গল্পকার কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা |
হোলি-কাহিনী কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রদীপ” পত্রিকার চৈত্র ১৩০৪ (এপ্রিল ১৮৯৮) সংখ্যায় প্রকাশিত। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০। ( গাথা ) ফিরিয়া আসিছে মথুরাপ্রসাদ ব্যবসা করিয়া। বহুদিনান্তে হোলির সময় আর কি প্রবাসে তিষ্ঠে হৃদয়? সে যে করিয়াছে দিবস-গননা বরষ ধরিয়া। গৃহে তার লাগি প্রণয়িণী-বালা চাহিয়া আছে পথ। কখন্ হেরিবে মুখ খানি তার, শুনিবে কণ্ঠবীণা-ঝঙ্কার, তনুলতা খানি বাঁধিবে হৃদয়ে ; পূরিবে মনোরথ! অশ্বারোহণে ক্ষিপ্রগমনে, গিয়াছে দশদিন। একদিন আর ;---পথ হবে শেষ, ঘুচিবে দীর্ঘ প্রবাসের ক্লেশ ; বিরহ-আঁধার, সুখ-মিলনের আলোক হবে লীন। দিবাশেষে যুবা উপনীত হয় শোণ-নদের তীর। বিস্তৃত বালু’'ভূমি সমতল, তারি মাঝখানে শীর্ণ শীতল সবুজ একটি মন্দ প্রবাহ ক্ষুদ্র-লহরীর। ওপারে দাঁড়ায়ে মলিন-বসন কৈলোয়ার গ্রাম। সেখানে বন্ধু কিষণপ্রসাদ, ভাবিল মধুরা---“বিষম প্রমাদ, প্রভাতে কল্য নাহি ছাড়ে যদি,--- বিপদে পড়িলাম।” রজনী আগত, বন্ধুগৃহেই অতিথি হ'তে যায়। বহু দিন পরে বন্ধু পাইয়া কিষণপ্রসাদ উলসিত হিয়া ; কত আনন্দে হসিত বদনে সম্ভাষে তাহায়। কাটে দুজনার গল্প আলাপে অর্দ্ধ-যামিনী। গল্প কেবল মথুরাপ্রিয়ার, স্নেহ ভালবাসা নবীন-হিয়ার, সামান্য কথা, তুচ্ছ ঘটনা,--- তাহারি কাহিনী। কিষণপ্রসাদ ঘুমাইয়া পড়ে ; মথুরা জাগিয়া ; হৃদয় তাহার দুরু দুরু করে, শোণিত-প্রবাহ ছুটে বেগভরে, কাটে না রজনী ক্ষণ গণি গণি প্রভাত লাগিয়া। পোহাইল নিশা এইরূপে ক্রমে, গেল অন্ধকার। মথুরাপ্রসাদ মাগিল বিদায়, কিষণ শুনিয়া হাসিয়া লুটায় ; “আজি যাবে তুমি? ইহার অধিক পারিবে কেন আর ! “বিবাহ করেছ বলে কি বন্ধু এমনি হ'তে হয়? নব-প্রণয়নী পেয়েছ বলিয়া, সকল কিছু কি যাইবে দলিয়া? আমাদের সেই শৈশব-প্রেম, তাহা কিছু কি নয়? "আজি নহে, কাল ;---এইত ব্যাপার--- মিলিবে প্রিয়াসাথ। একটি দিনে কি হৃদয় তোমার বিরহ-বজ্রে হবে চূরমার? সেই কি পড়িয়া মরিয়া যাইবে ডাকিয়া---‘কোথা নাথ!’ উৎসব আজি, হোলির এদিনে ছাড়ি কি হে তোমায়? এত সঙ্গীত, এত পরিহাস, আতর গোলাপ, সুখ-উচ্ছ্বাস, আবির অভ্র, মিঠাই মসালা যাইবে কি বৃথায়?” কাতর মথুরা কহিলা যা কিছু, ভেসে গেল সকল। চতুর কিষণ করিল প্রমাণ, নব প্রণয়ীরা বাতুল সমান,--- তাহাদের শত বেদনা-উৎস কল্পিত কেবল। বিষণ্ণমন মথুরাপ্রসাদ করিবে কিবা আর? সার দিনমান উৎসব মাঝে উল্লাস-প্রাণ বন্ধু-সমাজে, হাসিহীন মুখে দিল যোগদান, নয়নে জলভার। সে যে হায়, তারে বলে এসেছিল নিশ্চিত বচন ;--- "বৎসর কাল থাকি না যেথায়, হোলির রাত্রে, সখি, পুনরায় আসিব ফিরিয়া, চুম্বিব তোর চন্দ্র সুধানন।” সারা বরষের আশা যে তাহার চূর্ণ হবে আজ! ভাবিল “প্রিয়া গো কোমল হৃদয়, আমি নিতান্ত পাষাণ নিদয় ; তেনারে বক্ষে ব্যথা দিয়ে, হেথা করিতেছি বিরাজ।” * * * যবে রজনী তৃতীয় প্রহর পুর্ণ হ'ল প্রায় ; কাল-বিসূচিকা, ব্যাঘ্রের মত, আসিয়া ধরিল নিদ্রাবিরত, উৎকণ্ঠিত, গমনোদ্যোগী, ব্যাকুল মথুরায়। প্রবীণ বৈদ্য করিল গ্রহণ চিকিৎসার ভার। কখনো মৃত্যু, কখনো ভিষক্, মনে হুল বুঝি হবে পলাতক ;--- তিনটি প্রহর যুদ্ধ করিল সাধ্য যত বার। যখন সূর্য্য উচ্চ গগনে করিল আরোহণ, মৃত্যু হাসিল রক্তনেত্র, আস্ফালি করে লৌহবেত্র, বাজিল তাহার বিজয় ডঙ্কা, জিনিল ঘোর রণ। * * * * * * পর বৎসর আসিল আবার বসন্ত নবীন। হোলির বাদ্য আবার বাজিল, কিষণপ্রসাদ নীরবে কাদিল, আপন কক্ষে যাপিল গোপনে দীর্ঘ সারাদিন। ক্রমে দিনমণি ঢলিয়া পড়িল, দিবস আসন। উত্সব-গৃহে সাহানার সুর বাজিতে লাগিল দ্রুত সুমধুর, আসিল সন্ধ্যা বাধি অঞ্চলে কনক শশী খান। রজনী হইল দ্বিতীয় প্রহর, নিতান্ত নীরব। কিষণ একাকী তখনো জাগিয়া, অনুতাপানলে দহিতেছে হিয়া ; চমকি উঠিল শুনি যেন কোন দুরোত্থিত রব। খুলি গবাক্ষ দেখিল চাহিয়া, শোণের কিনারে, জ্বলেছিল যেথা চিতা মথুরার, সেখানে কে যেন করি চীৎকার, ফিরিছে ছুটিয়া বলিতে বলিতে “যেতে দিলে না রে।” কিষণপ্রসাদ শুনিতে লাগিল “যেতে দিলে না রে।” চন্দ্রস্তারকা অশ্রুনয়ানে চাহি চাহি যেন তারি মুখ পানে, শতবার করি বলিতে লাগিল, “যেতে দিলে না রে।” সকল রাত্রি থামিল না সেই “যেতে দিলে না রে” আজিও সেখানে প্রাতি বৎসর হোলিরজনীতে জাগে সেই স্বর, তীব্র-কাতর আর্ত্তনিনাদ--- “যেতে দিলে না রে।” . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
অকাল-মৃত্যু কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রদীপ” পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩০৫ (ডিসেম্বর ১৮৯৮) সংখ্যায় প্রকাশিত। রচনাকাল ২রা কার্ত্তিক, ১৩০৫ (নভেম্বর ১৮৯৮)। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০। Do we indeed desire the dead Should still be near us at our side? Is there no baseness we should hide? No inner vileness that we dread? - Tennyson. দ্বাপর চলিরা গেল, কলির বত্সর শত হইল অতীত ; একদিন বিশ্বপতি সহসা মন্ত্রণা-গৃহে আসি উপনীত। বদনে বিষাদ ছায়া, চক্ষু তাঁর ছল ছল করুণার জলে, বসিল মন্ত্রীর দল শঙ্কিত বিস্মিত মনে রাজপদতলে। কি যেন ভাবের স্রোত বহিতে লাগিল ব্যাপি বিশ্বচরাচর ; বিশ্ব কি থাকিতে পারে, আকুল আপনি যবে মহা-মহেশ্বর? কতক্ষণ গেল চলি ; প্রভূ তবে কহিলেন--- “শুন মন্ত্রিগণ, রাজোর বিধানগুলি পরিবর্ত্তনের কিছু আছে প্রয়োজন। কলিকালে জীবকুল আচরিছে কত পাপ, কত হিংসা দ্বেষ ; সে পাপের প্রতিফল--- গুরু লঘু দণ্ড নানা করেছি নির্দ্দেশ। সকল দণ্ডের মাঝে, অকাল মরণ দিয়া প্রিয়জনক্ষয়, কঠিন হইতে যেন কঠিন হয়েছে আহা, নিঠুরতাময়! শতটি বত্সর মাত্র প্রবর্ত্তন করিয়াছি কলির বিধান, পৃথিবীর আর্ত্তনাদে পাষাণ গলিয়া গেল, স্বর্গ কম্পমান! আর দণ্ড সমুদয় বরঞ্চ করিয়া দিয়া সুকঠিনতর, অকাল-মরণ হতে আমার সন্তানগণে অব্যাহতি কর। যাহাদের প্রিয়জন অকালে পৃথিবী হতে আনিয়াছ হরি, ফিরাইয়া দেহ সবে পৃথিবীতে পুনর্ব্বার, বিলম্ব না করি।” এ শুভ সম্বাদ নব নিমেষে প্রচার হল স্বর্গলোকময়। কোটি কণ্ঠ সমস্বরে স্বর্গ কাঁপাইয়া দিল গাহি জয় জয়। প্রিজনবিরহিত ন্বর্গগত বহুজন উত্সব পুলকে সাজাল অমরাবতী লক্ষ কোটি পারিজাতে, অসংখ্য আলোকে। কিন্তু বহু নারীজন মন্ত্রীরে কহিল আসি মিনতি করিয়া--- “আমাদের সর্ব্বজনে কেমন করিয়া প্রভু দিবে ফিরাইয়া? আমরা এসেছি ফেলে আমাদের পতিগণে গৃহশূন্য করে’, কিন্ত সে সকল গৃহ আজিও কি শূন্য আছে আমাদের তরে? যদি পুর্ণ হয়ে থাকে,--- যদি দেখি আমাদের স্থান আর নাই,--- কি হবে তা হলে প্রভূ? স্বর্গে, মর্ত্ত্যে, রসাতলে কোথা পাব ঠাঁই?” ইহা শুনি মন্ত্রিবর চিন্তাগ্রস্ত রহিলেন ধরি বহুক্ষণ। কহিলেন অবশেষে--- “সত্য কি হইতে পারে হেন অঘটন? অবশ্য এ কলিকাল, আচরিছে বহু পাপ মর্ত্ত্যবাসিগণে ; প্রেম-অপমান, যাহা ঈশ্বরের অপমান, করিবে কেমনে? বিভুর আদেশ তবে আপাততঃ কিছুকাল স্থগিত রাখিয়া, পরীক্ষার তরে দিব তোমাদের একজনে মর্ত্ত্যে পাঠাইয়া। যে ছিলে জীবিতকালে সকলের সমধিক স্বামীসোহাগিনী, পৃথিবী ভ্রমণ করি আসিয়া বর্ণনা কর সকল কাহিনী।” স্বর্গ খানি আলো করি একটি রমণী ছিল ---যমুনাসুন্দরী। সবে মিলি, পৃথিবীতে পাঠাতে চাহিল তারে নির্ব্বাচন করি। কে না জানে যমুনায় কত ভালবাসিত সে যমুনার স্বামী, যমুনা ছাড়িয়া আর কিছু নাহি ভাবিত সে সারা দিন যামি’। অমরার কত নারী (পরে আসিয়াছে যারা) দেখিয়াছে চোকে, উন্মাদ যমুনা-পতি পথে পথে কেঁদে ফিরে যমুনার শোকে। যমুনার দেশ হতে যে রমণী আসিয়াছে সবার নূতন, সে কহিল---“শুনিয়াছি কেমনে প্রেমিক করে বিরহ-যাপন। কারে না কহিয়া কিছু একদিন গঙ্গাধর ছাড়ি গেল দেশ। বহুকাল বন্ধুগণ কিছু না সম্বাদ পায়, কিছু না উদ্দেশ। অবশেষে একদিন পরিচিত পান্থজন কহিলেক আসি--- মথুরায গঙ্গাধর যমুনা-নদীর কূলে ফিরিছে উদাসী। সেইখানে নিজহাতে রচিয়াছে একখানি মৃত্তিকা-আলয়, মসীবর্ণ লেপিয়াছে গৃহের উপরে, নিম্নে, চারি ভিত্তিময়। যমুনার যাহা ছিল বসন, ভূষণ আদি, গিয়াছে লইয়া ; রাখিয়াছে সমুদয় পরম যতন করি গৃহে সাজাইয়া। কহিয়াছে, জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি সেথা করি বাস, যমুনার সুশীতল সুমধুর কোলে লবে অন্তিম নিশ্বাস।” শুনিয়া সকল কথা দুটি বিন্দু বরষিল যমুনার আঁখি। সে দুর্লভ সুধা-ফল নিমেষে হরিয়া নিল নন্দনের পাখী। যমুনার ছিল এক সুরকন্যা প্রিয়সখী, সঙ্গে লয়ে তায়, চন্দ্রিকা সাগর খানি সস্তরণ করি দোঁহে নামিল ধরায়। মথুরা নগরী দিয়া যমুনা বহিয়া যায় নদী কলস্বনা। যমুনা তাহার তীরে বহু অন্বেষণ করি পতি পাইল না। সখী দুটি, জ্যোতস্না হতে, ফুল-পরিমল হতে, লঘুতরা অতি--- পলকে অনেক দেশ পাতি পাতি অন্বেষিলা, মিলিল না পতি। যখন হইল নিশা সুগম্ভীর দ্বিপ্রহরা, চন্দ্র তন্দ্রাতুর, পাইল যুগল সখী সুনিভৃত শৈলদেশে, পুরী বহুদুর। যমুনার আঁখি দুটি তথা কি দেখিল হায়! ---গঙ্গাধর তার বিবাহ করিয়া পুনঃ পেতেছে নূতন করি সুখের সংসার। আর সে সন্ন্যাসী নাহি উদ্ভ্রান্ত বিরহী যুবা, নাহি ছাই দেহে ; সেজেছে নবীন সাজে, সমর্পি সে ছাইগুলি যমুনার স্নেহে! জানালা রয়েছে খোলা ; শয়ন-মন্দিরে তার জ্যোত্স্না প্রবাহিত, নিদ্রা-সুখে অচেতন, নবীনা প্রেয়সী বালা কণ্ঠে বিলম্বিত। স্বর্গবাসী প্রেতাত্মার অতি সমীপতা হেতু, স্বপ্ন দেখে তায়, আকুল ক্রন্দনে জাগে ; ভুলিতে পারেনি, আহা, আজো যমুনায়! জাগিয়া উঠিয়া বসি, নতনেত্রে ছলছল চাহি প্রিয়ামুখে, অপরাধীটির মত শিহরিয়া শিহরিয়া অনুতাপ-দুঃখে। জীবনের ফুলবনে যেন যমুনার ছায়া তুহিন-সম্পাত! বহুযত্নে সুরবাঁধা হৃদয়বীণার তারে লৌহ-দণ্ডাঘাত! কি দারুণ মর্মব্যথা বাজিল যমুনা-বুকে পুর্বকথা স্মরি! মানুষ হইত যদি, দয়াবতী মুর্চ্ছা আসি নিত জ্ঞান হরি। ধরিয়া সথীর গলা কাঁদিল যমুনা কত ফুঁপিয়া ফুঁপিয়া। প্রিয়সখী সুরবালা কি বলে' সান্ত্বনা দিবে পায় না খুঁজিয়া। কহে বালা, দেখ সখি, দেখ ঐ কত জন, কত লক্ষজন, এইরূপে পৃথিবীতে করিয়াছে প্রণয়ের বিশ্বাসঘাতন। যত কহে দেববালা, পশে না সান্ত্বনা বাণী যমুনার প্রাণে, অবশেষে লয়ে তারে ফিরিয়া চলিয়া গেল স্বর্গধাম পানে। সকল শুনিয়া মন্ত্রী ভাবিলা কেমনে হবে আদেশ পালন। যমুনার মত যারা, তাদের ফিরায়ে দিলে মর্ত্ত্য জ্বালাতন! শুধু যদি তারা যায়, যাদের পাইলে মর্ত্ত্য কোল পাতি লবে, এ মহাবিশ্বের রাজা পক্ষপাত দোষে দোষী হইবেন তবে। যথাকালে মন্ত্রিবর জানাইলা সব কথা বিশ্বপতি-পায়। শুনিয়া বিষাদে বিভু আপন আদেশ-বাণী রোধি দিলা হায়। . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
পরলোক তত্ত্ব কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রদীপ” পত্রিকার বৈশাখ ১৩০৬ (এপ্রিল ১৮৯৯) সংখ্যায় প্রকাশিত। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০। হে গোলাপ, কহ তুমি কার প্রণয়িনী? কেন দুদণ্ডের লাগি হেথায় উঠিলে জাগি? দেখাতে কি রূপ শুধু ওগো গরবিনি? গোলাপ কহিল---“শুন আমার কাহিনী। বহুদিন হ'ল গত, তোমা সবাকার মত মানুষ ছিলাম আমি, স্বামীসোহাগিনী ; এখানে এসেছি আজি সুমধুর বেশে সাজি, আমার সে প্রিয়মুখ দর্শনাকাঙ্ক্ষিণী ;--- এখনি এ পথ দিয়া জাইবেন তিনি।” এ কথা শুনিয়া মনে পরম বিস্ময় উপজিল, কহিলাম করিয়া বিনয় :--- “হে দেবি, আমার প্রিয়া আমারে ছাড়িয়া গিয়া কোখা, কবে, কি কি বেশে মোহিয়া হৃদয়, হয়েছেন, কহ, মম নয়নে উদয় ?” গোলাপ কহিল হাসি---“হে প্রেমিকবর, কত তার লেখা দিব---কহিতে বিস্তর। যে ফুল দেখিয়া তুমি বলেছ---সুন্দর, যে তারা দেখিয়া তুমি বলেছ---সুন্দর, যে গান শুনিয়া তুমি বলেছ---সুন্দর, ফে কাব্য শুনিয়া তুমি বলেছ---সুন্দর, সে কুসুমে, সে তারায়, দে গানে, সে কবিতায়, তোমার প্রেয়সী এসেছিল নিরন্তর। “আমরা পৃথিবী ছাড়ি চলিয়া যে আসি,--- যত কিছু সেথাকার, দেহ ও বাসনাভার, চিতানলে হয়ে যায় ভস্ম রাশি রাশি। শুধু থাকে হেমবৎ প্রেম অবিনাশী। প্রণয় আপদে তাই ঘিরে থাকি সর্ব্বদাই, শত ছদ্মবেশ ধরি আপনা প্রকাশি। নয়নের জল হই, বয়নের হাসি।” . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
নাম লেখা কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রদীপ” পত্রিকার শ্রাবণ ১৩০৬ (জুলাই ১৮৯৯) সংখ্যায় প্রকাশিত। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০। স্বপনে দেখিলাম যেন, এ ধরণীপুর ছাড়িয়া গিয়াছি আমি বহু-বহুদুর পরলোকে ; যেন কোনও পুরুষ @@@@ আমারে বেদের মত প্রাচীন ভাষায় কহিলেন,---"অনুসরি আইস পশ্চাতে।” চলিলাম ;---কতক্ষণ গিয়া তাঁর সাথে দেখিলাম, দুর্গ এক বিপুল আকার সুগভীর ; সভয়ে ছাড়িয়া সিংহদ্বার, প্রথমেই পাইলাম প্রাণমনোরম কুসুম-বাটীকা ; দেখি তার নিরুপম--- শোভা, চিত্ত প্রফুল্ল হইল। তার পরে ক্ষুদ্র কক্ষশ্রেণী,---তার ভিতরে ভিতরে বহুবিধ গন্ধ ও চন্দন, নানা সাজ বস্ত্র অলঙ্কার ;---নিতান্ত দুর্লভ, রাজ--- আকাঙ্ক্ষিত, সে সমস্ত সুখদ্রব্য রাশি ; ---স্বর্গাদপি প্রিয় তাহা মানিবে বিলাসী। তার পরে সংখ্যাতীত প্রকাঁণ্ড আকার কক্ষাবলী। একটির পানে চাহি তার, কহিলেন সে পুরুষ--- “আছে কি স্মরণ, নরজন্ম কতবার করেছ গ্রহণ পৃথিবীতে?---আমি রহিলাম নিরুত্তর তিনি পুনঃ কহিলেন---“হে সুকৃতবর, ইহা এক পুরস্কার ;---যাও, দেখ গিয়া! ঐ কক্ষে,---মহাকাল রেখেছে সঞ্চিয়া তব জন্ম-জন্মান্তের জীবদেহ গুলি। যাহারা এখানে আসে, আনে ফুল তুলি, আনে গন্ধদ্রব্য, নানা বসনভূষণ, আর যত মনোমত সুখোপকরণ, সব দিয়া পরম যতনে, সেবা করে সেই প্রিয় তনুগুলি ;---যাপা দেহ ধরে, দেহ চেয়ে তাহাদের প্রিরতর কিবা? তুমি যাও, স্বেচ্ছামত আজি সারাদিবা পূর্ণ কর মন অভিলাষ।”---এত বলি ধীরে ধীরে সে পুরুষ যাইলেন চলি। আমি সভয় বিস্ময়ে পশিলাম গিয়া সেই কক্ষে ; ---কি আশ্চর্য্য, রয়েছে পড়িয়া বালক, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ কত জন ; কেহ শ্যাম, গৌর কেহ ; বিভিন্ন গঠন @@@@@@@@ শান্তদেহে সুখনিদ্রালীন ; প্রেম, ভক্তি আর স্নেহে রঞ্জিত রয়েছে যেন বদনমণ্ডল প্রত্যেকের। ভাবিলাম, ইহারা সকল আমারি বিভিন্ন মূর্ত্তি! ধরি বহুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম নিশ্চল নয়ন পুত্তলিকাবৎ। ক্রমে পড়িল ম্মরণে মহাপুরুষের বাক্য বিচারিয়া মনে লোহিত চন্দন আর সুবর্ণের তুলি আনিলাম সংগ্রহ করিয়া। দেহগুলি তুলি তুলি একে একে, বক্ষে সবাকার লিখিলাম এ জন্মের প্রেয়সীবালার মধুনাম ; ---প্রতি দেহ হল রোমাঞ্চিত ; প্রতি চক্ষু হয়ে গেল অশ্রুবিগলিত। @@@ - অপাঠ্য অক্ষর। . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |