গল্পকার কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
*
দেবদূত ও বিক্রমাদিত্য
কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রদীপ” পত্রিকার চৈত্র ১৩০৬ (মার্চ ১৯০০) সংখ্যায়
প্রকাশিত। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০।


(একটি ইংরাজি কবিতার ভাবানুবাদ )

দ্বিপ্রহরা বিভাবরী ;---উজ্জয়িনী-পতি
সহসা উঠিলা জাগি শয়ন-মন্দিরে ;
দেখিলা দেবতা এক উজ্জ্বলমূরতি
দাঁড়ায়ে অনতিদূরে অবনত শিরে।

স্বর্ণময় গ্রন্থ এক বামহস্তে তাঁর,
দক্ষিণে লেখনী শোভে হীরক নির্মিত।
দেবতা লিখন রত মনে আপনার,
দেখিয়া বিক্রমাদিত্য পরম বিস্মিত।

দেবতা চরণে রাজা করিয়া প্রণাম,
করপুটে শুধাইলা প্রশ্ন সবিনয় ;---
"ওহে দিব্যধামবাসি, কি তোমার নাম?
কি লিখিছ কহ তুমি হইয়া সদয়।”

দেবতা কহিলা---“আমি দূত ঈশ্বরের,
সকল সংসারময় করিয়া ভ্রমণ
লিখি লিখি লইতেছি নাম প্রতোকের,
ঈশ্বরে প্রণয় করে যত যত জন।”

শুনিয়া বিক্রমাদিত্য জিজ্ঞাসেন তাঁয়,---
“দেখ দেখি, মম নাম আছে কিন্বা নাই।”
দেবতা করিয়া দৃষ্টি কহিলা রাজায়---
“তব নাম তালিকায় দেখিতে না পাই।”

শুনিয়া দুঃখিত রাজা চক্ষু করি নত
কহিলেন---“ভালবাসা ঈশ্বরের প্রতি
নাভি যদি থাকে মম, লিখিও অন্ততঃ
মানবগণেরে আমি ভালবাসি অতি।”
*        *        *
*        *        *
পরদিন নিশীযোগে আসি পুনরায়
দেবতা বিক্রমাদিত্যে দিলা সমাচার ;---
“ঈশর-প্রেমিক-জন-নাম-তালিকায়
ঈশ্বর লিখিলা নাম প্রথম তোমার।”

.         ****************          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
কামনা
কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “দাসী” পত্রিকার অক্টোবর ১৮৯৬ সংখ্যায় প্রকাশিত।
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০।


সারাদিন শুধু তাহারে ভাবিয়া
কাটিয়া যায়।
রাত্রি আসিয়া সে সুখ আমার
রাখে না হায়।
চেতনা, নিদ্রা ; আলোক, আঁধার ;
দিবস, যামিনী ;--- সম অধিকার ;
তবে কি আমার অর্দ্ধ-জীবন
যাবে বৃথায়?
তারে না ভাবিয়া নিশ্বাস লওয়া
---সে ত মিছায়।
চেতনা আমার আছেই তাহার
অনুক্ষণ।
সুপ্তিও চাহি করিতে মাত্র
তার স্বপন।
কোন্ দেবতার কোন্ প্রকরণে
কতকাল ধরি নিয়ত-পূজনে
আমার আকুল মনের বাসনা
হবে পূরণ?
---জীবন হবে কিছু---না---কেবল---
তার---স্মরণ!

.         ****************          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
শেষ দান
কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “দাসী” পত্রিকার জুন ১৮৯৬ সংখ্যায় প্রকাশিত।
মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০।


মনে পড়ে সাথের সে গেহ,
.        ---আহা কত সুখের আলয় ;---
ক্রমে ক্রমে সেদিন আসিল
.        যে দিনেতে না আসিলে নয়।
নয়নের নিবে গেল জ্যোতি
.        বয়নের হাসি গেল ঝরে’ ;---
গৃহ ছাড়ি রহিতে হইবে
.        পরদেশে দীর্ঘকাল ধরে’।
স্নেহময়ী জননী আমার,
.        তাঁর পায়ে প্রণাম করিয়া
রাজপথে বাহির হইনু
.        আঁখিজলে নয়ন ভরিয়া।

শুকতারা তখনো ডোবেনি,
.        গাছপালা তখনো আঁধার
বেশী দূর আসি নাই আমি,---
.        শুনিলাম পদশব্দ কা’র।
দেখিলাম---পশ্চাতে জননী
.        আসিছেন কিসের লাগিয়া ;
কই? কিছু, মনে ত পড়ে না,
.        এসেছি কি ফেলিয়া রাখিয়া?

মা আমার কহিলেন---“বাছা
.        আপনার ইষ্টদেবতায়
যে ফুলেতে পূজা করিয়াছি,
.        সেই ফুল দিলাম তোমায়।
সাথে সাথে রাখিয়ো সর্ব্বদা,
.        অকুশল আসিবে না কাছে ;
পাপ দূরে পলাইয়া যাবে,
.        সে দেশেতে বড় ভয় আছে।”
সেই ফুল ধরিয়ৈ হৃদয়ে
.        চলিলাম দীর্ঘপথ বাহি ;
আজিও তা রয়েছে হৃদয়ে,
.        নিশিদিন তারি পানে চাহি।

স্নেহময়ী প্রকৃতি-জননী
.        ---ওগো মহা জননী আমার!
আসিয়াছি পৃথিবী প্রবাসে,
.        সাথে লয়ে সে ফুল তোমার।
ভাগ্যে মাতা দিয়েছিলে ইহা,
.        তাই ত মা রয়েছি বাঁচিয়া ;
এখানে যে শক্র পদে পদে
.        ফিরিতেছে রাক্ষস সাজিয়া।
এ যে হেথা মরুভূমি মাগো,
.        সে আমার সুধা নির্ঝরিণী ;
এ যে মহা ব্যাধির নরকে
.        সে আমার অমৃতসঞ্জীবনী ;
@@@ মুর্ত্তিমতী বিবেকসুন্দরী
.        সে আমর এ পাপ নিলয়ে,
সে আমার সুখ, সে সন্তোষ,
.        সেই আশা, উৎসাহ হৃদয়ে।

@@ - অপাঠ্য অক্ষর।

.         ****************          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মহা যাত্রা
কবি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “দাসী” পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৮৯৬ সংখ্যায় প্রকাশিত। রচনার তারিখ
১২ই কার্ত্তিক ১৩০১। মিলনসাগরে প্রকাশ ১৩.৬.২০২০।


