তোমার আপন ভাবিয়া মনে।”

কহিল---“অশ্ব আছে প্রস্তুত তব পলায়ন লাগি’
সূর্য্য উদয় হবার পূর্ব্বে যাও হে এদেশ ত্যাগি’।”

ইব্রাহীম সে মুগ্ধ আজিকে য়ুসিফের অনুরাগে
অনুতাপে তার জ্বলিছে পরাণ বড় বিস্ময় লাগে!

আগন্তুক সে বিচলিত ভাবে য়ুসুফে ডাকিয়া কয়
“যারে তুমি এত করিলে করুণা---জান তার পরিচয়?

আতিথেয়তার ধর্ম্ম দেখালে যাহারে অপরিসীম
তব পুত্রের হরেছে যে প্রাণ আমি সে ইব্রাহীম!”

শুনিয়া য়ুসুফ ক্ষণেকের তরে শুধু নির্ব্বাক রহি’
কারুণ্যমাখা গম্ভীর স্বরে হঠাৎ উঠিল কবি---

“তবুও তোমারে ক্ষমিনু, পালাও এখুনি লইয়া প্রাণ”---
এই বলি তারে দ্বিগুণ স্বর্ণ করিল য়ুসুফ দান।

পলাতক যবে হ’য়ে গেল ক্রমে চোখের অন্তরাল
অতীতের কথা স্মরিল য়ুসুফ বসিয়া সে ক্ষণকাল ;

তারপর তার পুত্রের ছোট কবরের পাশে এসে
অশ্রুগলিত কণ্ঠে কহিল পুত্রেরি উদ্দেশে---

“হে মোর দুলাল আর নাহি ভয় বিশ্রাম কর সুখে---
দিয়াছি শাস্তি তারে যে ছুরিকা হেনেছিল তোর বুকে-

কল্পনাতীত শাস্তি দিয়েছি নিষ্ঠুর নির্ম্মম
ক্ষমেছি তাহারে,---নিঠুর শাস্তি নাহিক ইহার সম!

সব ক্ষোভ আজ মুছে গেছে মোর হৃদয়ের পট হ’তে
সব জঞ্জাল ঘুচে গেছে আজ পুণ্য-তোয়ার স্রোতে!”

.                   ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
অশ্রু-অর্ঘ্য
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। কবির মাতৃদেবীকে
উত্সর্গ করা এটাই গ্রন্থের প্রথম কবিতা। সেই গ্রন্থের টাইটেল পেজে কবির জায়গায়
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।

তরুণ কৈশোরে মা
গো তোমারি বিয়োগ
ভরিল তরুণ হিয়া অনাদি ক্রন্দনে ;
বিদ্রোহী হইল মন, আকস্মিক শোক
জীবন প্রভাতে আসি বাঁধিল সে মনে।

উন্মাদ বিদ্রোহী মন ছিঁড়িতে বাঁধন
ছুটিল অনন্ত পথে খুঁজিতে তোমারে ;
অবিরল বারিধারা ভরি’ এ নয়ন
আসিল নিভাতে সেই হৃদয় জ্বালারে।

মধ্যাহ্নে মরুর মাঝে ছুটাছুটি করি---
পরিশ্রান্ত হ’ল যবে এ কিশোর দেহ,
প্রখর রৌদ্রেতে যবে পিপাসায় মরি,
একবিন্দু বারিদান করিল না কেহ।

ছুটিল নির্ব্বেধ মন, তবু থামিল না
তোমারে হেরিতে মাগো সুদুর্গম পথে ;
বিধাতার লীলা খেলা তবু বুঝিল না,
ফিরিল না অবিলম্বে সেই পথ হ’তে।

দাবানল শিখা সম শোকানল আসি’
করি দিল ছারখার ভগ্ন এই হিয়া ;
নেরাশ্যের বিষমাখা বিদ্রূপের হাসি
পশিল শ্রবণে মাগো মরম ভেদিয়া।

তথাপি এ মূঢ়-মন জানিল না ভয়,
বিবেক বুঝাল কত বুঝিল মা তবু ;
বুঝিলনা একবার যারে কাড়ি লয়,
ফিরায়ে দেয় না বিধি আর তারে কভু।

সহসা ভাঙ্গিল ভুল স্থির হল মন
তোমা লাগি, স্নেহময়ী,---ছুটিল না বনে
হৃদয় মন্দির মাঝে করিল স্থাপন
জ্যোতির্ম্ময়ী মূর্ত্তি তব মানস আসনে।

হৃদয়ের ব্যথা যত গাঁথি এক সাথে
রচিয়াছি তাই আজি এই শোক-গাথা,
তারুণ্যের তপ্ত হিয়া আজিকে জুড়াতে
তোমারি চরণে মাগো রাখিতে এ মাথা ;-

রচিনু মরমগীতি বিদেশী ভাষায়
ঝরাতে মা শেষবার মরম যাতনা,
এ গীতি অঞ্জলি মাগো তব রাঙ্গা পায়
হাসি মুখে দিনু আজি, পুরিল বাসনা।

.                ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
অবেলায়
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। সেই গ্রন্থের টাইটেল
পেজে কবির জায়গায় শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।

আজি কেন অবেলায়
মাতিলে ফুল খেলায়,
ভুলেছ কেন প্রিয়ায়
.        বরষা প্রাতে!

ময়ূরী বসিয়া বনে
খেলিছে শিশির সনে,
নাচিয়া আপন মনে
.        ময়ূর সাথে

ভাব বুঝি ফুলসাথে
অরুণ-তিলক মাথে
আজি এ বরষা প্রাতে
.        আসি’ নটবর!

জমিয়ে দিনের মেলা
তব সাথে করি’ খেলা
---ভাসাবে গানের ভেলা
.        ওসে মনোহর।

স্বপনে দিল কি দেখা
নয়নে কি ছিল লেখা,
গোপনে আসিবে একা
.        মালা পরাতে!

তারি তরে বসি আজি
সাজায়ে ফুলের সাজি,
খেল কি আশার বাজী
.        বেদন সাথে।

.            ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পথচারী
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। সেই গ্রন্থের টাইটেল
পেজে কবির জায়গায় শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।


পথচারী ও পথচারী ভাই
.                ভাব্ ছ কি আজ আনমনে
বিদায়-গীতি গাইবে কি আজ
.                ডাকলে কোকিল ঐ বনে?

কোন কুহকে প’ড়লে আজি
.                কোন সে মায়ার বন্ধনে
মুক্ত-হৃদয় বন্দী হ’ল
.                কোন্ সে বালার ক্রন্দনে।

মৌমাছিদের ছন্দ-ভোলা
.                গুন্-গুনিয়ে গানখানি
আন্ লরে তোর মনের ভিতর
.                সুদূর দেশের কোন বাণী!

কোন সে বীণার ঝঙ্কারে আজ
.                হৃদি কমলের ঐ পটে
আঁকল আজি কোন সে স্মৃতি
.                নীল দরিয়ার ঐ তটে!

কোন মাদলের করুণ সুরে
.                দুলিয়ে দিল দিল্ টী তোর---
কোন সে কেয়ার গন্ধে মাতি,
.                পাগল-পারা মন-চকোর---

চায়রে যেতে ঐ সে পথে
.                গন্ধ-স্রোতে গা’ ঢেলে
বিদাই গীতি গাইতে কি তাই
.                চাস্ রে আজি সব ফেলে?

.            ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বুলবুলি
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। সেই গ্রন্থের টাইটেল
পেজে কবির জায়গায় শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।


বুলবুলি লো বুলবুলি,
কোন সে নিঠুর কর-পরশে
.        কণ্ঠ-বীণার তারগুলি
ছিঁড়ল আজি শীতের সাঁঝে
.        ঝাম্ সিয়ে ফুল বিলকুলি।

ফুল-বাগিচায় ফুলের শাখে
.        দেখলো বসে ফুলরাণী,---
তোর বেদনায় ভাগ বসাতে
.        ডাকছে দিয়ে হাত ছানি ;
তোর দুখেতেই দুলছে না লো
.        তার সে এলো চুলগুলি

বুলবুলি লো বুলবুলি,
.        তোরই দুখে মুর্ঝেছে আজ
.        .        ফুল বাগিচার ফুলগুলি।

দেখলো চেয়ে ঐ সে পথে
.        যায় রূপসা বনবালা,
তার সো কোমল রঙ্গীন হাতে
.        ঝরা ফুলের ঐ মালা ;
মরম জ্বালা জানাচ্ছেলো
.        বিন্ কারণে দোল্ দুলি।

বুলবুলি লো বুলবুলি,
.        তোরউ হিয়ার বেদন জেনে
.                যায় সে বালা পথ ভুলি।

কণ্ঠবীণা আজকে আবার
.        নূতন করে বাঁধনা লো,
বিরহ-আঁধার ঘুচিয়ে দিয়ে
.        শূন্য হিয়ায় জ্বাল আলো
ওরে    তোরই মধুর গানের লাগি
.        উঠ্ ছে হেনা চঞ্চলি

বুলবুলি লো বুলবুলি---
.        তোর তরে আজ দাঁড়িয়ে আছি
.                রঙ্ মহলার দ্বার খুলি’।

.            ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ফুল-বাণ
কবি শ্রীচাঁদমল
(কবি দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর)
আমরা “চাঁদমল” নামটি কবি দীনেশচন্দ্র সেনের ছদ্মনাম বলে মনে করছি। আশ্বিন ১৩৩৮
এ (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রকাশিত “মাদল” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি রয়েছে। সেই গ্রন্থের টাইটেল
পেজে কবির জায়গায় শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন ছাপা রয়েছে।

ফুল বাগিচার একটি কোণে
.                ফুট্ ল গোলাপ রংবাহার,
সৌরভে তার মত্ত পথিক
.                যায় যে ভুলে পথ্ তাহার

লাল গোলাপের পাপ্ ড়ী গুলি
.                ডাকছে যেন হাত নেড়ে
বলছে যেন---আয়রে পথিক
.                যাস্ না মোরে আজ ছেড়ে

বিদ্রোহী পা চলতে না চায়
.                ক্লান্ত দেহ যায় ঢলে
থম্ কে দাঁড়ায় পাগ্ লা পথিক
.                রঙিন ফুলের এই ছলে।

ফুলের নেশায় ডুবিয়েছে আজ
.                মত্ত পথিক মনটিকে,---
চল্ ল ছুটে ফুলের পানে
.                ধ’রতে রঙিন ফুলটীকে।

.            ****************                                
.                                                                                
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*