ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - পাতার উপরে . . .
১৮৭৬ সালের ২৯শে জুলাই, Indian Association of the Cultivation of Science এর প্রতিষ্ঠা হয়।
জন্মলগ্ন থেকেই অনেক বাঙালী বিশিষ্টজনেরা এই প্রতিষ্ঠানটির অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু
বিদ্যাসগর, বঙ্কিমচন্দ্র এবং আরও অনেকে তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ডাঃ মহেন্দ্রনাথ সরকার এবং তাঁর Indian Association of the Cultivation of Science এর কার্যকলাপ
নিয়ে মূলত প্রতিবাদী লেখা, দুবার লেখেন। প্রথম বার মহেন্দ্রলাল জীবিত থাকতে ১৩০৫ সালের (১৮৯৮খৃ)
ভারতী পত্রিকায়। দ্বিতীয়বার মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর ১৩১২ সালে (১৯০৫খৃ)।
ওপরে “ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ও Indian Association for the Cultivation of Science” অনুচ্ছেদে আমরা
দেখেছি যে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র, মহেন্দ্রলালকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে তিনি কলকাতার
ধনবানদের কাছে আবেদন করে বলেছিলেন . . .
“এই অনুষ্ঠান পত্র আজ আড়াই বত্সর হইত প্রচারিত হইয়াছে, এই আড়াই বৎসরে বঙ্গসমাজ ৪০ চল্লিশ
সহস্র টাকা সাক্ষর করিয়াছেন। মহেন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন যে- এই তালিকা খানি একটি আশ্চর্য্য দলিল।
ইহাতে যেমন কতকগুলি নাম থাকিতে স্পষ্টীকৃত হইয়াছে, তেমনি কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত
হইয়াছে । তিনি আর কিছু বলিতে ইচ্ছা করেন না।”
এই “কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত হইয়াছে” দের মধ্যে সম্ভবত তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর
দিকেও ইঙ্গিত করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। রবীন্দ্রনাথের তখন মাত্র ১৫ বছর বয়স।
১৮৯৯ সালে, প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্ন-এর উপস্থিতি তে ডাঃ
মহেন্দ্রলাল সরকার, বিজ্ঞানের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ কম বলে দেশবাসীর উদাসীনতার প্রবল
সমালোচনা করেন। আমরা ২৭ এপ্রিল ১৮৯৯ তারিখে অনুষ্ঠিত, 22nd Annual Meeting of the Indian
Association for The Cultivation of Science এর Annual Report থেকে ডাঃ সরকারের ভাষণের সেই অংশটি
এখানে তুলে দিচ্ছি . . .
“It is now for you, my countrymen of Bengal, to determine what you are to do with this Science Association
which you have established and which you have advanced so far, whether you are to advance it further or
leave it as it is to die of inanition. It cannot continue long without endowed professorship. From the very
beginning I have been telling you that in order to enable the Association to do its legitimate work, that of
research, you must have men devoting their whole time and attention to special subjects, and that you must
provide for them. But somehow or other I have not been able to convince you of this necessity, and the result
is that while we are sleeping over our oars a sister presidency has startled the country by what appears to
be a new scheme involving an outlay calculated to tax the resources of an empire. Neither the scheme nor
the estimate for the carrying it out is new. I have been giving out my views of both whenever I could get an
opportunity for doing it, I have been giving you accounts of the costs of the various laboratories of the world,
of the princely and disinterested gifts for the endowment of new professorships here, or of whole institutes
there. But these stories coming from hackneyed lip have apparently had no effect. Now that I am feeling that
I have come very nearly to the end of life’s journey I do not see what more I can do than solemnly and
imploringly to ask you to take the burden from off my shoulders and transfer it to yours.”
এখানে ডাঃ সরকার দুঃখ করে বলেছেন . . .
“ . . . and the result is that while we are sleeping over our oars a sister presidency has startled the country by
what appears to be a new scheme involving an outlay calculated to tax the resources of an empire.”
এখানে যে ঘটনাটির কথা উনি বলছেন সেই ঘটনাটি হলো - বম্বের জামশেদজী নাসেরওয়াঞ্জী টাটা (J.N.Tata),
১৯৮৩ সালে জাপান থেকে উত্তর আমেরিকা যাবার সময় সেই জাহাজে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত
হয়ে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থা তৈরীর কথা ভেবেছিলেন, ১৮৮৯ সালের বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে
প্রদত্ত আচার্য্য লর্ড রিয়ে-এর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তা স্থাপন করা স্থির করেছিলেন। এরজন্য তিনি তাঁর
সম্পত্তির একটি বড় অংশও নির্ধারণ করে রাখার কথা সর্বসমক্ষে জানালেন।
দুর্ভাগ্যবশতঃ জে.এন.টাটা তাঁর প্রস্তাবিত বিজ্ঞান মন্দির, তাঁর জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত হতে দেখে যেতে
পারেন নি। ব্রিটিশ সরকারে সঙ্গে এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা ইত্যাদি চলার পরে ১৯০৯ সালে
মহীশূররের রাজার দান করা, ব্যাঙ্গালোরের ৩৭১ একর জমিতে Indian Institute of Science স্থাপিত হয়। সেই
সময়ে সেই সংস্থায় টাটার দানের পরিমাণ প্রতি বছরে ছিল ১.২৫ লক্ষ টাকা।
স্বাভাবিকভাবে মহেন্দ্রলাল সরকারের মনে হতাশা দানা বেঁধেছিল যে কলকাতার ধনীরা যদি তাঁর প্রতিষ্ঠিত
Indian Association of the Cultivation of Science এর উপর আরেকটু দরাজ-হস্ত হতেন তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের
উদ্বোধনের ২২ বছরের মধ্যে আরও অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তা হয় নি। ১৮৯৯ সালে
মহেন্দ্রলালের ৬৬ বছর বয়সে তিনি মনে করতেই পারেন যে তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি পৌঁছে গেছেন।
সে কথাই তিনি উল্লেখ করে বলেছেন যে তিনি হতাশ হয়েছেন এবং অন্য কেউ তার দায়িত্বভার গ্রহণ
করুণ। আর মাত্র পাঁচ বছর পর ২৩.২.১৯০৪ তারিখে তিনি পরলোক গমন করেন। তখনকার গড়-আয়ু (Life
expectancies) ধরলে মহেন্দ্রনাথ কোনও ভুল কথা বলেন নি।
[ এখানে আমরা উল্লেখনীয় মনে করছি যে তখন (১৯০০ সালে) দেশবাসীর গড়-আয়ু (Life expectancies) ছিল মাত্র ২৩-২৬ বছর।
Middle East Journal of Age and Ageing, Volume 12, 3 October 2015 সংখ্যায়, বাগস্মৃতা ভাগবতী ও লবানন্দ চৌধুরী দ্বয়ের
(Bagsmrita Bhagawati & Labananda Choudhury), “Generation Life Table for India, 1901-1951” প্রবন্ধে আমরা তা স্পষ্ট দেখতে
পাই। লেখাটি http://www.me-jaa.com/ ওয়েবসাইটে পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . . । ]
রবীন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথের বাঙালী জাতিকে ব্রিটিশ ছোটলাটের (লেফটেনান্ট গভর্নর ম্যাকেঞ্জি) সামনে
দোষারোপ করা ভাষণে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে "ভারতী" পত্রিকায় এ নিয়ে লিখেছিলেন। আমরা সেই লেখার
কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। ১৩০৫ সালের (১৮৯৮খৃ) "ভারতী" পত্রিকায় "প্রসংঙ্গকথা ১", প্রবন্ধে তিনি
লিখেছিলেন . . .
“অল্পকাল হইল বাংলাদেশের তৎসাময়িক শাসনকর্তা ম্যাকেঞ্জিসাহেবকে সভাপতির আসনে বসাইয়া মান্যবর
শ্রীযুক্ত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় তাঁহার স্বপ্রতিষ্ঠিত সায়ান্স আসোসিয়েশনের দুরবস্থা উপলক্ষে
নিজের সম্বন্ধে করুণা, স্বদেশ সম্বন্ধে আক্ষেপ, এবং স্বদেশীয়ের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করিয়াছেন। ব্যাপারটি
সম্পূর্ণ শোচনীয় হইয় উঠিয়াছিল।
তাঁহার সমস্ত বক্তৃতার মধ্যে একটা নালিশের সুর ছিল। বাদী ছিলেন তিনি, প্রতিবাদী ছিল তাঁহার অবশিষ্ট
স্বজাতিবর্গ এবং জজ ও জুরি ছিল ম্যাকেঞ্জিপ্রমুখ রাজ-পুরুষগণ। এ বিচারে আমাদের নিরপরাধে খালাস
পাইবার আশামাত্র ছিল না।
কবুল করিতেই হইবে, আমাদের অপরাধ অনেক আছে এবং সেজন্য আমরা লজ্জিত--- অথবা সুগভীর
অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য-বশত লজ্জাবোধও আমাদের নাই। কিন্তু সেই অপরাধখণ্ডনের ভার আমাদের দেশের
বড়োলোকদের উপর। মানবসমাজের বিচারালয়ে বাঙালির নাম আসামীশ্রেণী হইতে খারিজ করিয়া লইবার
জন্যই তাঁহারা জন্মিয়াছেন, সেই তাঁহাদের জীবনের সার্থকতা। নালিশ করিবার লোক ঢের আছে এবং
বাঙালির নামে নালিশ শুনিবার লোকও রাজপুরুষদের মধ্যে যথেষ্ট মিলিবে। . . .
. . .অবশ্য সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি মহেন্দ্রবাবুর অকৃত্রিম অনুরাগ আছে এবং সেই. অনুরাগের টানে
তিনি অনেক করিয়াছেন। কিন্তু অনেক করিয়াছেন বলিয়া বিলাপ না করিয়া তাঁহাকে যে আরও অনেক
করিতে হয় নাই সেজন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানপ্রচারের উৎসাহে কোনো মহাপুরুষ
জেলে গিয়াছেন, কোনো মহাপুরুষকে অগ্রিতে দগ্ধ হইতে হইয়াছে। বড়োলোক হইয়া বড়ো কাজ করিতে
গেলে এরূপ অসুবিধা ঘটিয়া থাকে।
মহেন্দ্রবাবুর অপেক্ষা অধিকতর চেষ্টা করিয়া তাহা অপেক্ষা অধিকতর নিষ্ফল অনেকে হইয়াছেন। ডাক্তার
সরকারকে জিজ্ঞাসা করি, আজ পর্যন্ত সমস্ত বঙ্গদেশে এমন কয়টা অনুষ্ঠান আছে যে নিজের ঘর-দুয়ার
ফাঁদিতে পারিয়াছে, বহুব্যয়সাধ্য আসবাব সংগ্রহ করিয়াছে, যাহার স্থায়ী অর্থের সংস্থান হইয়াছে, এবং
ষাহার সভাপতি দেশের ছোটোলাট বড়োলাট সাহেবকে সম্মুখে বসাইয়া নিজের মহৎ ত্যাগস্বীকার
ঘোষণাপূর্বক অশ্রুপাত করিবার দুর্লভ অবসর পাইয়াছে। যতটা হইয়াছে বাঙালি তাহার জন্য ডাক্তার
সরকারের নিকট কৃতজ্ঞ, কিন্তু সেজন্য তিনিও বাঙালির নিকট কতকটা কুতজ্ঞতা স্বীকার করিতে পারিতেন।
বড়োলোকেরা বড়ো কাজ করিয়া থাকেন কিন্তু তাঁহারা আলাদিনের প্রদীপ লইয়া জন্মগ্রহণ করেন না।
কাজেই তাঁহারা রাতারাতি অসাধ্য সাধন করিতে পারেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে উচ্চপদস্থ
রাজপুরুষদের নাম ছোটোখাটো আলাদিনের প্রদীপবিশেষ। সেই প্রদীপের সাহায্যে এবং ভাক্তার সরকারের
নিজের নাম ও চেষ্টার জোরে এই বিজ্ঞানচর্চাবিহীন বঙ্গদেশে অকম্মাৎ পাকা ভিত এবং যন্ত্রতন্ত্রসহ এক
সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশন উঠিয়া পড়িল। ইহাকে একপ্রকার ভেলকি বলা যাইতে পারে। কিন্তু বাস্তবজগতে
আরব্য উপন্যাস অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে না। ভেলকির জোরে জনসাধারণের মনে বিজ্ঞানের প্রতি
অনুরাগ সঞ্চার করা সম্ভব নহে। আজ প্রায় সিকি শতাব্দীকাল বাংলাদেশে বিজ্ঞানের জন্য একখানা
পাকাবাড়ি, কতকগুলি আসবাব এবং কিঞ্চিৎ অর্থ আছে বলিয়াই যে বিজ্ঞান আপনা-আপনি গোকুলে বাড়িয়া
উঠিতে থাকিবে এমন কোনো কথা নাই। আরও আসবাব এবং আরও টাকা থাকিলেই ষে বিজ্ঞান আরও
ফুলিয়া উঠিবে এমনও কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম দেখা যায় না।
অবশ্য, দেশ কাল পাত্র সমস্তই যোলো আনা অনুকূল যদি হয় তবে তাহার মতো সুখের বিষয় আর-কিছুই
হইতে পারে না। কিন্তু সর্বত্রই প্রায় কোনো-না-কোনোটা সন্ধন্ধে টানাটানি থাকেই ; আমাদের এ দরিদ্র দেশে
তো আগাগোড়াই টানাটানি। অন্তত বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের যেমন দেশ, তেমনই কাল, তেমনই পাত্র! এখানে
সায়ান্স অ্যাসোসিয়েশন নামক একটা কল জুড়িয়া দিলেই যে বিজ্ঞান একদমে বাঁশি বাজাইয়া রেলগাড়ির
মতো ছুটিতে থাকিবে, অত্যন্ত অন্ধ অনুরাগও এরূপ দুরাশা পোষণ করিতে পারে না। গাড়ি চলে না বলিয়া
দেশাধিপতির নিকট দেশের নামে নালিশ রুজু না করিয়া আপাতত রাস্তা বানাইতে শুরু করা কর্তব্য।”
- প্রসঙ্গকথা ১, "ভারতী" পত্রিকার বৈশাখ ১৩০৫ (এপ্রিল-মে ১৮৯৮) সংখ্যা। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত, রবীন্দ্র
রচনাবলী, ১২শ খণ্ড ৫০৫-পৃষ্ঠা। “প্রসঙ্গকথা ১” লেখাটির PDF মিলনসাগরে পড়তে এখানে ক্লিক করুন...।
যখন তিনি এই লেখাটা লিখছেন (১৩০৫ বঙ্গাব্দ), তখনও রবীন্দ্রনাথের, গীতাঞ্জলীর একটিও কবিতা লেখা হয়
নি। আর তিন বছর পরে গীতাঞ্জলীর অন্তত দুটি কবিতা তিনি লিখবেন। আরও ১২ বছর পরে (১৩১৭ব,
১৯১০খৃ) বাংলাভাষায় গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হবে। ১৫ বছর পরে (১৩২০ব, ১৯১৩খৃ) ভূষিত হবেন নোবেল
পুরস্কারে।
এত তীব্র, জ্বালাময়ী এবং ব্যাঙ্গাত্মক লেখাতে আমাদের পরিচিত উদার, বিনয়ী ও ক্ষমাশীল রবীন্দ্রনাথকে
যেন চেনাই যাচ্ছে না! গীতাঞ্জলীর পরিণত রবীন্দ্রনাথ ইনি নন। কেন তিনি এত কটুভাষাতে বৃদ্ধ ডাঃ
মহেন্দ্রলাল সরকারের বিরুদ্ধে লিখতে গেলেন, তা আজ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিবার্য্যভাবেই।
রবীন্দ্রনাথ কি অ্যালবার্ট হলে সিস্টার নিবেদিতার বক্তৃতার পরে করা মহেন্দ্রলালের ব্যাঙ্গাত্মক উক্তির জন্যই
তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন? কারণ মহেন্দ্রলাল ছোটলাটের সামনে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে
সম্ভবত জুলাই মাসে তাঁদের বাত্সরিক অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০৫ বঙ্গাব্দ
অর্থাৎ ১৮৯৮-৯৯ সালেই। সিস্টার নিবেদিতার বক্তৃতার ঘটনাটি ঘটে ১৮৯৯ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, সেটিও
১৩০৫ বঙ্গাব্দেই। দুর্ভাগ্যবশত ১৩০৫ বঙ্গাব্দের "ভারতী" পত্রিকা আমরা হাতে পাইনি। লেখাটি পেয়েছি
রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে, যেখানে কেবল ১৩০৫ সালটিই উল্লিখিত রয়েছে। তাই আমরা সঠিকভাবে বলতে
পারছি না যে রবীন্দ্রনাথের লেখাটি "ভারতী"-র কোন সংখ্যায় বেরিয়েছিল। তবে, যদি রবীন্দ্রনাথের
"প্রসংঙ্গকথা ১" প্রবন্ধটি "ভারতী" পত্রিকার ফাল্গুন অথবা চৈত্র সংখ্যাতে বেরিয়ে থাকে, তাহলে আমরা
নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে অ্যালবার্ট হলের এই ঘটনাই রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটির পেছনে কাজ করেছিল
। সিস্টার নিবেদিতা তখন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথেরও অতি কাছের বন্ধুস্থানীয় হয়ে
পড়েছিলেন। তিনিই সিস্টার নিবেদিতাকে "লোক-মাতা" আখ্যা দিয়েছিলেন।
এই বিষয়ে এখানে তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া, মিলনসাগরের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য এই মুহূর্তে সম্ভব
নয়। কিন্তু অন্যত্র খুব সুন্দরভাবে, এই বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছে গুরুচণ্ডালী ওয়েবসাইটের
“মুক্তচিন্তার পথিক” নামক লেখকের পাতায়। তাঁর চমত্কার সুন্দর লেখাটি এবং সেই পাতায় তর্ক-বিতর্ক,
আগ্রহীদের জন্য অবশ্য-পাঠ্য বলে আমরা মনে করি। সেই পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
এরপরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে প্রচলিত ইংরেজী ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনকে দায়ী করেছেন
বাঙালীর বিজ্ঞানের প্রতি অনিহার কারণ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা
করা গেলে বিজ্ঞানকে এদেশে জনপ্রিয় করা যেতো। তিনি বিজ্ঞানের, বাংলায় পরিভাষা রচনার কথাও
বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫সালে (১৩১২ বঙ্গাব্দ) আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। পরলোকগত ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে
এখানে “মহাত্মা” সম্বোধন করলেও এবার তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাকে কাঠগড়ায় তুলে বলেছেন,
“বিজ্ঞানসভার মতো কর্মশূন্য সভা আমাদের জাতির পক্ষে লজ্জার বিষয়। ইহা আমাদের জাতির পক্ষে নিত্য
কুদৃষ্টান্ত ও নিরুৎসাহের কারণ"। প্রবন্ধটি নাতিদীর্ঘ বলে আমরা এবার “বিজ্ঞানসভা” শিরোনামের পুরো
প্রবন্ধটাই এখানে তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য . . .
“স্বর্গগত মহাত্মা মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় গবর্মেন্টের উৎসাহে ও দেশের লোকের আনুকুল্যে একটি
বিজ্ঞানসভা স্থাপন করিয়া গেছেন।
দেশে বিজ্ঞানপ্রচারই এই সভার উদ্দেশ্য।
আমাদের দেশের লোকহিতকরী সভাগুলির মতো এ সভাটি নিঃস্ব নয়। ইহার নিজের চালচুলা আছে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, দেশে বিজ্ঞানচর্চার তেমন ভালোরকম সুযোগ জুটিতেছে না। প্রেসিডেন্সি
কলেজে সম্প্রতি কিছু বন্দোবস্ত হইয়াছে, কিন্ত সেখানে আমরা পরাধীন, তাহার 'পরে আমরা অধিক ভরসা
রাখি না। আমাদের ছেলেদের যে বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই নাই, সেখান হইতে এমন খোঁটা খাইবার সম্ভাবনা আমাদের
আছে।
বিজ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে দেশের এমন দুরবস্থা অথচ এই বিদ্যাদুর্ভিক্ষের মাঝখানে বিজ্ঞানসভা তাঁহার পরিপুষ্ট
ভাণ্ডারটি লইয়া দিব্য সুস্থভাবে বসিয়া আছেন।
সেখানকার হলে মাঝে মাঝে লেকচার হুইয়া থাকে জানি---সেটা কলেজের লেকচারের মতো--- তেমন
লেকচারের জন্য কোনো বিশেষ বন্দোবস্তের বিশেষ প্রয়োজন নাই।
যাহা হউক, এটুকু নিঃসন্দেহ যে, বিজ্ঞানসভা নাম ধরিয়া একটা ব্যাপার এ দেশে বর্তমান এবং তাহার
যন্ত্রতন্ত্র-অর্থসামর্থ্য কিঞ্চিৎ পরিমাণে আছে।
আমাদের যাহা নাই, তাহার জন্য আমরা রাজদ্বারে ধন্না দিয়া পড়ি এবং চাঁদার খাতা লইয়া গলদ্ঘর্ম হইয়া
বেড়াই--- কিন্তু যাহা আছে, তাহাকে কেমন করিয়া কাজে লাগাইতে হইবে, সেদিকে কি আমরা দৃষ্টিপাত
করিব না। আমাদের অভাবের মাঝখানে এই যে বিজ্ঞানসভা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, ইহার কি ঘুম ভাঙাইবার
সময় হয় নাই।
আমাদের দেশে অধ্যাপক জগদীশ, অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র দেশবিদেশে যশোলাভ করিয়াছেন, বিজ্ঞানসভা কি
তাঁহাদিগকে কাজে লাগাইবার জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা করিতেছেন। দেশের বিজ্ঞানসভা দেশের বিজ্ঞানবীরদের
মুখের দিকে তাকাইবেন না? ইহাতে কি তাহার লেশমাত্র গৌরব বা সার্থকতা আছে।
যদি জগদীশ ও প্রফুল্লচন্দ্রের শিক্ষাধীনে দেশের কয়েকটি অধ্যবসায়ী ছাত্রকে মানুষ করিয়া তুলিবার ভার
বিজ্ঞানসভা গ্রহণ করেন, তবে সভা এবং দেশ উভয়েই ধন্য হুইবেন।
স্বদেশে বিজ্ঞার্ন প্রচার করিবার দ্বিতীয় সদুপায়, স্বদেশের ভাষায় বিজ্ঞান প্রচার করা। যতদিন পর্যন্ত না
বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের বই বাহির হইতে থাকিবে, ততদিন পর্যস্ত বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের
শিকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।
অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় প্রভৃতি কয়েকজন বিজ্ঞানপণ্ডিত, দেশের ভাষায় দেশের লোকের কাছে
বিজ্ঞানের পরিচয় দিতে উদ্যত হইয়াছেন। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে সেজন্য তাঁহাদের নাম থাকিয়া যাইবে।
কিন্তু বিজ্ঞানসভা কী করিলেন।
দেশের প্রতিভাবান্ ব্যক্তিদিগকে ও সুযোগ্য অনুসন্ধিত্সুদিগকে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ দান করা, ও দেশের
ভাষায় সর্বসাধারণের পক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষাকে সুগম করিয়া দেওয়া, বিজ্ঞান প্রচারের উদ্দেশে বিজ্ঞানসভার এই
দুটি মস্ত কাজ আছে ; ইহার মধ্যে কোনোটাই তিনি করিতেছেন না।
কেহ যেন না মনে করেন যে, আমি বিজ্ঞানসভার সম্পাদক প্রভৃতিকে এজন্য দায়ী করিতেছি। মন্দিরে প্রদীপ
জ্বালাইয়া রাখিবার ভার তাঁহাদের উপরে আছে মাত্র। কিন্তু সভা যে আমাদের সকলের। ইহা যদি সমস্ত
আয়োজন উপকরণ লইয়া নিষ্ফল হইয়া পড়িয়া থাকে, তবে সেজন্য আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। ইহাকে কাজে
লাগাইবার কর্তা আমরা সকলেই, কোনো ব্যক্তিবিশেষ নহে।
আমরা স্বকীয় শাসনের অধিকার লইবার জন্য রাজদ্বারে প্রার্থনা করিতেছি। কিন্তু বিজ্ঞানসভার মতো
ব্যাপারগুলি দেশের জমি জুড়িয়া নিক্ষল হইয়া পড়িয়া থাকিলে প্রতিদিন প্রমাণ হইতে থাকে যে, আমরা
স্বকীয় শাসনের অধিকারী নহি। কারণ, যে-অধিকার আমাদের হস্তে আছে তাহাকে যদি ব্যর্থ করি, তবে
যাহা নাই তাহাকে পাইলেই যে আমরা চতুর্ভুজ হইয়া উঠিব এ কথা স্বীকার করা যায় না। এই কারণে
বিজ্ঞানসভার মতো কর্মশূন্য সভা আমাদের জাতির পক্ষে লজ্জার বিষয়। ইহা আমাদের জাতির পক্ষে নিত্য
কুদৃষ্টান্ত ও নিরুৎসাহের কারণ।
আমার প্রস্তাব এই যে, বিজ্ঞানসভা যখন আমাদের দেশের জিনিস, তখন ইহাকে হাতে লইয়া ইহার দ্বারা
যতদূর পর্যন্ত সম্ভব দেশের কাজ করাইয়া, স্বজাতির অন্তত একটা জড়তা ও হীনতার প্রত্যক্ষ প্রমাণকে দূর
করিয়া দিতে যেন কিছুমাত্র বিলম্ব না করি।”
- বিজ্ঞানসভা, ভারতী পত্রিকা ১৩১২। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২শ খণ্ড ৫১৮-পৃষ্ঠা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বিজ্ঞানসভা” লেখাটির PDF মিলনসাগরে পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
স্বদেশিয়ানা, ডাঃ মহেন্দ্রলালের মজ্জাগত ছিল। কেউ এর অন্যথা বললে তা ঘোরতর অন্যায়-কথন ছাড়া আর
কিছুই হবে না। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর কাছে চর্চার ভাষা কি হওয়া উচিত এই বিষয়টি বোধহয়
গৌণ ছিল। তাঁর এবং তাঁর বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে আর কোনও শর্ত ছিলো না। তাই তিনি বিজ্ঞানচর্চার ভাষা
নিয়ে মাথা ঘামান নি।
রবীন্দ্রনাথ ওই প্রবন্ধে দুজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের
কথাও উল্লেখ করেছেন, যাঁরা ডাঃ সরকারের বিজ্ঞান সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই দুজনেই রবীন্দ্রনাথের
কাছের মানুষ ছিলেন। এই দুজনেই মহেন্দ্রলালের অ্যাসোসিয়েশনে লেকচার দিতে যেতেন বলে জানি।
জগদীশচন্দ্র বসু তো সেখানে প্র্যাক্টিকাল ক্লাসও নিতেন। তিনি ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত মহেন্দ্রলাল সরকারের
অ্যাসোসিয়েশানে লেকচার দিয়েছিলেন।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার নিজে নোবেল পুরস্কার পান নি ঠিকই, কিন্তু ১৯৩০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত
অ্যাসোসিয়েশনেই গবেষণা চালিয়ে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন তাঁর “রামন এফেক্ট অফ লাইট” আবিষ্কারের জন্য
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
মহেন্দ্রলাল, ভেঙ্কট রামনের নোবেল দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা দেখে গিয়েছিলেন।
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের নোবেল প্রাপ্তির পরে রবীন্দ্রনাথের
কোনও উদ্ধৃতি বা প্রতিক্রিয়া এখনও যোগাড় করে উঠতে পারি নি। তিনি কি রামনের নোবেল
প্রপ্তির পরে, মহেন্দ্রলাল ও তাঁর ইন্সটিটিউট ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্স এর প্রতি তাঁর মত পরিবর্তন
করেছিলেন? এ বিষয়ে আমরা রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যে তাঁরা যেন এই বিষয়ে
আলোকপাত করেন। আমরা তাঁদের বক্তব্য এখানে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরবো।
অনেক পরে ১৯৮৩ সালে, নোবেল পান ভেঙ্কট রামনের ভাইপো সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর যিনিও তাঁর
বিজ্ঞানজীবনের গবেষণা শুরু করেছিলেন মহেন্দ্রলালের তৈরী করা সংস্থাতেই। তাঁর জীবনের সম্ভবত প্রথম
গবেষণা পত্র অ্যাসোসিয়েসন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্স থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ডিসার্টেশনটি
পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
কবি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার - জন্মগ্রহণ
করেন হাওড়া জেলার পাইকপাড়ায় (মুন্সিরহাট)।
পিতা তারকনাথ সরকার ও মাতা অঘোরমণি দেবী।
তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মহেন্দ্রলাল
ছিলেন জ্যেষ্ঠ। মহেন্দ্রলালের মাত্র ৫ বছর বয়সে
পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর ভাইয়ের সাথে তাঁকে
এনে রাখা হয় কলকাতার নেবুতলায় তাঁর মামার
বাড়ীতে। ১৮৫৫ সালে ছাত্রাবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়
রাজকুমারী দেবীর সঙ্গে।
আমরা মিলনসাগরে কবি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কবিতা-গান তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে
দিতে পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা। এই পাতা, আধুনিক ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চিন্তা ও গবেষণার
জনক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতি মিলনসাগরের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
উত্স -
- শিশিরকুমার মিত্র সম্পাদিত “সচিত্র শিশির” পত্রিকার ১৩৩৩ সালের শারদিয়া সংখ্যার (সেপ্টেম্বর-
অক্টোবর ১৯২৬) “মণীষা-মন্দিরে” নামক বিগতজনদের স্মৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধ।
- Pundit Sivanath Sastri, “Men I have Seen”, 1919.
- শিবনাথ শাস্ত্রীর “Men I have Seen” গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ “মহানপুরুষদের সান্নিধ্যে”, ১৯৪৯, গ্রন্থের “ডাঃ
মহেন্দ্রনাথ সরকার” প্রবন্ধ।
- ডাঃ শরত্চন্দ্র বসু, “Dr. Sircar His Life” ।
- নিজের প্রতিষ্ঠিত The Calcutta Journal of Medicine এর জুলাই ১৯০২ সংখ্যায় প্রকাশিত, ডাঃ
মহেন্দ্রলাল সরকারের “Story of my conversion to Homeopathy”। মিলনসাগরে এই প্রবন্ধের PDF কপি
পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন . . .।
- A. Jayaraman, "Chandrasekhar Venkata Raman – A Memoir", 2017. বইটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
- বঙ্গদর্শন পত্রিকা, “ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা”, ভাদ্র ১২৭৯ (অগাস্ট ১৮৭২) সংখ্যা, ডাঃ মহেন্দ্রলাল
সরকার এবং সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবেদন।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, "প্রসঙ্গকথা ১", "ভারতী" পত্রিকা ১৩০৫। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত, রবীন্দ্র রচনাবলী,
১২শ খণ্ডস ৫০৫-পৃষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “প্রসঙ্গকথা ১” লেখাটির PDF মিলনসাগরে পড়তে এখানে
ক্লিক করুন . . . ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, "বিজ্ঞানসভা", ভারতী পত্রিকা ১৩১২। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত, রবীন্দ্র রচনাবলী,
১২শ খণ্ড ৫১৮-পৃষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বিজ্ঞানসভা” লেখাটির PDF মিলনসাগরে পড়তে এখানে
ক্লিক করুন . . . ।
- সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, "সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান" ১ম খণ্ড, ২০১০।
- Indian Association for the Cultivation of Science এর ওয়েবসাইট - http://iacs.res.in/index/index.html।
- মুক্তচিন্তার পথিক, “বিজ্ঞানসভা : মহেন্দ্রলাল ও রবীন্দ্রনাথ”, গুরুচণ্ডালী.কম।
- অবন্তিকা পাল, “শ্রীরামকৃষ্ণের ডাক্তার’ মহেন্দ্রলাল”, বঙ্গদর্শন.কম।
- অনিতেশ চক্রবর্তী, “রামকৃষ্ণদেবকেও ধমক দিতেন যে নাস্তিক ডাক্তার”, বঙ্গদর্শন.কম।
- Sister Nivedita’s lecture on Goddess Kali, Get Bengal.com.
- গুঞ্জন ঘোষ, "নিবেদিতার কালী", বর্তমান পত্রিকা, ।
- Bagsmrita Bhagawati & Labananda Choudhury, "Generation Life Table for India", 1901-1951, Middle
East Journal of Age and Aging. http://www.me-jaa.com.
- Saroj Upadhyay & Sudeshna Gupta, "Remembering a pioneer of scientific research", March 1, 2017.
The Statesman.
- পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, "বিজ্ঞানসভা থেকে রামকৃষ্ণদেব, কাঠখোট্টা এক ডাক্তারের কথা",
আনন্দবাজার পত্রিকা।
- গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ, জয়ঢাকওয়েব।
- "আজ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ১১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি", যুগ বার্তা।
- বিপ্লবকুমার ঘোষ, বিবেকানন্দ বনাম রবীন্দ্রনাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা।
- গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ, জয়ঢাক।
- Dr. Rajinder Singh, "SC C V Raman's Loyalty with the IACS", www.researchgate.net.
- Dr. Premashis Manna, “The Legends of CV Raman : A 100 kW Brain”, Good Morning Science.
- Mahendralal Sarkar, wikivisually.com
- প্রদীপ দেব, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, মুক্তমনা ব্লগ।
- প্রদীপ দেব, "জগদীশচন্দ্র বসুর ঘর-সংসার", মুক্তমনা ব্লগ।
- Indian Academy of Sciences, "Chandrasekhar, S. (1928) Thermodynamics of the Compton effect with
reference to the interior of the stars". http://repository.ias.ac.in .
- সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর, বাংলা উইকিপিডিয়া।
- Subrahmanyan Chandrasekhar. Wikipedia
- West Bengal Public Library Network
- https://archive.org/
- https://crossasia.org/
কবি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
৯টি কবিতা নিয়ে এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ১৭.১০.২০২০ ^^ উপরে ফেরত
...
কবি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের শিক্ষা জীবন - পাতার উপরে . . .
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের স্কুলজীবন শুরু হয় পাইকপাড়ার একটি পাঠশালায়। পিতার মৃত্যুর পরে ভাইয়ের
সাথে তাঁকে কলকাতায় মামার বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। কলকাতায় তিনি ১৮৪১ সালে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে
ভর্তি হন যার ১৮৬৭ সালে নতুন নামকরণ করা হয় হেয়ার স্কুল। এরপর ১৮৪৯ সালে জুনিয়র-স্কলারশিপ
নিয়ে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন যার পরে নাম হয় প্রেসিডেন্সী কলেজ এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্সী
বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৪ সালে মহেন্দ্রলাল কলিকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে স্নাতকোত্তর এম.ডি. পরীক্ষা পাশ করেন ১৮৬৩ সালে। তিনি দেশের দ্বিতীয় এম.ডি চিকিৎসক। প্রথম
এম.ডি, ছিলেন ডাঃ চন্দ্রকুমার দে যিনি ১৮৬২ সালে পাশ করেছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই কলেজে তাঁর সুনাম
ছড়িয়ে পড়েছিলো।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের অ্যলোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি - পাতার উপরে . . .
তিনি অ্যালোপ্যাথির প্রথিতযশা ডাক্তার থাকাকালীন হোমিওপ্যাথির চিকিত্সক হয়ে যান। এই নিয়ে ডাক্তার
মহলে তুমুল আলোড়ণের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন -এর বঙ্গীয় শাখার সহ-সভাপতি
থাকাকালীন ১৮৬৯ সালে তাঁকে সেই সংস্থা থেকে বহিস্কার করা হয়। প্রায় ছয়মাস কাল তিনি কর্মহীন হয়ে
পড়েন। বন্ধু-বান্ধব, ডাক্তার-জগত এবং পুরানো রোগীরাও তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। নিজ মত
প্রকাশের জন্য তিনি ১৮৬৭ সালে “Calcutta Journal of Medicine” পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। অ্যলোপ্যাথি
থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিত্সায় আসার বিষয়ে তিনি নিজেই বিস্তারিতভাবে লিখে গিয়েছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত
The Calcutta Journal of Medicine এর জুলাই ১৯০২ সংখ্যায় প্রকাশিত, “Story of my conversion to
Homeopathy” ।
১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর বঙ্গীয় শাখার উদ্বোধন করা হয়। ডাঃ মহেন্দ্রলাল
সরকার ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক। সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি হোমিওপ্যাথি
চিকিৎসাপদ্ধতিকে “হাতুড়ে চিকিৎসা” বা “quackery” বলে কটাক্ষ করেছিলেন। বাংলা তথা ভারতবর্ষে
হোমিওপ্যাথি চিকিত্সার পথীকৃত বাবু রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত তা পড়ে বুঝেছিলেন যে এই প্রবন্ধের লেখককে তিনি
বুঝিয়ে হোমিওপ্যাথির দিকে টেনে আনতে পারবেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা সত্তেও মহেন্দ্রলাল কিছুতেই রাজি
হচ্ছিলেন না তাঁর মত পরিবর্তন করতে।
ঠিক এই সময়ে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে “Morgan’s Philosophy of Homeopathy” নামক একটি প্যামফ্লেট দিলেন
সেই বন্ধুরই সম্পাদিত একটি পত্রিকায় রিভিয়ু বা সমালোচনা লিখে দেবার জন্য। এবার তিনি যেন হাতে চাঁদ
পেলেন! তিনি কাজটি হাতে নিয়ে ভাবলেন যে এই লেখায় তিনি হোমিওপ্যাথি আর বাবু রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্তকে
বুজরুকি করার জন্য তুলোধুনো করে ছাড়বেন! প্যামফ্লেটটির উপরে প্রথমবার চোখ বোলাবার পরে তাঁর
মনে হলো যে আরেকবার সময় নিয়ে লেখাটি পড়া উচিত। দ্বিতীয়বার পড়ার পরে তাঁর মনে হলো যে এত
তথ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিষয়ে কিছু লেখার আগে তথ্য নিজের চোখে যাঁচাই করে নেওয়া উচিত।
তাই এবার তিনিই নিজেই বাবু রাজেন্দ্র দত্ত কাছে প্রস্তাব রাখলেন যে তিনি তাঁর চিকিত্সা পদ্ধতি দেখতে
চান। কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু রোগীকে ওষুধ তখনই দেবেন যখন আর কোনও উপায় থাকবে না। তিনি দেখতে
চাইছিলেন যে অসুখ কেবল স্বাস্থ-বিধির নিয়ম-পালনে নিজে নিজেই সেরে যাচ্ছে না তো! বাবু রাজেন্দ্র দত্ত,
এক কথায় রাজি হলেন এবং মহেন্দ্রলাল এই চিকিত্সা-পদ্ধতির ফলাফল ১৮৬৫ সাল খেকে শুরু করে প্রায়
এক বত্সরকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করে চমকিত হলেন! কিছু রোগী অবশ্যই বিনা ওষধে ঠিক হচ্ছিল, কিন্তু বহু
রোগী হোমিওপ্যাথি চিকিত্সার প্রয়োগেই নিরাময় লাভ করছেন দেখে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা-পদ্ধতির
উপরে প্রগাঢ় আস্থাবান হয়ে পড়লেন।
প্রথমে তিনি তাঁর প্রফেসর ও ডাক্তারবন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু সকলেই এক কথায়
তা উড়িয়ে দিয়ে তাঁকে এসবের পেছনে গিয়ে নিজের পসার নষ্ট না করার পরামর্শ দিলেন। এরপর তিনি
১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে, ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর বঙ্গীয় শাখার, ৪র্থ অধিবেশনে সহ-
সভাপতির ভাষণে পড়লেন তাঁর “On the Supposed Uncertainty in Medical Science and on the Relationship
between Diseases and their Remedial Agents” প্রবন্ধটি। হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। এবং সেদিনই তাঁকে সেই
অ্যাসোসিয়েশন থেকে বহিস্কার করা হলো, হোমিওপ্যাথির সপক্ষে কথা বলার অপরাধে।
এই খবরে তিনি প্রায় একঘরে হয়ে পড়লেন এবং তাঁর রোগীরাও তাঁকে বর্জন করলেন। প্রায় মাস ছয়েক
কর্মহীন থাকার পর তিনি পুনরায় পসার লাভ করলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হোমিওপ্যাথি চিকিত্সক
হিসেবে। তাঁর উপর আস্থাবান রোগীদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং ভক্তবৃন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস !
মিলনসাগরে “Story of my conversion to Homeopathy” প্রবন্ধের PDF কপি পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন . . .।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ও Indian Association for the Cultivation of Science - পাতার উপরে . . .
কবি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর দ্বারা ১৮৭৬ সালের ২৯শে জুলাই কলকাতার
২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটে আনুষ্ঠানিকভাবে Indian Association of the Cultivation of Science এর প্রতিষ্ঠা।
দেশবাসী যাতে বিজ্ঞান চর্চার পূর্ণ সুযোগ পায় এবং তাঁদের ঠাকুর-দেবতা-পূজো-আচ্চা-গুরু-অবতার-
কুসংস্কারের নাগপাশ থেকে যাতে মুক্ত করে বিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে নিয়ে আসা যায়, তার জন্যই তিনি এই
সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় "সায়েন্স এস্যোসিয়েশন" এর কাজে
দান করে যান।
তাঁর পাশে ছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, জাস্টিস দ্বারকানাথ মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর,
ফাদার লাফন্ট, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, আবদুল লতিফ, প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরো অনেকে। ছোটলাট স্যার রিচার্ড টেম্পলও তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে
দিয়েছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকার ভাদ্র ১২৭৯ (অগাস্ট ১৮৭২) সংখ্যায়, প্রথমে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের
অর্থ দানের আবেদন এবং তারপরে বঙ্কিমচন্দ্রের, প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করার জন্য উদারহস্তে দান করার
আহ্বান প্রকাশিত হয় “ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা” শিরোনামের প্রবন্ধে। এখানে মহেন্দ্রলাল স্পষ্ট করে
জানিয়েছেন তাঁর সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কর্মপন্থা। সেই আবেদনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . .।
আবেদনের শেষে বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যা লিখেছিলেন তা খুবই তাত্পর্যপূর্ণ
ছিলো। তিনি লিখলেন . . .
“. . .অনুষ্ঠাতা মহেন্দ্র বাবু চাঁদা বা স্বাক্ষরকারিদিগের নাম সাদরে গ্রহণ করিতেছেন।
এই অনুষ্ঠান পত্র আজ আড়াই বত্সর হইত প্রচারিত হইয়াছে, এই আড়াই বৎসরে বঙ্গসমাজ ৪০
চল্লিশ সহস্র টাকা সাক্ষর করিয়াছেন। মহেন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন যে- এই তালিকা খানি একটি আশ্চর্য্য দলিল।
ইহাতে যেমন কতকগুলি নাম থাকিতে স্পষ্টীকৃত হইয়াছে, তেমনি কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত
হইয়াছে। তিনি আর কিছু বলিতে ইচ্ছা করেন না।
আমরা উপসংহারে আর গোটা দুই কথা বলিতে ইচ্ছা করি। বঙ্গধনীগণ আপনারা মহেন্দ্র বাবুর ঈষৎ
বক্রোক্তি অবশ্যই বুঝিয়া থাকিবেন তবে আর কলঙ্কভার শিরে কেন বহন করেন? সকলেই অগ্রসর হউন
যিনি এক দিনে লক্ষ মুদ্রা দান করেন, তিনি কেন পশ্চাতে পড়েন। পুত্র কন্যার বিবাহে যাঁহারা লক্ষ লক্ষ ব্যয়
করেন, তাঁরা কেন নিশ্চিন্ত, বসিয়া থাকেন? উড্রোসাহেব ভয়ানক বিজ্ঞানগুণঅস্বীকারদোষ বঙ্গসমাজমস্তকে
আরোপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এক বার মুক্ত হস্তে দান করিয়া সমাজ স্থাপন করিয়া স্বীয় ভ্রম দূর
করুন। বঙ্গীয় যুবকগণের অবস্থার উন্নতি সাধন করুন ; বঙ্গের শিল্পবিদ্যার পুনরুদ্ধার করুন। নহাশ্মা উড্রো
সাহেবকে বলি, তিনি কান্বেল সাহেবকে চিঠিতে যা বলিয়াছেন, তাহার কথায় আমাদের কাজ নাই, তিনি
কেন একবার স্বজাতীয়গণকে এই মঙ্গলকর কার্য্যের সাহায্য করিতে বলুন না। যদি তালিকাতে একটিও
শ্রেতাঙ্গের নাম না প্রকাশিত হয়, তাহা হইলে কত আক্ষেপের বিষয় হইবে।”
বঙ্কিমচন্দ্র, মহেন্দ্রলালের “... এই তালিকা খানি একটি আশ্চর্য্য দলিল। ইহাতে যেমন কতকগুলি নাম
থাকিতে স্পষ্টীকৃত হইয়াছে, তেমনি কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত হইয়াছে” উক্তিটির "কতকগুলি
নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত হইয়াছে" উক্তিটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর দিকে ইঙ্গিত করছে বলে
অনেকে মনে করেন। এ নিয়ে আমরা নীচে “মহেন্দ্রলাল সরকার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” অনুচ্ছেদে আলোচনা
করেছি।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল তাঁর ধনী রোগীদের কাছে আবেদন করতেন তাঁর সংস্থায় দান করতে। তেমনি একবার তাঁর
চিকিত্সায় আরোগ্য লাভ করে, বিজয়নগরমের মহারাজকুমার (Maharajkumar of Vizianagram) ৪০,০০০টাকা
দান করেন। সেই টাকা দিয়ে তৈরী হয় সংস্থার “বিজয়নগরম ল্যাবরেটরি”।
১৯০৭ সালে এই সংস্থায় যোগদান করে, ১৯৩০ সালে অ্যাসোসিয়েশনের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করতে
করতেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন তাঁর “রামন এফেক্ট অফ লাইট” আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত
হন।
এছাড়া ১৯২৮ সালে আরেক বিখ্যাত Astrophysicist সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর এই প্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর
এই সংস্থায় থাকাকালীন গবেষণাপত্রের নাম ছিল 'Thermodynamics of the Compton Effect with Reference to
the Interior of the Stars'।
দুঃখের বিষয় এই যে এই ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কবি-পরিচিতির এই পাতা প্রকাশনা অবধি সুব্রহ্মণ্যন
চন্দ্রশেখরের জীবনে কালটিভেশন অফ সায়েন্সের অবদানের কথা উইকিপেডিয়ার মত বড় বড় ওয়েবসাইটে
পাওয়া যায় না। আমরা উইকিপেডিয়ার সংশ্লিষ্ট লেখকদের কাছে আবেদন করছি তাঁরা যেন সুব্রহ্মণ্যন
চন্দ্রশেখরের জীবনে, ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চিন্তা ও গবেষণার জনক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত Indian
Association for the Cultivation of Science এর অবদানের কথা সংশ্লিষ্ট পাতায় উল্লেখ করেন।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর আই.এ.সি.এস-এর পরিচালনার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন তাঁর পুত্র
অমৃতলাল সরকার। ১৯৫০-৫১ সালে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে, পশ্চিম
দিকে, ২৯ বিঘা জমির উপরে, Indian Association for the Cultivation of Science কে তার নতুন বাড়ীতে
স্থানান্তরিত করেন। সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে তার ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক করুন . . .।
যাদবপুরে, এই প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ-দ্বারের পাশে সি.ভি. রামনের রিলিফ পোর্ট্রেট, মূল অফিস বিলিডিং এর
উপর তলায় অধ্যাপক কে. এম. কৃষ্ণানের মূর্তি এবং সিঁড়ীর দেয়ালে অধ্যাপক কেদারেশ্বর ব্যানার্জীর
রিলিফ পোর্ট্রেট, প্রভৃতি ভাস্কর্য তৈরী করেন পার্কস্ট্রীটের নেহেরু খ্যাত ভাস্কর সুরজিত দাস। মিলনসাগরে
ভাস্কর সুরজিত দাসের ভাস্কর্যের পাতায়, তাঁর সৃষ্ট এই সকল মূর্তি সহ আরও মূর্তির ছবি দেখতে এখানে
ক্লিক করুন . . . ।
অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন ওফ সায়েন্সের ওয়েবসাইট - http://iacs.res.in/index/index.html ।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন ও সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর - পাতার উপরে . . .
ডাঃ সরকারের মৃত্যুর পরে ১৯০৭ সালে ভারত (ব্রিটিশ) সরকারের অর্থনৈতিক বিভাগে কর্মরত একজন
উচ্চপদস্থ অফিসার (Assistant Accountant General) কলকাতায় কাজ করতে এসে Indian Association of the
Cultivation of Science এর সদস্য হয় যান। তিনি তাঁর অবসর সময়ে এই সংস্থায় গিয়ে বিজ্ঞানচর্চা করতেন।
তাঁর নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন। পরে তাঁকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯১৭ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতার সায়েন্স কলেজের Fellow
Professor (Palit Professor) করে নেন। ভেঙ্কটরামন এই সংস্থায় (IACS) তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান কারণ
তখন কলকাতার সায়েন্স কলেজে তাঁর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিলো না। ১৯৩০ সালে এখানেই কাজ করতে
করতে তাঁর “রামন এফেক্ট অফ লাইট” আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
পরবর্তীকালে Indian Association for the Cultivation of Science এবং ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রামন, ২৬ জানুয়ারী ১৯৩১ তারিখে, কলকাতা করপোরেশনের তরফে তাঁকে দেওয়া
সম্বর্ধনায়, ভবিষ্যতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার রূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের অভিভাষণের উত্তরে বলেছিলেন
. . .
"It was the late Dr. Mahendralal Sarkar, who, by founding Indian Association for the cultivation of Science,
made it possible for the scientific aspirations of my early years to continue burning brightly. Dr. Sircar
devoted a life-time of labour to the institution which he created and equipped in the hope that it would some
day be utilised for the advancement of science in India. Its doors were open, awaiting the arrival of someone
who could utilise the resources it offered. That arrival happened to be myself. Dr. Mahendra Lal Sircar did
not, alas, live to see his aims accomplished. He sowed that others might reap."
তাঁর এই ভাষণে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন এবং বন্ধুবর
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কে তাঁর প্রতি সহযোগীতা ও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ধন্যবাদ
জানিয়েছিলেন।
১৯২৮ সালে আরেক বিখ্যাত Astrophysicist সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর, কালটিভেশন অফ সায়েন্সে আসেন এবং
তাঁর প্রথম জীবনের কাজটি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত। তিনি ছিলেন স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণের
ভাইপো। তাঁর জীবনের সম্ভবত প্রথম গবেষণা পত্র 'Thermodynamics of the Compton Effect with Reference
to the Interior of the Stars', অ্যাসোসিয়েসন অফ কালটিভেশন অফ সায়েন্স থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই
ডিসার্টেশনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
দুঃখের বিষয় এই যে এই ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কবি-পরিচিতির এই পাতা প্রকাশনা অবধি সুব্রহ্মণ্যন
চন্দ্রশেখরের জীবনে কালটিভেশন অফ সায়েন্সের অবদানের কথা উইকিপেডিয়ার মত বড় বড় ওয়েবসাইটে
পাওয়া যায় না। আমরা উইকিপেডিয়ার সংশ্লিষ্ট লেখকদের কাছে আবেদন করছি তাঁরা যেন সুব্রহ্মণ্যন
চন্দ্রশেখরের জীবনে, ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চিন্তা ও গবেষণার জনক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত Indian
Association for the Cultivation of Science এর অবদানের কথা সংশ্লিষ্ট পাতায় উল্লেখ করেন।
তিনি উইলিয়াম ফাওলারের সঙ্গে ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তাঁর "Theoretical studies of the
physical processes of importance to the structure and evolution of the stars". গবেষণার জন্য। তাঁর নামে
নামকরণ করা হয়েছে the Chandrasekhar limit এবং আরও অনেক।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ও শিবনাথ শাস্ত্রী - পাতার উপরে . . .
শিবনাথ শাস্ত্রীর তিরোধানের বহু পরে, ১৯৪৯ সালে, এইচ্ রায় চৌধুরী দ্বারা প্রকাশিত, তাঁর ১৯১৯ সালে
প্রকাশিত “Men I have seen” গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ “মহানপুরুষদের সান্নিধ্যে” গ্রন্থে যে সাতজন মহাপুরুষদের
কথা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ পরমহংস প্রমুখদের সঙ্গে মহেন্দ্রলাল
সরকারও রয়েছেন।
মহেন্দ্রলাল শিবনাথ শাস্ত্রীকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই। সেই লেখা থেকে আমরা
সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডাক্তারের অতি সাধারণ ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার উল্লেখ দেখতে পাই। শিবনাথ শাস্ত্রি
সেই গ্রন্থের “ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“মহেন্দলাল সরকার মহাশয়ের অনাড়ম্বর জীবনের ধারাটিও বিশেষভাবে আমার মনকে তখন আকৃষ্ট করিয়া
তুলিয়াছিল। তাঁহার জীবনযাত্রা কেবলমাত্র আড়ম্বরশূন্যই ছিল না, তাহা দেশ-প্রেমেরও পরিচায়ক ছিল।
সেদিনের বৈদেশিক সভাতার প্রভাবের যুগেও কেহ কোনদিন তাঁহাকে ধূতিচাদর ও তালতলার চটি ব্যতীত
অন্য কোনরূপ বেশভূষা ব্যবহার করিতে দেখে নাই। প্রকাশ্য সভাসমিতি হইতে রোগীর কক্ষ পর্য্যন্ত সর্ব্বত্র
এই পরিচ্ছদেই তিনি যাতায়াত করিতেন।”
শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনে বহুবার তাঁর নিজের ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চিকিত্সা করেছেন ডাঃ
মহেন্দ্রলাল, আপনজনের মতোই। পৌত্তলিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আধিপত্তের বিরুদ্ধে থাকলেও
মহেন্দ্রলাল ঘোরতরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। একবার তাঁর স্ত্রীর গর্ভে একটি অপরিণত কন্যা জন্মগ্রহণ
করে। কন্যার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে তিনি ডাঃ মহেন্দ্রলালের শরণাপন্ন হন। সবকিছু করার পরেও শিশুটির
অবস্থার উন্নতি না দেখে শিবনাথ চিন্তিত-চিত্তে ডাক্তারকে সে কথা বলেছিলেন। উত্তরে ডাক্তার যা
বলেছিলেন তা তাঁর ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাসেরই পরিচায়ক ছিল। শিবনাথ এ নিয়ে লিখেছেন . . .
“আমি বলিলাম---শিশুটিকে রোগমুক্ত করবার কোন চেষ্টাই ফলপ্রসূ হচ্ছে না, এটাই আমায় মানাসিক ক্লেশ
দিচ্ছে।
ডাঃ সরকার স্মিত হাস্যে বলিলেন---যে বস্তু তোমার আয়ত্তের বাইরে তার দায়িত্ব নিয়ে কষ্ট পাও কেন? যা
কিছু এ ক্ষেত্রে করবার তা তো তুমি করছো, এ ভেবেই তুমি সন্তুষ্ট থাক। ফলাফলের চিন্তায় লাভ কি? তা
তো তোমার হাতে নেই---সে ভার ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দাও। আমি তো তোমাকে বহুবার বলেছি যে, শেষ
ফলাফল বা পরিণতি মানুষের আয়ত্তের বাইরে। একথা আমি শুধু মুখেই বলিনে, আমি সর্ব্বান্তঃকরণে
বিশ্বাসও করি। তুমিই চিন্তা করে দেখ, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাস যদি সুখে দুঃখে মানুষের চিত্তে এটুকু
স্বস্তি বা নির্ভরতা আনতে না পারে, তবে কি প্রয়োজন সে বিশ্বাসে?
ডাঃ সরকারের মুখের দিকে তাকাইয়া বুঝিলাম, ইহা কেবলমাত্র তাঁহার মুখের কথা নহে, ইহা তাঁহার জীবন
দর্শন। সুপ্রতিষ্ঠিত, অভিজ্ঞ চিকিংসকের সমস্ত জীবন প্রবাহটি যে ভগবৎ-ইচ্ছার স্রোতে মিলিয়া গিয়াছে ইহা
বুঝিতে বিলম্ব হইল না।
বুঝিলাম, জীবনে ধর্ম্ম-আন্দোলন করিয়াছি কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে ধর্ম্মকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি
নাই।”
পৌত্তলিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আধিপত্তের মহেন্দ্রলাল কতটা বিরোধী ছিলেন তা শিবনাথ শাস্ত্রীর “Men I
have seen” গ্রন্থের ১৯৬-পৃষ্ঠার এই অংশের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন . . .
"Whilst speaking of this forward look of Dr. Sircar I remember a little incident which happened at a public
meeting in the Albert Hall of Calcutta. On that cecasion a Western lady was the speaker. I do not distinctly
remember whether Dr. Sircar occupied the chair or not ; but he was present. In her lecture the lady said some
thing in defense of idolatry or of her Kali-worship, which took Dr. Sircar by surprise so much that he rose after
her speech and said some earnest words which thrilled every one present. The opening words I distinctly
remember. “Have I lived so Jong, in the world,” said the doctor, “to find an English-woman coming from the
West, and defending the idolatry of our land ? Certainly we have fallen on strange times.” He went on in that
strain, and thundered out his vehement, declamation of all retrogressive ideas.”
এখানে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে উল্লিখিত মিটিংটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯৯ সালে এবং সেই Western
Lady-টি ছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। কলকাতার "অ্যালবার্ট হল"-এর বর্তমান নাম "কফি হাউস"।
রামকৃষ্ণ পরমহংস ও ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার - পাতার উপরে . . .
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে মাস্টার ওরফে শ্রীম রচিত “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে রামকৃষ্ণ
পরমহংসের যখন গলায় ক্যানসার হয়, তখন তাঁর ভক্তরা ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে রামকৃষ্ণের চিকিত্সার
ভার সঁপেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আধিপত্তের বিরুদ্ধে থাকার দরুণ ডাঃ সরকার অন্যান্য ভক্তদের মতন
রামকৃষ্ণকে অবতার হিসেবে দেখতেন না এবং মানতেনও না। প্রয়োজনে কড়া কথাও শোনাতেন। কিন্তু
রামকৃষ্ণের উপরে তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা জন্মেছিল, তাঁর মনের সরলতা দেখে। তাঁর এই রোগীটিকে দেখতে এসে
তিনি ৫-৬ ঘন্টা সেখানেই থেকে যেতেন। ভক্তদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতায়, গান শুনে, তর্ক-
বিতর্কের মধ্যে সময় কাটাতেন। “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” গ্রন্থে উদ্ধৃত রামকৃষ্ণ, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল ও
লেখক শ্রীম-এর মধ্যে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে ডাক্তারের চরিত্রের বেশ খানিকটা জানা সম্ভব হয়। তেমন দুটি
ঘটনা আমরা এখানে উল্লেখ করছি . . .
একথা সবারই জানা যে মাঝে মাঝেই শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন কিছুক্ষণের জন্য, আরাধনা করতে
করতে বা গান শুনতে শুনতে বা শুধু কথা বলতে বলতে। ২৪.১০.১৮৮৫ তারিখে শ্যামাপুকুরে থাকাকালীন,
রামকৃষ্ণদেব ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারকে তাঁর এই সমাধি-অবস্থা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা, সিদ্ধির
নেশার মতো ভাবাবস্থায় হয়, ওটা কি?” উত্তরে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে মাস্টারকে
সোজাসুজি ডাক্তার-সুলভ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন . . .
“Nervous Centre-action বন্ধ হয়, তাই অসাড় - এ-দিকে পা টলে, যত energies brain-এর দিকে যায়। এই
nervous system নিয়ে Life। ঘাড়ের কাছে আছে - Medulla Oblongata ; তার হানি হলে Life extinct হতে
পারে।” ---উদ্বোধন কার্যালয় থেকে এপ্রিল ২০১৪ সালে প্রকাশিত শ্রীম-কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ২য় খণ্ড,
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ, ৯৪৬-পৃষ্ঠা॥
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার একবার শ্রীম-কে মাকালীর সম্বন্ধে বলেছিলেন - “কালী তো একজন সাঁওতালী মাগী।”
---উদ্বোধন কার্যালয় থেকে এপ্রিল ২০১৪ সালে প্রকাশিত শ্রীম-কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ২য় খণ্ড,
একবিংশ পরিচ্ছেদ, ৯৬০-পৃষ্ঠা॥
সমাজ সংস্কারক ও দাতা ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার - পাতার উপরে . . .
কেবল বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথাই তিনি ভাবতেন না। বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করে সমাজকে আরও উন্নত করার
কথাও তিনি ভাবতেন। বাল্য বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম মেয়েদের বিবাহের ন্যুনতম বয়স ১৬ বছর
করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি পরে আইনি স্বীকৃতিও পায়। তাঁর পরামর্শে সরকারি
বিবাহবিধি Marriage Act III of 1872, প্রণয়নে মেয়েদের বিবাহের বয়স ন্যুনপক্ষে ১৬ বছর নির্ধারণ করা
হয়েছিল।
মহেন্দ্রলাল, তাঁর স্ত্রী রাজকুমারী দেবীর নামে বৈদ্যনাথ ধামে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য একটি কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় "সায়েন্স এসোসিয়েশন" এর কাজে দান করে যান।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রাপ্ত সম্মাননা - পাতার উপরে . . .
১৮৮৮ সালে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে
অসমের চা-শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্বন্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়। মহেন্দ্রলাল শ্রমিকদের অপমানসূচক 'কুলি' শব্দ
ব্যবহারে আপত্তি করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনারারি ম্যাজিস্ট্রট, ১৮৮৭ সালে
কলকাতার শেরিফ এবং বঙ্গীয় ব্যবস্বাপক সভার সদস্য ছিলেন। ১৮৮৩ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার সি.আই.
ই. (C.I.E. - Order of the Indian Empire, Compamion) তে ভূষিত করেন এবং ১৮৯৮ সালে তিনি কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ডক্টর অফ ল” উপাধি পান। তাঁর জন্মস্থান, হাওড়া-আমতা রেলপথে মুন্সিরহাট
স্টেশনটির নাম “মহেন্দ্রলাল নগর” রাখা হয়েছে।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কবিতা ও ঈশ্বর-প্রেম - পাতার উপরে . . .
বিশ্বজুড়ে বাঙালী জাতির শত বদনাম সত্তেও বাঙালীর একটি এমন গুন আছে যা অন্য জাতির ক্ষেত্রে খুবই
বিরল। এমন বাঙালী হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যাঁর জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দু এক লাইন কবিতা
লেখেন নি! বাংলা ভাষায় যে পরিমান কবিতার আন্দোলন ঘটে গেছে, যে পরিমান কাব্যচর্চা চলেছে,
তেমনটি বোধহয় ভারবর্ষের আর কোনো ভাষায় দেখা যাবে না। আধুনিক কালে ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চিন্তা ও
গবেষণার জনক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারও এর ঊর্ধ্বে ছিলেন না!
তাঁর কোনও প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের খবর আমাদের কাছে নেই। শিশিরকুমার মিত্র সম্পাদিত “সচিত্র শিশির”
পত্রিকার ১৩৩৩ সালের শারদিয়া সংখ্যার (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২৬) “মণীষা-মন্দিরে” নামক বিগতজনদের
স্মৃতিচারণ ও জীবনীমূলক প্রবন্ধের, ১২৬০-পৃষ্ঠায় তাঁর দুটি গান পাই। প্রবন্ধের লেখকের নাম নেই। সম্ভবত
সম্পাদকের কলমেই লেখা হয়েছিল। এই প্রবন্ধেও ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কাব্যগ্রন্থের কোনও উল্লেখ
নেই। তাঁর এই কবিতা দুটি কোন বয়সে লেখা হয়েছিল, তাও জানা যায় না।
এ ছাড়া কবি অমিতাভ গুপ্ত তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ২০১১ সালে বেলুর রামকৃষ্ণ মিশন মঠ থেকে
প্রকাশিত, ডঃ জলধীকুমার সরকার-এর “শ্রীরামকৃষ্ণের ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার” গ্রন্থের ২য় সংস্করণের
(১ম সংস্করণ ১৯০১) “শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে” অধ্যায় থেকে ৮টি কবিতা দিয়েছেন, যার মধ্যে ৭টি নতুন
কবিতা। এর জন্য আমরা কবি অমিতাভ গুপ্তর কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ থাকছি। মিলনসাগরে কবি
অমিতাভ গুপ্তর কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
যাঁরা ডাঃ মহেন্দ্রলালকে নাস্তিক আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁদের স্তব্ধ করিয়ে দিয়ে এই নটি কবিতাই তাঁর ঈশ্বর-
প্রেমের অভিব্যক্তির প্রমাণ হিসেবে ধরা যায়। তিনি কেবল ঠাকুর-দেবতা-পূজো-আচ্চা-গুরু-অবতার-
কুসংস্কার ইত্যাদি ধর্মের যত নেতিবাচক দিকগুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাঁর অটল
বিশ্বাস ছিল। এই পাতায় উল্লিখিত শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা “Men I have Seen” অথবা “মহানপুরুষদের
সান্নিধ্যে” (১৯৪৯), গ্রন্থের “ডাঃ মহেন্দ্রনাথ সরকার” প্রবন্ধ এবং এই কবিতা থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।