শুনিয়াছি ভক্তিমার্গ বড়ই সরল,
নিতান্ত নিশ্চিত।
নাহি দস্যুভয়, অতি কোমল, মসৃণ,
কুসুম-বাসিতা।
দিনে-দিনে পথিকের পথ হয় শেষ,
আসে না যামিনী ;
নাহি শ্রান্তি নাহি ক্লেশ, অবসাদ-মেঘ,
নিরাশা-নাগিনী।
নিদাঘ-অনল নাহি, শিশির তুষার,
বরষা-কর্দ্দম ;
শুধু সুখ, শুধু শান্তি, অপার বিশ্বাস,
আশা অনুপম।
কিন্ত হায়, নয়ন মুদিয়া
ও পথে চলিতে হয় ; তাহা নাহি চাহি।
হই নাই ধৈর্য্যহীন, অত শীঘ্র তার
প্রয়োজন নাহি।
সুবিশাল, সুকঠিন, দুরারোহ ঐ
জ্ঞানমার্গ, ও পথে যাইব ;
আজি কালি নাহি পাই, এক দিন তারে
অবশ্য পাইব।
আমি শুধু চাহিনা তাঁহারে,
তাঁর মহিমাও আমি চাহি জানিবারে।
পূর্ণ হয় যদি সে বাসনা,
হয়ত তাঁহারে আমি আর চাহিব না।
বারিবিন্দু দিয়া যদি
সমুদ্র তুলনা করি---
প্রিয়ারে আমার দেখ নাহি চাহি তত
যত তার ভালবাসা হৃদয়ে রেখেছি ভরি।
এ বিপুল বিশ্ব রচনায়
অণুতে অণুতে আমি অন্বেষিব তাঁরে
প্রতিদিন মুগ্ধ হব তাঁহার দয়ায়,
তাঁর স্নেহ, মহিমার নব নব আবিষ্কারে।
প্রতি পুষ্প, প্রতি তারা, প্রতি গান, প্রতি পাখী
প্রতি জননীর মুখ, প্রতি প্রেমিকের আঁখি
প্রতি মেঘ, বৃষ্টিকণা, প্রতি বিজলীর খেলা,
প্রতি রামধনু, প্রতি সিন্দূর-মেঘের মেলা
প্রতিদিন রূপ-গুণ কহিবে তাঁহার
অনন্ত-অপার।
নদ-নদী, জলস্তম্ভ, সিন্ধু, হিমাচল,
গাইসর্, আগ্নেয়-গিরি, উষ্ণ-প্রস্রবণ,
ধুমকেতু, চন্দ্রসূর্য্য, পুর্ণিমা, অরোরা
মনেজগতের মহাতত্ত্ব অগণন ;
সকলের এক ভাষা, এক তান, এক লয়---
আমাদের সৃষ্টিকর্ত্তা অনন্ত মহিমাময়।
যুগ যুগান্তর ধরি,---কল্পান্ত অবধি
সে মহাসঙ্গীত যদি নাহি শুনিলাম,
নাহি যদি ধন্য হইলাম ;
কেমনে জনিব তাঁরে, কেমনে বাসিব ভাল,
কেমনে করিব পূজা, হৃদয় করিব আলো?
এইরূপে প্রতিদিন হইব মহান,
দেবতা সমান।
স্বজন করিয়াছেন তিনি যে আমারে,
সার্থকতা কোথা হ'ল তাঁর,
মাণিক্য না হইলাম যদি
উজ্জ্বল করিয়া এই সৃষ্টি-পারাপার?
নাহি জানি কত লক্ষ কত কোটি যুগ হ'ল,
বাযুভরে উড়িতাম তৃণ, শুষ্কপাতা ;
আজি দেখ কি পরিবর্তন!

আজি জানি কে আমার অস্তিত্ব-বিধাতা।
কত লক্ষ লক্ষ কত কোটি কোটি যুগ পরে,
নিখিল ব্রহ্মাণ্ড মাঝে সর্ব্বত্র করিয়া বাস,
এই আমি দাঁড়াইব তাঁর সিংহাসন-তলে,
তিনি হাসিবেন সুখে স্নেহসম্ভাষণহাস।
তবে না সম্পূর্ণ হবে উদ্দেশ্য তাঁহার
সেই তৃণ সৃষ্টি করিবার!

তাই-আমি নাহি যা’ব চক্ষু কর্ণ রোধ করি
নাম-জপ-তরণীতে ভক্তি-নদী বাহি ;
হে কাণ্ডারী গুরুদেব, চরণে প্রণাম করি,
অত শীঘ্র অধমের মোক্ষে কায নাহি।
এস সখী স্বাধীনতা---সাথে লয়ে এস
জ্যোতিষ বিজ্ঞান রাশি, সাহিত্য দর্শন আদি,
দুই জনে জ্ঞানপথে পরম কৌতুকে
চলি দিবারাতি।
মহাসৌন্দর্য্যে মাঝে ডুবিয়া ডুবিয়া
হয়ে যাব পরম সুন্দর ;
মহা মহিমার ছবি দেখিয়া দেখিয়া
প্রতি দিন হব মহত্তর।
প্রতি দিন সুদুর্জ্জয় বাড়িবে শকতি

পদে পদে বাধাবিঘ্ন দলি ;---
স্বপ্নাতীত যাহা, তাহা ঘটবে সহজে,
শকতির সীমা যাবে চলি।
একদিন পথ শেষ হবে,
দাঁড়াইব সম্মুখে তাঁহার ;
যবে হয্ আসিবে সে দিন,
পথেও ত আনন্দ অপার।

.         ****************          
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর